Sunday, December 11, 2016

MATH-PANCHALIR KOTHOKOTAY DHANYO MONGOL






নবান্ন আলপনা  ছবি --সুমন মন্ডল


 ভেতো বাঙালির কাছে ধান শুধু  আহার্যবস্তুই নয়;অর্থনীতি থেকে শুরু করে লোক উৎসব  -কৃষ্টি তথা লোকসংস্কৃতির বারো আনাই ধান কেন্দ্রিক।ফলনে পেছিয়ে পড়লে কি হবে  আজও  কুলীন সেই আমন ধান।আষাঢ় থেকে
পৌষমাস--আমনধানচর্যার যেন মহাকাব্যিক বিস্তৃতি। শুরু হয়েছে সেই ধান কাটার মরশুম।তাকে নিয়েই বর্ণাঢ্য নক্সি কাঁথা-- মাঠ-পাঁচালীর কথকতায় ধান্যমঙ্গল.........







অঘ্রানের মাঝামাঝি।মাঠে মাঠে বেলা কাটে সকাল হতে সন্ধে।ধান কাটার মরশুম।মুনিশে মুনিশে  মাঠ ছয়লাপ।নাস্তাপানি খাওয়া দাওয়া সবই মাঠে -ঘাটে।মুর্শিদাবাদের দূর দূরান্তের গরিব-গুর্বো লোকজন। জন -মজুর খাটতে এসেছে বর্ধমান-বীরভূম-নদিয়ার গাঁ-গঞ্জে।এখানকার লোকেরা বলে বিদেশী মুনিশ। পরিযায়ী পাখির মতো  দুদ্দার ভিড় করে  বছরে  দুবার। ধান লাগানো আর  এই  ধান কাটায়। রুইতে  যেমন সরেস  তেমনি পাই মানে লাইন খাড়া করে দ্রুত গতিতে ধান কাটতেও  ওস্তাদ।কথা বলে সুরেলা গলায়।তবে ধান এঁটুতে ( আঁঠি বাঁধতে) আবার ততটাই অষ্টরম্ভা! ঢিপ দেওয়া,পালা বাঁধা-- বিঁড়ে সাজানোয় এ অঞ্চলের মুনিশরা এক একজন সহজ শিল্পী।এক পর (প্রহর) রাত থাকতে মাঠ উঠেছে জেগে।খাটো দিনের বেলা।দুপুরের আজান শুনেই কর্মবিরতি। বেলা ঢলতেই দিগন্তে কুয়াশার সঙ্গে আঁধার নামে গুটি গুটি পায়ে ।জনহীন প্রান্তরে পড়ে থাকে মাঠের সোনালি শস্য --ধান!


গ্রাম-বাঙলার মানুষের কাছে  ধান শুধু আহার্য বস্তু নয়;সাক্ষাৎ লক্ষ্মী ঠাকরুন।জুতো পায়ে বা আকাছা হয়ে ধানে হাত-পা ঠেকানো একেবারেই  বারণ।পৌষ মাসে রাত-বিরেতে টাকা-পয়সা ধার দেওয়া বা নেওয়া সর্বৈব নিষিদ্ধ। কিম্বা জোরে শব্দ করলে গেরস্থরা রেগে টঙ। কারণ লক্ষ্মী বড়ো পয়মন্ত শান্ত দেবী।বেশী গোলমাল হলেই তিনি টুকুস করে  কেটে পড়েন।আর সেই স্থান দখল করবেন রুক্ষ কেশী অলক্ষ্মী! তখন বুঝবে খুড়ি বেলা হলে!তাছাড়া ধান -চালের সঙ্গে বঙ্গবাসীর সম্পর্ক কী আজকের?সিন্ধুসভ্যতার সমকালীন হলো আমাদের বর্ধমানের পান্ডুরাজার ঢিবি।প্রত্ন-উৎখননে সর্বনিম্ন স্তর থেকে  বেরিয়ে এসেছে ধানচাষের প্রত্ন নিদর্শন।তারপর যতদিন গেছে ধানের সঙ্গে বাঙালীর মন প্রাণ মান গেছে জড়িয়ে।ধান শুধু বাঙালীকে ধনবানই করেনি; দিয়েছে সম্মান ।চাষীর কাছে ধানী জমি জোয়ান ব্যাটার সমান।আবার অর্থ থেকে পরমার্থের প্রতীক ধান।মানুষের বিয়ে থা মাঙ্গলিক কর্মে দান ধ্যানের  সঙ্গে দুব্ব্যো ঘাস সহ ধান হয়ে উঠেছে আশীর্বাদের প্রধান উপকরণ।বাংলাদেশের বগুড়া জেলার মহাস্থান থেকে প্রাপ্ত মৌর্য আমলের এক শিলালিপি।এতে খোদিত রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে গড়ে ওঠা ধান্যভান্ডারের কথা ।

মুঠ পুজো ছবি সম্পর্ক মণ্ডল



লক্ষণ সেনের আনুলিয়া,তর্পণদিঘি,গোবিন্দপুর,শক্তিপুর তাম্রশাসনগুলির মঙ্গলাচারণ শ্লোকে গাঁথা ধান্যবন্দনার কথিকা।উদাহরণ বাড়িয়ে লাভ নেই।বোঝা যায় প্রাচীনকাল থেকেই রাষ্ট্রীয় অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি ছিল ধান।আজও তার খুব একটা পরিবর্তন হয়নি।তাই ধানীজমি নিয়ে কেউ ছিনিমিনি খেললে তার পরিণাম  যে ভয়ংকর -- নন্দীগ্রাম কান্ড তার জীবন্ত উদাহরণ।




বোরো ধান  বাজার মাত করলে  কি হবে আমনের কাছে আমলই  পায় নি কোনদিন। ধান কেন্দ্রিক লোকসংস্কৃতি আর  যাবতীয় লোকউৎসব আমনকে কেন্দ্র করেই।রামাইপন্ডিতের শূণ্যপুরাণ নাকি চর্যাপদের সমসাময়িক রচনা।এতে হরেক রকম আমনধানের কথা আছে যেমনকনকচূড়,কাঙুদ,কলমা,কসুমশালী,খিরখম্বা,গোতমপলাল,ঝিঙাশাল,সীতাশালী,লাউশালী,মুক্তাহার,মৌকলস  গৃহিনীপাগল ইত্যাদি।এখন অবশ্যি সে সবের পাট নেই।আগে গোবিন্দভোগ ধানের মাঠে ভুর ভুর করে সুগন্ধ ছড়াতো হেমন্তের বাতাস।এখন সবই খরানির ধান।যেমন ফলন তেমনি অর্থকরী।তবে কুলীন সেই আমন ধানই।আষাঢ় মাসে মিগের বাত আর অম্বুবাচীর  উৎসবে টানা বর্ষণে জল লেগে যায় জমিতে।নবোদ্যমে আজও  হাসিম শেখ আর রামা কৈবর্তের দল অস্থি চর্মসার বলদ ও ভোঁতা হাল নিয়ে আচোট জমিতে নাঙল ঠ্যালে।মাটির তলা থেকে বেরিয়ে আসে ঘুমন্ত গেঁড়ি গুগলি শামুক।ভিড় করে সাদা বকের দল। চাষিরা আপন মনে দরাজ গলায় মাঠাল গানে ভরিয়ে দেয়  বর্ষণসিক্ত আষাঢ়ের মাঠ-ঘাট......

                               নাগর কোথায় রইল্যা রে...
                               জল লেগেছে তোমার বাকুড়িতে.........।। 



শাওন মাসের রিমিঝিমি বরিষণে ধান্যসুন্দরীরা গায়ে গতরে বেড়ে ওঠে।আসে তাদের নবযৌবন।ধান্যবতীরা  হয়ে ওঠে গর্ভবতী।ধীরে ধীরে বিয়েন ছাড়ে।থোড় আসে।আর জমে ওঠে দুধ।আশ্বিনসংক্রান্তি হলো ধানের পূর্ণ প্রসব কাল।তারপরই পেকে ওঠার সময়।ধানিজমি যেন কৃষিলক্ষ্মীর আদিগন্ত সবুজ শাড়ি।লেগেছে তাতে সোনার পরশ।ধানের বনে হিমেল হাওয়া আর সোনা রোদের মাখামাখি,মাতামাতি।পরম তৃপ্তিতে পেকে উঠছে আগুন রঙা ধান।আশ্বিন সংক্রান্তি। আজ যে ধান্যলক্ষ্মীর পূর্ণ প্রসবের দিন।ভোরে উঠবে চাষি।নেবে সেই শরের ডাককাঠি।যেন অমোঘ  এক যাদুদন্ড।আর এক গেলাস কানায় কানায় মা-গঙ্গা।শিশির ভেজা আলপথে,দুব্বো ঘাসে ঘাসে পা দিয়ে চাষি মাঠকে শোনাবে ধানের গর্ভ-বার্তাঃ' ধান ফুল......ধান ফুল............মাঠের সব ধান ফুল..।সে ডাক মাঠ থেকে মাঠে পড়বে ছড়িয়ে।এখনো যে ধান প্রসূত হয়নি,সে আসবে ধরিত্রীর গর্ভ ভেদ করে।এখনো যে ধান ফুলোই নি সে এবার হেসে উঠবে রাঙা আলোয়।জমির ঈশান কোণে গঙ্গাকে দিয়ে আসবে চাষি।নিয়ে আসবে মাঠের পানি।ডাকের জল খেয়ে মেঠো সরীসৃপরা চলে যাবে শীতঘুমে।মা লক্ষ্মী হেসে উঠবেন মাঠ আলো করে।




কার্তিক-সংক্রান্তিতে মুঠ আনা এক মজার অনুষ্ঠান।ভোরবেলায় চাষি চান  করে নতুন কাপড় চোপড় পরে কাস্তে নিয়ে মাঠে হাজির।জমির ঈশাণকোনে আড়াই আলুই ধান আড়াই প্যাঁচে কেটে ছালের কাপড় জড়িয়ে  মাথায় নিয়ে চুপটি করে  সোজা বাড়ি।লক্ষ্মীর আটনের পাশে কলা বউর মতো রেখে দিয়ে শুরু হয় পুজো আচ্চা।পূর্ববঙ্গে ছিল ভিন্ন রীতি।বাতা গাছের পাঁচটা ডগি আর  মাঙ্গলিক উপচার নিয়ে ধানি জমিতে গিয়ে বাতার ডগায় সিঁদূর মাখায়। পাঁচটা ধানের ছড়া  তাতে বেঁধে নিয়ে লক্ষ্মীর সঙ্গে পুজো  আরম্ভ হয়ে যায় ঘটা করে।ময়মনসিংহগীতিকার মলুয়া পালায় আছে   

                                                   
                                পাঞ্চগাছি বাতার ডুগুল হাতেতে লইয়া।
ধানের গাড়ি মাঠ থেকে ঘরমুখো
                                মাঠের মাঝে যায় বিনোদ বারোমাস্যা গাহিয়া।।





অঘ্রান মাস পড়তে না পড়তে মাঠের রঙ বদলাতে শুরু করে।আগুন রঙা ধান ক্রমশ পাকা সোনায় পরিণত। উদ্ধত ঋজু ধান এবার  সকল অহংকার লুপ্ত করে ফলভারে নত। শুরু হবে ধান  কাটা ।তার আগেই লঘু অর্থাৎ নতুন ধান্যে হবে নবান্ন তোমার ভবনে ভবনে...।নবানে এই নতুন চালের গুড়ো আর বহু পদাবলী সমন্বিত  অন্নভোগ কৃষিলক্ষ্মী ,গৃহদেবতা, দরিদ্র নারায়ণ, পাখ-পকুরি্‌,গৃহপালিত প্রাণী,আত্মীয় স্বজনকে খাইয়ে কর্তা  গিন্নি শেষে সেই প্রসাদ গ্রহণ করেন।নবান্ন বহু পুরাতন কৃষি উৎসব।বৃহদ্ধর্মপুরাণে নবান্নের কথা আছে--

-
                          মার্গশীর্ষে মহাভাগে নবান্নৈঃপূজয়েদ্ধরিম।
ছন্দবদ্ধ ধান্য-পাঁচালি ছবি লেখক
                         পায়সংশর্করা দুগ্ধং দদ্যাৎ কৃষ্ণায় ভক্তিতঃ।।





(উত্তরখন্ড,দশম অধ্যায়) অর্থাৎ অগ্রহায়ণ মাসে নবান্ন দ্বারা হরিপূজা করবে।তাঁকে ভক্তিপূর্বক দুধ ও চিনি এবং পায়স নিবেদন করবে।পরবর্তীকালে শ্রেণি ধর্ম নির্বিশেষে গ্রাম্যবাঙালির ফসল কাটার প্রাক উৎসবে পরিণত হয়। কৃষিজীবী মুসলমানদেরও বড়ো প্রিয় উৎসব এটি। গ্রাম্যবাঙালির যথার্থ সার্বজনীন লোকউৎসবের দৃষ্টান্ত হয়ে উঠেছে নবান্ন।অনেকেই আবার বলেন বৈদিক যুগে বিশেষ বিশেষ ঋতুতে  যজ্ঞ সম্পন্ন হতো ।অগ্রহায়ণ মাসে 'আগ্রায়ণ ইষ্টি' নামে এক ঋতুযজ্ঞ হতো। এই যজ্ঞে  সুনাশীর নামে এক কৃষি দেবতাকে বিশেষ ভোগ নিবেদন করতো।এটাই নাকি নবান্ন উৎসবের আদিম  রূপ।এরপরই আমন ধান কাটা শুরু হয়ে যেত ।পৌষ তোদের ডাক দিয়েছে আয়রে তোরা আয়..।.এখন অবশ্য পৌষের ডাকের অপেক্ষা আর কেউ করেনা ।নবানের আগেই মাঠ ফাঁকা।গোরুর গাড়ি বদলে ট্রাক্টর নামক যন্ত্র দানবের গর্জন।ছোটখাটো ডায়নোসরের মতো ধান কাটার মেসিন। উদ্ধত থাবায় ধান্যলক্ষ্মী।বেঁটে খাটো ধানগাছের অসহায় আত্মসমপর্পণ---সব মিলিয়ে মাঠ-পাঁচালিতে ভিন্ন সুরের দোলা।



অথচ কয়েক দশক আগেও পৌষ মাস মানে এক আলাদা অনুভূতি।লক্ষ্মীমাস বলে কথা।ধীরে সুস্থে ধান কাটা ।তারপর মাঠে মাঠে ধান সাজানোর সহজ ছন্দ।দেখলে দু চোখ  জুড়িয়ে যেত। মাঠতো নয়;যেন  সত্যেন দত্তের ছন্দময় পদ্য।রাতে মাঠ-পাহাড়ার জন্য কুঁড়ে তৈরি করা।সেও সেই ধান দিয়ে একটা গুহার মতো বানানো।হাতে পাঁচ ব্যাটারি টর্চ লাইটের জ্বলন্ত চোখ।আর চোর প্রতিহত করার সেই মান্ধাতা আমলের লাঠি।হৈ--হৈ-----! রাত পাহাড়ার হাঁক-ডাক! সে ডাক ক্রমশ অনেক কণ্ঠস্বরে মিলিত হয়ে পৌষের নিকষকালো রাত চিঁড়ে ছড়িয়ে পড়তো মাঠ থেকে মাঠে।গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে । ধানকাটা সারা হলে   গোরুর গাড়ি করে বাড়ি নিয়ে যাওয়ার পালা।মাঠে মাঠে  গো-গাড়ি চলাচল করার জন্য আল কেটে দিয়ে গোল পড়ে যেত।মানে গাড়ি চলাচলের  সাময়িক রাস্তা। দু দিকে ধানের পালা সাজিয়ে মাঝে চাপ-বাঁশ দিয়ে এঁটে গো-গাড়ি তখন মৃদুমন্দ ছন্দে বাড়িমুখো।চাষির হাতে পাঁচন আর মুখে গরমাগরম বচন।ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা ধানের শিষ কুড়োবার জন্য আসতো গাড়ির সঙ্গে ।ফিরতি পথে ধানের গাদায়  বসে থাকার  বাড়তি সুখ।ছেলেপুলের হাতে তখন কাঁচা পয়সা।গ্রামে গ্রামে রাতে বসতো  অস্থায়ী দোকান।পাঁউরুটি সস্তার কেক, লেড়ো, গুড়বাদাম, হাতে তৈরি বিস্কু্‌ট, চানাচুর আর কাঁচের মার্বেল।মাঠে মাঠে পড়ে থাকা ধানের শিষ কুড়িয়ে এনে বিক্রি করা তখন দারুন ফ্যাসন।মাঠ থেকে ধান উঠে গেলে আবার ছেলেপুলের দল টাকনা কোদাল নিয়ে মাঠে ইঁদুরের গর্ত খুঁজে বেড়াত। মেঠোইঁদুররের দল সেই গর্তগুলোয় প্রচুর ধান কেটে কেটে রেখে দিত। শেষ ধান কাটা বা বাড়ি নিয়ে যাওয়ার সময় একটা ভারি মজার প্রথা ছিল।সে কথাটাই বলি।






প্রশ্ন হলো --এই দাওন শব্দটির অর্থ কী? রাঢ়ের বিশিষ্ট গবেষক ড. অমলেন্দু মিত্র  মশাই অনুমান করেছেন যে সাঁওতালদের আগমনের পূর্বে নাকি সাঁওতালপরগণা অঞ্চলে দামন নামে এক পার্বত্য জনজাতি বাস করতেন।ফার্সি ভাষায় দামন মানে কিনারা।হয়তো জমির কিনারা থেকে কয়েক গুচ্ছ ধান উপড়িয়ে আনার জন্যই একে   দাওন বলা হতো।অনেকেই আবার মনে করেন গ্রিক শস্যদেবী ডিমেটরের সঙ্গে দাওনের শুধু ধ্বনিগত মিল নয়;প্রকৃতিগতও মিল রয়েছে।ডিমেটর শুধু শস্যকে পরিপক্ক করেন না তিনি শস্যের পাহাড়াদার।হোমারের ওডিসি কাব্যে শস্যদেবী ডিমেটরের স্বর্ণকেশের কথা আছে যা স্পষ্টত পাকা ফসলের প্রতীক। ইউরোপের বিভিন্ন দেশে শস্যকাটার পর শেষ আঁটিকে দাওনের মতোই পবিত্র ভাবে বাড়ি আনা হয়।বাংলা অভিধানগুলিতে দাওন না থাকলেও দাঁও শব্দটি আছে।উৎস হিসাবে বলা হইয়েছে হিন্দী শব্দ।মনে হয় অষ্ট্রিকগোষ্ঠীর ভাষা থেকে আগত।এক অর্থে দাওন মানে কৃষীলক্ষ্মীর সস্নেহ আশীর্বাদ।চাষের ফসল মানেই অনিশ্চয়তা।সবটাই ভাগ্যে ভোগা।তাই ফসল ঘরে তোলা  একধরনেরে দাঁও ছাড়া আর কি বলা যাবে?কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোয় সারারাত ধরে জুয়া অর্থাৎ পাশা খেলার চল ছিল।মূল উদ্দেশ্যই ছিল দাঁও মানে ভাগ্যলক্ষ্মীর কৃপা লাভ করা। সে যাইহোক--সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বদলে যাচ্ছে মাঠ-পাঁচালির কথকতা।তবু যখন ধানকাটা বিস্তীর্ণ ফাঁকা মাঠে এসে দাঁড়াই ,মনটা বড়ো হু হু করে ওঠে।ফিরে যাই শৈশবে।সেই শীতের ঠোঁট ফাটা রুক্ষ দুপুর।ধানগাড়ীর চলালচল।হঠাৎ করে বহুরূপীর আগমন।আমরা তখন মাঠ ভেঙে ছুটে চলেছি।হাতে কুড়ানো ধানশিষের গুচ্ছ।চোখে মুখে অজানা আনন্দের  উষ্ণ-উত্তেজনা ।





