কৃষ্ণনগরের রাজাদের আদি রাজধানীর সুলুক-সন্ধান
কৃষ্ণনগরের রাজাদের আদি রাজধানী মাটিয়ারি
উদয়ন মজুমদার
১৭৮৭ সালে ব্রিটিশ ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানির রাজত্বকালে আত্মপ্রকাশিত নদীয়া জেলার (বর্তমানে সংশোধিত বানানবিধি অনুসারে ‘নদিয়া’) ইতিহাস যথেষ্ট প্রাচীন ও গৌরবময়। ইতিহাসের অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রেক্ষাপটের সাক্ষী এই নদিয়া জেলা। বাংলাদেশ সীমান্ত সংলগ্ন নদিয়া জেলার কৃষ্ণগঞ্জ থানার অন্তর্গত মাটিয়ারী, নদিয়ার অন্যতম প্রাচীন ইতিহাস সমৃদ্ধ এক গ্রাম।
মাটিয়ারী গ্রামের নামকরণ সম্পর্কে অনেক কথা প্রচলিত থাকলেও, গ্রামটি উঁচু মাটির ঢিপি বা স্তুপের উপর দাঁড়িয়ে আছে বলেই এরূপ নামকরণ বলেই বেশিরভাগজন মনে করেন। গ্রামটির উত্তর-পূর্ব দিক জুড়ে রয়েছে বাংলাদেশ। কাঁটাতারের ওপিঠে রয়েছে চুয়াডাঙ্গা জেলার রাজাপুর, ধোপাখালি, জীবননগর, গয়েশপুর, গোয়ালপাড়া গ্রাম। গ্রামের উত্তর-পশিম দিক জুড়ে রয়েছে হাতিয়ার বিল, কাঠুয়া বিল, নতুন বিল ও চারাতলার বিল। গ্রামের কাছ দিয়েই বয়ে গেছে মাথাভাঙ্গা উপনদী, যার পশ্চিম শাখাটি চূর্ণী ও পূর্ব শাখাটি ইছামতী নামে দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত হয়েছে।
১৬০৬ খ্রিস্টাব্দে নদিয়ার এই মাটিয়ারী গ্রামেই জমিদার ভবানন্দ মজুমদার প্রথম তার রাজধানী স্থাপন করেন। নদিয়াধিপতি মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদারের পূর্বপুরুষ ভবানন্দ মজুমদারের সময়কাল থেকেই মাটিয়ারী গ্রামের শ্রীবৄদ্ধি ঘটে।
রামচন্দ্র সমাদ্দারের প্রথম পুত্র ছিলেন দুর্গাদাস। সাহসী, বুদ্ধিমান, চতুর, কূটকুশলী দুর্গাদাস মোঘলসম্রাট জাহাঙ্গিরের আমলে (১৬০৫ থেকে ১৬২৭ খ্রিস্টাব্দ ) সেনাপতি মানসিংহকে যশোররাজ প্রতাপাদিত্য দমনে সাহায্য করেছিলেন। কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির দেওয়ান কার্তিকেওচন্দ্র রায়ের লেখা কৃষ্ণনগর রাজবংশের ইতিহাস ‘ক্ষিতীশ বংশাবলী চরিত’ গ্রন্থে এর সমর্থন পাওয়া যায়। এরই ফলশ্রুতিতে সম্রাট জাহাঙ্গির ১৬০৬ খ্রিস্টাব্দে এক ফরমান জারি করে দুর্গাদাসকে নদিয়া, মহতপুর, লেপা, সুলতানপুর, কাশিমপুর, মা্রূপদহ বয়েশা, মসুন্ডা ইত্যাদি ১৪টি পরগনার জমিদারি প্রদান করেন।
জমিদার হবার পর দুর্গাদাস ‘ভবানন্দ মজুমদার’ নামে পরিচিত হয়ে ওঠেন। এইসময় জমিদারি দেখাশোনা করার জন্যে ভবানন্দ বর্তমান নদিয়া জেলার কৃষ্ণগঞ্জ থানার মাটিয়ারীতেই তাঁর প্রথম রাজধানী স্থাপন করেন। একই সাথে বাংলাদেশের মেহেরপুর জেলার অন্তর্গত বাগোয়ানেও আর একটি রাজপ্রাসাদ স্থাপন করেছিলেন। পরবর্তীকালে এই বংশের অষ্টমপুরুষ মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র ১৭২৮ খ্রিস্টাব্দে রাজধানী কৃষ্ণনগরে স্থানান্তরিত করেন।
