Sunday, February 25, 2018

PROTNO-SAMRAT

https://thekoulal.wordpress.com কৌলাল ওয়েবসাইটেও পড়তে পারেন।আর দেখতে পারেন মনের মতো ছবি।
                                     

                              প্রত্নসম্রাটঃ কলমে ক্যামেরায়



ভারতবর্ষের প্রত্নমানচিত্রে মঙ্গলকোট একটি উজ্জ্বল নাম।প্রায় ছয় বর্গ কিমি স্থানজুড়ে মঙ্গলকোটের প্রত্নস্থান।অন্যান্য গ্রামগুলি এই তালিকায় যুক্ত করলে বৃহত্তর মঙ্গলকোটের প্রত্নক্ষেত্র আরও বেড়ে যাবে।মঙ্গলকোটের পুরাসম্পদগুলি শৌখিন পুরাসংগ্রাহক বা ক্ষেত্রসমীক্ষকরা অনেকদিন আগে থেকে সংগ্রহ করে চলেছেন।এককড়ি দাস ,প্রয়াত কেশবচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়,মুহম্মদ আয়ুব হোসেন আসরাফ আলি প্রমুখদের নাম সর্বাগ্রে উল্লেখ্য।

 এই ধারায় আর এক উজ্জ্বল নাম মুন্সি জিয়াউর রহমান।লোকে  একডাকে চেনে সম্রাট মুন্সি নামে।শিক্ষব্রতী ও সমাজসেবী।আর সংগ্রহ করে চলেছেন পরশপাথর এই প্রত্নরত্ন।মঙ্গলকোটের ভূমি-সন্তান হওয়ার কারণে  ছোট থেকেই সংগ্রহ করছেন এসব অমূল্য প্রত্নসম্পদ।তিনি চান প্রত্নতীর্থ মঙ্গলকোটে হোক পুরামিউজিয়াম।এখানেই তিনি দান করতে চান যখের সম্পত্তির মত আগলিয়ে রাখা প্রত্নরত্নগুলি।তাঁর সংগৃহীত প্রত্নসম্পদের কথা তিনি নিজেই লিখেছেন --কৌলাল অনলাইন ওয়েবসাইটে।প্রতি রবিবার প্রকাশিত হবে সেই অমৃতসমান প্রত্নকথন।

                                  মঙ্গলকোটের প্রত্নরত্ন



নমস্কার! আমি সম্রাট মুন্সি।কৌলাল ওয়েবসাইটে আপনাদের স্বাগত।প্রথমেই বলি আমি ঐতিহাসিক বা প্রত্নবিশেষজ্ঞ নই।প্রত্নপ্রেমিক বলতে পারেন।খ্যাপার মতো খুঁজে ফিরি পরশপাথর সন্ধানে।আপনারা জানেন প্রত্নক্ষেত্র হিসাবে  মঙ্গলকোট বিশ্বহেরিটেজের তালিকায় অন্তুর্ভুক্তি হবার দাবি রাখে।কারণ তাম্রাশ্মীয় যুগ থেকে সাম্প্রতিক যুগ পর্যন্ত মঙ্গলকোটে ধারাবাহিক জনবসতির প্রমাণ মিলেছে।আজ আপনাদের দেখাবো কয়েকটি গুরু্ত্বপূর্ণ পুরাবস্তু। আশারাখি আপনারা মতামত দেবেন।আমি শুধু বিবরণটুকু দিয়ে যাবো।

                                  মূর্তি

এই মূর্তিটি কালো পাথরের।প্রাপ্তিস্থান মঙ্গলোকোট।উচ্চতা প্রায় ছয় ইঞ্চি।তবে ভাঙাচোরা।উচ্চতা আরও ছিল নিঃসন্দেহে।দম্পতি মূর্তি।যেন হরগৌরী বসে আছেন।গৌরীর কোলে সন্তান।কার্তিক অথবা শিশু গণেষ।নীচে পাদপীঠে ভক্ত।আবার অনেকেই বলেন এটি জৈনতীর্থঙ্করদের মূর্তি।এর বেশি কিছু বুঝিনি।আপনারা যদি এই বিষয়ে আলোকপাত করেন আমরা সাধারণ পুরাপ্রেমীরা খুশি হবো।
                              জলপ্রদীপ

মঙ্গলকোটে প্রচুর   কালোরঙের মাটির  জলপ্রদীপ মিলেছে।এগুলি ভিতরে ফাঁপা।উপরে তেল সলতে থাকতো।মূলত পুজোর সময় পুরোহিতের হাতে যাতে ছ্যাঁকা না লাগে তার জন্য এই ব্যবস্থা ছিল।এগুলি অনেকের মতে কুষাণ যুগের প্রদীপ।
                              মুদ্রা

মঙ্গলকোটে প্রচুর মুদ্রা মিলেছে।কপার কাস্ট কয়েন থেকে শুরু করে বিবিধ ঐতিহাসিক যুগের মুদ্রা।এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো সুলতানি বা মোঘল আমলের মুদ্রা।একটি গুরুত্বপূর্ণ মুদ্রার ছবি এখানে দিলাম।কিন্তু মুদ্রালেখ সম্পর্কে জানতে পারিনি।আপনারা যদি এ বিষয়ে আলোকপাত করেন।খুবই আনন্দ পাবো।আজ এই পর্যন্ত।আবার আগামি রবিবার।নমস্কার সালাম।ভালো থাকবেন।

Saturday, February 24, 2018

বাড়ির কাছে আরশিনগরঃভারতীয় চীনাদের খোঁজে দ্বিতীয় পর্ব

 আমদের ওয়েবসাইটে  পড়ুন--https://wordpress.com/view/thekoulal.wordpress.com

                          বিশ্ব-ইতিহাস ও লোকসংস্কৃতি





   ভারতীয় চীনাদের খোঁজে: কলকাতার   এক     বিস্মৃত অধ্যায়!

                                         দ্বিতীয় পর্ব : মানুষ যখন দেবতা।




                                                             ডা: তিলক পুরকায়স্থ

সান ইয়াৎ সেন স্ট্রীটের ভোর বাজারের ফুটপাথে ভরপেট প্রাতরাশ খেয়ে পেট ও দিল, দুটিই ভরপুর খুশ। স্থানীয় বাজারে আরো কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করলাম, কিছু ছবি তোলা হলো।এরপর চললাম স্থানীয় দর্শনীয় স্থানগুলো দেখতে।দর্শনীয় স্থান বলতে দেখলাম, চীনাদের ঘরদোর গুলি নববর্ষ উপলক্ষে কাগজের মালা, বেলুন এবং চীনা লণ্ঠন দিয়ে সাজিয়েছে। বেলুন, লণ্ঠন সব লাল রঙের।আশ্চর্য হয়ে যেতে হয় যে টেরিটিবাজার, চায়না টাউনের মতন ছোট জায়গাতেও নয় নয় করে বর্তমানে সর্বমোট ছটি চীনা মন্দির বা উপাসনা স্থল আছে।চীন বা চীনা বলতেই আমাদের মানস পটে উঠে আসে বর্তমানের সমৃদ্ধশালী লাল চীনের ছবি, যেখানে ধর্ম এখনও একান্তই ব্যক্তিগত স্তরে পালিত হয়। সেখানে কলকাতায় এত চীনা মন্দির কেন ? টেরিটিবাজার ছাড়াও পূর্ব কলকাতার ট্যাংরাতে চীনা মন্দির আছে, এমন কি চীনা কালী মন্দির ও দেখা যায়।এত মন্দিরের কারণ কি?

এই বিষয়টি নিয়ে চমৎকার বিশ্লেষণ করলেন টুং
অন চার্চে উপস্থিত এক প্রাজ্ঞ, সৌম্য বয়স্ক চীনা ভদ্রলোক।
লাল চীনের জনসাধারণের মানসিকতার সঙ্গে ভারতীয় চীনাদের মানসিকতার অনেক ফারাক আছে, যেটা একান্তই স্বাভাবিক।এ দেশের চীনারা সেই সব অভিবাসীদের বংশোদ্ভূত যারা ছিলেন কৃষি শ্রমিক, ছুতোর মিস্ত্রি, জুতো তৈরির মিস্ত্রি ইত্যাদি, অর্থাৎ সমাজের খেটে খাওয়া নিম্নবিত্ত মানুষ।পেটের দায়ে বিদেশে এলেও তাঁরা সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন তাঁদের নিজস্ব সংস্কৃতি, ধর্ম, পৌরাণিক গাঁথা, বিশ্বাস, তাঁদের নিজস্ব দেব দেবী ইত্যাদি।

সুবৃহৎ চিনদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আগত অভিবাসীরা নিজেদের প্রথা মতন দৈনন্দিন জীবনযাপন থেকে দেব-দেবীর পূজা, সবই করতেন।যেহেতু এখনও ভারতীয়রা, চীনাদের সেভাবে আপন করে নেয়নি, তাই নতুন প্রজন্মও বাপ ঠাকুর্দার প্রচলিত মত ও পথ আরো জোরে আঁকড়ে আছে।খ্রিস্টান দের সঙ্গে, বৌদ্ধ ধর্মে , কনফুসিও ধর্মে, তাও ধর্মে বিশ্বাসী মানুষ, সব মিলে মিশে একাকার।
প্রথম দিকের চীনা অভিবাসীদের বৃহৎ অংশই এসেছিল ক্যান্টন থেকে, কারণ প্রথম পুরুষ টং আছিও ক্যান্টনিজ ছিলেন।তাই টেরিটিবাজারের বর্তমান চীনাদের বৃহৎ অংশই সেই ক্যান্টনিজদের বংশোদ্ভূত। আর অনেকে এসেছিল ফুজিয়ান প্রদেশ থেকে, যাঁরা সাধারণত হাক্কা নামে পরিচিত ছিল।ক্যান্টনিজ ভাষায় হাক্কা অর্থ বিদেশী, অর্থাৎ বোঝা যাচ্ছে যে বর্তমান ভারতের মতনই সেই সময় চীনাদের মধ্যেও, প্রদেশে প্রদেশে জনসাধারণের মধ্যে বিভেদ বিদ্যমান ছিল।

দীপাঞ্জন ঘোষের লেখাতে পাচ্ছি- টং আছিও র মৃত্যুর পরে চীনারা প্রথমে ধর্মতলার নিকটে কসাইটোলা এবং তার পরে বৌবাজারের কাছে টেরিটিবাজারে এসে বসতি গড়ে তোলেন। পত্তন হয় চীনাপট্টির , বর্তমানের চায়না টাউন। ক্যান্টনিজরা মুখ্যত শুরু করে হোটেল/ রেস্টুরেন্টের ব্যবসা। হাক্কা সম্প্রদায় কাঠের ব্যাবসা এবং জুতোর দোকান খুলে বসে। সাংহাই থেকে আগত অভিবাসীরা কাপড় এবং লন্ড্রির ব্যাবসায় চলে যায়।আর হুপে বলে একটি সম্প্রদায়,চাইনিজ ডেন্টিস্ট হয়ে বসে যায়,  হয়তো চীন দেশেও তাঁরা এই ব্যবসা করতো।আর এক বৃহৎ সংখ্যক চীনা চর্ম জাত ব্যাবসার সঙ্গে যুক্ত ছিল। এই চর্ম দ্রব্য ব্যাবসার কারণেই পরে এনারা পূর্ব কলকাতার ট্যাংরায় উঠে যান এবং কলকাতার দ্বিতীয় চায়না টাউন গড়ে ওঠে।উল্লেখযোগ্য যে প্রতিটি সম্প্রদায়ের নিজস্ব ক্লাব এবং চার্চ অর্থাৎ মন্দির ছিল যদিও সেই প্রাচীন মন্দিরগুলি খুঁজে পাইনি।বর্তমানের মন্দিরগুলি ঊনিশ শতকের শেষ থেকে বিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে তৈরি।