ঠিক যেন নিত্যকালের অপু দুর্গাদের মাঠ ভেঙে ছুটে চলা......।।






নবান্ন্ পদাবলী    ছবি সম্পর্ক মন্ডল
সৌজন্য সংবাদ পত্রিকায় প্রকাশিত

Sunday, October 16, 2016

LOKKHI OLOKKHI PUJO EK LOUKIK KRISHI UTSOB


     


              লক্ষ্মী অলক্ষ্মীর পুজো এক লৌকিক কৃষি উৎসব




সোনার থালার মতো পুর্ণিমার চাঁদ উঠেছে  পুব আকাশে।মাঠে মাঠে ছড়ানো মুঠো মুঠো চাঁদের হাসি।সোনামুখি সবুজ  ধানখেত।আজ যে কোজাগরী লক্ষ্মীপুজো।রাতভর জাগরণ।যে শুয়ে থাকে তার ভাগ্যতে পড়বে গেরো।  প্রহর জাগো রে...।সম্পদ সৌভাগ্য সমৃদ্ধির দেবী আসেন চুপি চুপি।যে ঘরে জ্বলবে আলো,থাকবে শান্তি--- সেখানেই পড়বে লক্ষ্মীর পদচিহ্ন।ঘর দুয়োর হেসে উঠবে। লক্ষ্মীর প্যাঁজ আর লতাপাতার আল্পনা পাবে প্রাণ।ছায়া ছায়া গাছপালার ফাঁক দিয়ে নিকোনো উঠোনে ঝরবে জোৎস্নার চন্দন।


 প্রদোষকালে ঘটে-পটে প্রতিমায় শুরু লক্ষ্মী  পুজন।কোথাও বা ব্যতিক্রমী কলাবউ পুজো। আটনের নীচে কলার পেটো দিয়ে বানানো ময়ূরপঙ্খী নাও। বাঙালীর বাণিজ্য বসতির বিলুপ্তপ্রায় স্মৃতি ।পাশে সাতটি বাকারি মানে গোলা।তাতে রাখা-- ধান-শষ্য- সোনা-দানা ফল-মাকড় ইত্যাদি।চূড় করা নৈবেদ্য।চিঁড়ে সিঁড়ি খই তিল মুড়ি আর নারকোলের সুবাসিত নাড়ু।আধপাকা নোয়ানো ধানশিশের গুচ্ছ।পিদিমের  নরম আলো।শংখ ঘন্টা কাঁসর ঝাঁজ করতালের আরতি নয়।ঢোলের  মিঠি বাদনে হবে পুজন।লক্ষ্মী বড়ো লক্ষ্মীমন্ত দেবী।ঝগড়াঝাঁটি অশান্তি চেল্লামিল্লি দেখলেই  ফুরুৎ ধাঁ। আর সেই স্থান দখল করবে ভয়ংকরী অলক্ষ্মী।অশান্তির ঝালাপালায় জীবন হবে জেরবার,ছারখার।সবশেষে হাহাকার।

অলক্ষ্মীর কথা না হয় পরেই বলবো।এখন লক্ষ রাখি ঐ লক্ষ্মীতে। সত্যি বলতে কি---শব্দটির মূলেও এই লক্ষ ।মানে ---উদ্দেশ্য অভিপ্রায়।লক্ষ্মীর উপাসনা শুধু অর্থ উপার্জনের জন্য নয়;পরমার্থের অন্বেষণ। ।ঋগবেদে লক্ষ্মী কোন দেবী নন,সৌন্দর্যের প্রতিশব্দ মাত্র। সুন্দরের বৈদিক দেবী শ্রী।পরবর্তীকালে লক্ষ্মীর সাথে এঁটে উঠতে না পেরে শ্রীদেবী এখন পর্দে কা পিছে। তবে হ্যাঁ আমাদের নামের নাকের ডগায়  উপসর্গের মত শ্রীর অবস্থান।শ্রীমান,শ্রীযুক্ত শ্রীমতির উপরেই তার  যত কেরামতি। যদিও অনেকেই এখন  শ্রীহীন  হতে ভালোবাসেন।



পৌরাণিক যুগে লক্ষ্মী ক্রমশ শক্তিশালী দেবী।মহাকাব্য পুরাণাদি থেকে জানা যায় তিনি সমুদ্র গর্ভজাতা অপ্সরী।সুরাসুর মিলে সমুদ্র মন্থন কালে সাগর সেচে তুলে আনা হয়।।চতুর্ভূজা বা দ্বিভূজাদেবীরএক হাতে পদ্ম থাকবেই।তাই তাঁর নাম কমলা পদ্মা ।আবার সাগর থেকে উত্থিত হয়ে তিনি বিষ্ণু বক্ষস্থিতা বলে বিষ্ণুপ্রিয়া। রাতচরা পেঁচা তাঁর বাহন ।প্রাচীন মুদ্রা শিলালেখে এবং মূর্তি পরিকল্পনায় লক্ষ্মী সেই খ্রিস্টপূর্ব যুগ থেকেই রয়েছেন।শক- পার্থীয় শুঙ্গ- কুষাণ-গুপ্ত যুগের সুবর্ণ মুদ্রায় দেবী লক্ষ্মী পদ্মাসনা,বরদা।আবার লক্ষ্মীর অন্যান্য প্রস্তর মূর্তির তুলনায় গজলক্ষ্মী মূর্তি সুপ্রাচীন কাল থেকেই পূজিত হয়ে আসছে।পদ্মাসনা লক্ষ্মীকে দু দিকে এক জোড়া করে দিকহস্তী কুম্ভোদক ঢেলে  অভিষিক্ত করছে।সাঁচী ভারহুতের স্তূপেও গজলক্ষ্মী খোদিত।শুধু হিন্দু ধর্মে নয়; বৌদ্ধ ও জৈনধর্মেও লক্ষ্মীর জনপ্রিয়তা তুঙ্গে।


তবে লক্ষ্মী শুধু পৌরাণিক  দেবী নন ,অনার্যদের আদি দেবী।আর্য সংস্কৃতিতে লক্ষ্মী যদি সম্পদ সৌন্দর্যের দেবী হন প্রাগার্য কালচারে খিদের অন্নই হলো লক্ষ্মী।তাই তিনি কৃষিলক্ষ্মী।মেয়েলি ব্রতের দেবী,ঘরের লক্ষ্মী,ধান্যলক্ষ্মী।ধান যার আছে সেই ধনবান।বহুব্রীহি মানেই ধনী।  রাঢ়-বাংলায় মাঠের ফসল কাটার সময় এলেই লক্ষ্মীর আরাধনা ।চৈতি পৌষালি আর ভাদুরে ফসল  উঠলেই চৈত্র ভাদ্র ও পৌষসংক্রান্তিতে লক্ষ্মী পুজো ঘরে ঘরে।এই তিনবার লক্ষ্মীকে নতুন করে পাততে হবে।আটনে আলপনা দিয়ে লক্ষ্মীর ঘরে ২১ কাঠা ধান দিতে হবে।ধানের মাথায় বসবে চেলির ঘোমটা পরা বেতের কাঠা।চার দিকে বসবে পেঁচা।সামদ্রিক কড়ি।লক্ষ্মীর চিরুনি তামার মুদ্রা আরো কত কি! সঙ্গে নৌকা।এ যেন বাঙালীর প্রত্ন মিউজিয়াম।বধূ পরম্পরায় পূজিত এক জীবন্ত ইতিহাসের সূতিকাগার।লক্ষ্মীর নৈবেদ্য বলতে ভাত ডাল শাক সব্জির সহজিয়া পদাবলী।আর থাকে মায়েদের রান্না করা পরমান্ন।এইতো পরম প্রসাদ।এটাই বাঙালীর চিরকালীন কামনাঃআমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে।শান্ত শিষ্ট বাঙালীর জাতীয় দেবী লক্ষ্মী ছাড়া আর  কে হতে পারেন?


কিন্তু মাঝে মাঝে যে লক্ষ্মীছাড়া হতে হয়। তখন নেমে আসে দুর্ভাগ্য ,বিভ্রাট সর্বনাশ। এইতো জীবন!আমাদের অনেকেরই কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের মতো হতভাগ্যের গান গাওয়ার শক্তি নেই।কন্ঠ উঁচিয়ে বলতেও পারি না" হাস্যমুখে অদৃষ্টেরে করবো মোরা পরিহাস"। সেই কারণেইতো অলক্ষ্মীর পুজো,ভয়ে ভক্তিতে। তবে এর উৎস বহু প্রাচীন।একসময় পূর্ববাংলার  ঘরে ঘরে আশ্বিনসংক্রান্তিতে মেতে উঠতো গাড়শিব্রতে।কেউ বলেন  গাড়শি নাকি ফারসি শব্দ।অন্যরা দাবী করেন গাড়শি আসলে গৃহস্থ শব্দের বিকৃত উচ্চারণ।শব্দ নিয়ে বিতর্ক থাকলেও অর্থে কিন্তু  সেই অলক্ষ্মী তাড়িয়ে লক্ষ্মী পুজো। ।ক্ষেত্রসমীক্ষায় দেখেছি---আশ্বিন সংক্রান্তির খুব ভোর বেলায় উঠে  ব্রতীরা বাসি কাপড়ে  মাঠ থেকে শব্জি নিয়ে আসেন।তারপর বাড়িতে পাট-ঝাঁট না দিয়ে আমানি মানে শব্জি কাটাকুটো করে  সিধে গঙ্গা বা পুকুরে ভুখ ভুখ করে ডুব। । বাড়ি এসে রান্না বান্নায় মনোনিবেশ।নানারকম তরিতরকারি থাকলেও তেঁতুল মেশানো একটা ডাল থাকবেই।আগের দিন রাতে নেমন্তন্ন করতে হবে  কাককে।রান্না হয়ে গেলে কলাপাতায় সব ধরনের খাবার আগে কাককে খাওয়াতে হবে।ভারি মজার এই ব্রতটি।সাঁজের বেলায় জ্বেলে দিতে হবে কলার পেটো দিয়ে বানানো চেরাগ।সেই চেরাগের আলোয় দূর হবে অলক্ষ্মী অমঙ্গল দারিদ্র।



 অনেকেই বলেন গাড়ুব্রত আসলে  দশমহাবিদ্যার অন্যতম ধূমাবতীর পুজো।এই বিদ্যাদেবী  নাকি সতীর চিতার উত্থিত ধূম থেকে নির্গত হয়েছিলেন।প্রচন্ড খিদেয় নিজের স্বামী মানে শিবকেই কড়মড়িয়েই খেয়েছিলেন।পরে শিবের কাছে তালাক পেয়ে চিরকালের  বিধবা।এনার হাতে থাকে দেবী শীতলার মতো ঝাঁটা আর পতাকায় আঁকা অমঙ্গলের বার্তাবহ কাকের চিত্র।গাড়ুব্রতে ধূমাবতীর প্রভাব থাকতেই পারে ।তবে অলক্ষ্মীর প্রসঙ্গকে অস্বীকার যায় না।অনেক স্থানে গাড়শি ব্রতের দিন কাক ডাকার আগে বাড়ির সকলে ঊঠে  গায়ে হলুদ মেখে নেন।মাটি দিয়ে তৈরি করে  একটা আস্ত শূকর মূর্তি।কুলো বাজিয়ে সেই শূকর বলি দিয়ে ফেলে দিয়ে আসেন তেমাথা রাস্তায়। কালীপুজোর রাতে অনেক স্থানে লক্ষ্মী পুজো হয়।তবে লক্ষ্মীপুজোর আগেই  অলক্ষ্মীর পুজো। সে এক দেখার জিনিষ।


 লক্ষ্মী-নারায়ণ-কুবের তিন পুতুল বানানো হয় পিটুলি মানে চাল-বাঁটা দিয়ে।প্রথমটিকে সিঁদূরের প্রলেপ দেওয়া হয়।এটি লক্ষ্মী।দ্বিতীয়টিকে নীল রঙের চূর্ণ দিয়ে নারায়ণ  আর কুবের পুতুলকে দেওয়া হয় অপরাজিতাপাতা বাঁটার প্রলেপ।পুতুলগুলি বসানো হয় কলার পেটোতে ।শুরু হয় লক্ষ্মীপুজোর আয়োজন।অবশ্যই তার আগে অলক্ষ্মী পুজো করে বিদেয় করতে হবে।'একটি গোবরের পুতুলকে কালো রঙে ভুত করে মেয়েদের ঝরে পরা চুলের নুড়ি গোবর আর মোমবাতি জ্বেলে বাঁহাত দিয়ে পুজো। এরপর কুলোর উলটো পিঠে চাপিয়ে কাঁসর বাজিয়ে অলক্ষ্মী বিসর্জন। তারপর লক্ষ্মীপুজোয় বসতে হবে।

    এই অলক্ষ্মী পুজোকেই অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর অনার্যদের পূজিত আদি শষ্যলক্ষ্মী বলেছেন তাঁর বহুল প্রচলিত বাংলার ব্রত গ্রন্থে ।তাঁর মতে এই সবুজ হলুদ লাল রঙের তিনটি পুতুল প্রাগার্য লক্ষ্মী পুজোর নিদর্শন। আসলে শষ্যের তিন প্রকার রূপ।সবুজ হলো শষ্যের প্রথম রূপ। তারপর সেই শষ্যের পাক রঙ ধরে। শেষে পরিপূর্ণ পক্ক।লাল রঙের  লক্ষ্মীপুতুল সেই ঝুনট পাকা শষ্যের প্রতীক।এই আদিম লক্ষ্মীপুজো শুধু বাংলায় নয়;বাংলার বাইরেও প্রচলিত ছিল।যেমন মেক্রিকোর পুরাণেও রয়েছে শষ্য রক্ষয়িত্রী তিন বর্ণের তিন দেবতার কথা।পরবর্তীকালে এই আদিম লক্ষ্মীপুজোই অলক্ষ্মী বলে পরিত্যক্ত হয়েছে।এই অলক্ষ্মী পুজোর সঙ্গে মিল আছে ঝাড়খন্ড বাংলা সীমান্তে ডোম সম্রদায় পূজিত এঁটু ঠাকুরের ।উচ্ছিষ্ট পরিত্যক্ত আবর্জনা বাসি পচা খাবার দাবার দিয়ে এই দেবতার পুজো করেন ডোমেরা।বর্ণহিন্দু উচ্চ সমাজে দুর্গাপুজোর সময় কোথাও কোথাও বিজয়াদশমীর সাঁজবেলায়  এমনি এক দেবীর পুজো হয়।নাম তার উচ্ছিষ্টা  চন্ডালিনী।নাথ সম্প্রদায়গত চক্রবর্তী বামুন চার দিনের বাসি ফুল বেলপাতা দিয়ে দেবী পুজো করেন ----ওঁ নমঃ উচ্ছিষ্ঠা চন্ডালিন্যৈঃ নমঃ মন্ত্রে।


অবনীন্দ্রনাথের মতে কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোর মধ্যে  অনেকখানি টিকে আছে সেই আদিম অনার্যলক্ষ্মীর  স্মৃতি।পুজোর উপকরণগুলি দেখলেই বোঝা যায়।কোজাগর মানে কে জাগে।এই মায়াবী পূর্ণিমার রাতে যারা জেগে থাকেন ,পাশা অর্থাৎ দ্যূতক্রীড়া করেন দেবী তাঁকে বর দান করেন।বোঝ ঠ্যালা! যে লক্ষ্মীকে নিয়ে এত বড়ো বড়ো  কথা সেখানেই জুয়া খেলা!!!!তবে কি ডাল মে কুচ কালা হ্যায়!  অনেকেরই সেই গল্পটা জানা আছে।জগৎ  শেঠের ধনী হবার গপ্পো।বিদ্যা বুদ্ধির খাতিরে দিল্লীতে ডাক পড়লো শেঠ মশাইএর।সম্রাট তার বুদ্ধি চাতুর্যের খুব প্রশংশা করে বললেন  কি চাই আপনার? মায়ের শেখানো বুলি শেঠ আওড়ে গেলেনঃ দিল্লীতে কোজাগরী রাতে কেউ যেন আলো না জ্বালে।সম্রাট বললেন  ঠিক আছে।এদিকে কোজাগরী রাতে সারা দিল্লী অন্ধকার হয়ে রইলো শুধু আলো জ্বলছে  শেঠের বাড়িতে।দেবী লক্ষ্মী  জগৎ ভ্রমণে বেরিয়ে দেখতে পেলেন দিল্লীতে সব অন্ধকার শুধুমাত্র জগৎএর বাড়িতেই আলো জ্বলছে।দেবী বললেন আমাকে একটু আশ্রয় দেবেন?শেঠের মা দেবীর ছলনা বুঝতে পেরে বললেন আপনি বসুন আমি যতক্ষণ না ফিরে আসছি ততক্ষণ থাকুন।।শেঠের মা  লক্ষ্মীকে পুত্রের কাছে  চিরস্থায়ী করার জন্য যমুনার জলে প্রাণ দিলেন।


এই কিংবদন্তীর একাধিক তাৎপর্য থাকতেই পারে।তবে সারারাত জেগে উৎসবের কথাটা বেশ ভালোই বোঝা যায়।আরো বোঝা যায় আদিম কৃষি উৎসব ক্রমশ বিদেয় হয়েছে।প্রবেশ করেছেন পৌরাণিক লক্ষ্মী।   কোজাগরী পূর্ণিমার মূল বৈশিষ্ট্য ছিল সারারাত ধরে রঙিন উৎসব ।এর সঙ্গে মিল রয়েছে মেক্রিকো পেরু দেশের শষ্য উৎসবের।শারদ পূর্ণিমায় সেখানকার আদিবাসীরা ভুট্টার ছড়াকে পুজো করে।নানা খাবার তৈরী করে শষ্যদেবীর কাছে নিবেদন করে।সঙ্গে থাকে একটি সিদ্ধ করা ব্যাঙ।শেষে থাকে কুমারী বলির ঘটনা।আর সারা রাত ধরে চলে মেয়েদের এলোচুলে নৃত্য।  আজও কোজাগরী পূর্ণিমার মত্ততার রাত্রিতে জোৎস্না প্লাবিত মাঠের দিকে তাকালে সেই বিলীয়মান  কৃষি উৎসবের কথাই মনে পড়ে।

 সৌজন্যঃ সংবাদ পত্রিকায় প্রকাশিত
 ছবি ঃ নেট ও নিজস্ব

Tuesday, October 11, 2016

PROTNO-PITH MONGALKOT
















                              প্রত্ন-পীঠ মঙ্গলকোট

                                           