ভবানন্দ মজুমদারের সময়ে মাটিয়ারী সম্পন্ন গ্রাম হিসেবে বিবেচিত হতো। তখন সম্পন্ন গ্রাম বলতে ধনী এবং শিক্ষিত লোকের বসবাস, পর্যাপ্ত জলাশয় এবং চাষযোগ্য জমি সমৃদ্ধ গ্রাম। সে অর্থে মাটিয়ারীতে তখন কোনকিছুরই অভাব ছিল না। একাধিক সম্পন্ন হিন্দু-মুসলমান পরিবারের বাস, নদিয়ার বিখ্যাত সংস্কৃত টোল, পাঠশালা, গান-বাজনা ও সংস্কৃতি চর্চার পুরদস্তুর চল ছিল তৎকালীন মাটিয়ারীতে। সংস্কৃত চর্চার গুরুত্বপূর্ণ পীঠস্থান হিসেবে মাটিয়ারীকে দ্বিতীয় নবদ্বীপ বলা হতো। মাটিয়ারীতেই বাস করতেন যদুভট্ট, জহ্নু মহাপাত্র, নারায়ণ মল্লিকের মত গুণীজন।
ভবানন্দের সময়কালে মাটিয়ারী গ্রাম ছিল হিন্দু-মুসলমান সম্প্রদায়ের সহাবস্থানের জনপদ। সেই কারণেই মাটিয়ারীতে একাধারে শিবমন্দির ‘রুদ্রেশ্বর’ ও পীর মালেক উল গাউস-এর দরগা বা ‘বাবা বুড়ো সাহেবের দরগা’-দেখা যায়। যতদূর জানা যায়, মালেক উল গাউস বা ‘বুড়ো পীর বাবা’ খ্রিস্টীয় ষোড়শ শতকে পারস্যের ইস্পাহান শহরের এক ধনী পরিবারে জন্মগ্রহন করেন, পরে আত্মানুসন্ধানের টানে বাড়ি ছাড়েন। ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রদেশ ঘুরে বর্তমান পশিমবঙ্গের মাটিয়ারীতে পদার্পণ করেন। রাজা ভবানন্দের বিশেষ অনুরোধে বর্তমান মাটিয়ারীর দরগা সন্নিহিত অঞ্চলে বসবাস শুরু করেন এবং সেখানেই দেহ রাখেন। তাঁর সমানভূমিই বর্তমান বাবা বুড়োসাহেবের দরগা। তাঁর জীবদ্দশায় রাজা ভবানন্দ মজুমদার তাঁকে ‘হজরত শাহ মুলুকে উল গাউস’ অর্থাৎ ‘ফকিরের বাদশাহ’ উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন। বুড়োসাহেবের আবির্ভাব ও তিরোধান দিবস ৭ই আষাঢ় অম্বুবাচী তিথিতে।এই দিন আজও মেলা অনুষ্ঠিত হয় দরগাতে।
বর্তমান মাটিয়ারী গ্রাম ভবানন্দ মজুমদারের আমলের অভিন্ন মাটিয়ারী গ্রামের তুলনায় অনেক সঙ্কুচিত। রাজধানী স্থানান্তর ও পরবর্তী বিভিন্ন প্রেক্ষাপটকে সামনে রেখে বর্তমান সময়ের আশপাশের অনেক গ্রাম তৎকালীন মাটিয়ারী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। সুপ্রাচীন হাইস্কুল (মাটিয়ারী বানপুর উচ্চ বিদ্যালয়), স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে রেলওয়ে স্টেশনসহ (বানপুর রেলওয়ে স্টেশন) সকল রকম আধুনিক সুযোগসুবিধা সমন্বিত একটি গ্রাম, মাটিয়ারী আজ অনেক উন্নতি করেছে বা করছে। অনেক কৃতি সন্তানের জন্মভূমি মাটিয়ারী ।প্রচারের আলোয় তেমনভাবে মুখ তুলে না তাকালেও সে স্বমহিমায় বিরাজমান আছে এবং থাকবে।

কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃমাটিয়ারী
বানপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষক ও স্বনামধন্য কবি শ্রীতাপসকুমার মিত্র ও তাঁর সম্পাদিত ‘আকাশের বর্ণমালা’ (আঞ্চলিক ইতিহাস বিষয়ক সংখ্যা),
তমোশ্রী মিত্র বাঙ্গালীর ইতিহাস-নীহাররঞ্জন রায়, নদীয়া কাহিনি-কুমুদনাথ
মল্লিক, ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে নদিয়া-নিতাই ঘোষ, কৃষি সাহিত্য-স্বপন ভৌমিক।
ভালো লিখেছো উদয়ন. প্রথম লেখা হিসেবে বেশ ভালো. চালিয়ে যাও.
ReplyDeleteKhub valo udyan keep it up
ReplyDeletevery nice article...
ReplyDelete