কলকাতার চীনা সংস্কৃতির আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক দেখতে পাচ্ছি, উৎসবাদি থেকে ঘর সাজানো, সবকিছুতেই চড়া রঙের ব্যাবহার।এই ব্যাপারটি নিয়ে অনেককেই প্রশ্ন করেছিলাম যার মধ্যে অন্যতম নিউ মার্কেটের 'জিমিস' রেস্টুরেন্টের প্রাক্তন শেফ , বর্তমানে টেরিটিবাজার জি হিং চার্চ এবং ক্লাবের সদস্য এবং ভারতীয় চীনাদের উন্নতি এবং বিভিন্ন চ্যারিটেবল কাজে যুক্ত ৭২ বছরের টগবগে, ঝরঝরে বাংলা বলা যুবক টনি লো।এনাদের কাছ থেকে যতদূর জেনেছি, আপনাদের অবগত করছি।
লাল রঙের ব্যবহার সর্বাধিক দেখা যায় কারণ জীবনের প্রতীক রক্তের বর্ণ গাঢ় লাল।এজন্যই চীনা নববর্ষে বাড়ি ঘর, চীনা লণ্ঠন, কাগজের শিকল, বেলুন, চীনা ভাষায় লেখা অভিনন্দন বার্তা সব লালে লাল।এই লাল রঙের সঙ্গে লাল চীনের কোনো সম্পর্ক নেই।ঝাউ রাজতন্ত্রের প্রতীক হিসেবে লাল রঙকে ধরা হয়।আরেকটা কথা, একটি প্রাচীন বিশ্বাস যে চৈনিক অপদেবতা " নিয়ান" নাকি লাল রঙ সহ্য করতে পারে না।তাই অপদেবতা তাড়াতে ঘরদোর লাল রঙের হয়, যেভাবে আমরা কুলো/ঝাড়ু ইত্যাদি ঘরের সামনে টাঙিয়ে রাখি, সেরকমই আরকি!


লাল যদি শুভ হয় তবে নীল রং হচ্ছে অশুভ এবং ভূত প্রেতের প্রতীক।অবশ্য নীল নয়না সুন্দরীদের এই লিস্টে রাখা হয় কিনা জানিনা!সাদা রংকে পবিত্রতা বলে ধরা হয়। আবার মৃত্যুর প্রতীক ও সাদা রং। আমরাও তো মৃত্যুর পরসাদা শাড়ি বা কোরা ধুতি পড়ি।কালো রং জীবনদাতা জলের প্রতীক।সবচেয়ে পবিত্র রঙ হলুদ বা সোনালী। হলুদ রঙ ধরিত্রীর প্রতীক।রাজকীয় ঘরবাড়ির ছাদ হলুদ রঙের হয়।

এই দেখুন, কথা হচ্ছিল মন্দির আর ধর্ম নিয়ে, আর কোথায় চলে গেছি।হ্যাঁ, যে কথা বলছিলাম- তাও ধর্মের সঙ্গে হিন্দু ধর্মের বেশ মিল আছে।হিন্দু ধর্মের মতন ঠাকুর দেবতা, স্বর্গ মর্ত, সবই আছে,  আমাদেরই ধর্ম বিশ্বাসের মতন তাও ঠাকুর দেবতারাও কেবল স্বর্গে থাকেন।
গৌতম বুদ্ধ ছাড়াও অনেক দেবতা আছেন যেমন চিকিৎসার দেবতা বাওসেং দাদি, যোদ্ধা দেবতা গুয়ান ইউ, মেঘ ও বৃষ্টির  দেবতা চীনা ড্রাগন, আমাদের দেবী সরস্বতীর মতন ওয়েন চাঙ, ইনি অবশ্য দেবতা।

এখানে একটি উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হচ্ছে, হিন্দুধর্মে যেমন দেব দেবীরা সবাই পৌরাণিক চরিত্র, চিনদেশে কিন্তু তা নয়।এখানে যেমন অনেক পৌরাণিক দেব দেবী আছেন যথা ড্রাগন, সমুদ্র দেবী লিন মাও লিয়াং ইত্যাদি, তেমনি অনেক দেব দেবী আছেন যাঁরা আদিতে মনুষ্য চরিত্র।পরে এঁদের ওপর দেবত্ব আরোপিত করে দেবতায় উন্নীত করা হয়েছে। স্বয়ং গৌতম বুদ্ধ তো আছেনই, আরো অনেকে আছেন যেমন যোদ্ধা দেবতা গুয়ান য়ু বা কোয়ান টি, যিনি এক বিখ্যাত যোদ্ধা ছিলেন।কাজেই পৌরাণিক দেবতার সঙ্গে অনেক মনুষ্য দেবতা , চীনাধর্মে  দেখা যায় ।
আমরা চললাম টেরিটিবাজারের ধারে কাছে এই সকল দেবতা এবং মনুষ্য দেবতাদের মন্দির দর্শনে।                    
(চলবে.........)

ছবি:
১) অছিপুরের চীনা মন্দিরের প্রধান ফটক , সব লালে লাল- ঝুলে ঝুলে লাল দম মস্ত কলন্দর।
২)টেরিটিবাজারের মন্দিরে চমৎকার কম্যুনিটি হল।
৩) দেবতার অস্ত্র শস্ত্র।
৪)মনুষ্য রুপী দেবতা গুয়ান য়ুর মূর্তি।
৫) মন্দিরের দেওয়ালে আঁকা মানুষ দেবতার ছবি।
 তথ্যসূত্র: Interment of Chinese Indians- WikipediaHttps://en.m.wikipedia.org>wiki>Interment
 ডা: তিলক পুরকায়স্থ ,CEQ 2/3, CENTRAL HOSPITAL KALLA, ASANSOL    713340.
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের MBBS, MD, মুখ্যত চিকিৎসক, কেন্দ্রীয় সংস্থার উৎকৃষ্ট চিকিৎসা সেবা পদক, লাইফ টাইম আচিভমেন্ট আওয়ার্ড ইত্যাদি প্রাপ্ত।নেশায় ভ্রামনিক , ফটোগ্রাফার এবং শখের লেখক।

Friday, February 23, 2018

KRISHNANOGORER RAJADER ADI RAJDHANI MATIYARI

         

 

 

        কৃষ্ণনগরের রাজাদের আদি রাজধানীর সুলুক-সন্ধান


                কৃষ্ণনগরের রাজাদের আদি রাজধানী মাটিয়ারি

                                               উদয়ন মজুমদার


১৭৮৭ সালে ব্রিটিশ ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানির রাজত্বকালে আত্মপ্রকাশিত নদীয়া জেলার (বর্তমানে সংশোধিত বানানবিধি অনুসারে ‘নদিয়া’) ইতিহাস যথেষ্ট প্রাচীন ও গৌরবময়। ইতিহাসের অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রেক্ষাপটের সাক্ষী এই নদিয়া জেলা। বাংলাদেশ সীমান্ত সংলগ্ন নদিয়া জেলার কৃষ্ণগঞ্জ থানার অন্তর্গত মাটিয়ারী, নদিয়ার অন্যতম প্রাচীন ইতিহাস সমৃদ্ধ এক গ্রাম।


মাটিয়ারী গ্রামের নামকরণ সম্পর্কে অনেক কথা প্রচলিত থাকলেও, গ্রামটি উঁচু মাটির ঢিপি বা স্তুপের উপর দাঁড়িয়ে আছে বলেই এরূপ নামকরণ বলেই বেশিরভাগজন মনে করেন। গ্রামটির উত্তর-পূর্ব দিক জুড়ে রয়েছে বাংলাদেশ। কাঁটাতারের ওপিঠে রয়েছে চুয়াডাঙ্গা জেলার রাজাপুর, ধোপাখালি, জীবননগর, গয়েশপুর, গোয়ালপাড়া গ্রাম। গ্রামের উত্তর-পশিম দিক জুড়ে রয়েছে হাতিয়ার বিল, কাঠুয়া বিল, নতুন বিল ও চারাতলার বিল। গ্রামের কাছ দিয়েই বয়ে গেছে মাথাভাঙ্গা উপনদী, যার পশ্চিম শাখাটি চূর্ণী ও পূর্ব শাখাটি ইছামতী নামে দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত হয়েছে।

১৬০৬ খ্রিস্টাব্দে নদিয়ার এই মাটিয়ারী গ্রামেই  জমিদার ভবানন্দ মজুমদার প্রথম তার রাজধানী স্থাপন করেন। নদিয়াধিপতি মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদারের পূর্বপুরুষ ভবানন্দ মজুমদারের সময়কাল থেকেই মাটিয়ারী গ্রামের শ্রীবৄদ্ধি ঘটে।


রামচন্দ্র সমাদ্দারের প্রথম পুত্র ছিলেন দুর্গাদাস। সাহসী, বুদ্ধিমান, চতুর, কূটকুশলী দুর্গাদাস  মোঘলসম্রাট জাহাঙ্গিরের আমলে (১৬০৫ থেকে ১৬২৭ খ্রিস্টাব্দ ) সেনাপতি মানসিংহকে যশোররাজ প্রতাপাদিত্য দমনে সাহায্য করেছিলেন। কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির দেওয়ান কার্তিকেওচন্দ্র রায়ের লেখা কৃষ্ণনগর রাজবংশের ইতিহাস ‘ক্ষিতীশ বংশাবলী চরিত’ গ্রন্থে এর সমর্থন পাওয়া যায়। এরই ফলশ্রুতিতে সম্রাট জাহাঙ্গির ১৬০৬ খ্রিস্টাব্দে এক ফরমান জারি করে দুর্গাদাসকে নদিয়া, মহতপুর, লেপা, সুলতানপুর, কাশিমপুর, মা্রূপদহ বয়েশা, মসুন্ডা ইত্যাদি ১৪টি পরগনার জমিদারি প্রদান করেন।

জমিদার হবার পর দুর্গাদাস ‘ভবানন্দ মজুমদার’ নামে পরিচিত হয়ে ওঠেন। এইসময় জমিদারি দেখাশোনা করার জন্যে ভবানন্দ বর্তমান নদিয়া জেলার কৃষ্ণগঞ্জ থানার মাটিয়ারীতেই তাঁর প্রথম রাজধানী স্থাপন করেন। একই সাথে বাংলাদেশের মেহেরপুর জেলার অন্তর্গত বাগোয়ানেও আর একটি  রাজপ্রাসাদ স্থাপন করেছিলেন। পরবর্তীকালে এই বংশের অষ্টমপুরুষ মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র ১৭২৮ খ্রিস্টাব্দে রাজধানী কৃষ্ণনগরে স্থানান্তরিত করেন।