প্রত্নতীর্থ মঙ্গলকোট।দেবভূমি মঙ্গলকোট।হিন্দু-বৌদ্ধ-জৈন-সুফি-ইসলাম-লোকায়ত  ধর্মের মিলনক্ষেত্র  উজানি মঙ্গলকোট।সেই সুদূর প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে শুরু করে  মৌর্য-শুঙ্গ-কুষাণ-গুপ্ত-পাল-সেনপর্ব থেকে মধ্যযুগ হয়ে একেবারে হাল আমলেও মঙ্গলকোট আছে  সেই মঙ্গলকোটেই।আষ্টে-পৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে ইতিকথার বাঁধন। জড়িয়ে আছে কিংবদন্তির রাজা বিক্রমাদিত্যের রাজ কাহিনি।তাঁর সঙ্গে অষ্টাদশ আউলিয়ার সংগ্রাম ও পরাজয়ের এক বেদনা-বিধুর আলেখ্য। ছড়িয়ে আছে চণ্ডীমঙ্গলকাব্যের ধনপতি শ্রীমন্ত সদাগর লহনা খুল্লনা আর মা মঙ্গলচন্ডীকে নিয়ে  ইতিউতি স্মৃতি গাথা। মৌন হয়ে আছে অজয় কুনুর নদির তীরে একদা মোঘল-পাঠানদের যুদ্ধ-কথা,মোঘলসম্রাট শাজাহানের সংগে সুফিসাধক হামিদ বাঙ্গালীর জ্ঞান-গর্ভ বাতচিত,সুলতান হোসেন শাহার বিলীয়মান কীর্তি...সবমিলিয়ে বাঙ্লার ইতিহাস তথা সংস্কৃতিতে মঙ্গলকোট এক জমজমাট অধ্যায়।


অথচ  সংবাদপত্রের পাতায় বা টিভির স্ক্রিনে মাঝে মাঝে ভেসে ওঠে  --- রাজনৈতিক হানাহানিতে মত্ত মঙ্গলকোটের ঘোর অমঙ্গলের সংবাদ।নিজেদের মধ্যে দলাদলি হানাহানি খুনোখুনির জঘ্ন্ন খবর। সেখানে মঙ্গলশঙ্খ নিনাদের পরিবর্তে গোলাগুলি ছোঁড়ার হাড়হিম সংবাদ। এদিকে মঙ্গলকোট শুধু বাংলা বা ভারতবর্ষ নয়,সমগ্র  বিশ্বের প্রত্নমানচিত্রে এক উজ্জ্বল নাম।সেই সিন্ধুসভ্যতা উত্তর তাম্রাশ্মীয় যুগ থেকে আজ পর্যন্ত নিরবচ্ছিন্ন জনবসতির অস্তিত্ব বর্তমান মঙ্গলকোটে...ছয় বর্গ কিমি প্রসারিত এমন প্রত্নক্ষেত্র  বিশ্বে বিরল দৃষ্টান্তের অধিকারী। এই সংবাদের খবর রাখে ক-জন!
গোটা গ্রামটিকেই বলা যেতে পারে প্রত্নডাঙার উপর বসানো।  গ্রামে  রাস্তা তৈরি করার সময় মূল ডাঙা বিচ্ছিন্ন হয়ে একাধিক ডাঙায় পরিণত।  সুতরাং মঙ্গলকোট মানেই প্রত্ন-রত্ন প্রসবিনী খনি।সামান্য মাটি খুঁড়লেই বেরিয়ে আসে  মাটির তৈরি প্রত্নসুন্দরীর মুখমন্ডল,মাটির পুতুল টেরাকোটা মূর্তি, ছাঁচে ঢালা তাম্রমুদ্রা, নানা ধরনের সিল ,সিলমোহর, পুঁতি, খেলনা আর বিভিন্ন যুগের ভাঙাচোরা তৈজসপত্রাদি। হাতবদল হয়ে দেদার পুরা সম্পদ হয়ে যাচ্ছে পাচার।কুনুর নদির গর্ভ থেকে মিলেছে একাধিক প্রস্তরমূর্তি যেমন কুষাণ পর্বের গণধরমূর্তি,পাল সেন আমলের একাধিক ত্রিবিক্রম বিষ্ণুবিগ্রহ,মহিষমর্দিনী দুর্গা ইত্যাদি।এগুলির অধিকাংশ  সংরক্ষিত আছে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় মিউজিয়ামে। প্রত্নডাঙাগুলির উপর যত্র-তত্র অপরিকল্পিত বসতি গড়ে উঠছে বা উঠছে।প্রশাসনের এ বিষয়ে  ভ্রুক্ষেপ নেই।নেই ইতিহাস আর ঐতিয্যকে বাঁচানোর জন্য সংগঠিত আন্দোলন।অথচ যথাযথ সরকারি পরিকল্পনা থাকলে শুধুমাত্র মঙ্গলকোটের ইতিহাস আর পুরাকীর্তি নিয়ে খুলে যেতে পারে  পশ্চিমবঙ্গের পর্যটন শিল্পের এক নয়া দিগন্ত। গতানুগতিক গ্রাম্য অর্থনীতিতে আসতে পারে পরিবর্তন।মুছে যাবে বাঙালীর ইতিহাস বিমুখতার অপবাদ।  আমরা কবে ভাববো এসব কথা!
মঙ্গলকোট কুনুর নদির অববাহিকায় অবস্থিত।উজানি কোগ্রামের কাছে কুনুর অজয় নদির সঙ্গম---যা মঙ্গলকাব্যে ভ্রমরার দহ নামে বিখ্যাত।এখানকার বণিকরা অজয় কুনুর আর গঙ্গাপথ ধরে সমুদ্র বাণিজ্যযাত্রা করে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির চুড়ায় উঠেছিল।মঙ্গলকাব্যে যার প্রমাণ রয়েছে। মঙ্গলকোটে প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখননে প্রাপ্ত পুরাসম্পদও সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সাক্ষ্য দেয় ।  অনেকেই বলেন মঙ্গলকোটের নামকরণ নাকি মোঘলদের অনুষঙ্গে।একেবারে ভ্রান্ত ধারনা।মঙ্গলকোটের সঙ্গে জড়িয়ে আছে উজানির দেবী মঙ্গলচণ্ডীর নাম।বৃহদ্ধর্মপুরাণে বলা হয়েছে উজ্জয়নি বা উজানিপুরের মঙ্গলকোষ্ঠপীঠে দেবী মঙ্গলচণ্ডীর অবস্থান।
                                 উজ্জয়িন্যাং যথাপূর্ব্যাং পীঠং মঙ্গলকোষ্টকম।
                                শুভা মন্ডলচন্ডাখ্যা যত্রাহং বরদায়িনী।।১,০১,১৪


নানাভাবে আবিস্কৃত মঙ্গলকোটের পুরাসম্পদগুলি শৌখিন পুরাসংগ্রাহক বা ক্ষেত্রসমীক্ষকরা অনেকদিন আগে থেকে সংগ্রহ করে চলেছেন।এককড়ি দাস ,প্রয়াত কেশবচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়,মুহম্মদ আয়ুব হোসেন আসরাফ আলি প্রমুখদের নাম সর্বাগ্রে উল্লেখ্য।এদের সংগৃহীত পুরাসম্পদ রাজ্যপ্রত্নতত্ত্ব সংগ্রহালয়ে ,কাটোয়া মহকুমা গ্রন্থাগারে কিম্বা ব্যক্তিগত সংগ্রহে রয়েছে।পাশাপাশি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরাতত্ত্ব বিভাগ কতৃর্ক অধ্যাপক অমিতা রায় ও অধ্যাপক সমীর কুমার মুখোপাধ্যায়ের যৌথ নেতৃত্বে ১৯৮৬ সাল থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত মঙ্গলকোটের বিক্রমাদিত্যের ডাঙা,মনুমিঞার ডাঙা ও কাছারি ডাঙা উৎখনিত হয়।এর ফলে খ্রিষ্ট পূর্ব ১২০০ শতক থেকে খ্রিষ্টীয় ১৮০০ শতক পর্যন্ত মোট তিন হাজার বছরের বর্ণময় বঙ্গসভ্যতার ধারাবাহিক প্রত্ন নিদর্শন আবিস্কৃত হয়।


 হরপ্পা বা সিন্ধু সভ্যতা প্রাক-বৈদিক।সিন্ধু নদের উপত্যকায় গড়ে উঠেছিল এই নাগরিক সভ্যতাটি। পাথরের সঙ্গে তামার ব্যবহার ফলে প্রাগৈতিহাসিক জীবনযাত্রায় এসেছিল অভূতপূর্ব পরিবর্তন।এই কারণেই বলা হয় তাম্রাশ্মীয় সভ্যতা।আর্যদের আক্রমণ বা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ফলে হরপ্পা সভ্যতার বিনাশ ঘটে--এমনটাই মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।অনেকেই মনে করেন গঙ্গাপথ ধরে নাকি "উত্তর হরপ্পা সভ্যতা" ছড়িয়ে পরেছিল রাঢ় অঞ্চলে।বিষয়টা বিতর্কিত হলেও একটা কথা দিনের আলোর মত স্পষ্ট মঙ্গলকোট থেকে মাত্র ৩০ কিমি দূরে পান্ডুরাজার ঢিবি উৎখননে প্রাপ্ত পুরা নিদর্শনে প্রমাণিত হলো--রাঢ় অঞ্চলে হরপ্পা সভ্যতার সমকালীন  কৃষিকেন্দ্রিক তাম্রাশ্মীয় সভ্যতা গড়ে উঠেছিল।রেডিও কার্বণ  পরীক্ষা দ্বারা প্রমাণিত পান্ডুরাজার ঢিবিতে আদি জনবসতি গড়ে উঠেছিল খ্রিষ্ট পূর্ব ১৭০০ অব্দে।নিঃসন্দেহে আদি বাঙালীর আদি বঙ্গসংস্কৃতির সূতিকাগার।এই সভ্যতা শুধু পান্ডুরাজার ঢিবিতেই সীমাবদ্ধ থাকেনি।অজয়-দামোদর-ময়ূরাক্ষী কোপাই-কুনুর-খড়ি নদির অববাহিকার রাঢ় অঞ্চলে  ছড়িয়ে পড়েছিল।যার দৃষ্টান্ত---বীরভূমের বাহিরি, বর্ধমান জেলার বড়োবেলুন আমারুন এবং  বৃহত্তর মঙ্গলকোট ইত্যাদি। মঙ্গলকোটএ  প্রাপ্ত পুরাসম্পদের রেডিও কার্বন পরীক্ষায় প্রমাণিত এখানকার আদি জনবসতি খ্রিষ্টপূর্ব ৯৪০ অব্দের।শুধু তাই নয়---তামার সঙ্গে মঙ্গলকোটবাসীরা সেই সময় থেকে লোহার ব্যবহার করতে শিখে গিয়েছিল।এইকারনেই পন্ডিতরা মঙ্গলকোট সভ্যতাকে তাম্র-লৌহ সভ্যতা বলে চিহ্নিত করেছেন।শুধু জীবনযাত্রার মানের পরিবর্তন নয়্‌--- রাঢ়ের  সমাজ অর্থনীতিতে এসেছিল গভীর পরিবর্তন।
 

মঙ্গলকোট উৎখননে মঙ্গলকোটের অধিবাসীদের সাংস্কৃতিক জীবনধারার ক্রমবিকাশ ও অগ্রগতির মোট সাতটি স্তর ভিত্তিক বিন্যাস প্রত্নবিজ্ঞানীদ্বয় লক্ষ করেছেন।প্রথম পর্বের সময়কাল খ্রিষ্ট পূর্ব ১২০০ থেকে খ্রিষ্ট পূর্ব ৬০০ অব্দ।এই পর্বের উল্লেখযোগ্য পুরা নিদর্শন লাল-কালো কৌলাল আর্থাৎ মাটির তৈরি নানা ধরনের জিনিষ-পত্রাদি।এই পর্বের আর একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্যের কথা আগেই বলেছি----লোহার ব্যবহার।দ্বিতীয় স্তর খুবই গুরুত্বপূর্ণ।একদিকে তাম্রপ্রস্তর যুগের অবসান অপর দিকে আদি ঐতিহাসিক যুগের অভ্যুদয়।এরই মধ্যবর্তী সময়কাল। সময় কাল খ্রি.পূ.৬০০ অব্দ থেকে খ্রি.পূ.৩০০ অব্দ।এই পর্বে মিলেছে বেশ কিছু পোড়া মাটির নারীমূর্তি,বিডস ,হাড়ের তৈরি যন্ত্রপাতি।তৃতীয়পর্ব ঐতিহাসিক মৌর্য-শুঙ্গ যুগ।এই পর্বে লাল-কালো কৌলালের অবলুপ্তি ঘটার সাথে সাথে উত্তর ভারতীয় মসৃণ  চিক্কন কৃষ্ণ কৌলালের আবির্ভাব ঘটেছে।এই সময় থেকে উত্তর ও মধ্য ভারতের কৃষ্টি ও সংস্কৃতির যোগ শুরু হয়েছিল মঙ্গলকোটের। এই যোগ কুষাণ ও গুপ্তযুগে আরও নিবিড় হয়ে ওঠে। এই সময় থেকে মিলেছে সিলভার পাঞ্চ কয়েন ও ঢালাই তাম্র মুদ্রা।শুঙ্গযুগের  অন্যতম বৈশিষ্ট্য টেরাকোটা পঞ্চচূড়া যক্ষিণী  মূর্তি।  মিলেছে সরকারি ও প্রাইভেট কালেক্টরদের উদ্যোগে।পাওয়া গেছে ঘোড়ায় চড়া যোদ্ধাবেশী দেবী মূর্তি।বেহালায় রাজ্য প্রত্নতত্ত্ব সংগ্রহালয়ে মঙ্গলকোট থেকে প্রাপ্ত অনুরূপ আর একটি টেরাকোটা ফলক আছে। মন্তব্য করা হয়েছে... Female divinity on horse back.Mangalkot Dt .Burdwan.3rd cent.A.D.(Treasures of The State Archaelogical Museum West  Bengal  plate no 10) টেরাকোটা যক্ষিণী মূর্তিগুলি বেশ অভিনব ।প্রশস্ত নিতম্ব,ক্ষীণ কটী,সমুন্নত উত্থিত পয়োধর,সুকেশী ,সর্বালঙ্কারে ভূষিতা এবং বস্ত্র পরিহিতা হলেও অনেকের যৌনাঙ্গ প্রদর্শিত---এমন দেবীই যক্ষিণী।মাথার খোঁপা বিশেষ বৈশিষ্ট্য যুক্ত।খোঁপার আকৃতি চূড়া বা পাখির মতো।হেয়ার পিন দিয়ে আঁটা।হেয়ার পিনের সংখ্যা দশ বা বারোটি।পিনগুলি আকৃতিতে যুদ্ধাস্ত্র বা আয়ুধের মতো।এরা অনেক সময় অপদেবী রূপে পূজিতা হয়েছেন।শুধু হিন্দু ধর্মে নয়,যক্ষ যক্ষিণী পুজো জৈন ও বৌদ্ধ ধর্মে ব্যাপক মাত্রাতে অনুপ্রবেশ করেছিল।গাঙ্গেয় বাংলার বিবিধ প্রত্নক্ষেত্র থেকে যেমন তমলুক চন্দ্রকেতুগড় আনখোনা ফরাক্কা মঙ্গলকোটে পাওয়া গেছে।আসরাফের সংগ্রহে একটি যক্ষিণীর মুখমন্ডলে আড়াআড়ি দাগ কেটে ভয়ংকরী রূপে দেখা্নো হয়েছে।


চতুর্থ পর্ব কুষাণযুগ।এই সময় থেকে মঙ্গলকোটে শুরু হয় নগরায়ণ।সর্বভারতীয় কুষাণ সভ্যতার প্রভাব পড়ে মঙ্গলকোটে।ইটের স্থাপত্য দেখা যায়।আবিস্কৃত ইটের আকার ছিল 40x27x7 সেমি। বাড়িঘরের সঙ্গে যুক্ত ছিল কুয়ো ,পয়ঃপ্রণালী।এই স্তরে আবিস্কৃত হয়েছে প্রচুর সিলমোহর,পোড়া মাটির ফলক।পঞ্চমস্তর --গুপ্তযুগ।এই সময়ে প্রচুর সিলমোহর পাওয়া গেছে।তার মধ্যে দেখা যায় নানা ধরনের প্রতীক ও চিহ্ন।যেমন বেড়ার মধ্যে গাছ,স্তূপ,পূর্ণ কুম্ভ ধ্বজা,শঙ্খ,ষাঁড় ইত্যাদি।আসরাফের সংগ্রহে প্রায় পঞ্চাশ টির অধিক সিল-মোহর রয়েছে ।যা কাটোয়া থেকে প্রকাশিত কৌলাল পত্রিকায় ধারাবাহিক ভাবে এর বিবরণ প্রকাশিত হয়েছিল।আসরাফের সংগ্রহে  আরও একটি মূল্যবান সিলমোহর রয়েছে ।গুপ্ত ব্রাহ্মী বর্ণে খোদিত রুদ্রদাসস্য নামাঙ্কিত শিলমোহর।এছাড়া তিন মুখো একটি বিরল শ্রেণীর  শিলমোহর দেখা যায়।কোন কাজে  এগুলি ব্যবহৃত হতো তা এখনো বোঝা যায়নি।নানা ধরনের পুঁতির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো কারনেলিয়ান আগেট স্ফটিক চ্যালসিডনি কাঁচ হাতির দাঁতের তৈরি নানান সামগ্রী।এই সময় থেকে প্রচুর পরিমাণে কপার কাস্ট মুদ্রা মেলে।ঐতিহাসিকেরা মনে করেন ছাঁচে ঢালা তাম্রমুদ্রা প্রধানত মৌর্য-শুঙ্গ-কুষাণ-গুপ্তযুগে চালু ছিল।এই মুদ্রাগুলিতে কোন লিপি নেই।নেই কোন রাজার নাম বা দেব দেবির প্রতিকৃতি।বরং তৎকালীন লোকজীবনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগ রয়েছে ।মুদ্রাগুলিতে পড়েছে কৃষিভিত্তিক সমাজ জীবনের ছাপ।মুদ্রায় বেশকিছু জীব-জন্তুর প্রতিকৃতির ছাপ আছে।যেমন হাতি,ষাঁড়,ঘোড়া,সাপ, উট ইত্যাদি।



কিছু মদ্রায় রয়েছে তৎকালীন যুগে প্রচলিত ধর্মবিশ্বাসের ছাপ বা সাংকেতিক চিহ্ন।যেমন ক্রশ চিহ্ন,স্তূপ , স্বস্তিক চিহ্ন,যজ্ঞবেদী,রেলিং দেওয়া গাছ,বা বোধি বৃক্ষ ইত্যাদি।আরও নানা ধরনের দুর্বোধ্য সাংকেতিক চিহ্ন মুদ্রাগুলিতে দেখা যায়।এর সঙ্গে অদ্ভুত মিল রয়েছে গ্রামগঞ্জে ঘরের দরজায় আঁকা সাংকেতিক চিহ্নগুলির সঙ্গে ।বিশেষজ্ঞরা মনে করেন মুদ্রাগুলি মাটির ছাঁচে গলিত তামা ঢেলে বানানো হতো।আসরাফ ,আয়ুব হোসেন ও বর্তমান প্রতিবেদকের  সংগৃহীত মুদ্রাগুলির গড় ওজন ৩.৫৭ গ্রাম।পশ্চিমবঙ্গের নানা স্থান থেকে এই ধরনের মুদ্রা প্রচুর পাওয়া গেছে  যেমন চন্দ্রকেতুগড়,বোড়াল,পোখরানা।কাটোয়ার মঙ্গলকোট ছাড়াও কপারকাস্ট কয়েন মিলেছে কেতুগ্রামের আনখোনার মাঝিডাঙ্গা থেকে। মঙ্গলকোটের গুপ্ত পরবর্তী ষষ্ঠ ও সপ্তম স্তর দুটি খুবই বিক্ষিপ্ত অবস্থায়  পাওয়া গেছে।উল্লেখযোগ্য প্রত্ন নিদর্শন তেমন মেলেনি।এরপরেও মঙ্গলকোটে উৎখনন করা হয়েছে বিক্ষিপ্ত ভাবে।


