কৃষ্ণকলি
স্বপনকুমার ঠাকুর
কালো তার গায়ের রঙ।কোঁকরানো চুল।ঘর বলতে ছিটেবেড়ার কুঁড়েঘর। লালমাটি দিয়ে নিকোনো চুকোনো।তারমধ্যে খড়ি দিয়ে ফুলকারি নক্সা। ভক্ত সেই মনসা ভাদুর আর দিদিঠাকরুনের।গান -বাজনা বিলাসী।উৎসবে সাজে।কুঁচিয়ে পরে শাড়ি।কপালে লাল রঙের টিপ।দল বেঁধে মেলায় গিয়ে সস্তার আংটি কেনে। সোনালি হার পরে।কালো চোখে কাজল টেনে ভাঁজো নাচতে আসে।গোপনে আসনাই করে ।কবি হলে বলতুম কৃষ্ণকলি।আসলে গ্রাম- গঞ্জের খেটে খাওয়া এক্কেবারে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীদের বউ-ঝি।
স্বামীর মতো তারাও কাজ-কর্ম করে খায়।ধান কাটে।ধান ঝাড়ে।পালা দেয়।কিন্তু সেতো চাষের সিজিনে ।আবার স্বামীর সঙ্গে এক আদঢোক গিলে নিয়ে দেদার ফুর্তি করে।তবে তাদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রাটা ভিন্ন ধরনের।যারা তাদের জীবনকে প্রত্যক্ষ ভাবে দেখেছেন তারা ছাড়া বুঝবেন না। স্বামীরা পরের খেতে কাজ করতে যায় সেই ভোরবেলায়।কেউ লাঙ্গল চষে।ধান রোয়।কেউ বা মেঠো খড়ো ঘর ছাওনার কাজে তলপেটে খাটে।আর তাদের গিন্নিরা একটু বেলা হলে বড় পাতকাটা নিয়ে বেড়িয়ে পড়ে মাঠে ঘাটে।।কোথাও তালগাছের শুকনো খোঙা কাটে ।বাবলার ডাল ভাঙে। খড়খড়িয়ে গাছে উঠে বটের শুকনো নামাল কাটে।জ্বালানি সংগ্রহ করে।এ কাজ তারা যৌথভাবেও করে।তারপর ছায়াবহুল বটতলায় বসে ভাগপর্ব। মাথায় শকনো বোঝারড্যাং চাপিয়ে বাড়ি মুখো।তখন সুজ্জিদেব মাঝ গগনে।
চুলোতো জ্বলবে কিন্তু খাবার? গেরস্থবাড়ি থেকে দুসের চাল পেয়েছে বরের মজুরি বাবদ।আনাজ বলতে এর ওর জমি থেকে শাকপাতা ছিঁড়ে পেট কোঁচরে ভরা।এবার কিন্তু একটু আমিষ দরকার।নেমে পড়ে পুকুরে।একঠা মাঠির ঠিলি বসিয়ে দেয় জলে।এবার নিজে গা ডুবিয়ে দু হাত দিয়ে পুকুরের ভিতরে পাঁক ঘাঁটকায়।গুগুলি চ্যাং ছিঙুরির বাচ্ছা কেঁয়ে পুঁটি ধরে ঠিলিতে ভরে।ঘাটের পাশে জোয়ান ছেলে শিশ দিতে দিতে মোষের গা ধোয়ায়।বাউরিদের বউটার প্রায় অনাবৃত একটুকস যৌবন দেখে হাঁ করে চেয়ে থাকে।বৌটা গাল পাড়ে শুনিয়ে শুনিয়ে।তারপর একসময় একটা দারুন কটাক্ষ হেনে মিলিয়ে যায় দুপুরের ঘূর্ণি বাওরের মতো।
এবার দোকান করার পালা।আদবয়সী দোকানদার।যত রসিকতা মেয়েদের সঙ্গে । পাঁচ টাকার বাজেট। দড়িবাঁধা তেলের শিশিতে তেল।খুঁটে বাঁধা জিরে নঙ্কামরিচ পাঁচমিশেলিঝাল আর একটা সস্তার ধূপকাঠি।আরও দেখতাম বিড়ি ১০ পয়সার মতিহারি তামাকপাতা।বাড়িতে গিয়ে রান্না বলতে মাঠ থেকে ধরে আনা বেহুলা ক্যাংরাকে গরমবালিতে ভেজে শিলে আচ্ছা করে বেঁটে লঙ্কা আর নুন মাখান জবরদস্ত পদ।কিম্বা গুগুলিসানা কিম্বা কাঁচা পিয়াজ আর অপর্যাপ্ত ঝাল মেশানো চ্যাংমাছ পোড়ার অমৃতময় ব্যঞ্জন।তাতেই আন ভাত আন ভাত অবস্থা।খেতে নিতে নিতে বেলা যেত গড়িয়ে।
কৃষ্ণকলিদের নিজস্ব একটা সংগীতচর্চার আসর ছিল।তার নাম মাঠালে গান।সে গানে আদিরসের ভিয়েন ছিল।ছিল নারীর একান্ত নিজের দুঃখ বেদনা চাওয়া পাওয়ার জগত যার মধ্যে শরীরের চাওয়া পাওয়া।এর নাম মাঠালে গান।ছোট ছোট চুটকির মতো রসালো। সবটা শোনা যেতো না ।কেননা পুরুষ দেখলেই স্টপ।শাকতুলতে তুলতে কিম্বা খেঞো কাটতে কাটতে গুনগুনিয়ে এই মাঠালে গান গাইত।বেশ কিছু সংগ্রহ করেছিলাম একসময়। যেমন...............
মারিস নারে খালভরা /মাছকোথা পাবো
জমিতে বইছে মাঠান/বাপের বাড়ি যাবো।
ইদানিং একশোদিনের কাজ, সরকারি সুযোগ সুবিধা নিঃসন্দেহে তাদের জীবনযাত্রাকে অনেকটা পরিবর্তনের আস্বাদ যুগিয়েছে।কিন্তু আজও গ্রামে গ্রামে বাগদি বাউরি হাড়ি মুচিদের জীবনযাত্রার মান খুব একটার পরিবর্তন হয়নি। আমার নিজের গ্রামে বাউরি হাড়ি মুচি বাগদি মিলিয়ে অন্তত চারশ ঘর পরিবার রয়েছে।সরকারি চাকরি পেয়েছেন মাত্র একজন কি দুজন।সিডিউলকাস্টের সুযোগকে কাজে লাগিয়েছেন অন্য এক গোষ্ঠী। খুব সত্য কথা তারা কিন্তু এদের তুলনায় বড়োলোক সংরক্ষণের আগে থেকেই।সুতরাং তাদের ভদ্দরলোক হতে বেশীদিন সময় লাগেনি।বাকিরা পড়ে আছেন সেই ঘোর তিমিরে।
কবে তাদের জীবনযাত্রার পরিবর্তন হবে??
No comments:
Post a Comment