ভবানন্দ মজুমদারের সময়ে মাটিয়ারী সম্পন্ন গ্রাম হিসেবে বিবেচিত হতো। তখন সম্পন্ন গ্রাম বলতে ধনী এবং শিক্ষিত লোকের বসবাস, পর্যাপ্ত জলাশয় এবং চাষযোগ্য জমি সমৃদ্ধ গ্রাম। সে অর্থে মাটিয়ারীতে তখন কোনকিছুরই অভাব ছিল না। একাধিক সম্পন্ন হিন্দু-মুসলমান পরিবারের বাস, নদিয়ার বিখ্যাত সংস্কৃত টোল, পাঠশালা, গান-বাজনা ও সংস্কৃতি চর্চার পুরদস্তুর চল ছিল তৎকালীন মাটিয়ারীতে। সংস্কৃত চর্চার গুরুত্বপূর্ণ পীঠস্থান হিসেবে মাটিয়ারীকে দ্বিতীয় নবদ্বীপ বলা হতো। মাটিয়ারীতেই বাস করতেন যদুভট্ট, জহ্নু মহাপাত্র, নারায়ণ মল্লিকের মত গুণীজন।

পুরনো ঐতিহ্যের সাক্ষী হিসেবে রাজবাড়ির চিহ্ন আজ অবলুপ্তির পথে। রাজবাড়ির বাগান, মজে যাওয়া পুকুর, পুরনো নায়েববাড়ি আজ আর স্বমহিমায় নেই। ভবানন্দ মজুমদারের নাতি রাজা রাঘব রায় প্রতিষ্ঠিত ‘রুদ্রেশ্বর’ শিবমন্দির আজ তাঁর কৌলীন্য হারিয়ে নিঃশব্দে বিরাজমান। রাজবাড়ির বুকে ১৬৬৫ খ্রিস্টাব্দে রাজা রাঘব রায় প্রতিষ্ঠিত, পোড়ামাটির অপরূপ ভাস্কর্যমন্ডিত শিবমন্দিরটি নদিয়া জেলার অন্যতম প্রাচীন শিবমন্দির। মন্দিরগর্ভে কালো মারবেল পাথরের শিবলিঙ্গও, ‘রুদ্রেশ্বর’ নিত্যপুজিত হন। মন্দিরের গায়ে পোড়ামাটির মূর্তির মধ্যে কৃষ্ণলীলা, গোপিনীদের বস্ত্রহরণ, নৌকাবিলাস, অশ্বারুঢ় যোদ্ধা এবং হাতির পিঠে মোঘল যোদ্ধাদের ফলকগুলি  উপযুক্ত রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে নষ্ট হয়ে যেতে বসেছে।

ভবানন্দের সময়কালে মাটিয়ারী গ্রাম ছিল হিন্দু-মুসলমান সম্প্রদায়ের সহাবস্থানের জনপদ। সেই কারণেই মাটিয়ারীতে একাধারে শিবমন্দির ‘রুদ্রেশ্বর’ ও পীর মালেক উল গাউস-এর দরগা বা ‘বাবা বুড়ো সাহেবের দরগা’-দেখা যায়। যতদূর জানা যায়, মালেক উল গাউস বা ‘বুড়ো পীর বাবা’ খ্রিস্টীয় ষোড়শ শতকে পারস্যের ইস্পাহান শহরের এক ধনী পরিবারে জন্মগ্রহন করেন, পরে আত্মানুসন্ধানের টানে বাড়ি ছাড়েন। ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রদেশ ঘুরে বর্তমান পশিমবঙ্গের মাটিয়ারীতে পদার্পণ করেন। রাজা ভবানন্দের বিশেষ অনুরোধে বর্তমান মাটিয়ারীর দরগা সন্নিহিত অঞ্চলে বসবাস শুরু করেন এবং সেখানেই দেহ রাখেন। তাঁর সমানভূমিই বর্তমান বাবা বুড়োসাহেবের দরগা। তাঁর জীবদ্দশায় রাজা ভবানন্দ মজুমদার তাঁকে ‘হজরত শাহ মুলুকে উল গাউস’ অর্থাৎ ‘ফকিরের বাদশাহ’ উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন। বুড়োসাহেবের আবির্ভাব ও তিরোধান দিবস ৭ই আষাঢ় অম্বুবাচী তিথিতে।এই দিন আজও মেলা অনুষ্ঠিত হয় দরগাতে।


বর্তমান মাটিয়ারী গ্রাম ভবানন্দ মজুমদারের আমলের  অভিন্ন মাটিয়ারী গ্রামের তুলনায় অনেক সঙ্কুচিত। রাজধানী স্থানান্তর ও পরবর্তী বিভিন্ন প্রেক্ষাপটকে সামনে রেখে বর্তমান সময়ের আশপাশের অনেক গ্রাম তৎকালীন মাটিয়ারী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। সুপ্রাচীন হাইস্কুল (মাটিয়ারী বানপুর উচ্চ বিদ্যালয়), স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে রেলওয়ে স্টেশনসহ (বানপুর রেলওয়ে স্টেশন) সকল রকম আধুনিক সুযোগসুবিধা সমন্বিত একটি গ্রাম, মাটিয়ারী আজ অনেক উন্নতি করেছে বা করছে। অনেক কৃতি সন্তানের জন্মভূমি মাটিয়ারী ।প্রচারের আলোয় তেমনভাবে মুখ তুলে না তাকালেও সে স্বমহিমায় বিরাজমান আছে এবং থাকবে।

উদয়ন মজুমদার, বিজ্ঞানের ছাত্র, তবে নেশা সাহিত্য ও ইতিহাসে। স্ট্রীট ও আস্ট্রোফটোগ্রাফি শখ হলেও সাহিত্য ও ইতিহাসে্র প্রেমে পড়েছেন। ঘুরতে ও অন্বেষণ করতে ভালবাসেন।
কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃমাটিয়ারী বানপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষক ও স্বনামধন্য কবি শ্রীতাপসকুমার মিত্র ও তাঁর সম্পাদিত ‘আকাশের বর্ণমালা’ (আঞ্চলিক ইতিহাস বিষয়ক সংখ্যা), তমোশ্রী মিত্র বাঙ্গালীর ইতিহাস-নীহাররঞ্জন রায়, নদীয়া কাহিনি-কুমুদনাথ মল্লিক, ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে নদিয়া-নিতাই ঘোষ, কৃষি সাহিত্য-স্বপন ভৌমিক।

Thursday, February 22, 2018

VAROTIYO CINADER KHONJE:KOLKATAR EK BISMRITO ODHYAY



                             





      ভারতীয় চীনাদের খোঁজে: কলকাতার এক বিস্মৃত অধ্যায়!

                                                               প্রথম পর্ব


                                    টেরিটি বাজারের ফুটপাতে

                                       গরমভাতের থালা হাতে

 

 

                                                 ডা.তিলক পুরকায়স্থ
 


চন্দ্র বর্ষের প্রথম দিনটি সারা পৃথিবীতে চীনা নববর্ষ হিসাবে চিহ্নিত।এই উৎসবকে বসন্ত উৎসব বা স্প্রিং ফেস্টিভ্যাল ও বলা হয়।এবছর নববর্ষ পড়েছিল ১৬ ই ফেব্রুয়ারি, শুক্রবার।সেদিন সারা পৃথিবীর মতন কলকাতার ক্ষয়িষ্ণু চীনা সম্প্রদায়ের লোকজন চায়না টাউন- টেরিটি বাজার এবং ট্যাংড়াতে মহা ধুমধামের সঙ্গে এই দিনটি পালন করে। এই উৎসব চলবে মাসাধিক কাল ধরে, শেষ হবে মার্চ মাসের ১৮ তারিখ।


তাই চলুন আমরাও বেরিয়ে পড়ি ইন্ডিয়ান চাইনিজ দের সঙ্গে মোলাকাত করতে কলকাতার চীনে পাড়ায়।পরিচয় করি আমাদেরই এক প্রাচীন প্রতিবেশীদের সঙ্গে, যাদের আমরা আমাদের স্বভাব সিদ্ধ অহঙ্কারে না চেনার, না জানার ভান করে দূরে সরিয়ে রেখেছি। অথচ বিস্মিত হয়ে দেখবেন যে অধিকাংশ চীনারা আমাদের আদব কায়দা, আহার বিহার আত্মস্থ তো করেছেই, দুর্গা পূজা, কালী পুজোতেও তাঁরা সানন্দে যোগদান করছেন।প্রায় সবাই নিজেদের ভাষার সঙ্গে অনর্গল হিন্দি, বাংলা বলেন।নতুন প্রজন্ম তো হিন্দিতেই বেশি স্বচ্ছন্দ।তাহলে আমরা কেন এমন উন্নাসিক, চীন ভারত নরম- গরম সম্পর্কের জন্য এই নিরীহ,(অধিকাংশই) গরিব লোকগুলোকে কেন দায়ী করি, কেন এদের দূরে সরিয়ে রাখি?

কিন্তু পরিস্থিতি তো আগে এমন ছিল না।৩০/৪০ দশকে যখন ভারত ব্রিটিশের অধীন এবং চীন জাপানের অধীন, তখনকার সামাজিক অবস্থান নিয়ে একটি অসাধারণ মানবিক মূল্যবোধ সম্পন্ন উপন্যাস লেখেন পদ্মভূষণ মহাদেবী ভার্মা, যার চিত্ররূপ দেন মৃনাল সেন।১৯৫৯ সালে মুক্তি পাওয়া সেই অসাধারণ বই " নীল আকাশের নিচে" , এখনো আমাদের হৃদয় মুচড়ে দেয়, চোখের পাতা সিক্ত হয়ে ওঠে চীনা ফেরিওয়ালা ওয়াং লু এবং তীব্র সাজাত্যবোধের অধিকারিণী বাঙালি গৃহবধূ বাসন্তীর অভিনয়ে অনবদ্য মানবিক অনুভূতির প্রকাশ দেখতে দেখতে।

অথচ আশ্চর্য লাগে, এই সিনেমাকেও সেযুগের রাজনৈতিক অধিকারীরা বেশ কিছুদিন ব্যান করে রেখেছিল। শুধু তাই নয় এই রাজনৈতিক কর্তারা ১৯৬২ সালে চীন- ভারত যুদ্ধের সময় অসংখ্য নিরীহ, সাধারণ, ছাপোষা ভারতীয় চীনাদের কোনো কারণ না দর্শিয়ে নির্বাসনে পাঠান, ব্রিটিশ জমানার কুখ্যাত রাজস্থানের দেউলি ক্যাম্পে, যার সিংহভাগ ছিল বয়স্ক এবং শিশুরা।১৯৬৭ সাল অবধি বিনা বিচারে, বিনা চার্জে এদের বন্দী করে রাখা হয়, যার বৃহৎ সংখ্যক আর ফিরে আসেননি।সেই দুঃখে, গ্লানিতে বেশিরভাগ ভারতীয় চীনা, খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করে, খ্রিস্টান নাম নিয়ে, এদেশ ত্যাগ করে ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, আমেরিকা পাড়ি দেন, তাই বর্তমানে ইন্ডিয়ান চাইনিজ জনসংখ্যা অত্যন্ত কমে গেছে।


কোন কথা থেকে কোথায় চলে এলাম। শুরু করেছিলাম চীনা নববর্ষ দিয়ে। চীনা নববর্ষে প্রতি বছর এক একটি রাশির প্রতীক হিসাবে এক একটি জীব ঘুরে ফিরে আসে।যেমন এই বছরটি হচ্ছে 'ইয়ার অফ দা ডগ'।সামনের বছর নববর্ষের দিন পড়বে, ৫ ই ফেব্রুয়ারিতে, সেটি হবে ' ইয়ার অফ দা পিগ'।