ইতিহাস মানে অতীতের  স্মৃতি রোমন্থন নয়--অমোঘ শিকড়ের টান। রোমান্স বিলাসী জীবন বিমুখতা নয়-অস্তিত্বের নিবিড় বন্ধন। জীবন সংগ্রামের প্রেরণা । ইতিমধ্যে চর্যাগীতিকে  উড়িয়ারা তাদের ভাষার প্রাচীন সাহিত্য নিদর্শন বলে দাবী করে  কেন্দ্রীয় সরকারের কাছ থেকে  ধ্রুপদী ভাষার মর্যাদা আদায় করে নিয়েছে।বাংলাভাষা  তার ধ্রুপদী  মর্যাদা হারাতে বসেছে।এরপর নাকি রসগোল্লারও আবিস্কারের দাবীদার  উড়িয়ারা। একের পর এক  অতীত ঐতিয্য আমাদের হাতছাড়া হতে চলেছে।এটাই স্বাভাবিক ।কেননা সেই হরপ্পাসভ্যতার সমকালীন বাঙালীদের আদি ঠিকানা পান্ডুরাজার ঢিবি বা মঙ্গলকোট  সম্পর্কেই আমরা ঘোরতর উদাসীন।রসগোল্লা তো অনেক পরের বিষয়।বাঙালীর এই  আত্মঘাতী আত্মবিস্মৃতির মানসিকতা কবে লুপ্ত হবে??
সৌজন্যঃ সংবাদ পত্রিকায় প্রকাশিত




 email drswapankrthakur@gmail.com

Saturday, October 08, 2016

BORGI LUTHERA VASKOR PONDITER OSOMAPTO DURGAPUJO

                ইন্দ্রাণী-দাঁইহাট ও মারাঠি লুঠেরা ভাস্কর পন্ডিতের দুর্গা  পুজো
                                    







বারো ঘাট তেরো হাট।তিন চন্ডী তিনেশ্বর।আর এটা  যে বলতে পারে-দাঁইহাট-ইন্দ্রাণীতে তার ঘর।একটি লোকপ্রিয় প্রবাদ-বা লোকধাঁধা।  আর এই ধাঁধায় বাঁধা পড়েছে এক বিলুপ্ত নগরীর আত্ম-কথন।কাটোয়ার শাঁখাই  ঘাট থেকে ভাউসিং-দাঁইহাট ।সাত কিমি ব্যাপী গঙ্গার পশ্চিম তীরবরাবর  প্রসারিত  প্রাচীন গাঙ্গেয় নগরী--ইন্দ্রাণী।বর্তমানে  শহর কাটোয়ার একাংশ  ও দাঁইহাটের বৃহদংশ যার অন্তর্ভুক্ত।


হাট মানেই বিকিকিনির গঞ্জ-বাজার।হাট মানে শুধু দাঁইহাট নয়;আতুহাট,ঘোষহাট-পানুহাট-মোড়লহাট-একাইহাট-বিকিহাট-বীরহাট-পাতাইহাট ইত্যাদি।হাটে হাটে চলে চাল-ডাল-তেল-গুড় লবণ ভুঁষিমাল-কৃষিজ সম্পদের বেচা-কেনা। সঙ্গে তাঁত রেশম গাড়া বস্ত্র ।পাথর কাঁসাপিতলের ঘর-গেরস্থালির বাসন-কোসন।পাথর কাঠ-ধাতুর  মনোহর  দেববিগ্রহ।নীলকুঠি,চিনির কুঠি,সোনারুপোর বিপণি ।বড়ো বড়ো আড়ত। মহাজনি কারবার। টোল চতুষ্পাঠী।মন্দির মসজিদ-গির্জা । সুন্দরী বারাঙ্গনা, সতীদাহ অন্তর্জলিযাত্রা-গঙ্গায় সন্তান বিসর্জন--- কি ছিলনা ইন্দ্রাণীতে।গঙ্গার ঘাটগুলো  নিছকই স্নানের ঘাট নয়।সমুদ্র বাণিজ্যের  যেন ছোট ছোট বন্দর।সবমিলিয়ে প্রাচীনযুগ থেকেই জমজমাট এক  বাণিজ্য-নগরী ইন্দ্রাণী।মোঘল সম্রাট আকবরের আমলে সরকার সুলেমানাবাদের অন্তর্গতএক বিশিষ্ট পরগনা।মহামতি আকবর এখান থেকে বাৎসরিক রাজস্ব পেতেন ৫,৮২,১২০ দাম।রূপ ডেকে আনে কলঙ্ক।সমৃদ্ধি বহে আনে সর্বনাশ! অর্থ- প্রাচুর্যের চোরাস্রোতে ঢোকে বিলাসিতা। ক্ষয় আর দুর্বলতা।ইন্দ্রাণীতেও তার ব্যতিক্রম হয়নি।



অষ্টাদশ শতকের চারের দশক।আলিবর্দির নবাবি সিংহাসন তখন টলমল।উড়িষ্যায় বিদ্রোহ ঘোষণা করেছেন দুর্দান্ত দুর্দানা বেগম।তাঁর স্বামী দ্বিতীয়মুর্শিদকুলি খাঁ।উদ্ধত জামাতা বাকর আলি।ক্রুদ্ধআলিবর্দি ১৭৪১ সালে শীতকালে বিদ্রোহ দমন করতে গেলেন। নিজ জামাতা সৌলদজঙ্গকে উড়িষ্যার সিংহাসনে বসিয়ে ১৭৪২ সালের এপ্রিল মাসে প্রবেশ করলেন বর্ধমানে।এদিকে ভাস্কর পন্ডিতের নেতৃত্বে প্রায় চল্লিশ হাজার বার্গির সেনা বর্ধমানের রানি সায়রের পাড়ে নবাবকে ছেঁকে ধরলেন পঙ্গপালের মতো। চৌথ বাবদ দশ লক্ষ রুপিয়া মেটাতে হবে জলদি।এটাই তাদের দাবী।মামার বাড়ির আবদার আর কী! সে দাবী ফুৎকারে উড়িয়ে দিলেন বিরক্ত নবাব।কিন্তু পরিস্থিতি বদলে গেল গিরগিটির মতো।ভয়ংকর বর্গি  সেনাদের গেরিলাযুদ্ধের গরলে নবাব বাহিনীর ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা।কোন রকমে কাটোয়ায় এসে পড়ি কি মরি বলে মুর্শিদাবাদে ছুট লাগালেন।এদিকে ভাস্কর পন্ডিত তার দূরন্ত বর্গিবাহিনী নিয়ে দাঁইহাটে গাড়লেন ঘাঁটি ।


বর্ধমানরাজাদের বাসভবনটি হয়ে উঠলো বর্গিদের প্রশাসনিক ভবন।শুরু হলো লুঠ-পাট।অগ্নিদাহ।নারীর উপর বলৎকার।দাঁইহাটের গঙ্গায় মাটিয়ারির সঙ্গে যুক্ত করা হলো নৌকা দিয়ে ভাসমান সেতু।হাঙ্গামা ছড়িয়ে পড়লো পূর্ববঙ্গেও। এ- আলিবাবা আর চল্লিশ চোরের চিচিং ফাঁকের কিসসা নয়।চল্লিশ হাজার খতরনাক বর্গিসেনার হাড়হিম করা অত্যাচারের কাহিনী। ইতিকথা ছাড়িয়ে ছড়িয়ে আছে বাংলার হাটে-মাঠে-বাটে-ঘাটে কিংবদন্তী আর জনশ্রুতি রূপে।হুগলিজয় করে সেখান থেকে মির হবিব নিয়ে এলেন যুদ্ধজাহাজ।সমগ্র দক্ষিণবংগের হত্তাকর্তা বিধাতা হয়ে উঠেন  কোহলৎকর ভাস্কর পন্ডিত। নবাবি শাসন হয়ে পড়লো সুপ্ত লুপ্ত অন্তর্হিত।ব্যপ্ত হলো বর্গিদের দাপট।বঙ্গজুড়ে নেমে এলো--ত্রাস-বিভীষিকা ।শয়তানের অভিশাপ।এর পরই ভাস্কর দাঁইহাটে আয়োজন করেন  বড়ো মাপের দুর্গাপুজো।সে এক এলাহি ব্যাপার।সে কথায় আসছি।তার আগে ইন্দ্রাণী সম্পর্কে কয়েকটি তথ্য  জানানো প্রয়োজন।


ইন্দ্রাণী এক নদীর নাম।সপ্তমাতৃকার এক জননী।  লোকপুরাণের  নায়িকা।আর কান টানলে যেমন মাথা আসে তেমনি নায়িকা থাকলেই নায়ক আসবেন।সুতরাং ইন্দ্রাণীর পাশেই হাজির হলেন স্বর্গের রাজা ইন্দ্র।ভগীরথ গঙ্গাদেবীকে আনছিলেন মর্ত্যে  শাঁখ বাজিয়ে। এদিকে ইন্দ্রের নির্দেশে দেবতারাও শঙ্খধ্বনি করতে লাগলেন কাটোয়ার অজয়-গঙ্গার মোহানার তীরে। নাম হলো শঙ্খধ্বনি ঘাট।মানে শাঁখাই ঘাট।কাটোয়ার পাশ দিয়ে সুরুধনি প্রবাহিত হতেই রাজা ইন্দ্র প্রথমে গঙ্গা নাইলেন।ঘাটের নাম হলো ইন্দ্রেশ্বর ঘাট।এই ঘাটের কথা লিখে কামাল করে দিয়েছেনপ্রাক চৈতন্যযুগের কবি কৃত্তিবাস ওঝা।ইন্দ্রেশ্বর ঘাটে যে বা নর স্নান করে /অযুত বৎসর থাকে সে স্বর্গপুরে।। নবম শতকের মহাভরতের টীকাকার নীলকণ্ঠ বাচস্পতি মশাই আবার লিখে দিলেন এই ঘাটের মাথায় বসে সুন্দরী শচী নাকি সহস্র বছর ধ্যান করে ইন্দ্রকে পতিরূপে বাগিয়েছিলেন।এখানেই গড়ে উঠেছিল ইন্দ্রাণীর মন্দির।কবিকঙ্কন মুকুন্দ সেই নগরদেবীকে বন্দনা করে লিখেছিলেন---ভুবন মোহিনী মাগো ইন্দ্রাণী জননী জাগো দৈব নাশে তব শরণে।ইন্দ্রাণীর ভূমিপুত্র কবি কাশীরাম দাস তাঁর অমৃতসম মহাভারতে  লিখেছিলেন---
                                
                                 ইন্দ্রাণী নামেতে দেশ পূর্বাপর স্থিতি।
                                  দ্বাদশ তীর্থে যথা বৈসে ভাগীরথী।



আজ হারিয়ে গেছে সব কিছু ...মন্দির গেছে বিস্মৃতির গর্ভে।গঙ্গা চলে গেছে দূরে---বহুদূরে।শুধু রেখে গেছে তার ভালোবাসার অভিজ্ঞানটিকে -----ইঁদের পুকুর।এখন বাঁশ ঝাড় ঘেরা নিছকই এক এঁদো পুকুর। এক সময় ইন্দ্রদ্বাদশীর দিনে কিশোরী মেয়েরা প্রথম প্রণয় পুরুষ ইন্দর ঠাকুরের একটি মাটির মূর্তি গড়ে তাকে মাথায় নিয়ে ডুব দিত  ইঁদের পুকুরে।উঠে আসতো যেন এক পূর্ণ নারী হয়ে!!

 


শৈব শাক্ত সুফি রামায়েত বৈষ্ণব সাধনার ঘাঁটি হয়ে ঊঠেছিল ইন্দ্রাণীতীর্থ।তিনেশ্বর হলেন তিন বিখ্যাত শিবলিঙ্গ--চন্দ্রেশ্বর।ঘোষেশ্বর আর ইন্দ্রেশ্বর।একাধিক চন্ডির অস্তিত্ব আজও রয়েছে।আছে বদর শাহের মাজার।বেড়াগ্রামে মাটি খুঁড়তে গিয়ে পাওয়া গেল জৈন তাম্রশাসন।এতে খোদিত হয়েছে স্বর্গস্থানতুল্য ইন্দ্রাণী তীর্থের মহিমা।জেমস লঙ সাহেব গঙ্গা পথে ফিরছিলেন কলকাতা।দাঁইহাটের পাশ দিয়ে যেতে হঠাৎ তাঁর নজরে পড়লো এক ডুবন্ত প্রস্তরমন্দিরের প্রতিষ্ঠাফলক।রতনে রতন চেনে।ফলকটি তিনি এসিয়াটিক সোসাইটিতে জমা দিলেন।লিপির পাঠোদ্ধারে বোঝা গেল এ মন্দির পালযুগের প্রথম দিকের ।সপ্তম-অষ্টম শতকের।আর যারা কচু চেনে --তারা মন্দিরের অলংকরণগুল চুরি করে সাফ করে দিলো।দেওয়ানগঞ্জে দেওয়ান মাণিকচাঁদ আর এক রাজবাড়ি হাঁকালেন।বাঁধালেন গঙ্গার ঘাট--মাণিকচাঁদের ঘাট তথা অতিবড়ো ঠাট।এইতো আটের দশকের কথা।খবরটা এখনও বাসি হয়ে যাইনি।বিকিহাটের বকুলতলায় পড়ে থাকা ভগ্ন বিষ্ণুর পাদপীঠে খোদিরত লেখ  থেকে জানা গেল  পালযুগের জনৈক বণিক বসন্ত সিংহের  কথা।যিনি  হয়তো বিখ্যাত ভৃগু সিংহের উত্তর-পুরুষ।যাঁর নাম অনুসারেই আজকের ভাউ সিং জনপদ।


সপ্তদশ শতকে বর্ধমান রাজাদের উত্থান।তাঁদের দাক্ষিণ্য বর্ধমান ছাড়িয়ে ইন্দ্রাণী-দাঁইহাটে হয়ে গেল ক্রমবর্ধমান।দাঁইহাট হলো বর্ধমান রাজাদের ধর্মীয় রাজধানী।গঙ্গাবাসক্ষেত্র। ঠিক যেমন দ্বাদশ শতকে  সেন রাজাদের ধর্মীয় রাজধানী হয়েছিল গঙ্গাহৃদি নবদ্বীপ। তেমনি দাঁইহাটের গঙ্গার তীরে গড়ে উঠলো রাজঅট্টালিকা।বাঁধানো ঘাট। রাজা রানির সাধের দেবালয় ।গড়ে উঠলো ছোট বড়ো মন্দির।যেমন কিশোর-কিশোরীমন্দির।বিকিহাটে প্রতিষ্ঠিত হলো হরগৌরীর প্রস্তরবিগ্রহ।রাজাদের সমাধি সৌধ।বর্ধমান জেলার অন্যতম পুরাকীর্তি সমাজবাটী।  ১৭৪০ সালে প্রয়াত হয়েছিলেন মহারাজ কীর্তিচন্দ্র রায়।তাঁর অন্ত্যেষ্টি ক্রিয়ার স্মারক এই  সমাজ বাটি। ইন্দ্রাণী দাঁইহাটের সমৃদ্ধি যখন গৌরবের চূড়ায় তখনই হাজির হলো  কালান্তক যম সম বর্গিরা।নবাব আর  বর্ধমান রাজশক্তিকে তাড়িয়ে  তারাই হয়ে উঠলো বঙ্গেশ্বর।রাজধানী ---একালের দাঁইহাট।


১৭৪২ সালের সেপ্টেম্বর মাস।রাজধানী দাঁইহাটে দুর্গাপুজো হবে আর পুজো করবেন স্বয়ং ভাস্কর পন্ডিত। চারদিকে সাজো সাজো রব।নবাবের টিকিটি পর্যন্ত দেখা নেই।মির হবিব যেন নাগপুরের সর্দার রঘুজির দেওয়ান।ইন্দ্রাণীর জমিদাররা ভাস্করের পুজোর জন্য নজরানা নিয়ে আসছে।পালে পালে ছাগ মেষ আসছে।দুর্গার সামনে বলি দেওয়া হবে।রাজবাড়িতে তৈরি হচ্ছে দেখার মতো দুর্গা প্রতিমা। চারদিকে সাজো সাজো রব।এলাহি ব্যাপার।কবি গঙ্গারাম  তাঁর মহারাষ্ট্রপুরাণে এসম্পর্কে চমৎকার লিখেছেন---
                                 এইরূপে কুমোর প্রতিমা বানাইয়া।
                              ভাস্করের ঠাঁই তারা গেল বিদায় হইয়া।।
                              তারপর উপাদএ সামগ্রী আইলো যত।
                               ভার বান্ধিতে বোঝাএ কত শত।।
                              ভাস্কর করিবে পূজা বলি দেবার তরে ।
                             ছাগ মহিষ আইসে কত হাজারে হাজারে।।


সেদিন ছিল ২৬ শে সেপ্টেম্বর।দুর্গাসপ্তমীর পুজো।সারা বাংলার সঙ্গে দাঁইহাটবাসীও ভয়ে ভক্তিতে   মত্ত।ভাস্করের দুর্গাপুজোয় অঢেল খানাপিনার আয়োজন।মদের ফোয়ারা ছুটছে।চলছে বাঈজিদের নাচা-গানা। দেদারফুর্তি। নবাব এই সুযোগটার জন্য ওৎ পেতেছিলেন।বিপুল সংখ্যক সৈন্য সমাবেশ করে উদ্ধারণপুরে গঙ্গা পার হলেন। দিনের আলোয় তারা মিলিয়ে গেল ভুতের মতো।মহাষ্টমীর সন্ধিপূজা  বেজে উঠলো গ্রাম-গ্রামান্তরে।সকলেই দেবিপ্রাঙ্গণে হাজির।এই অবসরে সৈন্যরা আবার সমবেত হলো শাঁখাইএর অজয় তীরে।ঘোর অন্ধকার রজনী।নগরবাসীরা মাতৃ আরাধনায় মগ্ন।ধীরে পেরুতে হবে অজয়নদী।আশ্বিনের দুর্বিনীত অজয় গঙ্গার ভয়াবহ সঙ্গমস্থল।পেরুতে হবে সকলকে।তারপর দাঁইহাটে গিয়ে অতর্কিতে আক্রমণ করতে হবে উৎসব বিগলিত বর্গিদের।চুপিসারে তৈরি হলো নৌকার সেতু।কিন্তু বিধি বাম। হাতি ঘোড়া আর সৈন্যদের পদভারে সেতু গেল মড় মড় করে ভেঙে।হাতি ঘোড়া  যুদ্ধের রসদ আর অসংখ্য সৈন্য গেল জলের তোড়ে  ভেসে।বিপুল লোকসান।প্রায় ১৫০০ সৈন্যের ঘটলো সলিল সমাধি।জেমস গ্র্যান্ট ডাফ সাহেব তাঁর সুবিখ্যাত গ্রন্থ এ হিস্ট্রি অব মারাঠায় লিখেছেন..."Fifteen hundred men were plunged into the Adjee and totaly lost." ".


 সকলেই ভেঙে  পড়লেন।শুধু ভেঙে পড়লেন না নবাব।যেমন করেই হোক বর্গিদের তিনি বাংলা ছাড়া করবেন।কঠোর প্রতিজ্ঞায় তিনি অটল।কর্তব্যে অবিচল।তাই অতি সন্তর্পণে আবার সেতু মেরা মতির কাজ শুরু হলো।কাজ শেষ হতেই সৈন্যরা নির্বিঘ্নে অজয় পার হল।এবার নব উদ্যমে নবাবি সেনা দাঁইহাটের পথে ধাবিত।ইতিমধ্যে বর্গিরা খবর পেয়ে দলে দলে তখন ঘোড়া ছুটিয়ে  মহারাষ্ট্রের পথে।  দাঁইহাটের পূজা প্রাঙ্গন তখন বর্গি আর নবাবি সেনার রণাঙ্গনে পরিণত।নবমীর প্রভাতে লন্ড-ভন্ড হয়ে গেল দেবী পুজো।অসংখ্য বর্গি সেনা মারা গেল।যেন দেবীপূজায় নরবলির মহা আয়োজন।ভাস্কর পন্ডিত বিপদ বুঝে আগেই পলায়ন করেছিলেন।কথিত আছে তাঁর কাছে  ছিল এক সোনার দুর্গা প্রতিমা।বিধর্মীরা পূজার পবিত্রতা নষ্ট করে দেবে বলে নাকি সেই স্বর্ণপ্রতিমাটিকে গঙ্গার জলে ভাসিয়ে দিয়েছিলেন।নবমীতেই দশমীর বাজনা বাজিয়ে ফিরে গিয়েছিলেন মহারাষ্ট্রে।কঠোর প্রতিজ্ঞা করেছিলেন দাঁইহাটের মাটিতে।রক্তের হোলি খেলবেন এই বাংলায়।আজও সেই দুর্গাপূজা আসে।ভাঙাচোরা বাড়িটাতেই।লোকমুখে যার পরিচিতি --ভাস্কর পন্ডিতের দুর্গাপুজো।


ঐ যে দেখছেন----ভাঙা দেওয়ালটুকু! ওটাই বর্ধমানরাজাদের বিরাট গঙ্গাবাস ভবনের শেষ চিহ্ন।ওখানে আজও রয়েছে গোলা বর্ষণের ক্ষতচিহ্ন।নিচে জননী জাহ্নবীর  পরিত্যক্ত নদিখাত।বাঁধানো ঘাট--বারদুয়ারী।ডান দিকে রাজাদের সমাধি স্মারক--সমাজবাড়ি।কিশোর-কিশোরী মন্দির।আজ গঙ্গা অভিমানে দূরে সরে গেছে।গাছ-গাছালি আর আত্মবিস্মৃতির পলিতে চাপা পড়ে ইতিকথা!বঙ্গে বর্গি হাঙ্গামার স্মারক চিহ্ন রাজবাড়িটা ভাঙতে ভাঙতে শুধু এইটুকু!!একটা বোবা জিজ্ঞাসা চিহ্নের মত  বেবাক দাঁড়িয়ে!অচিরে হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়বে।আত্মবিস্মৃত বাঙালী শুধু নিদ্রালু সন্তানদের ঘুম পারাতে পারাতে বলবে-----
                         খোকা ঘুমালো পাড়া জুড়ালো বর্গি এলো দেশে।
                         বুলবুলিতে ধান খেয়েছে খাজনা দেবো কিসে।।


শুধু পুজোর এই চারটি দিন ইতিহাসের বিবর্ণ পাতা থেকে বেরিয়ে আসবে বর্গিরা...ভাস্কর পন্ডিত...আর স্মৃতির ক্যানভাসে উজ্জ্বল হয়ে উঠবে  অতীতের ইন্দ্রাণী-দাঁইহাট।।






 সৌজন্য ঃদৈনিক সংবাদে প্রকাশিত

Sunday, October 02, 2016

KAATA MUNDOR DURGAPUJO EK ULOT DEBIPURAN

              







 

       কাটামুন্ডর দুর্গাপুজো:  এক উলট দেবীপুরাণ

                                  


দুর্গা দুর্গতি নাশিনী।দশ প্রহরণধারিণী।মহিষমর্দিনী সিংহবাহিনী। সিংহ কখনো শ্বেত বর্ণের  খানিকটা ঘোড়ার মতও দেখতে। কখনো বা নরসিংহের আদলে গঠিত এক অদ্ভুত পৌরাণিক জীব।উত্তরবঙ্গে বিশেষকরে কোচবিহারের রাজাদের পূজিত দেবী দুর্গা ভয়ংকরী। যোদ্ধাবেশে অসুর নিধনে রত। সঙ্গে উদ্ধত  জয়া বিজয়া।সিংহের পাশা পাশি  একটা তাগড়াই বাঘ অসুরের হাতকে কামড়ে ধরেছে।দেবীর হস্ত  সংখ্যা নিয়ে নানা পুরাণে নানা কথা। দ্বিভূজা ,চতুর্ভূজা অষ্টভূজা   দশভূজা অষ্টাদশ কিম্বা সহস্রভূজা।গায়ের রঙ তপ্ত কাঞ্চন বা অতসী মানে তিসী ফুলের মতো।কখনো বা ঘোর লালবর্ণের দেবী।সাধারণত মহিষাসুর সহ কার্তিক গণেষাদি কিম্বা হরগৌরী  --এই পারিবারিক মূর্তিতেই পূজিত হন।



 কোন সন্দেহ নেই দেবী দুর্গার মধ্যে  প্রাচীন সংস্কৃতি মিলেমিশে একাকার।কৃষিদেবী বৃক্ষদেবী ,নগরের দুর্গ রক্ষয়িত্রী দেবীরূপে তাঁকে অনায়াসে সনাক্ত করা যায়।আদ্দিকালের লোকদেবীরাও দুর্গার মধ্যে আত্মগোপন করে আছেন।যেমন--লৌকিক বনদুর্গার পুজো আজো বহাল তবিয়তে টিকে আছে।কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় দুর্গার  বিরল ব্যতিক্রমী  শুধুমাত্র এক মুন্ডরূপের পুজো মূলত রাঢ় দেশের গোপভূমি অঞ্চলে জাঁক-জমকের সঙ্গে অনুষ্ঠিত হয়ে চলেছে। নেই মহিষাসুর,নেই মহিষ,নেই সিংহ বা বাঘ। পুত্র কন্যাদের কথা না হয় বাদই দেওয়া গেল।কেবলমাত্র গলা অব্দি কাটাএক নারীমুন্ড। দুর্গা রূপে পূজিত হচ্ছেন।যদিও দুর্গার এই ব্যতিক্রমী রূপটি সম্পর্কে কোন শাস্ত্রীয়

ব্যাখ্যা নেই।


অবশ্য দশমহাবিদ্যার ছিন্নমস্তার কথা এই প্রসঙ্গে উঠতেই পারে।তবে সেখানে ছিন্নমুন্ড থাকলেও দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখানো হয়েছে মাত্র।দক্ষিণ  চব্বিশ পরগনার এক বিস্তৃত অঞ্চলে একজোড়া মুন্ডমূর্তি বারা ঠাকুর হিসাবে পূজিত হোন।অনেকেই বলেন জোড়া মুন্ডের একটি ব্যাঘ্রদেবতা দক্ষিণ রায়ের ।অপরটি মহিলামূর্তি দেবী নারায়ণীর।শধু লৌকিক বারা ঠাকুর নয়;মনসার মুন্ডমূর্তি পূজিত হয় কালনা থানার উপলমতি উদয়পুরে।।সুতরাং এদিক থেকে দেখলে দুর্গার মুন্ডমূর্তি কোন ব্যাতিক্রমী বিষয় নয়,আগেই বলেছি  বহু লৌকিক দেবী দুর্গার মধ্যে মিশে আছে ।  সুতরাং প্রাচীন  মুন্ডমূর্তির পুজোর রীতি  এই দুর্গাপুজোর মধ্যে কোনরকমে  বেঁচে বর্তে আছে।


 অনেকেই বলেন মুন্ডপুজো আসলে প্রাচীন মুখোস পুজোর দৃষ্টান্ত। প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকেই ধর্ম সংস্কৃতিতে মুখোসের ব্যবহার চলে আসছে।মুখোস হলো মুখঢাকা মুখ।মুখের আবরণ বা ছদ্মমুখ।প্রাচীন গ্রীসে ইউরোপে এশিয়ার নানা উপজাতি ধর্মীয় কার্যকলাপে মুখোস ব্যবহার করে থাকেন।আমাদের দেশে কালকে পাতার শৈব  সন্যাসীরা কালীর মুখোস পরে  নাচানাচি করেন।কোথাও চামুন্ডার মুখোস পরা হয়।ক্ষীরগ্রামে  দেবী যোগ্যাদ্যার পুজোয় মুখোস পরে  মোরনাচ করা হয়।কাঠ শোলা মাটি দিয়ে এই মুখোসগুলি নির্মিত হয়।ছৌনাচে বিভিন্ন দেবদেবীর মুখোস আজও দেখা যায়। দুর্গা মুখোশ অন্যতম দৃষ্টান্ত মঙ্গলকোটের প্রত্নক্ষেত্র থেকে একাধিক মাটির তৈরি প্রতীকী মুখোশ অথবা মুন্ড মূর্তি মিলেছে । তবে পোড়া মাটির নয়।কাঁচা মাটির।উচ্চতা পাঁচ ইঞ্চির মতো।বিশেষজ্ঞরা বলেন প্রাচীনকালে লোকায়ত দেব-দেবীর থানে এই মুখোশ বা মুন্ডমূর্তি ছলন হিসাবে দেওয়ার প্রথা ছিল।পুরুষালি মুখ।নাকের গঠনটি লক্ষ্য করার মতো।মুখোশ্রীতে মায়াবি আদিমতা।এই ধরনের একাধিক প্রত্ন -মুন্ডমূর্তি কাটোয়া মহকুমা গ্রন্থাগারে সংরক্ষিত আছে।


 মুখোস বা মুন্ডমূর্তির দুর্গাপুজো মূলত বাঁকুড়ার কয়েকটি গ্রামে আর বর্ধমান জেলার আউসগ্রাম থানা যা প্রাচীনকালের গোপভূমি অঞ্চলের দু একটি গ্রামে এখনো টিকে  রয়েছে ।যেমন দিগনগরের রায় পরিবারে ,মঙ্গলকোটের পালিগ্রামে আর কেতুগ্রাম থানার গোমাইগ্রামে।গোমাইএর পুজোটির আদি উৎস গোপভূমি।পরে এ বিষয়ে বিস্তারিত বলা হয়েছে।এই পুজোগুলি কাটা  মুন্ডর পুজো নামে সুপরিচিত।লোকশ্রুতিগুলি বেশ মজার এবং যথেষ্ট ভাবনার খোরাক যোগায়।দেবী দুর্গা নাকি তার কাটা মুন্ড দেখিয়ে বিভ্রান্ত করেছিলেন মহিষাসুরকে।অসুর দেবীকে মৃত ভেবে যুদ্ধ পরিত্যাগ করেছিলেন।
এই  গল্পে মহিষাসুর হত্যার কোন প্রসঙ্গ নেই।নেই দশভূজা দুর্গার গল্প। তবে অনেক স্থানে যেমন দিগনগরের রায় বাড়ির কাটামুন্ডের সঙ্গে পুর্ণাঙ্গ জয়া বিজয়ার মূর্তি আছে।  সব মিলিয়ে এ এক অন্য ছিন্নমস্তার কাহিনী।


কেতুগ্রামের গোমাইএর কাটামুন্ড মায়ের আবার ভিন্ন জনশ্রুতি।গ্রামের কোঁয়ার সদগোপদের এই দেবী কাটামুন্ড মা।এরা ছিলেন প্রাচীন গোপভূমির অমরাগড় দিগনগর প্রভৃতি অঞ্চলের ডাকসাইটে ভূস্বামী। এরা নাঙ্গল ধরে না ,কলম ধরা জাত।এদের দাপটে বাঘে গোরুতে  একসময়ে  এক ঘাটে জল খেত।প্রায় তিনশ  বছর আগে  এদেরই পূর্বপুরুষ হরগোবিন্দ রায় অমরাগড় থেকে  গোমাই এ চলে আসেন জমিদারি প্রাপ্তির সূত্র।একদিন তিনি শরতের দুপুরে কেতুগ্রাম থেকে ফিরছিলেন গোমাই।নির্জন মাঠে ঠাকুরপুকুরের ধারে বিরিক্ষি বটতলা।ভাদরমাসের রোদ চরা দুপুরে তিনি ক্লান্তি মেটাবার জন্য বটতলায় বসলেন।শরীর মন শীতল হলো ,পুকুরে পদ্মফুল আর পদ্মপাতার   যেন বন লেগেছে।তৃষ্ণা মেটাবার জন্য পুকুরের জল আঁচলা  ভরে পানকরতেই একটা অলৌকিক দৃশ্য দেখে চমকে উঠলেন।একি মায়া না মতিভ্রম।পদ্মফুলের মাঝে এ্কটা আস্ত নারীর মুখমন্ডল। পদ্মের মতোই  সরোবরে ভাসছে ।কাছে যেতেই সেই পদ্মমুখ জলের তলায় ধীরে ধীরে তলিয়ে যায়।তিনি বিশ্বাস অবিশ্বাসের দোলায় দুলতে থাকেন।ভোর রাতে  স্বপন দেখলেন ঃ ওরে হরগোবিন্দ তুই ঠিকই দেখেছিস ।আমি দেবী দুর্গা ।যে রূপে তুই আমাকে দেখেছিস সেই রূপেই কর পূজা।অনুরূপ স্বপ্ন দেখলেন পার্শবর্তী শিবলুন গ্রামের মৃৎশিল্পী গোপাল সূত্রধরের পূর্বপুরুষ।আর সেই শুরু।উভয় বংশ পরম্পরার সহযোগিতায় আজও অনুষ্ঠিত হয়ে চলেছে গোমাইএর জাগ্রতা কাটামুন্ডর পুজো।


সাবেকি আদলে গঙ্গা মৃত্তিকা দিয়ে দেবীর মাতৃমুখ তৈরি হয় শিল্পীর বাড়িতে।ষষ্ঠীর দিন প্রবীণ সেবাইতের সামনে দেবীর চক্ষুদা্নে পর একটি পুরানো তামার টাটে বসিয়ে দেবীমুন্ড নিয়ে আসা হয়  দেবীমন্ডপে।মাথায় ধরা হয় ঐতিয্যবাহী ছাতা।রাস্তায় ছিটানো হয় গঙ্গার জল।এরপর গর্ভমন্দিরে চালি সদৃশ এক কাঠের সিংহাসনে কাটামুন্ড বসিয়ে বেনারসী শাড়ি আর শোলার কলকা দিয়ে সাজানো হয়।পুজো সংশ্লিষ্ঠ সকলেই নির্দিষ্ট ভূমি পেয়েছেন।সপ্তমীর দিন কলা বৌ আনার আগে সেবাইতরা প্রায় দেড়শো ভরি সোনা আর রুপোর গহনা দিয়ে দেবীকে সজ্জিত করেন। দেবী পুজোর দিনে আরতি হয় না ,অন্নভোগও নেই।প্রসাদ শুধুমাত্র নৈবেদ্যে।সপ্তমীতে আখ চাল-কুমড়ো অষ্টমীর সন্ধিপুজোয় বলি হয় নধর কালো পাঁঠা।নবমীতে হয় বিশেষ বলিদানপর্ব। রাতের দিকে তাৎপর্যপূর্ণ  পূর্বপুরুষ পুজো।দশমীর পুজোর বিশেষ আকর্ষণ আবার কুমারীপুজো।দশ বছরের কম বয়স্কা কুমারী মেয়েকে মূলসেবাইত ভান্ডার ঘরে বসিয়ে পুজো করেন।দশমীর দুপুরে দেবীর নিরঞ্জন হয় দেবীপুকুরে। বর্ধমান জেলার আউশগ্রাম থানার জঙ্গলমহলের এক প্রাচীন গ্রাম দেবশালা।এখানে বর্ধমান রাজাদের এক সময় গড়-বাড়ি দুর্গ ছিল।রাজার কর্মচারী ছিলেন কেতুগ্রামের বহরাণ গ্রামের বক্সী সম্প্রদায়।এই উত্তর রাঢ়ীয় কায়স্থরাও মুন্ডমূর্তিতে দেবী দুর্গার পুজো করে থাকেন।এখানেো দেবী দুর্গা কতৃক অসুরকে ছলনা করা ও তাঁর কাটা মুন্ড দেখানোর লোকগল্প প্রচলিত আছে।


এই  লোকশ্রুতিগুলি থেকে একটা ইঙ্গিত বেরিয়ে আসে  ভয়ংকর যুদ্ধ এবং তার ফলে  দেবীর কাটা মুন্ডর কোন ঘটনা। প্রাচীনকালে যুদ্ধে  বিজয়ী বীর পরাজিত শত্রুর মাথা কেটে নিয়ে আসতো।এটাই ছিল দস্তুর,  এটাই যেন  তার বড়ো উপহার।যেমন অনেক পিরের আস্তনার সঙ্গে জড়িয়ে আছে স্থানীয় শাসকশক্তির সঙ্গে মুসলিম গাজির যুদ্ধ এবং তার ফলশ্রুতি স্বরূপ  কাটা মুন্ডর  করুণ কেচ্ছা।ত্রিবেনীর জাফর খাঁর মাজার ,মঙ্গলকোটের অষ্টাদশ আউলিয়ার  মাজারে কান পাতলেই শোনা  যাবে কাটামুন্ডর  কিসসা।দুর্গার মুন্ড মূর্তির পুজো কি এমনি কোন সুপ্রাচীন  যুদ্ধস্মৃতির ইঙ্গিতবাহী?- যেখানে দেবী দুর্গার মহিষাসুর বিজয়ের পরিবর্তে   পরাজয়ের  উলট পুরাণের গপ্পো লুকিয়ে আছে?লুকিয়ে আছে নারী হত্যার কোন করুণ আলেখ্য?কাটামুন্ডপুজোর  স্মৃতি কি তারই কথা বলে ? বিষয়টি নিয়ে ভেবে দেখার প্রয়োজন আছে বৈকি!!


Friday, September 30, 2016


MOHALOY THEKE MOHALOYA


                                    

             মহালয়া কি বাঙালীর বিলীয়মান ইতিহাস চেতনা?