এবার একটু পিছন ফিরে ইতিহাসের দিকে তাকাই।ফা হিয়েন সম্ভবত প্রথম চীনা নাগরিক যিনি সম্রাট অশোকের সময় ভারতে আসেন তাম্রলিপ্ত বন্দর দিয়ে।এর পর আসেন বৌদ্ধ ভিক্ষু , পন্ডিত এবং পরিব্রাজক হিউয়েন সাং সম্ভবত ৬৩০ খ্রিস্টাব্দে কাশ্মীর দিয়ে।

এরপর আসি আধুনিক যুগে।জব চার্নক কলকাতায় এলেন ১৬৯০ সালে।এর পরে প্রায় ৯০ বছর পরে ১৭৭৮ সালে যে চৈনিক ভদ্রলোক প্রথম ভারতবর্ষের মাটিতে, সঠিকভাবে বললে বজবজ জেটিতে পা দিলেন তিনি টাং আছিও।এই টাং আছিও ছিলেন কোওয়াং- টুং বা ক্যান্টনের চায়ের ব্যবসাদার।ভারতে বাণিজ্য বৃদ্ধির লক্ষ্যে তিনি আসেন, সঙ্গে নিয়ে আসেন কিছু চীনা শ্রমিক এবং ক্যান্টনের বিখ্যাত ইংরেজ ব্যবসায়ী জেমস ফ্লিন্টনের একটি সুপাারিশ পত্র।দেখা করেন গভর্নর জেনারেল লর্ড হেস্টিংস এর সঙ্গে।ফ্লিন্টনের সুপারিশ পত্র আর চীনা চায়ের স্বাদ-গন্ধে হেস্টিংস সাহেব তো বেজায় খুশি।সঙ্গে সঙ্গে বজবজের গঙ্গার ধারে ৬৫০ বিঘা জমির বরাদ্দ করলেন আছিওর জন্য। শর্ত দিলেন এই জমিতে আখের চাষ  এবং সুগার মিল তৈরি করতে হবে।তখন এই বিস্তীর্ণ এলাকার মালিক বর্ধমানের মহারাজা।গভর্নর এর হুকুমে তিনি ৬৫০ বিঘা জমির পাট্টা দিলেন টাং আছিও কে, বাৎসরিক ৪৫ টাকা খাজনার বিনিময়ে।

আছিও চীন দেশে ফিরে গিয়ে আরো ১১০ জন চীনা শ্রমিককে নিয়ে এসে, ১৭৭৮ সালেই শুরু করেন আখের চাষ।সুগার মিল তৈরি করতে লাগে তিন বছর।এরপর ১৭৮১ সাল থেকে শুরু হয় ভারতবর্ষের প্রথম সুগার মিল।বাংলা ভাষায়ও নতুন শব্দ জুড়ে যায়-চীনা মালিকের তৈরি সুগারের নামকরণ হয় "চিনি"।অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক যে কারখানা চালু হবার দু বছরের মধ্যেই ১৭৮৩ সালে আছিও সাহেবের মৃত্যু হয়।কিন্তু ততদিনে আছিও সাহেবের নামে বজবজের কাছে এই জায়গাটির নাম হয়ে গেছে " অছিপুর"।


এরপর আমরা যাচ্ছি টেরিটিবাজারের চায়না টাউন এ।আবার পরে ফিরে আসবো অছিপুর।গল্ফ গ্রীন থেকে বেড়িয়ে সকাল সাতটার মধ্যে পৌঁছেছি সানইয়াত সেন স্ট্রিট, টেরিটিবাজার। পেটে ছুঁচোর ডন বৈঠক চলছে।কুছ পরোয়া নেহি! পৌঁছে গেছি স্বর্গের রন্ধন শিল্পীদের ঠিকানায়।

আপনারা কতজন জানেন জানিনা, বিশুদ্ধ, অতি উত্তম ঘরোয়া চীনা প্রাতরাশের স্বর্গ হচ্ছে টেরিটিবাজার এবং ট্যাংড়ার কালীমন্দির সংলগ্ন এলাকা।এখানে ঘরে প্রস্তুত চীনা খাবার, অথেন্টিক চীনা মশলা দিয়ে তৈরি করে ঘরের গিন্নিরা যে চৈনিক প্রাতরাশ পরিবেশন করেন, ভূ ভারতে এর তুলনা নেই।চৈনিক রন্ধনকে কেবলমাত্র উদরপূর্তির খোরাক হিসাবে দেখলে সেটি হবে নিতান্ত মূর্খের চিন্তা।চৈনিক রন্ধন প্রণালী নিজেই বিশ্ব বিখ্যাত।এখানের খাবারের স্বাদ যে শুধু ফাটাফাটি তাই নয়, দামের দিক থেকেও কমের দিকে।ঘুরে ঘুরে প্রথমে দেখে নিলাম কি কি খাদ্যবস্তু পাওয়া যাচ্ছে।বলা যেতে পারে কি পাওয়া যাচ্ছে না! মাথা খারাপ হবার যোগাড়।মোমো ই কত রকমের- ফ্রাইড মোমো, স্টিম মোমো,পরক ফ্রাইড মোমো, পরক স্টিম মোমো। পরিচিত আইটেম ফিস সুইমাই বা ডাম্পলিং এর সঙ্গে আছে ভেজ ডাম্পলিং, প্রন ডাম্পলিং।একটি আইটেমে পেট ভরাতে হলে পাবেন রেড মিট পাও(ছোট) এবং ঝাই পাও(বড়)।এখানে শেষ নয়- আছে চিকেন অনটন, মিট বল, ফিস বল, পরক বল স্যুপ।চমৎকার ঘরে তৈরি পনির বা টফু নিয়ে এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক বসে আছেন।নিতে পারেন মেই কো পান(রাইস পুডিং)। এক শিশি তেলে ডোবানো সর্ষে শাক বা হামছই নিয়ে নিলাম, ঘরে গিয়ে দেখবো ডাক্তারনি কি বানান এটা দিয়ে!পর্যবেক্ষণ হয়ে গেলে খেতে বসলাম এক থালা ধোঁয়া ওঠা আতপ চালের ভাত ও চীনা সসেজ লাপচিয়ং দিয়ে।পাশেই দাঁড়িয়ে খাবার ব্যবস্থা আছে।এই লাপচিয়ং এর এত নাম আগে শুনেছি যে, ভেবেই এসেছিলাম, গরম ভাত আর লাপচিয়ং খেতেই হবে।স্বাদগ্রন্থি গুলিতে যে অপূর্ব শিহরণ খেলে গেল, যে অসাধারণ আবেশে চোখ প্রায় বুজে আসছিল, সেখানে নিঃসন্দেহে চায়না টাউনের গরম ভাত ও লাপচিয়ং এর মিশ্রণকে রসনার মহাকাব্য বলা যায়।

তথ্যসূত্র: Interment of Chinese Indians- Wikipedia

Https://en.m.wikipedia.org>wiki>Interment
 ডা: তিলক পুরকায়স্থ ,CEQ 2/3, CENTRAL HOSPITAL KALLA, ASANSOL    713340.
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের MBBS, MD, মুখ্যত চিকিৎসক, কেন্দ্রীয় সংস্থার উৎকৃষ্ট চিকিৎসা সেবা পদক, লাইফ টাইম আচিভমেন্ট আওয়ার্ড ইত্যাদি প্রাপ্ত।নেশায় ভ্রামনিক , ফটোগ্রাফার এবং শখের লেখক।








   

Wednesday, February 21, 2018

HA MORI! BANGLA VASHA !!

   

                            হা মরি বাংলা ভাষা! 

 

বাংলাভাষাঃ সাহিত্যের ভাষা থেকে জীবন-জীবিকার ভাষা করতে দেয়নি পশ্চিমবাংলার ভদ্দরলোকেরা!!

 ২১শে ফেব্রুয়ারি।আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। সকাল থেকে শুরু হয়ে গেছে পাড়ার মোড়ে মোড়ে অনুষ্ঠান।বাংলাভাষা এই।বাংলাভাষা তাই।গলাবাজি,নাচ-গান কবিতা-আবৃত্তি।ভাষাশহীদদের জন্য কুম্ভীরাশ্রু।বাংলাভাষা নিয়ে কত রঙ বাহারি আক্ষেপ।তারপর যথা পূর্বং তথা পরং।পানাপুকুরের সেই একই রূপ।ফি বছরের চেনা নাট্যদৃশ্যের   পুনরাবৃত্তি!! হা মরি বাংলাভাষা!!



আচ্ছা-- সত্যি করে বলুনতো--বাংলাভাষার সার্বিক  উন্নতি কি আমরা মন প্রাণ থেকে কোনদিন চেয়েছি? চাই কি বাংলা আমাদের সরকারি ও দরকারি ভাষা হয়ে উঠুক? বাংলা হয়ে উঠুক যেমন প্রাণের ভাষা তেমনি মানের ভাষা,তেমনি জীবন-জীবিকার ভাষা?সত্যি কথা বললে অনেকের গায়ে ফোস্কা পড়বে জানি।নেহাৎ স্কুল-কলেজে বাংলাভাষাটা পড়ানো হয় তাই রক্ষে! না হলে বাংলা শিখে হাতে ভিক্ষের ঝুলি।বলুন কোন কাজে লাগবে বাংলা?আমি যখন  বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা নিয়ে পড়তাম তখন অনেকেই  আমাকে ব্যঙ্গ করে বলতো 'বাংলার বাগ"! সেদিন রাগ হলেও আজ বুঝি কথাটা কত বাস্তব! তাই আমার ছেলেকে বলি আর যা শিখবে বাবা শেখো, কিন্তু বাংলা নৈব নৈব চ!তবে হ্যাঁ পারোতো কিছু লিখো! পেটে ছুঁচোয় ডন মারলেও মন ভরবে!

আসলে বাংলাভাষা জনম দুখিনী। খ্রিষ্টীয় দশম শতাব্দী বা তার পূর্বে এই ভাষার জন্ম হলেও প্রাচীন বা মধ্যযুগে এই ভাষা রাষ্ট্রিয় ভাষা হয়ে ওঠেনি।পাল-সেন আমলে নিঃসন্দেহে রাষ্ট্রভাষা ছিল সংস্কৃত।মধ্যযুগের সূচনা পর্ব থেকে রাষ্ট্রভাষা পরিবর্তিত হয়ে ফারশিভাষাতে পরিণত হয়।একসময় জীবন জীবিকার ভাষা ছিল ফারশি।ফারশিভাষা জানা লোকের কদরই ছিল আলাদা।মধ্যযুগের ভদ্রলোকেরা তাই ফারশি শিখতো।আগে যেমন সংস্কৃত ছিল জীবন জীবিকার ভাষা।ফারশি জানা লোকের কদর আদর সমাদর তখন বরাবর।এই কারণে মেয়েদের কুমারীব্রত সেঁজুতিব্রতে ফারশি জানা বরের কামনা করা হয়েছে বারবার।পলাশির যুদ্ধের পর থেকে অবস্থা পালটাতে শুরু করে।ইংরেজরা রাজশক্তির নিয়ামক হয়ে ওঠে।শুরু হয় ইংরেজি ভাষার চর্চা।সমস্ত ক্ষেত্রে ইংরেজির প্রয়োগ শুরু হয় ব্যাপকমাত্রায়।স্বাধীন ভারতে ইংরেজিভাষার মহিমা অপ্রতিহত গতিতে বেড়ে চলেছে।সেখানে বাংলা পড়ে আছে বাংলাতেই।


তর্ক উঠতেই পারে এ নিয়ে।বলতেই পারেন মধ্যযুগে গৌড়বঙ্গের সুলতানদের সহায়তা পেয়েছিল বাংলাভাষা।রুকনুদ্দিন বারবাক শাহ হোশেন শাহ থেকে শুরু করে তাঁদের লস্করদের  পৃষ্ঠপোষকতায় মধ্যযুগীয় বাংলাপাঞ্চালীসাহিত্যের অভূতপূর্ব বিকাশ ঘটেছিল।কিন্তু  গৌড়াধিপরা কি বাংলাভাষাকে কোন সরকারি  কাজে প্রয়োগ করেছিলেন? তাঁরা কবিদের পৃষ্টপোষকতা করেছিলেন।কবির গলায় ঝুলিয়ে দিয়েছেন সুবর্ণের হার?বঙ্গভাষার মর্যাদা সেই অর্থে কোথায় বাড়লো?রাজকাজ্জ্যে বাংলাটা কী লাগতো শুনি?বাংলাভাষা সেই সাহিত্যের জটাজালেই আবদ্ধ হয়ে রইলো।রাষ্ট্রের স্বীকৃতি পেল কি?