শুভ মহালয়া।পিতৃপক্ষের অবসান।দেবীপক্ষের সূচনা।অমানিশার সমাপ্তি।জ্যোতির্ময়ীর অভ্যুদয়।নীল আকাশে রাশি রাশি পেঁজা তুলো।আলতা ধোয়া রোদ্দুর।হিমের পরশ।কাশের বনে হাওয়ার লুটোপুটি। শিশিরসিক্ত শিউলির সুবাসে স্নিগ্ধ শারদপ্রকৃতি।উদাসী  ভোরের বাওরে ভাসে বীরেন্দ্র ভদ্রের উদাত্ত কণ্ঠের ভোরাই...।আশ্বিনের শারদ প্রাতে ...!বাজলো তোমার আলোর বেণু...। সুর ছুয়ে যায় নদীর তীরে তীরে ,ধানের বনে বনে।মন থই থই পুজো  পুজো গন্ধে।এই একটা ভোরেই বা ঙালী  বিভোর হয়ে থাকে বিলীয়মান বেতারের আকাশবাণীতে।


মহালয়া মানেই শারদোৎসবের কাউন্ট ডাউন শুরু।  মহালয়া মানেই বনেদি বাড়িগুলিতে দেবীর মৃণ্ময়ী থেকে চিন্ময়ী হয়ে উঠার শুভক্ষণ। মহালয়া মানেই ছেলেপুলে নিয়ে  মা দুগগার বাপের বাড়িতে আগমন  উপলক্ষে চূড়ান্ত আয়োজন।হিমালয় তখন মহালয় ছাড়া আর কী!তবে যাই বলুন এই মহালয়া শব্দটির অর্থ বড়ো গোলমেলে।কেউ  কেউ বলেন মহালয়া মানে মহালয়। অর্থাৎ আলয় ছেড়ে তখন মহাপ্রলয়।দেবাসুরের রক্তাক্ত সংগ্রাম বেধেছিল বহুযুগ ধরে।জমে উঠেছিল মৃতদেহের পাহাড়।সেই সব  বেওয়ারিস মৃতদেহর আত্মার শান্তি কামনার জন্যই নাকি এই স্মরণ মূলক আচার অনুষ্ঠানের নাম মহালয়া।আবার কেউ বলেন  এই দিনেই প্রভু রামচন্দ্র অকাল বোধন  মানে  কাঁচা ঘুম ভাঙিয়ে দেবী দুর্গার পুজো করেছিলেন  দশানন রাবনকে বধ করার উদ্দেশে। এই ভয়ংকর যুদ্ধ অনুষঙ্গগুলি বাদ দিলে বাস্তবে দেখা যায় সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্র। মহালয়ার পুণ্যলগনে নদীবক্ষে পিতৃপুরুষদের উদ্দেশে অসংখ্য মানুষের তর্পণ রত জলছবি।সিক্ত বাস।অঞ্জলি বদ্ধ দু হাতে প্রদত্ত পবিত্র নীর।উচ্চারিত মন্ত্রে বিশ্বের সকল প্রাণসত্তার জন্য আকুল শান্তিকামনা।ওঁ শান্তি...।ওঁ শান্তি...।।

তর্পণ শব্দটির অর্থ-- তৃপ্ত করা।পিন্ড আর জলদান করার শাস্ত্রীয় রীতি।মহালয়া তাই এক অর্থে গণ-শ্রাদ্ধানুষ্ঠান।মৃত পূর্বপুরুষদের শ্রদ্ধা সহকারে স্মরণ।মনন ও বিনম্র ভক্তি অর্পণ।হিন্দু পুরাণ অনুসারে মানুষ মারা গেলে যমদূত তার জীবাত্মাটি  নিয়ে যায় স্বর্গ ও মর্ত্যের মাঝামাঝি পিতৃলোকে।এখানেই থাকেন মৃত তিন পুরুষের আত্মা।পিতা পিতামহ ও প্রপিতামহের জীবাত্মা।সূর্য যখন কন্যা রাশিতে প্রবেশ করে অর্থাৎ ভাদ্র পূর্ণিমার পরের দিন থেকে অমাবস্যা পর্যন্ত চলে পিতৃপক্ষ। অবশ্য স্থান ভেদে এর পার্থক্য আছে। যেমন দক্ষিণ আর পশ্চিম ভারতে শুরু হয় গণেশ পুজোর পরের দিন থেকে।উত্তর ভারতে নেপালে  ভাদ্রমাসের পরিবর্তে আশ্বিন মাসের কৃষ্ণপক্ষ হলো এই পিতৃপক্ষ।এই সময়ে পিতৃলোকে বসবাসকারী  আমাদের পূর্বপুরুষরা মর্ত্যলোকে নেমে আসেন।তাঁদের জীবিত উত্তরসূরীদের কাছে প্রার্থনা করেন চির আকাঙ্খিত অন্নজল,পিন্ডোদক।এই কারণে এই পনেরো দিন  চলে শ্রাদ্ধ-তর্পণ-পারলৌকিক কর্মাদি। তবে শেষের দিন ভিড় হয় রেকর্ড।এই অমাবস্যা তাই মহালয়া অমাবস্যা নামে সুপরিচিত। অনেকেই বলেন সর্ব পিতৃ অমাবস্যা।এদিন আমাদের কাছে পিতা স্বর্গ,পিতা ধর্ম। পিতৃপূজার দিন।শাস্ত্রীয় বিশ্বাস  এরপরই সূর্য বৃশ্চিক রাশিতে গমন করে ।শুরু হয় দেবীপক্ষ।
 মহালয়া নিয়ে মহাভারতেও রয়েছে মনোজ্ঞ উপাখ্যান।মহাদানী কর্ণের মহাপ্রয়াণের পর তাঁর স্থান হয়ে ছিল স্বাভাবিক ভাবেই স্বর্গে।সেখানে রাশি রাশি মণি মাণিক্য রত্ন দেখতে পেলেন।কিন্তু পেলেন না এক মুঠো খাবার।স্বর্গের রাজা ইন্দ্রের কাছে জানতে চাইলেন কেন তার সঙ্গে এই স্বর্গীয় প্রবঞ্চনা? ইন্দ্র বললেন---মর্ত্যলোকে  কি পিতৃপুরুষদের উদ্দেশে তর্পণ করেছিলেন মহাদানী কর্ণ?কর্ণ বুঝতে পারলেন তাঁর ভুল।তিনি ইন্দ্রের আদেশে পুনরায় ফিরে গেলেন মর্ত্যে।পিতৃপুরুষদের তর্পণ করে স্বর্গে এসে নিজেও তৃপ্ত হলেন।লোকবিশ্বাস ---এই সময় তর্পণ করলে জীবিত বংশধরেরা ধর্ম-অর্থ-কাম-মোক্ষ এই চতুর্বর্গ ফললাভ করেন।


মহালয়া কোন ভৌত কাহিনী নয়।আবার নিছক গরম ভাতের গপ্পোও নয়।আমাদের সুপ্রাচীন পূর্বপুরুষ পুজোর দৃষ্টান্ত এই  মহালয়া।শিকর সন্ধানের স্নিগ্ধ স্মৃতি।আদিবাসীরা তাদের পূর্বপুরুষদের স্মরণে বীরস্তম্ভ প্রোথিত করতো।জৈন ও বৌদ্ধরা সমাধিগাত্রে স্তম্ভ বা স্তূপ নির্মাণ করতো।হিন্দুরা করেন পূর্বপুরুষদের স্মরণে তর্পণ।মহালয়া তাই এক অর্থে প্রাচীন ইতিহাসকে স্মরণ করা ।যাঁরা অতীত হয়ে গেছেন অথচ যাঁদের দানে আমরা সমৃদ্ধ হচ্ছি,ভোগ করছি যাঁদের সম্পদ --তাঁদেরকে শ্রদ্ধার সঙ্গে   করছি স্মরণ ।মহালয়ার পুণ্য প্রভাতি লগ্নে আবক্ষ গঙ্গায় নিমজ্জিত হয়ে যখন তিল আর গঙ্গাদোক দিয়ে পূর্বপুরুষদের উদ্দেশ্যে শান্তির মন্ত্রোচ্চারণ করি তখন আসলে  স্মরণ করি সেই অনাগত অতীতকে।বিলীয়মান ইতিহাসকে।ঐতিয্য আর পরম্পরাকে।
  সৌজন্য ঃ দক্ষিণবঙ্গের জনপ্রিয় দৈনিক সংবাদ পত্রিকায় প্রকাশিত।



Saturday, September 24, 2016

KONO EK GRAMER KOTHA.......

                                                












                                   কোন এক গাঁয়ের কথা




এপারে খেড়ুয়া আর ও পারে গনফুল।মাঝখানে বহে যায় দূরন্ত অজয়।অবিশ্যি তার দূরন্তপনা ঝুপঝুপিয়ে বৃষ্টি আসার ক'টা দিন মাত্র!তারপরে ঘাপটি মেরে গুটিয়ে যাওয়া যেন  একখান সাপ।  ভরা খরানিতে চোখ যায় যদ্দূর--ধূ ধূ বালুচর। নিকোনো উঠোনের মতো তকতকে।জলের চিহ্নটুকু নেই। তবে হ্যাঁ--অনেকটা বালি খুঁড়লে খানিক বাদে ভেসে ওঠে কাঁচ কাঁচ পানি।ঠিক যেন আয়না।ইতিউতি সোঁতার বালি ফুঁড়ে গজিয়ে উঠেছে  একপোঁচ কুশের জঙ্গল। এদিকে শুধু লরি আর ট্রাকটরের কালো ধোঁয়া ছাড়ার প্রতিযোগিতা। প্রাগৈতিহাসিক জন্তুর মতো নাছোড় গর্জন ছেড়ে দিনরাত অজয়ের বুক চিঁড়ে চলাচল।মাঝ নদিতে মেশিনে কাটা হচ্ছে বালির ডাঁই।সেই বালি লোড হয়ে লরির পর লরি  ছোটে শিং ভাঙা গোরুর মতো। ছুটে যাচ্ছে নদিয়া হুগলি হাওড়ার পথে পথে।-সিন্ডিকেট সাম্রাজ্যে।এই হলো গিয়ে খেড়ুয়ার বালিঘাটের বারোমাস্যা।

ব্যাতিক্রম সকলকেই ছুঁয়ে যায়।বাদ যায় না খেড়ুয়ার বালিঘাটও।গত জুন মাসে গভীর রাতে বালি কাটতে গিয়ে তলা থেকে উঠে এলো দুটো পাথরের মূর্তি।বালির কুয়োতে চান করাতেই দেখা গেল--জোড়া বিষ্ণুমূর্তি।কালো কষ্টি পাথরে খোদিত। পাল-সেন আমলের প্রচল বিগ্রহ।ততক্ষণে রাতের আঁধার কেটে পুবাকাশে আলোর আভা ছড়িয়ে পড়ছে।কিন্তু ক্ষতি যা হবার  তা হয়ে গেছে।একটি মূর্তি প্রায় অক্ষত থাকলেও যন্ত্রের ধারালো ব্লেড অপরটির নাক ,বুক একেবারে চেঁচে দিয়ে সমান করে দিয়েছে।পরের ঘটনা বাংলা টিভি সিরিয়ালের চিত্রনাট্য। আপনাদের জানা।সকালে যথারীতি পুলিশ আসবে।গ্রামবাসীরা ততক্ষণ ঢাক ঢোল -কাঁসর ঘণ্টা বাজিয়ে পুজো শুরু করে দেবে।রাস্তায় রাস্তায় টাকা -পয়সার তোলা -- তোলা হবে। পুজো আর মন্দির তৈরির জন্য।ছুঁচ হয়ে ঢুকে পড়বে স্থানীয় রাজনীতি।প্রশাসন মূর্তি উদ্ধার করতে গেলেই ফাল হয়ে হয়ে বেরিয়ে আসবে উন্মত্ত জনতা।খেড়ুয়ার ক্ষেত্রেও যে এর ব্যতিক্রম ঘটেনি তা বলাই বাহুল্য!

খেড়ুয়া কাটোয়া মহকুমার মঙ্গলকোট থানার যাকে বলে অতি প্রাচীন অজ গাঁ।অজয়ের ধার ঘেঁসে বসতি।প্রাচীনকাল থেকেই নদিপথে সহজ যোগাযোগ,পলি মাখা খেতে পর্যাপ্ত ফসল,সেই সংগে নদির মাছ ইত্যাদি অজয় যেমন দু হাত ভরে খেড়ুয়াকে দিয়েছে, বিনিময়ে গত পঞ্চাশ বছর ধরে অজগর সাপের মতো একটু একটু করে গ্রামের খেত,বাঁশঝাড়,মন্দির,বাস্তুভিটে জমিদার বাড়ি,  চাটুজ্জ্যেদের মনসাতলা-- সবমিলিয়ে গাঁয়ের  আদ্দেকটা গিলে নিয়েছে।অধিকাংশ গ্রামবাসীর হাসি-কান্না-সুখ-দুঃখ-কোলাহল-তুলসীমঞ্চ-শয়ন কক্ষ অজয়ের বানে বিলীন হয়ে স্তব্ধ এক ইতিকথা ।শুধু একটি উল্লেখযোগ্য  জীর্ণ ফাটল ধরা দালান রীতির বৈষ্ণব মন্দির অজয়ের রক্ত চক্ষুকে উপেক্ষা করে অক্টোপাশের মতো  আজও আটকে রেখেছে  এক বিরিক্ষি বটগাছ তার ঝুরির মায়াবি বাঁধনে। যথাস্থানে তার কথা শোনানো হবে।বাকি গ্রামবাসীরা ভিটে হারিয়ে এককিমি দূরে উঁচুডাঙায় বেঁধেছে নতুন করে আস্তানা।কালক্রমে জনপদ গজিয়ে ঊঠে নামকরণ হয়েছে নতুনখেঁড়ো।আর পুরাতন খেঁড়োতে রয়ে গেছে অজয়ের কোলের সন্তান--- অন্ত্যজ সম্প্রদায়েরা। তারাই মাথায় করে তুলে এনেছে  একদা বামুন-কায়েতদের পূজিত ভগবান বিষ্ণুকে।

 খেড়ুয়া স্থান-নামটির একাধিক অর্থ।কেউ বলেন খড়।গেঁয়ো উচ্চারণে খ্যাড়। লোকগানে রয়েছে -"হিঁদুদের দুগগা পুজো।ভ্যাতোরে খ্যাড়ের গুঁজো।আবার নদির চরায় পর্যাপ্ত ফলে ক্ষীরা।দারুন সুস্বাদু এক সব্জি।গ্রাম্য উচ্চারণে এরই নাম খেঁরো। এর থেকেও স্থাননামটি হতে পারে হয়তো।খেড়ু মানে অশ্লীল হাসি ঠাট্টার চুটকি জাতীয় গানের নাম।এর থেকেও আসতে পারে।তবে ক্ষেত্রসমীক্ষায় দেখা গেছে--খেড়ুয়া গ্রামের সঙ্গে খড় বা ক্ষীরার  ঘনিষ্ঠ সমপর্ক থাকলেও খেড়ুগানের কোন যোগ নেই।একসময় খেড়ুয়া গ্রামে নীলকুঠি ছিল।ইংরেজ কুঠিয়াল নীলচাষ করে বেশ পসার জমিয়েছিলেন।কিন্তু অজয়ের হড়পা বানে তিনিও নাকি পগার পার। এখন শুধু কুঠিরপুকুর বা মাঠের স্থাননামে ক্ষীণ স্মৃতিটুকু আটকে। আজও রয়েছে গ্রাম্য দেবতা ক্ষেত্রপাল।আষাঢ় নবমীতে বেশ জাঁক করে পুজো হতো।পাঁঠা চোট হতো ঘরে ঘরে।আত্মীয়-কুটুমরা আসতো।এখন হয় নমো নমো করে।ধর্মরাজ পুজোয় তোড়জোড় বেশ ভালো।তবে নামু খেঁড়োর চেয়ে উপর খেঁড়োতেই সরেস।

 এবার আসি মন্দির কথায়। মোঘল আমলে একবার বঙ্গেশ্বর হয়েছিলেন অম্বরের রাজা মানসিংহ।তাঁর আমলে যে কয়জন বাংলার ভুঁইয়া বা জমিদার মোঘল শাসন না মানার হিম্মত দেখিয়েছিলেন তাদের  মধ্যে যশোরের রাজা প্রতাপাদিত্য অন্যতম।মানসিংহ বৈষ্ণব ধর্মের প্রবল অনুরাগী হলে কি হবে রাজকার্যে শাক্তের থেকেও শক্ত।তাই প্রতাপাদিত্যকে চরম শাস্তি দিয়ে হরণ করে নিয়ে গেলেন যশোরের রাজবাড়ির কুলদেবতা রাধামধবের দারুবিগ্রহ আর যশোরেশ্বরী কালীকে।অম্বরের রাজমন্দিরে প্রতিষ্ঠিত হলো অপূর্ব শৃঙ্গার রসাত্মক চার ফুটের অধিক উচ্চতা বিশিষ্ট দারু বিগ্রহ রাধা-মাধব।তারপর গঙ্গা দিয়ে বয়ে গেল অনেক জল।
শ্রীচৈতন্যদেবের দোসর প্রভুনিত্যানন্দ বিয়ে থা করে সংসার পাতলেন।যথা সময়ে দুই সন্তানের জনক হয়ে উঠলেন।বীররভদ্র গোঁসাই আর মেয়ে গঙ্গা।মেয়ের বিয়ে হলো কাটোয়ার কাছে গঙ্গাতীরের নলিয়াপুরের কবি দ্বিজ মাধবের সঙ্গে। গঙ্গা-মাধবের সন্তান প্রেমানন্দের আরাধ্য সেই মা গঙ্গাই।তিনি যেদিন স্বর্গধামে গেলেন প্রেমানন্দ হয়ে গেলেন অনাথ।জীবনদেবতার সন্ধানে তিনি পাগলের মতো ঘুরতে শুরু করলেন সারা ভারতবর্ষ।কোথাও পেলেন না শান্তি।মনের আরাম।ঘুরতে ঘুরতে একদিন পৌঁছে গেলেন অম্বরের রাজমন্দিরে। কিন্তু একি দেখলেন! যাঁকে তিনি খুঁজে বেড়াচ্ছেন -----যিনি চেতনে -অচেতনে -মননে -স্মরণে -বিস্মরণে -শয়নে স্বপনে চির জাগরুক সেই যুগলতনু তাঁর সামনে।প্রেমানন্দ আর প্রেমের আনন্দে স্থির থাকতে পারলে না ।লুটিয়ে পড়লেন রাধা-মাধবের চরণতলে।তাঁর প্রেম-সমাধি ভঙ্গ হলো রাজবাড়ির লোকেদের সেবা শুষ্রূষায়।রাজবাড়ির লোকজন   প্রভু নিত্যানন্দের দৌহিত্রকে দেখতে পেয়ে আনন্দে ভক্তিতে গদগদ হয়ে উঠলেন

।তাঁরা করজোড়ে বললেন----আমাদের পরম সৌভাগ্য আপনি এখানে পদার্পণ করেছেন।আদেশ করুন প্রভু-কি চাই আপনার?

-----আমার চাই-রাধামাধব!
---কিন্তু এ যে রাজার ঠাকুর!রাজসেবা! আপনার পক্ষে কি সম্ভব?
---সবই সম্ভব যদি প্রভু কৃপা করেন।

রাজবাড়ির লোকেরা সম্মত হয়ে রাধামাধবকে দান করলেন প্রেমানন্দকে।তিনি গঙ্গাপথে রাধামাধব নিয়ে উঠলেন শাঁখাইএর এক জগন্নাথ মন্দিরে।কিন্তু ইতিহাসের ইঙ্গিত  অন্যদিকে।রাজস্থানের বৈষ্ণবধর্ম ছিল মূলত স্বকীয় পন্থার।রাধামাধব পরকীয়া বিগ্রহ।পরবর্তীকালে জয়পুরের রাজা সেহাই জয় সিংহএর সভাপন্ডিত ছিলেন কেশব ভট্টাচার্য।তিনি স্বকীয়া পন্থীর হয়ে পরকীয়াবাদীদের পরাজিত করেছিলেন।যদিও শেষপর্যন্ত তিনি পরাজিত হয়েছিলেন পরকীয়াবাদী পন্ডিত কবি রাধামোহন ঠাকুরের কাছে।সে কারণে রাজবাড়ির লোকেরা রাধামধবের প্রকৃত সেবাইত প্রেমানন্দকে নির্বাচিত করে তাঁকেই মূর্তি দান করেছিলেন।প্রেমানন্দের জ্যেষ্ঠপুত্র খেড়ুয়াগ্রামে বসবাস করতে থাকেন।সেই সূত্রে এই গ্রামে বর্ধমান রাজাদের ও শিষ্যদের অর্থানুকূল্যে খেড়ুয়া গ্রামে টেরাকোটা অলঙ্করণ সমৃদ্ধ এক নাটমন্দিরসহ দালান মন্দির গড়ে ওঠে।রাধামাধব শুধু সেবাইত  গোঁসাইদের ঠাকুর নন;সময়ান্তরে হয়ে ওঠেন এলাকার প্রাণের ঠাকুর।বছরে প্রায় মাসখানিক থাকেন রাধামাধব- জগন্নাথ খেড়ুয়াতে.১৮ ই চৈত্র থেকে ২৫ শে বৈশাখ।মেলা বসতো।অজয়ের দুপারে র গ্রামের মানুষজন আসতো কাতারে কাতারে।কীর্তনগানে নামসংকীর্তনে আর মানুষের বন্যায় ছাপিয়ে যেত।কিন্তু অজয়ের দু-কুল প্লাবী বন্যায় একদিন দেবতার মন্দির হয়ে গেল শূন্য।মানুষের সঙ্গে রাধামাধব উঠলেন নতুন খেঁড়োতে।

খেড়ুয়ার ইতিকথার নটেগাছ মুড়োতে এখনো বাকি আছে।বহুকাল আগে থেকেই এ গ্রামে প্রবাহিত হয়েছে  পৌরাণিকবৈষ্ণবধর্মের ফল্গুধারা।বছর বিশেক আগেই অজয়ের দহে চান করতে গিয়ে গ্রামবাসীরা জল থেকে তুলে আনে চার ফুটের অধিক  উচ্চতার  পাল-সেন যুগের এক অপূর্ব বিষ্ণু মূর্তি। সে মূর্তি রয়েছে পুরনো খেঁড়োর মৌলীতলয়ায়।তারপর গত জুন মাসে পাওয়া গেল আরও দুটি বিষ্ণুবিগ্রহ।বিষয়টি নিয়ে আলোচনার দাবি রাখে।
হিন্দুদের ত্রিদেবতা ব্রহ্মা বিষ্ণু ও মহেশ্বর।বিষ্ণু জগৎপালক দেবতা।বিষ্ণু শব্দটির অর্থ-- বিশ্ব ব্যাপক,বিশ্বপ্রবেশক।বৈদিক সাহিত্যে দ্যু স্থানের প্রধান সৌরদেবতা ।পরবর্তীকালে ব্রাহ্মণ জাতীয় গ্রন্থাবলী ও উপনিষদে বর্ণিত জলদেবতা নারায়ণ এবং আরও পরবর্তী কালে মহাভারত পুরাণাদির দেবায়িত বাসুদেব -কৃষ্ণের সঙ্গে বিষ্ণু মিলে মিশে একাকার হয়ে যায়।একেবারে গোড়ার দিকে বিষ্ণু নয়;কৃষ্ণের মূর্তি পুজো শুরু হয়েছিল বৃহত্তর ভারতবর্ষে বীরপুজোর মধ্য দিয়ে ।প্রথমে চালু হয়েছিল কৃষ্ণ বলরামের পুজো।পরে যাদব পরিবারের আরও দুই প্রজন্মের বীর নায়ক যথা প্রদুম্ন্য-শাম্ব ও অনিরুদ্ধকে নিয়ে পঞ্চবীরের উপাসনা হিন্দু সমাজে ক্রমশ  জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।কালক্রমে বিষ্ণু উপাসকরা নানা দলে ও উপদলে বিভক্ত হয়ে পড়েন।যেমন ভাগবত,একান্তিক, বৈষ্ণব ইত্যাদি।বৈষ্ণব শব্দটির প্রথম উল্লেখ মেলে পঞ্চম শতকের দ্রহসেন ও ব্যাঘ্রসেনের শিলালিপিতে।তবে এগুলির মধ্যে বিষ্ণু উপাসনায় পাঞ্চরাত্র দর্শনই ক্রমশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এবং পূর্বভারতে বিশেষ করে গাঙ্গেয় বাংলায় একসময়  এই মতবাদ দারুণ ভাবে ছড়িয়ে পড়ে।

  পাঞ্চরাত্রর মতবাদে 'পর-বাসুদেব"--হলেন সর্বশক্তিমান ঈশ্বর।এই পরবাসুদেবের মধ্যে রয়েছে ছয়টি গুণ যথা--জ্ঞান,শক্তি,বল,ঐশ্বর্য,বীরত্ব আর তেজ-নির্দোষ।পরবাসুদেব কোন ব্যক্তি নন। মূলত নিরাকার একটা আইডিয়া।তবে ভক্তের আকুল-ব্যাকুল ডাকে তিনি সাকার হন।তখন তিনি বূহ্য অর্থাৎ এক শরীর থেকে আরেক শরীরে রূপান্তরিত হন।চতুর্বূহ্য থেকে কালক্রমে বিষ্ণুর ২৪ প্রকার রূপ দেখা যায়।বাসুদেব থেকে  তৈরি হয় কেশব নারায়ণ ও মাধব।সংকর্ষণ থেকে হয় গোবিন্দ বিষ্ণু মধুদূদন।প্রদ্যুম্ন থেকে জন্ম নেয় ত্রিবিক্রম বামন শ্রীধর ।অনিরুদ্ধ থেকে উদভব হয়  হৃষিকেশ পদ্মনাভ ও দামোদর ইত্যাদি ।ভাস্কর্যের ক্ষেত্রে  এই ২৪ ধরনের বিষ্ণু মূর্তির পার্থক্য দেখানো হয়েছে শুধু মাত্র শংখ,চক্র গদা পদ্ম --এই চারটি আয়ুধ লাঞ্ছনের হস্তান্তর ঘটিয়ে।

আনুমাণিক অষ্টম শতকে রচিত বৈখানসাগম গ্রন্থ থেকে জানা যায় যোগ সাধনায় সিদ্ধিলাভ ,ব্যক্তিগত শৌর্য-বীর্য লাভ,সাংসারিক কামনা বাসনা  পূরণ ও শত্রুর ক্ষতিসাধন ---এই চার ধরনের উদ্দেশ্য পূরণ করার জন্য  চার প্রুকার বিষ্ণুমূর্তি পুজো করা হতো।তাদের নাম যথা ১.যোগবিষ্ণু ২.ভোগবিষ্ণু ৩.বীরবিষ্ণু ৪.আভিচারিক বিষ্ণু।প্রতিটি মূর্তি আবার গঠনের দিক থেকে তিন রীতির যথা ---স্থানক,আসন ও শয়ান রীতির।সহায়ক মূর্তি নিয়ে আর একটি শ্রেণী বিভাগ আছে যেমন নির্ধারিত সহায়ক মূর্তির সমাহার থাকলে "উত্তম"।কম থাকলে "মধ্যম"।আর আদৌ না থাকলে "অধম"।অজয় গর্ভ থেকে প্রাপ্ত তিনটি মূর্তি ভোগবিষ্ণু ও স্থানক রীতির এবং মধ্যম শ্রেণীভুক্ত  প্রস্তর বিগ্রহ।কালো কষ্ঠিপাথরে খোদিত।ব্যবহার করা হয়েছে হাই রিলিফ পদ্ধতি।ত্রি-মাত্রিক ফর্ম দেওয়ার জন্য বিষ্ণুর বগল থেকে দু পাশ দিয়ে পা পর্যন্ত পাথর কেটে বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে।আকৃতি ঠিক ভি- সাইজের।অধিকাংশই ত্রি বা পঞ্চরথাকৃতি।পাদপীঠে খোদিত দু পাশে উৎকটাসনে উপবিষ্ট  এবং দু হাত অঞ্জলিবদ্ধ পূজক মুনি ও ভক্ত।পাদপীঠের মাঝ বরাবর পদ্মের মৃণাল।আসনটি স্বাভাবিকভাবেই ওই দ্বিদল প্রস্ফূটিত পদ্মের।বিষ্ণুর দুপাশে লক্ষ্মী সরস্বতী সহ দুই পরিচারিকার।পৃষ্ঠপটে খোদিত আরও দুটি পদ্মমৃণাল উঠে গেছে বিষ্ণুর দু হাতে


চূড়ায় দেখা যায় একটি কাল্পনিক পশু মুখ।এরই নাম কীর্তিমুখ।চোখ দুটি গোল গোল।নাসারন্ধ্র ফোলানো। ।পরবর্তীকালে এই কীর্তিমুখ পাল-সেনযুগের প্রস্তরভাস্কর্যের অন্যতম অলংকরণের  বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। মূর্তির পিছনে থাকে চালি বা পৃষ্ঠপট।গবেষকদের মতে পৃষ্ঠপট পরিকল্পনায় একটি দার্শনিক প্রত্যয় কাজ করেছে।পট বা চালি  যেন স্বর্গ-মর্ত্য- পাতালের ইঙ্গিতবাহী।নীচে জলসহ পাদপীঠ যেন মর্ত্যভূমির প্রতীক।ভক্তদম্পতি বা পূজক মুনি যার প্রতিনিধি।দেবদেবীর মূর্তিসহ পিছনের চালি হলো আকাশের প্রতীক।আর চালির চূড়া হলো মহাশূণ্যের ইঙ্গিতবাহী।এইভাবেই শিল্পী একখন্ড পাথরের বুকে ফুটিয়ে তুলেছেন সীমা থেকে অসীমের ব্যঞ্জনা। বিষেশজ্ঞরা আরও আনুমান করেছেন এই চালির সূচনা ব্যাপ্তি ও পরিণতি পালযুগে।প্রথমদিকে দেব-দেবীর মাথার পশ্চাতে যে গোলাকার প্রভামন্ডল ছিল তা উপরে ও নীচে প্রসারিত হয়ে পট বা চালিতে পরিণত হয়েছে।
                                                   অজয় গর্ভ থেকে প্রাপ্ত অক্ষতপ্রায় প্রথম  মূর্তির উচ্চতা তিন ফুট।অপর মূর্তিটির উচ্চতা প্রায় পৌনে তিন ফুট। দুটি মূর্তি একই ধরনের।চালির উপরি ভাগে সুগঠিত কীর্তিমুখ।দুপাশে বিদ্যাধর ও বিদ্যাধরী।তাদের পায়ের উপরে বসে আছে আরো এক জোড়া মূর্তি।চালির  প্রান্তে কিন্নর কিন্নরী গণধরেরা রয়েছে।অলঙ্করণ হিসাবে সিংহ হাতির মোটিফ ব্যবহৃত হয়েছে।বিষ্ণু সমপাদস্থানিক ভঙ্গিমায় দন্ডায়মান। তাঁর দু পাশে লক্ষ্মী ও সরস্বতী। বিষ্ণুর উপরের ডানহাতে গদা বাম হাতে চক্র  নিচের বাম হাতে শঙ্খ আর ডানহাতে পদ্ম।বিষেশজ্ঞদের মতে মূর্তি দুটি ভোগবিষ্ণু ও ত্রিবিক্রম রূপের।পাকা রাস্তার ধারে অস্থায়ী শিব মন্দিরে পুজো শুরু হয়ে গেছে বিষ্ণুদ্বয়ের।লোক-জন আসছেন।প্রণামী পড়ছে ভালোই।

ফিরতি পথে ভাবছিলাম-- দেশের জাতীয় সম্পত্তি মূল্যবান এই মূর্তিগুলি কি গ্রামে রাখা যুক্তিসঙ্গত?নবাবিস্কৃত এই মূর্তিগুলি নিয়ে গ্রামবাসীদের এই আবেগ উন্মাদনাতো ক'দিনের মধ্যেই ভাটা পড়বে।গ্রামে গ্রামে ক্ষেত্রসমীক্ষা করতে গিয়ে দেখি এইতো বাস্তব চিত্র! ভক্তির নেশা ছুটে গেলে মূর্তি পড়ে থাকে সম্পূর্ণ অরক্ষিত অবপ্সথায় ---মূর্তিচোরেদের অপেক্ষায়।এখন যেমনটি পড়ে রয়েছে নিরাপত্তাহীন এক কুড়েঘরে বছর বিশেক আগে অজয় গর্ভ থেকে প্রাপ্ত বড়ো বিষ্ণুমূর্তিটি।সেখানটা বড়োই নির্জন!!                                                          

 সৌজন্য একদিন পত্রিকায় প্রকাশিত

Wednesday, September 21, 2016

SAAT AANAR SINGHABAHINI DURGA

         কা-গ্রামের সাত আনার সিংহবাহিনী পুজোঃ ঘরের মেয়ে থেকে   রণরঙ্গিনী দুর্গা

    

                     



বাংলার জমিদারি প্রথার সঙ্গে যে দেবী ওতোপ্রতো ভাবে জড়িত--নিঃসন্দেহে দুর্গতিনাশিনী দুর্গা। সন্দেহ নেই--বনেদি বাড়ির দুর্গোৎসবের বারোয়ানাই জমিদারি। যেমন মুর্শিদাবাদ জেলার সালার থানার কা-গ্রামের সাত আনার জমিদারবাড়ির দুর্গাপুজো। এখনো রীতিমত বিখ্যাত।জমিদারি আড়ম্বরে,জাঁকজমকে,ব্যতিক্রমী নিয়ম-নিষ্ঠায় ব্যনার্জিও চ্যাটার্জি বাড়ির এই পারিবারিকপুজো জেলাস্তরেও বহুল চর্চিত।সাবেকি আদলে গড়া এক চালির প্রতিমা  সাত আনার দুর্গা।  ।রথের দিন দেবীর গায়ে মাটি পড়ে।পুরুষানুক্রমে প্রতিমা গড়ে আসছেন ব্রাহ্মণশিল্পী।ডাক সাজে অলঙ্কৃত করেন পাঁচুন্দির মালাকারশিল্পীরা।

বোধনের দিন থেকেই দেবীপুজোর উদবোধন।ঘটস্থাপন করে শুভ সূচনা।সকালেই পুজো শুরু।দুপুরে চিরাচরিত অন্নভোগ।ঘরের মেয়ে উমার জন্য ঘরোয়া পদাবলি;শাক-শব্জি-ভাজা আর চাটনি।সাঁজে বাজে ঢোলের মিঠি বাদন।সঙ্গে  শীতলারতি।চতুর্থিতে পুজোনির্ঘণ্টে পরিবর্তন।ঢাক ঢোল বাজিয়ে আসে চতুর্থীঠাকরুনের ঘট।ঘরের মেয়ে উমা ক্রমশ রণরঙ্গিনী দুর্গাতে পরিবর্তিত হতে থাকেন।দেবীর পাদপীঠে রাখা হয় জমিদারবাড়ির সেকেলে সব বলিদানের  খড়্গ-বগি-খাঁড়া।সপ্তমী অষ্টমীতে ছাগবলির পাশাপাশি আখ কুমড়ো বলি দিয়ে দেবীকে বৃথাই  তৃপ্ত করার চেষ্টা।কেননা নবমীর দুপুর থেকে দেবীপ্রাঙ্গণ যেন রক্ত ঝরা রণাঙ্গন। উদ্দাম বাজনার সঙ্গে পশুদের শেষ  ব্যাকুল আর্তনাদ। ভক্তদের ভয়ার্ত কণ্ঠের মাতৃবন্দনার সঙ্গে রক্তের ফোয়ারায় বধ্যভূমি রঞ্জিত ।ছাগ ,মেষ ইত্যাদির সঙ্গে মোষ বলিতে ঘরের মেয়ে উমা তখন  মহিষাসুর মর্দিনী দেবী দুর্গা। বিজয়া দশমীর প্রাতেও সাত আনার দুর্গাতলা ষোল আনা রণভূমি ।গ্রাম্যদেবী কঙ্কচন্ডীকে নিয়ে আসা হয় দেবীর কাছে।কানা খোঁড়া পাঁঠা বলি দিয়ে দেবীকে তৃপ্ত করা হয়।।দশমীর দুপুরে অপরাজিতার পুজো দিয়ে গ্রামবাসীরা দেবীর কাছে করজোরে প্রাথর্না জানায়ঃআসছে বছর আবার এসো্‌......।

Friday, July 29, 2016

Saturday, July 23, 2016

BIRVUMER ITANDA SHUDHU MANDIR-GRAM NOY;OITIHASIK GANA-AVYUTHANER EK DURJAY GHATI


















                          বীরভূমের ইটান্ডা শুধু মন্দিরগ্রাম নয় 

                                             ঐতিহাসিক              

                                         গণ-অভ্যুত্থানের                        

                                          এক দুর্জয় ঘাঁটি

ইটান্ডার গৌরব হাড়কাটা জোড়-বাংলা কালীমন্দির

 

                                       সাদামাটা গন্ডগ্রাম ইটান্ডা।যদিও টেরাকোটা মন্দিরপ্রেমীদের কাছে এক অতিপরিচিত নাম। কেননা বীরভূম জেলার একমাত্র জোড়-বাংলা কালী মন্দিরটি এই গ্রামেই আছে।রয়েছে আরও কয়েকটি দৃষ্টিনন্দন টেরাকোটা সুউচ্চ শৈবমন্দির। সংস্কারের অভাবে সেগুলির দশা বার্ধক্যের শেষপ্রান্তে । তবে ইটান্ডা শুধু শিব বা কালীর বসতভূমি নয়;যাকে বলে বাণিজ্যে বসতি লক্ষ্মী। একসময় বীরভূমের বিকিকিনির বিরাট বিপণন কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল গ্রামটি ।



অজয় তীরবর্তী ইটান্ডাতে শুধু ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাণিজ্য করেনি।অতি প্রাচীন কাল থেকেই এক আন্তর্জাতিক জমজমাট বাণিজ্যকেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল।পিতল-কাঁসার তৈজসপত্রাদি,লৌহজাত হরেক কিসিমের দ্রব্য,গালার তৈরি নানান সামগ্রী, রেশম-গাড়া বস্ত্র ইত্যাদি কাটোয়ার গঞ্জ -বাজার হয়ে গঙ্গা আর সমুদ্র পথে ভিন দেশে পাড়ি জমাত।ইটান্ডায় ভিড় করতো দেশি বিদেশি সওদাগরেরা।কাঁচা টাকা উড়ে বেড়াতো।অর্থ প্রাচুর্যে গড়ে উঠেছিল প্রচুর অট্টালিকা-সৌধ।দেবায়তন। বিলাস বৈভব ভোগ-সম্ভোগে  সমৃদ্ধ এক অলিখিত  ইতিহাস।তারপর কালান্তরের ঝড়ো হাওয়ায় একে একে নিভিল দেউটি।

                                      বীরভূমের দক্ষিণ-পূর্ব সীমান্তে ইটান্ডা।বোলপুর থেকে দূরত্ব মেরেকেটে ২০ কিমি।বাহিরি  নিমতলা বাসস্ট্যান্ড থেকে খাড়া দক্ষিণে। সাত থেকে আট কিমি পিচ রাস্ত পেরিয়ে সবুজবনকে পিছনে ফেলে ইটান্ডায় প্রবেশ করবেন।গ্রামের পূর্বদিকে  চলে গেছে  আঁকাবাঁকা পাকা রাস্তা।পশ্চিমে গোলাম ঘাট।উত্তরে কানা অজয়নদি।এখন স্থির জলাশয়।অতীতে এই শাখা খাতেও অজয় প্রবাহিত হতো। বেশ কয়েক কিলোমিটার প্রবাহিত হয়ে বাসাপাড়ার কাছে গিয়ে মূল অজয়ে মিশতো।বর্তমানে অজয় বহে যাচ্ছে দক্ষিণ দিকে ।ইটান্ডার কোল ঘেঁষে।গ্রামের জনসংখ্যা হাজার তিনিকের বেশী হবে না।সব ধরনের জনজাতির বসবাস।জীবিকা সেই মান্ধাতার আমলের চাষ-বাস।ইদানিং জীবন জীবিকার প্রয়োজনে অনেকে ভিন প্রদেশে পাড়ি জমিয়েছে।
অজয়ের স্থীর জলে......