  বাংলাভাষার উদ্ভব হয়েছে মাগধী অপভ্রংশ থেকে।  সেই কারণে বোধহয় রাঢ়ী উপভাষাতেই বাংলাভাষার আদি প্রাণশক্তি নিহিত আছে। স্বাভাবিকভাবেই পশ্চিমবংলাতেই বাংলাভাষার বিকাশ বিস্তার হয়েছিল প্রাচীন কাল থেকেই।কিন্তু কি আশ্চর্য !এই  পশ্চিমবাংলাতেই বাংলাভাষা চরম অবহেলার শিকার।কবি  সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বাংলাভাষার জন্য যে আন্দোলন শুরু করেছিলেন সেই আন্দোলন বর্তমানে স্তিমিত। এখনো অফিস আদালতে বাংলাভাষাকে ব্যবহার করতে গেলে কোথায় যেন  আত্মহীনমন্যতা গ্রাস করে।এইতো সংবাদপত্রে দেখছিলাম প্রশাসনিক আমলারা আবার ইংরাজিতে কথা বলতে উৎসাহিত করছেন কর্মচারীদের।আর সেটাই পিঠ চাপড়ানো খবর হচ্ছে সংবাদপত্রে!আসলে বাংলা ভাষাকে অবজ্ঞা করাই আমাদের ভদ্রলোকেদের সংস্কার গৌরব।বাংলা পড়বে বাঙলাতে যাদের কিছু হবে না বলেই।আমার ছেলের বাংলাটা ঠিক আসে না বলে আত্মতৃপ্তি অনুভব করি।এইতো চলে আসছে সেই প্রাচীন কাল থেকেই।আজও তার ব্যতিক্রম নেই।

তবে পশ্চিমবঙ্গ যা পারেনি পুর্ববাংলা তা করে দেখিয়েছে। এখানেই বাঙালী হিসাবে সান্ত্বনা।বাংলাভাষার জন্য ওরা প্রাণ দিয়েছে।শহীদ হয়েছে।ওদের রাষ্ট্রভাষা বাংলা।ওদের জন্যই নেট দুনিয়াই বাংলা এখন সর্বত্রগামী। সুতরাং ওরা ভাষার জন্য প্রাণ দেবে।শহীদ হবে আর আমরা মোড়ে মোড়ে বাংলাভাষার জন্য কুম্ভীরাশ্রু ফেলবো।

হা মরি বাংলা ভাষা!
ছবিঃনেটের সৌজন্যে।।


Sunday, February 18, 2018

PILSONYA GRAMER SHRIKHOL BADONE NADIYANONDON

 

 

 

 

 পিলসোঁয়ার শ্রীখোলবাদনে নদিয়ানন্দন


প্রাচীন জনপদ পিলসোয়াঁ।অনেকেই দাবি করেন একাদশ শতকের ঈশ্বর ঘোষের তাম্রশাসনে উল্লিখিত গাল্লিটিপক ,দিঘসোদিকা আর পিয়ল্লমন্ডল জনপদ--- একালের গোতিষ্ঠা দীর্ঘসোয়াঁ আর পিলসোয়াঁ গ্রাম।কুনুর নদির ঘেরাটোপে এ গ্রামের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অতুলনীয়।রয়েছে  সহজিয়া আউলচাঁদের আস্তানা।কাটোয়া মহকুমার সার্কিট টুরিজমের অন্যতম দর্শনীয় স্থান হতে চলেছে। এ-গ্রামের বিশিষ্ট শ্রীখোল বাদক শ্রীনদিয়ানন্দন বৈরাগ্য।ইনি পশ্চিমবঙ্গ যুবকল্যাণ দপ্তর আয়োজিত প্রতিযোগিতায় রাজ্যস্তরে প্রথম পুরুস্কার প্রাপ্ত শিল্পী।গ্রামের কিশোর দের নিয়ে তিনি তৈরি করেছেন একটি শ্রীখোল-বাদক-দল।দেখুন--কুনুরের তীরে বটের ছায়ায়   সেই বাজনার এক ঝলক!

Friday, February 16, 2018

HARIYE GELO DALER BORI DR.SWAPANKUMAR THAKUR



                           হারিয়ে গেল ডালের বড়ি

 

                                           ড.স্বপনকুমার ঠাকুর 


বড়া আর বড়ির মধ্যে যতই অমিল থাক একটি জায়গায় তাদের দারুন মিল।উভয়েই বটিকা শব্দ থেকে উদ্ভূত।তবে বড়া বেশ বড় সড়।নাদুস নুদুস চেহারার।।ডালের বড়া থেকে শুরু করে তালের বড়া ছানার বড়া বাঙালির রসনায় রসের অমিত্তি।বড়ি সেই তুলনায় নেহাৎ বেঁটে খাটো চেহারার।অনেকের না-পসন্দ!তবে হলে কী হবে! বড়ি নিয়ে মাঘ-ফাগুনে বাঙলীর আগ্রহ উদ্দীপনা  এক সময় ছিল বহুত বড়িয়া।


তবে দিন-কাল পাল্টেছে।আজকাল বড়ি নিয়ে বাঙালীর আর তেমন বাড়াবাড়ি কি লক্ষ করি? সুক্তো টক ঝোল আর রসার অলঙ্কার ছিল এই বড়ি।বিয়ে থা ভোজবাড়ি মানেই হিং দেওয়া বড়ি। কালোজিরে পোস্ত ছেটানো বড়ির কদর আদর। মহাপ্রভুর খাবার মেনুতে ফুলবড়ি হলেই তিনি খুশি হতেন।ভোজ-কাজ অন্নপ্রাশনে বড়ি মাস্ট।এখন সেসব কোথায় গেল?এখন বাজারে যে বড়ি মেলে তাতে আবার চাল-গুঁড়ির ঢিপ।আসল বড়ি মেলে কই?


একসময় এই মাঘ ফাগুনে মা দিদিমারা বড়ি দিতেন।গাঁ-গঞ্জে ধানের জমির আলে খুবি করে কলাই বুনে দিত।এরই নাম ছিল আলকলাই।এই কলাই যাঁতায় ভেঙে নিয়ে তেল মাখিয়ে চটে ঘষে নেওয়া হতো খোসা ছাড়াবার জন্য।গেরস্থ সংসারে লোকের অভাব নেই।বেশ কড়া পাকের রোদ উঠেছে।সুতরাং এই সময়ে বড়ি দিতে হবে।রাতে পাঁচসের কলাই ভিজিয়ে মুলো ঘষার পালা শুরু হতো টকুইয়ে।কিম্বা পাকা চালকুমরো,পাকা লাঊ ইত্যাদি।আমার দিদিমা বিশেষজ্ঞ ছিলেন বাঁধাকপির বড়ির।কালোজিরে পোস্ত সহযোগে সেই বড়ির আস্বাদ আজও অনুভব করি।

ডালের সঙ্গে আনাজের অনুপাত হলো ৩ঃ১।কলাইডালে আনাজ মিশিয়ে এবার ফাঁটার পালা।যত পারতো ফাঁটতো।তারপর এক বাটি জলে ফেলে দেখে নিত বড়ি ঠিক বেঁধেছে কিনা।যতক্ষণ না ঠিক হতো ততক্ষণ চলতো ফাঁটাফাঁটি  ।কলাইডাল ছাড়াও মুসুরি বা মটরডালের বড়ি হলেও এতে আনাজ দিত না কেউ।এছজাড়া বড়িসমাজে এরা অতটা কুলীনও নয়।আমার এক মুসলমান বন্ধুর বাড়িতে দেখেছিলাম পিঁয়াজ মেশানো বড়ি দিতে।ত্তবে স্বাদ গ্রহণ করার সৌভাগ্য হয়নি।

ফাঁটাতো হলো--এবার বড়ি দেওয়ার পালা।তার আগে দড়ির খাটটিকে বেশ ভালো করে ঝেড়ে ঝুড়ে প্রস্তুত করা হয়েছে। এখন যত্ন করে বড়ি দেওয়ার পালা।আমার  ঠাকুরদাদা ঠাকুমা থাকতেন বাংলাদেশে রঙপুরে।ওখানেই স্কুলে পণ্ডিতি করতেন ঠাকুরদা।ঠাকুমা বলতেন ওখানে আবার বড়ি দেওয়ার সময় তেল সিঁদুর ধান দূর্বা দিয়ে প্রথমে ডাল দিয়ে বুড়ো আর বুড়ি বানিয়ে পুজো করা হতো।এরাই বড়ির জনক বা দেবদেবী।তবে এই প্রথা এই বঙ্গে কোথাও দেখিনি।আপনারা কি দেখেছেন? তবে হ্যাঁ ! বড়িতে যাতে কেউ নজর না দেয় তার জন্য বড়ির নাকে গেঁথে দিত লালটুকটুকে পাকা লঙ্কা।

বড়িতে রোদ খাইয়ে বয়াম ভরে রাখা হতো।গ্রাম অঞ্চলে বর্ষাকালে আনাজ কোথা? সুতরাং বড়িতো আছেই তবে ভাবনা কিসের।আর আমরা বাপু রাঢ়ি লোক।কিছু না হোক একটু পোস্ত আর তেঁতুলের টক দিলেই আমাদের ভোজ।তো টক মজাতে বড়ির জুড়ি মেলা ভার! গয়না বড়ি তো রোদে জিলিপির প্যাঁচ দেওয়া।একটা ন্যাকড়ায় ডাল ভরে সামান্য একটু ফুটো করে চাপ দিয়ে গয়না বড়ি হতো।চূড় বালা কানের দুল ইত্যাদি আকারের।তবে শিল্পী ছাড়া এই বড়ি দেওয়া কি সম্ভব? আজ বাঙালীর জীবন থেকে একে একে অপসৃত হচ্ছে তার সাবেক ঐতিয্য।বড়ি দেওয়া আর দেখতে পাইনা।ওই এক আদজন! একটা থালায়  মিক্সিতে খানিকটা ডাল বেঁটে এবরো খেবরো বড়ি দিচ্ছেন নিজের সখে.।