কেউ কেউ বলেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাণিজ্য করার সূত্রে গাঁয়ের এমন অদ্ভুত নাম। ইস্ট ইন্ডিয়া এই শব্দ দুটির বিকৃত উচ্চারণে ইটান্ডা।প্রসঙ্গত স্মরণ করা যেতে পারে ১৭৮২ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজ বেনিয়া জন চিপ এই গ্রামে নীলকুঠী স্থাপন করে নীলচাষ  শুরু করেছিলেন এবং তারপর থেকে বীরভূম জেলার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে নীলচাষের প্রসার ঘটেছিল।লালমাটির বীরভূমকে নীলচাষের খেত খামার বানিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। বরিষ্ঠ বীরভূম গবেষক সিদ্ধেশ্বর মুখোপাধ্যায় ভিন্ন মত পোষণ করেন।তাঁর মতে দুই নদির মধ্যবর্তী অংশকে বলে টান্ডা।ইটান্ডার দক্ষিণে ও উত্তরে অজয় নদি। মধ্যেকার ঊর্বর ভূভাগেই গড়ে উঠেছে প্রাচীন জনপদটি।এই কারণে গ্রামের নাম হয়েছিল টান্ডা।আর ইস্কুল আস্পর্ধা ইত্যাদি শব্দের মতোই  আদিতে স্বরাগমের ফলে টান্ডা বেড়ে হয়েছে ইটান্ডা।
দশমহাবিদ্যার এক বিদ্যা

ইটান্ডার পঞ্চচূড়া মন্দির
গ্রামে দুটি বাসস্ট্যান্ড।।রথতলা বাসস্ট্যান্ডে নামলে  নজরে আসবে কেশবাঈ চন্ডীতলা।ফাঁকা চত্ত্বর।একটা বহুকালের পুরনো জরাজীর্ণ মন্দির।তার গর্ভ ভেদ করে প্রকান্ড একটা  ঝাঁকরা গাছ মাথা তুলে দাঁড়িয়ে। লোকশ্রুতি অনুসারে এখানে সতীর কেশ অর্থাৎ চুল পড়েছিল।এটি সতীর উপপীঠ।আগে দেবীর প্রস্তর মূর্তি ছিল।একসময় সেটিও চুরি হয়ে যায়।এখন বিগ্রহ শূন্য মন্দির।তবে নিত্য পূজা হয়।১লা বৈশাখ দেবীর বিশেষ উৎসব।জামাই ষষ্ঠির পরের দিন  বাৎসরিক পূজো ।গ্রাম ষোল আনা অংশ গ্রহণ করে।ইটান্ডায় যখন বাণিজ্য প্রসিদ্ধি ছিল তুঙ্গে তখন স্থানীয় গন্ধবণিকরা কেশবাঈতলায় আসতেন। যাত্রাসিদ্ধিদেবতার বিষেশ পুজো দিতেন।তারপর গৃহদেবতার পুজো সেরে অজয়ের বুকে ময়ূরপঙ্খি নৌকা ভাসিয়ে দূর সমদ্রে বাণিজ্যযাত্রা শুরু ।দুর্গাপুজোর বিজয়াদশমীর রাত্রে বিসর্জনের পূর্বে এলাকার  দেবী প্রতিমাগুলি সার দিয়ে কেশবাঈচন্ডীতলায় নামানো হতো।মেলা বসতো। জমে উঠতো গান বাজনার মেঠোআসর। বাজনদারদেরমধ্যে চলতো প্রতিযোগিতা।তারপর রাত করে দুর্গা মাঈকি জয় বলে অজয়ের দহে দেবীদের জলশয়ান।সে সময়  ইটান্ডার জমিদার ছিলেন গ্রামের সিংহ পরিবার। বৈষ্ণব ধর্মে দিক্ষীত। তাঁরা শুরু করেছিলেন এক ঐতিয্যবাহী রথযাত্রা।রথের দিনে সিংহবাড়ি থেকে বলরাম সুভদ্রা জগন্নাথ আসতেন।পিতলের রথে গ্রাম প্রদক্ষিণ হতো। মেলা বসতো।জিলিপি পাঁপড়ভাজার গন্ধে, খোল খঞ্জনি কাঁসরের একটানা বাজনার ছন্দে  আষাঢ়ের ভেজা পরিবেশ তখন  আরও রসায়িত।এখন শুধু নামেই রথতলা।গ্রামের সিংহবাড়ি যেমন ভেঙে পড়েছে,হারিয়ে ফেলেছে তার অতীত গৌরব জৌলুস তেমনি তাঁদের জগন্নাথ মন্দিরও ভগ্নস্তূপে পরিণত হয়েছে।


                      ইটান্ডার গ্রামের অন্যতম পুরাকীর্তি জোড় বাংলামন্দিরটি। বীরভূম জেলায় এর দ্বিতীয় উদাহরণটি নেই।এই মন্দিরটির জন্য ইটান্ডার খ্যাতি দেশ-বিদেশে।একসময় মন্দিরটি বলতে গেলে ভেঙে পড়েছিল।অনেক মূল্যবান টেরাকোটা ফলক নষ্ট হয়ে গিয়েছিল।Indian National Trust For Art And Cultural Heritage সংক্ষেপে INTACH  র উদ্যোগে নতুন করে সংস্কার হয়েছে।বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গ পুরাত্তত্ব সর্বেক্ষণ দ্বারা অধিগৃহীত।গ্রামবাসীদের মতে এখানে পূর্বে শ্মশান ছিল।পাশে বাস করতেন গ্রামের মুচি সম্প্রদায়ের হাড়কাটা গোষ্ঠীরা। মৃত পশুর হাড়, শিং প্রভৃতি কেটে খোদাই করে চিরুনি গলার মালার পুঁতি ও নানা ধরনের শৌখিন জিনিষ বানাতো তারা।সেগুলি স্থানীয় বাজারে বিক্রয় করতো।এরাই প্রতিষ্ঠা করেছিলেন শ্মশানকালী।মন্দিরটির প্রতিষ্ঠাতা তারাই।লোকে এখনো এই কালীমন্দিরকে হাড়কাটা বা হঠকা কালী মন্দির বলে থাকেন।অনেকে আবার বলেন হাড়কাটারা পেশায়  দুর্ধুষ ডাকাত ছিল ।ডাকাতি করতে যাওয়ার আগে এই শ্মশান প্রান্তরে কালীভজনা করতো।অঢেল ডাকাতির পয়সা খরচ করে এই মন্দির গড়ে উঠেছিল।অনেকেই আবার বলেছেন উনিশ শতকের গোড়ার দিকে পোর্তুগিজ বণিকরা নাকি এই মন্দিরের প্রথম সংস্কার করেছিলেন।কলকাতার বউবাজারের  পোর্তুগিজ কবিয়াল এন্টনি ফিরিঙ্গির স্মৃতি সম্বলিত ফিরিঙ্গিকালীবাড়ি রয়েছে ।ইটান্ডার এই মন্দিরটিও অনুরূপ বীরভূমের একমাত্র ফিরিঙ্গিকালীবাড়ি!

শ্রীধর মন্দির

পাইনদের রেখদেউল
  এই মন্দির নিঃসন্দেহে উনিশ শতকের।টেরাকোটা ফলকগুলিতে রামায়ণ মহাভারত পুরাণ ও তৎকালীন সামাজিক রাজনৈতিক জীবনের  খন্ডচিত্রগুলি ধরা পড়েছে শিল্পদের নিপুণ হাতে।বেস প্যানেলে ফলকগুলির মধ্যে উল্লেখ্য হলো কামান বন্দুক নিয়ে নৌযুদ্ধের দৃশ্য।সিংহ শিকারের ছবি ইত্যাদি।বেস প্যানেলের উপরে রয়েছে সৈন্যদের রুট মার্চ,সেকালের অভিজাতদের চিত্র।ওয়াল প্যানেলে দশাবতার ও দশমহাবিদ্যামূর্তি খোদিত হয়েছে যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো কূর্মাবতার মৎস্যাবতার ইত্যাদি।কার্নিশ ফলকে রাবণের সীতাহরণ,জটায়ু কর্তৃক বাধাদান ।অন্যদিকে সূর্যের রথ আটকাচ্ছে হনুমান এমন সব পৌরাণিক দৃশ্যাবলী।মন্দিরে কৌণিক ভাস্কর্য বিশেষ প্রসংসার দাবী রাখে।গবেষকদের মতে কৌণিক ভাস্কর্য মূলত উলম্ব রেখায়  খোদিত শিবসেনা ও কালীসেনার যুদ্ধ দৃশ্যের সিরিজ।রথের দারু ভাস্কর্য থেকে এগুলি টেরাকোটার মন্দিরে অলংকরণ হিসাবে ব্যবহৃত হতে থাকে ।অনেকে  অলঙ্করণের বিশেষ মোটিফ পদ্মলতা বা পত্রলতার সাদৃশ্যে একে মৃত্যুলতা বলেছেন।


সিংহদের পরিত্যক্ত শৈব মন্দির
    ইটান্ডার বাজার পাড়ায় রয়েছে গন্ধবণিকদের বিখ্যাত তিনটি মন্দির।দক্ষিণমুখো রেখদেউল।মন্দিরের প্রতিষ্ঠালিপি থেকে জানা যায় প্রতিষ্ঠাতা গদাধর পাইন।১৮১৫ খ্রিষ্টাব্দে বা বাংলা ১২২২ সালে মন্দিরটি স্থাপিত হয়।গর্ভগৃহে রয়েছে  তিনফুট উচ্চতা বিশিষ্ট কালো রঙের শিবলিঙ্গ।পাইনরা তাঁতি সম্প্রদায়ের। বস্ত্র ব্যবসা করে ধনী হয়ে উঠেছিলেন।মন্দিরে প্রাত্যহিক শিবের পুজো ছাড়াও শিবের গাজনে বেশ ধূমধাম হয়।১৯৪৪ সালে মন্দিরটি সংস্কার করা হয়েছিল।সংস্কার করেছিলেন সুভাষচন্দ্র পাইন। মন্দিরে টেরাকোটা প্যানেলের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো বিষ্ণুর দশাবতার ফলক ।এছাড়া আর্চ প্যানেলে রাধাকৃষ্ণের রাসনৃত্য খোদিত হয়েছে।



বামন আবতার
দ্বিতীয় মন্দির পঞ্চরত্ন শৈবমন্দির।প্রায় চল্লিশ ফুট উচ্চ।এই মন্দিরটির প্রতিষ্ঠাতা একসময়ের ইটান্ডার বিখ্যাত বণিক রাসানন্দ সাধু।ইনি কাঁসা পিতলের ব্যবসাদার ছিলেন।মন্দির প্রতিষ্ঠাকাল ১২৩৫ সাল।অর্থাৎ ইংরেজি ১৮২৮ খ্রিষ্টাব্দ।সাধুদের বর্তমান প্রজন্মের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল রাসানন্দের পিতা গোপাল।পিতামহ কাশীরাম।রাসানন্দের পুত্রের নাম হরিচরণ।তস্য পুত্র রামচরণ।এই মন্দিরের টেরাকোটা অলংকরণ অতীব দৃষ্টিনন্দন।ত্রিস্তরীয় আর্চ প্যানেলে রামচন্দ্রের সভাদৃশ্য খোদিত হয়েছে ।দশাবতারের বেশকিছু ফলক রয়েছে।এছারা সাই্ড প্যানেলে শাড়িপরিহিতা কালী ,ষড়ভুজ গৌরাঙ্গ,শিশু কৃষ্ণকে নিয়ে পুতনা ,কীর্তিমুখ প্রভৃতি ফলক ।মন্দিরের বর্তমান অবস্থা আদৌ ভালো নয়।সংস্কারের আশু প্রয়োজন।অবিলম্বে পশ্চিমবঙ্গ পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ কর্তৃক অধিগ্রহণ করা উচিৎ।

                              সাধু পরিবারের আর একটি মন্দির দেখার মতো।বিষ্ণু বা শ্রীধর মন্দির।শোনা যায় রাসানন্দের কন্যা বা বিধবা ভগ্নি নাকি এই মন্দিরটি স্থাপনা করেছিলেন।তিনি  একবার বৃদাবন গিয়েছিলেন।সেখান থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে ইটান্ডায় এসে সর্বস্ব খরচ করে এই দ্বিতল মন্দিরটি তৈরি করেন।দেখে মনে হবে কোন জমিদার বাড়ি।দ্বিতলে শ্রীধরের গর্ভগৃহ।অলংকৃত দেওয়াল,প্রতিটি স্থানই পঙ্খ ও স্টাকোর কাছে সমৃদ্ধ।ভূমিকম্পের ফলে মন্দিরটির বিরাট ক্ষতি হয়ে গেছে।দোতালায় উঠতে গেলে ভয় লাগে।মনে হয় যেকোন সময় যেন গোটা মন্দিরটি ভেঙে পড়বে।শ্রীধরের দোল উপলক্ষে দোল উৎসব হয়।গ্রামের সর্দারপাড়ার মোড়ে একটি আটচালা শৈব মন্দির রয়েছে।সিংহ দের জমিদারবাড়ির মতোই তাদের শিবের চালা মন্দিরটির অবস্থা বড়ো করুণ।একরকম ভেঙে পড়েছে বললেই চলে। এ বিষয়ে শুধু গ্রামবাসীদের উদাসীনতাকেই দায়ি করা যায় না;অজয়নদির বন্যার ফলে পুরাকীর্তি ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে।বর্তমানে ইটান্ডার মুখ্য উৎসব ধর্মরাজ পুজো।আষাঢ় পুর্ণিমায় অনুষ্ঠিত হয়।সেবাইত গ্রামের মাল সম্প্রদায়।

রামায়ণ ফলক
      ইটান্ডা শুধু মন্দির পুরাকীর্তির গ্রাম নয়;বর্গিহাঙ্গামার সঙ্গে জড়িয়ে এর নাম।১৭৪২  থেকে ১৭৫১ সাল।এক দশকেই চার বার মারাঠা লুঠেরা বর্গিরা বাংলাদেশ আক্রমণ করে ছারখার করে দিয়েছিল। লুঠ-পাট,নারী ধর্ষণ,হত্যা-প্রতিহত্যায় কায়েম হয়েছিল সন্ত্রাস বিভীষিকা।অসংখ্য লোক বর্গিহাঙ্গামার শিকার ।দলে দলে মানুষ গ্রাম ছেড়েছিল একটু বাঁচার আশায়।বীরভূমের কেঁদুয়া ডাঙায় সুপুরের কোর্টের ডাঙায় এরা ঘাঁটি গেড়েছিল।ইটান্ডাতেও বর্গিহাঙ্গামা হয়েছিল।সেই সময়ে ইটান্ডার জমিদার ছিলেন পাঠান জোড়াল খাঁ।তিনি বর্গিহাঙ্গামার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন।সাধারণ মানুষকে একত্রিত করে গণ আন্দোলনের সূচনা করেছিলেন।


   ইটান্ডার বাজারপাড়া পেরিয়ে খানিকটা গেলেই মুসলিম জনবসতি--গড়পাড়া।দক্ষিণ দিকে কিছুটা দূরেই বয়ে চলেছে অজয় নদি।এখানেই ছিল জমিদার জোড়ালখাঁয়ের গড়বাটি।এখন পুরোপুরি জঙ্গল।বাঁশ বন।বুজে যাওয়া গড়খাত।শোনা যায় জোড়াল খাঁয়ের গড়বাটিতে বড়ো বড়ো চারটে গেট ছিল।ভিতরে ছিল মসজিদ।এখনো মসজিদের ধ্বংশাবশেষ দেখা যায়।মসজিদের পাশে বালা শহিদের মাজার।পূর্বে মাঘ মাসের শেষে উরস পালিত হতো।এখন নাম কা ওয়াস্তে হয়।কথিত আছে জোড়াল খাঁ'রা চিলেন সাত ভাই।রাজ খাঁ,বিজলি খাঁ,করাত খাঁ,গুমরো খাঁ,বাদল খাঁ প্রমুখ।জোড়াল খাঁ এক হিন্দুর ছেলেকে মানুষ করেছিলেন।সেও অসাধারণ বলশালী ছিল।একবারে ষোল সের দুধ পান করতে পারতো।এরাই সমবেত ভাবে বর্গিহানার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল। অস্ত্র বলতে বড়ো বড়ো মাটির বাঁটুল।গুলতির সাহায্যে সজোরে নিক্ষেপ করে শত্রু পক্ষকে ঘায়েল করত।


  বর্গিরা ইটান্ডার বাজার লুঠ করতে এলে গ্রামবাসীরা জোড়াল খানের গড় বাটিতে এসে আশ্রয় নিত।গ্রামের ঘর বাড়ি লুঠ করলেও বর্গিরা  খালি হাতে ফিরে যেতে বাধ্য হতো।এইভাবে পর পর তিনবার ইটান্ডা লুঠ হলে জোড়াল খাঁ তার ভাইদের সঙ্গে যুক্তি করে সামনা সামনি যুদ্ধ করার প্রস্তুতি শুরু করলো।তাঁর জমিদারির নিম্ন বর্গের জোয়ান ছেলেদের তালিম দিলেন-- লাঠি চালানোয় অস্ত্র ধারণে।এবার বর্গিরা আসতেই জোড়াল খাঁ'য়ের নেতৃত্বে ইটান্ডাবাসীরা ঝাঁপিয়ে পড়লো বর্গিদের উপর।তারা পরাজিত হয়ে ফিরে যেতে বাধ্য হয়েছিল। জয় হয়েছিল মানুষের সঙ্ঘ শক্তির ,গণ অভ্যুত্থানের।ইটান্ডা হয়ে উঠেছিল গণ অভ্যুত্থানের এক দুর্জয় ঘাঁটি।

জয় মানুষের জয়!!!!!!!!!!!!!!!!!!!



দক্ষিণবঙ্গের অন্যতম জনপ্রিয় পত্রিকা সংবাদে প্রকাশিত

                    

PROTNO-SAMRAT

https://thekoulal.wordpress.com কৌলাল ওয়েবসাইটেও পড়তে পারেন।আর দেখতে পারেন মনের মতো ছবি।                                              ...