ছবিঃনেটের সৌজন্যে।

Thursday, February 15, 2018

কৌলাল ON LINE:SWAPAN THAKURER BLOG


 আনন্দের কথা এবার থেকে শুরু হলো কৌলাল অন লাইন ব্লগ।এই  অন লাইন ব্লগে এবার আপনাকেও স্বাগত। বাংলার ইতিহাস সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ক ক্ষেত্রসমীক্ষা ভিত্তিক যে কোন মৌলিক লেখা ছবি ভিডিও  সহ পাঠিয়ে দিন। বাংলা বা ইংরাজিতে লেখা পাঠান।নির্বাচিত হলে ব্লগে পোস্ট করা হবে। এই ব্লগটি অল্প দিনের মধ্যে  যেভাবে পাঠকের কাছে সমাদৃত হয়েছে তাতে আমরা আনন্দিত ও উৎসাহিত।আপনিও এই ব্লগে লিখুন।আর  দেশ বিদেশের পাঠকের কাছে পোঁছে যান।অভ্রতে টাইপ করে মেল করুন -- drswapankrthakur@gmail.com.ফোন --9332933023.সঙ্গে পাসপোর্ট সাইজের ছবি আর সংক্ষিপ্ত লেখক পরিচিতি পাঠাবেন ।



যেকোন যোগাযোগ-----

 ড.স্বপনকুমার ঠাকুর কাটোয়া দত্ত মিলের মাঠ কাটোয়া পূর্ববর্ধমান পিন ৭১৩১৩০


Tuesday, February 13, 2018

VALENTINE DAY O MOHASHIBO RATRI


              



 ভ্যালেন্টাইন ডে ও মহাশিবরাত্রি


আজকের দিনটা যাকে বলে ষোল আনা প্রেমের দিন।ভালোবাসার নিশা। পরিণয়ের রাত্রি। মহাশিবরাত্রি।হরগৌরীর মহামিলনের রাত। এইদিন গৌরী শিবের গলায় মালা পরিয়ে বলেছিলেনঃ এ রাত তোমার আমার। অন্যদিকে ভ্যালেনটাইনডে।আত্মত্যাগের দিন।অনুরাগের ছোঁয়ায় শুধু ভালোবাসা আর ভালোবাসা।একদিকে পথের প্রান্তে ফুটে ওঠা আকন্দফুলের স্নিগ্ধতা।অন্যদিকে গোলাপের রক্তিমতা।


 পুরাণ মতে আজকের রাতে শিবপার্বতীর বিয়ে হয়েছিল ঘটা করে।আবার কেউ বলেন শিব আজকে ধরাধামে লিঙ্গরূপে অবতীর্ণ হয়েছিলেন।তাইতো প্রণয়ের রাত, পরিণয়য়ের রাত এই মহাশিবরাত্রি। আজও ভারতের আদর্শ দম্পতির প্রতীক হর-গৌরী।সেই কারণে হিন্দু রমণীরা আজকের রাতে চারপ্রহরে চার বার লিঙ্গরূপী শিবের মাথায় জল ঢালেন।শিব শুধু নটরাজ নন,তিনি প্রেমের দেবতা।
অন্যদিকে এই চোদ্দই ফেব্রুয়ারি আবার ভ্যালেন্টাইন্স ডে।বসন্ত সমাগত।গাছে গাছে কচি কিশলয়।ডালে ডালে পুঞ্জিত আম্রমুকুল।কোকিল কুহুতানে ডাকছে।মনের বনে জেগেছে  বাউল বাতাসের খ্যাপামি।আজতো চুপি চুপি তাকে বলতে বড্ড ইচ্ছে করে --"ভালোবেসে সখি নিভৃত যতনে আমার নামটি লিখো তোমার মনের মন্দিরে"।


তার্কিকরা বলবেন সেকি! ভালোবাসার আবার দিন ক্ষণ আছে নাকি! আরে বাবা-- প্রতীকী বলেতো একটা কথা আছে! ভ্যালেন্টাইন সেই প্রতীক মাত্র। প্রেমেপড়ার দিন।গল্পটা সবার জানা।রোমসম্রাট ক্লদিয়াস টু।সাম্রাজ্যরক্ষা তাঁর বড় দায়।যত বড় শক্তিশালী সৈনিক হোক না কেন।নারীর এক কটাক্ষেইতো সে কুপোকাত! সম্রাট তা বিলক্ষণ জানেন।সেই জন্যই দিলেন আইন জারি করে রোমসাম্রাজ্যে সৈনিকরা বিয়ে করেছো কি ঘ্যাচাং!

  এদিকে যাজক ভ্যালেন্টাইন রাজার আইনকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে গোপনে বিয়ে দিতে লাগলেন সৈনিকদের।রাজার কাছে খবর গেল।হুকুম দিলেন পাকড়াও উসকো।দিলেন জেলে পুরে।বললেন--অপরাধ স্বীকার কর।প্রাণে বাঁচবে।ভ্যালেন্টাইন প্রেমের শক্তিতে বলীয়ান। রাজাজ্ঞাকে করলেন থোড়াই কেয়ার।১৪ই ফেব্রুয়ারি ভ্যালেন্টাইনকে হত্যা করা হলো।তিনি হয়ে উঠলেন কালক্রমে প্রেমের দেবতা--অখণ্ড ধরনীতে।


সুতরাং আজ এই প্রেমের দিনে সকাল থেকেই শুরু হবে মনের বনে লুকোচুরি।প্রেমের উছ্বাস।গোলাপের সৌরভ। এলোমেলো দখিনা বাতাসের  দাপাদাপি।মন দেওয়া নেওয়া।চাই কি চোখের ইশারাতেই  বিশ্বজয়! উন্মোচিত হবে নব যৌবনের কিশলয়।আমাদের পৌঢ় হৃদয় আকাশে দেখা দেবে হঠাত আলোর ঝলকানি।কারু কারু জেগে উঠবে  ধুলো পড়া স্মৃতির চরাভূমি।কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে!

কিন্তু সবুজ মনের অবুঝ প্রেমকে চিরকাল শাসন করেই এসেছে শক্তিশালীরা।  অধিকাংশ পরকীয়া  রতি মানেই রক্তারক্তি। হত্যা প্রতিহত্যা।আজও সংবাদমাধ্যমে পরকীয়া প্রেমের আঘাতের ছবি দেখি।কিন্তু পরকীয়াতেই প্রেম পায় এক প্রচণ্ড  শক্তি।একরোখা,উদ্দাম।সে হয়তো মরণের মধ্য দিয়েই জয়লাভ করে ।সমাজ চায় আমাদের প্রেম হোক  স্বকীয়া। এখানেই চিরন্তন দ্বন্দ্ব।রাধাকৃষ্ণর প্রেম অবৈধ হলেও তাদেরও শাস্ত্র মতে বিবাহ হয়েছে। সেখানে সমাজের দায় বেশি।অবৈধ প্রেম বৈধতা পেয়েছে পরিণয়ের মধ্য দিয়ে।গর্গপুরাণেই রাধাকৃষ্ণের বিয়ের বিশদ বর্ণনা রয়েছে।


 এক হিসাবে ভ্যালেন্টাইনডে কিন্তু বৈধপ্রেমেরই দিন। যাজক ভ্যালেন্টাইন  নর-নারীর প্রেমকেই স্বীকৃতি দিয়েছিলেন  বিবাহের মাধ্যমে।সুতরাং ভ্যালেনটাইন ডে নিয়ে গেল গেল করার কিছু নেই।তিনিও অবৈধ প্রেমকে বৈধ করার জন্যই শহীদ হয়েছিলেন। আর এখানেই মিলে যায় দিন আর রাত্রি।ভ্যালেন্টাইন আর শিব।ভ্যালেনটাইন ডে আর মহাশিবরাত্রি ।

Monday, February 12, 2018

KRISHNOKOLI SWAPANKUMAR THAKUR


                                       কৃষ্ণকলি

                                         




                                                  স্বপনকুমার ঠাকুর


কালো তার গায়ের রঙ।কোঁকরানো চুল।ঘর বলতে ছিটেবেড়ার কুঁড়েঘর। লালমাটি দিয়ে নিকোনো চুকোনো।তারমধ্যে খড়ি দিয়ে ফুলকারি নক্সা।  ভক্ত সেই মনসা ভাদুর আর দিদিঠাকরুনের।গান -বাজনা  বিলাসী।উৎসবে সাজে।কুঁচিয়ে পরে শাড়ি।কপালে লাল রঙের টিপ।দল বেঁধে মেলায় গিয়ে সস্তার আংটি কেনে। সোনালি হার পরে।কালো চোখে কাজল টেনে ভাঁজো নাচতে আসে।গোপনে আসনাই করে ।কবি হলে বলতুম কৃষ্ণকলি।আসলে গ্রাম- গঞ্জের খেটে খাওয়া  এক্কেবারে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীদের বউ-ঝি।

স্বামীর মতো তারাও কাজ-কর্ম করে খায়।ধান কাটে।ধান ঝাড়ে।পালা দেয়।কিন্তু সেতো চাষের সিজিনে ।আবার স্বামীর সঙ্গে এক আদঢোক গিলে নিয়ে দেদার ফুর্তি করে।তবে  তাদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রাটা ভিন্ন ধরনের।যারা তাদের জীবনকে প্রত্যক্ষ ভাবে দেখেছেন তারা ছাড়া  বুঝবেন না। স্বামীরা পরের খেতে কাজ করতে যায় সেই ভোরবেলায়।কেউ লাঙ্গল চষে।ধান রোয়।কেউ বা মেঠো খড়ো ঘর ছাওনার কাজে তলপেটে খাটে।আর তাদের গিন্নিরা একটু বেলা হলে বড় পাতকাটা নিয়ে বেড়িয়ে পড়ে মাঠে ঘাটে।।কোথাও তালগাছের শুকনো খোঙা কাটে ।বাবলার ডাল ভাঙে। খড়খড়িয়ে গাছে উঠে বটের শুকনো নামাল কাটে।জ্বালানি সংগ্রহ করে।এ কাজ তারা যৌথভাবেও করে।তারপর ছায়াবহুল বটতলায় বসে ভাগপর্ব।  মাথায় শকনো বোঝারড্যাং চাপিয়ে বাড়ি মুখো।তখন সুজ্জিদেব মাঝ গগনে।


 চুলোতো জ্বলবে কিন্তু খাবার? গেরস্থবাড়ি থেকে দুসের চাল পেয়েছে বরের মজুরি বাবদ।আনাজ বলতে এর ওর জমি থেকে শাকপাতা ছিঁড়ে পেট কোঁচরে ভরা।এবার কিন্তু একটু আমিষ দরকার।নেমে পড়ে  পুকুরে।একঠা মাঠির ঠিলি বসিয়ে দেয় জলে।এবার নিজে গা ডুবিয়ে দু হাত দিয়ে পুকুরের ভিতরে পাঁক ঘাঁটকায়।গুগুলি চ্যাং ছিঙুরির বাচ্ছা কেঁয়ে পুঁটি ধরে ঠিলিতে ভরে।ঘাটের পাশে জোয়ান ছেলে  শিশ দিতে দিতে মোষের গা ধোয়ায়।বাউরিদের বউটার প্রায় অনাবৃত  একটুকস যৌবন দেখে হাঁ করে চেয়ে থাকে।বৌটা গাল পাড়ে শুনিয়ে শুনিয়ে।তারপর একসময় একটা দারুন কটাক্ষ হেনে মিলিয়ে যায় দুপুরের ঘূর্ণি বাওরের মতো।

 এবার দোকান করার পালা।আদবয়সী দোকানদার।যত রসিকতা মেয়েদের সঙ্গে । পাঁচ টাকার বাজেট। দড়িবাঁধা তেলের শিশিতে তেল।খুঁটে বাঁধা জিরে নঙ্কামরিচ  পাঁচমিশেলিঝাল আর একটা সস্তার ধূপকাঠি।আরও দেখতাম বিড়ি  ১০ পয়সার মতিহারি তামাকপাতা।বাড়িতে গিয়ে রান্না বলতে মাঠ থেকে ধরে আনা বেহুলা ক্যাংরাকে গরমবালিতে ভেজে শিলে আচ্ছা করে বেঁটে লঙ্কা আর নুন মাখান জবরদস্ত পদ।কিম্বা গুগুলিসানা কিম্বা কাঁচা পিয়াজ আর অপর্যাপ্ত ঝাল মেশানো চ্যাংমাছ পোড়ার  অমৃতময় ব্যঞ্জন।তাতেই আন ভাত আন ভাত অবস্থা।খেতে নিতে নিতে বেলা যেত গড়িয়ে।

কৃষ্ণকলিদের নিজস্ব একটা সংগীতচর্চার আসর ছিল।তার নাম মাঠালে গান।সে গানে  আদিরসের ভিয়েন ছিল।ছিল নারীর একান্ত নিজের দুঃখ বেদনা চাওয়া পাওয়ার জগত  যার মধ্যে শরীরের চাওয়া পাওয়া।এর নাম মাঠালে গান।ছোট ছোট চুটকির মতো রসালো। সবটা শোনা যেতো না ।কেননা পুরুষ দেখলেই স্টপ।শাকতুলতে তুলতে কিম্বা খেঞো কাটতে কাটতে গুনগুনিয়ে এই মাঠালে গান গাইত।বেশ কিছু সংগ্রহ করেছিলাম একসময়। যেমন...............
        



            মারিস নারে খালভরা /মাছকোথা পাবো
            জমিতে বইছে মাঠান/বাপের বাড়ি যাবো।

ইদানিং একশোদিনের কাজ, সরকারি সুযোগ সুবিধা নিঃসন্দেহে  তাদের জীবনযাত্রাকে অনেকটা পরিবর্তনের আস্বাদ যুগিয়েছে।কিন্তু আজও গ্রামে গ্রামে বাগদি বাউরি হাড়ি মুচিদের জীবনযাত্রার মান খুব একটার পরিবর্তন হয়নি।   আমার নিজের গ্রামে বাউরি হাড়ি মুচি বাগদি মিলিয়ে অন্তত চারশ ঘর পরিবার রয়েছে।সরকারি চাকরি পেয়েছেন মাত্র একজন কি দুজন।সিডিউলকাস্টের  সুযোগকে কাজে লাগিয়েছেন অন্য এক গোষ্ঠী।  খুব সত্য কথা তারা কিন্তু  এদের তুলনায় বড়োলোক সংরক্ষণের আগে থেকেই।সুতরাং তাদের ভদ্দরলোক হতে বেশীদিন সময় লাগেনি।বাকিরা পড়ে আছেন সেই  ঘোর তিমিরে।



 কবে তাদের জীবনযাত্রার পরিবর্তন হবে??

Saturday, February 10, 2018

RAR BANGLAR KOBIGAN KOBIYAL SUVASISH BANERJEE

 জনপ্রিয় লোকসঙ্গীত কবিগান।এ শুধু গান নয়,কবির লড়াই।গানের লড়াই।বক্তব্য চুটকিগল্প ছড়ার লড়াই।সবশেষে থাকে বোলকাটাকাটি ।তারই একঝলক।কবিয়াল শুভাশিষ  ব্যনার্জির উপস্থাপনায়।

Saturday, February 03, 2018

কবিয়াল শুভাশিষ ব্যানার্জির কণ্ঠে কবিগান

মা-মাটি-মানুষের গান রাঢ়-বাংলার কবিগান।এই সময়ের জনপ্রিয় কবিয়াল শ্রীশুভাশিষ ব্যানার্জি।তাঁর কণ্ঠে শুনুন শাক্ত বৈষ্ণব পালার ব্বৈষ্ণবের ভূমিকায় অসামান্য গায়কি।কবিয়ালের সঙ্গে যোগাযোগ--7586836243

Tuesday, January 30, 2018

PROVU NITYANONDA CORIT

        


                             বড়ো গূঢ় নিত্যানন্দচরিত

                 

বৈষ্ণব মহাজন লিখেছেন যদি গৌর না জন্মাতো তাহলে "রাধার মহিমা প্রেমরস সীমা জগতে  জানিত কে!"আবার গৌরভক্তরা মনে করেন মহাপ্রভুকে জানতে বা বুঝতে নিত্যানন্দই ভরসা।তিনি দয়াল-ঠাকুর। গৌরভক্তি প্রেমদাতা।তাঁর কৃপাতেই গৌরসুন্দর ধরা দেবেন।ভক্তরা তাই সবার আগেই ঘোষণা করেন-- জয় নিতাই। কিন্তু নিত্যানন্দকে জানা কি এতই সোজা! সত্যি কথা বলতে কি-- মহাপ্রভুকে জানা বা বোঝার অন্তত চেষ্টাটুকু করা যায়;কিন্তু পদে পদে যিনি বিপরীত তাঁকে বোঝা কার্যত অসম্ভব! ফলে সহজেই হাল ছেড়ে দিয়ে নিত্যানন্দ বিরোধী হয়ে যাওয়াটাই স্বাভাবিক। যেমনটি হয়েছিল তাঁর সমকালে। তাঁর জীবনকাহিনীর মতো তিনি নিজেই এক মহারহস্যময় চরিত্রের দৃষ্টান্ত। বড়ো গূঢ় নিত্যানন্দ!


বস্তুত,গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্মে এক নিঃশ্বাসে উচ্চারিত  দুটি নাম গৌর-নিতাই। আজও গৌর-নিতাই'র দারু বিগ্রহ বাংলার বহু মন্দিরে ও বাড়িতে নিত্য সেবিত।তবে মহাপ্রভুর  নামে প্রচারিত গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্ম বলতে যা আমরা বুঝি তাহলো নিত্যানন্দ প্রচারিত বৈষ্ণবধর্ম। মহাপ্রভুকে তিনিই অখন্ড বঙ্গদেশে  জনপ্রিয় করে তুলেছিলেন।সমাজের উচ্চবর্ণের ব্রাহ্মণ কায়স্থ বৈদ্য থেকে শুরু করে প্রান্তিক  তৃণমূলস্তরেও বৈষ্ণবধর্মকে জনপ্রিয় করে তোলার কৃতিত্বের অধিকারী নিত্যানন্দ।
আবার বঙ্গদেশে তাঁর নেতৃত্বে গুরুবাদ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।তিনি অধিকাংশ বৈষ্ণবপদকর্তাকে পদ রচনায় অনুপ্রাণিত করেছিলেন।তাঁর অনুগামীরাই তাঁর উৎসাহে চৈতন্যজীবনী সাহিত্য রচনা করলেও তিনি নিজে রয়ে গেছেন  নেপথ্যে।

অদ্ভুত বৈপরীত্যময় নিত্যানন্দের চরিত্র।সন্ন্যাসজীবন থেকে মুক্তি নিয়ে সংসারী হয়েছিলেন।সন্ন্যাসীর কৌপিনবস্ত্র পরিত্যাগ করে রাজবেশ পরিধান করেছিলেন।তিনি নিজেই যেন মূর্তিমান এক বিতর্ক ।অথচ সেকালের মতো একালেও তিনি যেন নির্বাসিত এক বৈষ্ণবসাধক।রহস্যময় তাঁর ব্যক্তিজীবন।সমকালে তাঁকে বুঝেছিলেন গুটিকয়েক ব্যক্তি।যার মধ্যে শ্রীচৈতন্যদেব ছিলেন অন্যতম।অথচ সত্যিকারের গণনায়ক বলতে যা বোঝায়  মহাপ্রভু নন স্বয়ং নিত্যানন্দ ।একথা মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করেছেন একালের বৈষ্ণবপণ্ডিত-গবেষকরা।









নিত্যানন্দের ব্যক্তিজীবন বড় রহস্যময়।ভাবতে আশ্চর্য লাগে  শিষ্য বৃন্দাবনদাসকে চৈতন্যভাগবতকাব্য রচনার অনুপ্রেরণা যেমন যুগিয়েছিলেন তেমনি চৈতন্যজীবনী রচনার মুখ্য উপাদানগুলি  যুগিয়েছিলেন। সেখানে নিত্যানন্দের কথা খুবই কম।শুধু জানা যায় নিত্যানন্দের বীরভূমজেলার একচক্রাগ্রামে জন্ম।বাবা-মুকুন্দ ওঝা।মা-পদ্মাবতী।রাঢ়ীয়শ্রেণির ব্রাহ্মণ। বন্দ্যোপাধ্যায় কৌলিক পদবি। গ্রামে পরিচিতি ছিল হাড়াই  পণ্ডিত নামে।পুজো আর্চা নিয়ে থাকতেন। বলরাম দাসের প্রেমবিলাস থেকে অতিরিক্ত আরও কয়েকটি অতরিক্ত তথ্য জানা যায়।যেমন গৃহজীবনে নিত্যানন্দের নাম ছিল চিদানন্দ।তাঁর আরও কয়েকটি ভাই ছিল।নিত্যানন্দের জন্ম হয়েছিল মাঘমাসের শুক্লপক্ষের ত্রয়োদশীতিথীতে। বৃন্দাবন দাস লিখেছেন--


                মাঘমাসে শুক্লা ত্রয়োদশী শুভদিনে।
                পদ্মাবতী গর্ভে একচাকা নামে গ্রামে।।

 গবেষকদের মতে নিত্যানন্দ মহাপ্রভুর চেয়ে বয়সে বছর দশেকের বড় ছিলেন।সেই সূত্রে তাঁর জন্ম আনুমানিক ১৪৭৬/৭৭ খ্রিষ্টাব্দ।বাল্যকাল থেকে নিত্যানন্দ ধর্মীয় নাট-গীতে অনুরক্ত ছিলেন। কিশোর অবস্থায় উপনয়ন সংস্কারের পর তিনি এক সন্যাসীর সঙ্গে পলায়ন করেন।  সহজেই অনুমান করা যায় নিত্যানন্দ অতি ছোট থেকেই সন্যাসজীবনের প্রতি আসক্ত ছিলেন। তিনি সন্ন্যাস গ্রহণ করে তীর্থে তীর্থে পরিব্রাজক হয়ে ঘুরে বেড়ান।গয়া-কাশি প্রয়াগ-মথুরা রঙ্গনাথ দণ্ডকবন ত্রিমল্ল বেঙ্কটনাথ কন্যকানগরী মাহিস্মতী হরিদ্বার ইত্যাদি তীর্থস্থানে প্রায় কুড়ি বৎসর কাটান।

 দুটি দশকের এই বিচিত্র জীবন সম্পর্কে কোন তথ্য জানা যায় না।বরাবর তিনি এ সম্পর্কে মৌন রয়ে গেছেন। দুটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য অবশ্য জানা গেছে প্রথমতঃ তিনি অবধূত অর্থাৎ তান্ত্রিক সন্ন্যাসী ছিলেন।ভক্তিরত্নাকর  থেকে জানা যায়-- তিনি পুরীসম্প্রদায়ের শিষ্য ছিলেন ।লক্ষীপতিপুরীর নিকট দীক্ষা লাভ করেছিলেন।কেউ কেউ বলেন  নিত্যানন্দ শংকর সম্প্রদায়ের সারদামঠে দীক্ষিত সন্ন্যাসী।তবে এসম্পর্কে কোন সুনির্দিষ্ট তথ্যাদি নেই দ্বি্তীয়তঃ নিত্যানন্দ ছিলেন বেশে অবধূত। আকারে মহামল্ল এবং ভোজনপানে বীরাচারী।নবদ্বীপে বৈষ্ণব পরিকরদের সঙ্গে সাক্ষাৎকারের সময় মদ্যপানের কথা প্রকাশ্যেই বলেন।বৃন্দাবন দাস লিখেছেন--

             মধু আন মধু আন বলি প্রভু ডাকে।
             হুঙ্কার শুনিতে যেন দুই কর্ণ ফাটে।। 
 নিত্যানন্দ বীরাচারি তান্ত্রিক অবধূত সাধক হলেও প্রকৃতিতে ছিলেন কৃষ্ণপ্রেমী।আর একটি বৈশিষ্ট্য হলো নিত্যানন্দ  শিশুর মতো সরল অকপট।ক্ষণে রুষ্ট ক্ষণে তুষ্ট।এমন বিচিত্র স্বভাবের  ছিলেন নিত্যানন্দ।

বৃন্দাবনে সম্ভবত আলাপ হয়েছিল মাধবেন্দ্রপুরীর সঙ্গে।যাঁর কৃষ্ণপ্রেম  ছিল কিংবদন্তী তুল্য।বৃন্দাবন দাস লিখেছেন... মাধবেন্দ্র পুরী কথা অকথ্য কথন/মেঘ দরশন মাত্র হন অচেতন।।এই মাধবেন্দ্রপুরীর কাছ থেকে মহাপ্রভুর কথা জানতে পেরেছিলেন সম্ভবত।এই কারণে নিত্যানন্দ নবদ্বীপে নন্দন আচার্যের বাড়িতে আসেন। বৃন্দাবন দাস লিখেছেন--

                মহাবধূত বেশ প্রকাণ্ড শরীর।
                নিরবধি ভক্তিরসে দেখি মহা ধীর।।
                অহর্নিশ বদনে বোলয়ে কৃষ্ণনাম।
                ত্রিভুবনে অদ্বিতীয় চৈতন্যের ধাম।
                নিজানন্দে ক্ষণে ক্ষণে করয়ে হুঙ্কার।
                মহামত্ত যেন  বলরাম অবতার।।

নিত্যানন্দ ও মহাপ্রভুর সাক্ষাৎ একটি ঐতিহাসিক ঘটনা।মহাপ্রভু ভাগবতের একটি শ্লোক পাঠ করে নিত্যানন্দের হৃদয় জয় করেনিয়েছিলেন।নিত্যানন্দে্র হৃদয়ে জাগ্রত হয়েছিল  অন্তহীন কৃষ্ণপ্রেম।মূর্ছিত নিত্যানন্দকে মহাপ্রভু কোলে করে প্রেমালিঙ্গন দিয়েছিলেন।শচীমাতাও নিত্যানন্দকে দেখে  পুরাতন পুত্রশোক ভুলেছিলেন।তিনি যেন বিশ্বরূপ হয়ে ধরা দিয়েছিলেন শচীমাতার কাছে।নবদ্বীপ পর্বে নিত্যানন্দ যেন ক্রমশ গৌরের দ্বিতীয় তনু হয়ে উঠেছিলেন।নাম সংকীর্তনে অংশগ্রহণকরা, কাজীর অন্যায় আদেশের  বিরোধিতাকরা,জনগণকে স্বৈরাচারী শাসকের বিপক্ষে এক কাট্টাকরা, জগাই মাধাই'র হাতে চরম লাঞ্ছিত হলেও প্রেমালিঙ্গনে কৃষ্ণপ্রেমে মাতোয়ারা করে তোলেন  এই নিত্যানন্দ।মহাপ্রভুর সন্ন্যাস গ্রহণে অভিভাবকের মতো প্রতিটি কাজ সম্পন্ন করে  তাঁকে নীলাচলে নিয়ে যাওয়া ,দাক্ষিণাত্য ভ্রমণে সাহায্যকরা ইত্যাদি ক্ষেত্রে তাঁর সদর্থক ভূমিকা লক্ষ করা যায়।


নিত্যানন্দ মহাপ্রভুর সঙ্গে নীলাচলে থাকতে চেয়েছিলেন।কিন্তু  মহাপ্রভু বুঝেছিলেন নীলাচলে নিত্যানন্দকে অনেকেই মেনে নিতে পারবে না।তাছাড়া তিনি অদ্বৈত আচার্যসহ নিত্যানন্দকে গৌড়দেশে বৈষ্ণবধর্ম প্রচার করার আদেশ দিয়েছিলেন

                 নিত্যানন্দে আজ্ঞা দিল যাও গৌড়দেশে।
                 অনর্গল প্রেমভক্তি করহ প্রকাশে।।

এর পর থেকেই নিত্যানন্দের জীবনে  আবার পরিবর্তন আসে।নিত্যানন্দের সঙ্গী হলেন রামদাস,গদাধর দাস,পরমেশ্বর দাস প্রমুখ বৈষ্ণবপরিকরবৃন্দ।তিনি আগেই সন্ন্যাসীর দণ্ডকমণ্ডলু ভেঙেছিলেন।এবার কৌপীনবস্ত্র ত্যাগ করলেন।দিব্য পট্টবাসে সজ্জিত হলেন। চৈতন্যভাগবতে রয়েছে--"কাষায় কৌপীন ছাড়ি দিব্য পট্টবাস/ধরেন চন্দনমালা সদাই বিলাস"।তিনি পরিচিত হয়ে উঠলেন কৃষ্ণের অগ্রজ বলরাম হিসাবে।তাঁর প্রধান প্রধান সহচরেরা হয়ে উঠলেন ব্রজের গোপবালক গোপাল।তাঁরাও অদ্ভুত বেশে সজ্জিত হয়ে হয়ে ভাগবতেরযুগকে যেন তাঁদের জীবনে মননে উজ্জীবিত করে তুললেন। বাংলা হয়ে উঠলো বৃন্দাবন।ভাগীরথী হলো যমুনা। বৃন্দাবনদাস লিখেছেন--
-
              কারো কোন কর্ম নাই সংকীর্তন বিনে।
              সভার গোপাল ভাব বাড়ে ক্ষণে ক্ষণে।।
              বেত্র বংশী শিঙ্গা ছাঁদডুরি গুঞ্জাহার।
              তাড়খাড়ু হাতে পায়ে নূপুর সভার।।

নিত্যানন্দ এবার বিয়ে করলেন কালনার গৌরীদাস পণ্ডিতের ভ্রাতা সূর্যদাস সরখেলের দুই কন্যা বসুধা ও জাহ্নবাকে।শুরু হলো এক নতুন জীবন।সপ্তগ্রাম অঞ্চলের ধনী বণিকরা তাঁর শিষ্য হলেন।বৈষ্ণবধর্ম এবার পায়ের তলায় মাটি পেল। নিত্যানদ তাঁর পরিকর নিয়ে মহাপ্রভুর নাম ও প্রেমধর্ম প্রচার করতে শুরু করলেন গাঙ্গেয় বাংলায়। বাংলায় বৈষ্ণবধর্মের মহাপ্লাবন বইতে শুরু করলো।

 এদিকে নিত্যানন্দের এই জীবন-যাপন বিশেষকরে  সন্ন্যাসী থেকে ধনী গৃহস্থ রূপ ও  বিচিত্র আচরণ অনেকের কাছে অসহ্য হয়ে উঠলো।তারা বিরূপ সমালোচনা শুরু করলেন।অনেকেই আবার  মহাপ্রভুকে মানলেও নিত্যানন্দের কঠোর সমালোচনা করলেন।কৃষ্ণদাস কবিরাজের ভাই শ্যামদাস মহাপ্রভুকে মানলেও নিত্যানন্দের ঘোর বিরোধী ছিলেন।এই কারণে কৃষ্ণদাসের সঙ্গে শ্যামদাসের বনিবনাও হয়নি।বৃন্দাবনদাস নিত্যানন্দ বিরোধীদের একহাত নিয়েছিলেন।বৈষ্ণব সুলভ বিনয় পরিত্যাগ করে  নিত্যানন্দ বিরোধীদের মাথায়  লাথি পর্যন্ত মারতে চেয়েছিলেন।

 আসলে নিত্যানন্দের জীবন বড় রহস্যময়।মহাপ্রভুর প্রয়াণের অন্তত আট দশ বছর  পর তিনি প্রয়াত হয়েছিলেন।অথচ তাঁর শেষ জীবন সম্পর্কে কোন তথ্য জানাই যায় না।মহাপ্রভুর শেষ বারো বছরের দিব্যোন্মাদ পর্বটিও সুচারু ভাবে চিত্রিত করেছেন কৃষ্ণদাস কবিরাজ চৈতন্যচরিতামৃত কাব্যে। কিন্তু নিত্যানন্দের ক্ষেত্রে তিনি নীরব।নিত্যানন্দের শেষ জীবনের কোন তথ্যই জানা যায় না।


 আগেই বলেছি--নিত্যানন্দের চরিত্রের অন্যতম  বৈশিষ্ট্য ছিল শিশুর মতো সারল্য ।কখনো তিনি বাহ্যজ্ঞান লুপ্ত হয়ে নগ্ন হয়ে যেতেন।কখনো তিনি ঝাঁপিয়ে পড়তেন উদ্দাম গঙ্গাবক্ষে।কখনো শিশুর মতো মালিনীর স্তন পান করেছেন।কখনো তিনি মহাপ্রভুর দণ্ড ভেঙে দিয়েছেন।কখনো রাজকীয় বেশ পরিধান করে নামসঙ্কীর্তনে মত্ত হয়েছেন।কখনো সামান্য ত্রুটির জন্য কাউকে গালিগালাজ করেছেন। তবে পাগলের মতো ভালোবেসেছেন মহাপ্রভুকে।এমনি এক বিচিত্র স্বভাবের মহা সাধক ছিলেন নিত্যানন্দ।সাধারণ লোকের পক্ষে তাঁকে বুঝতে না পারাটাই স্বাভাবিক।তিনি যেন সমস্ত নিয়মের ঊর্ধে উঠে গিয়েছিলেন। নিত্যানন্দভক্তরা বলেন তিনি বেদ-বিধির অতীত।বড়ো গূঢ় নিত্যানন্দ।এই নিত্যানন্দকে বুঝেছিলেন সমকালে হাতেগোনা কয়েকজন ব্যাক্তি।যাঁর মধ্যে মহাপ্রভু ছিলেন অন্যতম।এখনো কি তাঁকে আমরা বুঝতে পেরেছি বা বুঝবার চেষ্টা করি?


PROTNO-SAMRAT

https://thekoulal.wordpress.com কৌলাল ওয়েবসাইটেও পড়তে পারেন।আর দেখতে পারেন মনের মতো ছবি।                                              ...