ভারতীয় চীনাদের খোঁজে: কলকাতার এক বিস্মৃত অধ্যায়!
প্রথম পর্ব
টেরিটি বাজারের ফুটপাতে
গরমভাতের থালা হাতে
ডা.তিলক পুরকায়স্থ
চন্দ্র বর্ষের প্রথম দিনটি সারা পৃথিবীতে চীনা নববর্ষ হিসাবে চিহ্নিত।এই উৎসবকে বসন্ত উৎসব বা স্প্রিং ফেস্টিভ্যাল ও বলা হয়।এবছর নববর্ষ পড়েছিল ১৬ ই ফেব্রুয়ারি, শুক্রবার।সেদিন সারা পৃথিবীর মতন কলকাতার ক্ষয়িষ্ণু চীনা সম্প্রদায়ের লোকজন চায়না টাউন- টেরিটি বাজার এবং ট্যাংড়াতে মহা ধুমধামের সঙ্গে এই দিনটি পালন করে। এই উৎসব চলবে মাসাধিক কাল ধরে, শেষ হবে মার্চ মাসের ১৮ তারিখ।
তাই চলুন আমরাও বেরিয়ে পড়ি ইন্ডিয়ান চাইনিজ দের সঙ্গে মোলাকাত করতে কলকাতার চীনে পাড়ায়।পরিচয় করি আমাদেরই এক প্রাচীন প্রতিবেশীদের সঙ্গে, যাদের আমরা আমাদের স্বভাব সিদ্ধ অহঙ্কারে না চেনার, না জানার ভান করে দূরে সরিয়ে রেখেছি। অথচ বিস্মিত হয়ে দেখবেন যে অধিকাংশ চীনারা আমাদের আদব কায়দা, আহার বিহার আত্মস্থ তো করেছেই, দুর্গা পূজা, কালী পুজোতেও তাঁরা সানন্দে যোগদান করছেন।প্রায় সবাই নিজেদের ভাষার সঙ্গে অনর্গল হিন্দি, বাংলা বলেন।নতুন প্রজন্ম তো হিন্দিতেই বেশি স্বচ্ছন্দ।তাহলে আমরা কেন এমন উন্নাসিক, চীন ভারত নরম- গরম সম্পর্কের জন্য এই নিরীহ,(অধিকাংশই) গরিব লোকগুলোকে কেন দায়ী করি, কেন এদের দূরে সরিয়ে রাখি?
কিন্তু পরিস্থিতি তো আগে এমন ছিল না।৩০/৪০ দশকে যখন ভারত ব্রিটিশের অধীন এবং চীন জাপানের অধীন, তখনকার সামাজিক অবস্থান নিয়ে একটি অসাধারণ মানবিক মূল্যবোধ সম্পন্ন উপন্যাস লেখেন পদ্মভূষণ মহাদেবী ভার্মা, যার চিত্ররূপ দেন মৃনাল সেন।১৯৫৯ সালে মুক্তি পাওয়া সেই অসাধারণ বই " নীল আকাশের নিচে" , এখনো আমাদের হৃদয় মুচড়ে দেয়, চোখের পাতা সিক্ত হয়ে ওঠে চীনা ফেরিওয়ালা ওয়াং লু এবং তীব্র সাজাত্যবোধের অধিকারিণী বাঙালি গৃহবধূ বাসন্তীর অভিনয়ে অনবদ্য মানবিক অনুভূতির প্রকাশ দেখতে দেখতে।
অথচ আশ্চর্য লাগে, এই সিনেমাকেও সেযুগের রাজনৈতিক অধিকারীরা বেশ কিছুদিন ব্যান করে রেখেছিল। শুধু তাই নয় এই রাজনৈতিক কর্তারা ১৯৬২ সালে চীন- ভারত যুদ্ধের সময় অসংখ্য নিরীহ, সাধারণ, ছাপোষা ভারতীয় চীনাদের কোনো কারণ না দর্শিয়ে নির্বাসনে পাঠান, ব্রিটিশ জমানার কুখ্যাত রাজস্থানের দেউলি ক্যাম্পে, যার সিংহভাগ ছিল বয়স্ক এবং শিশুরা।১৯৬৭ সাল অবধি বিনা বিচারে, বিনা চার্জে এদের বন্দী করে রাখা হয়, যার বৃহৎ সংখ্যক আর ফিরে আসেননি।সেই দুঃখে, গ্লানিতে বেশিরভাগ ভারতীয় চীনা, খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করে, খ্রিস্টান নাম নিয়ে, এদেশ ত্যাগ করে ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, আমেরিকা পাড়ি দেন, তাই বর্তমানে ইন্ডিয়ান চাইনিজ জনসংখ্যা অত্যন্ত কমে গেছে।
কোন কথা থেকে কোথায় চলে এলাম। শুরু করেছিলাম চীনা নববর্ষ দিয়ে। চীনা নববর্ষে প্রতি বছর এক একটি রাশির প্রতীক হিসাবে এক একটি জীব ঘুরে ফিরে আসে।যেমন এই বছরটি হচ্ছে 'ইয়ার অফ দা ডগ'।সামনের বছর নববর্ষের দিন পড়বে, ৫ ই ফেব্রুয়ারিতে, সেটি হবে ' ইয়ার অফ দা পিগ'।
এবার একটু পিছন ফিরে ইতিহাসের দিকে তাকাই।ফা হিয়েন সম্ভবত প্রথম চীনা নাগরিক যিনি সম্রাট অশোকের সময় ভারতে আসেন তাম্রলিপ্ত বন্দর দিয়ে।এর পর আসেন বৌদ্ধ ভিক্ষু , পন্ডিত এবং পরিব্রাজক হিউয়েন সাং সম্ভবত ৬৩০ খ্রিস্টাব্দে কাশ্মীর দিয়ে।
এরপর আসি আধুনিক যুগে।জব চার্নক কলকাতায় এলেন ১৬৯০ সালে।এর পরে প্রায় ৯০ বছর পরে ১৭৭৮ সালে যে চৈনিক ভদ্রলোক প্রথম ভারতবর্ষের মাটিতে, সঠিকভাবে বললে বজবজ জেটিতে পা দিলেন তিনি টাং আছিও।এই টাং আছিও ছিলেন কোওয়াং- টুং বা ক্যান্টনের চায়ের ব্যবসাদার।ভারতে বাণিজ্য বৃদ্ধির লক্ষ্যে তিনি আসেন, সঙ্গে নিয়ে আসেন কিছু চীনা শ্রমিক এবং ক্যান্টনের বিখ্যাত ইংরেজ ব্যবসায়ী জেমস ফ্লিন্টনের একটি সুপাারিশ পত্র।দেখা করেন গভর্নর জেনারেল লর্ড হেস্টিংস এর সঙ্গে।ফ্লিন্টনের সুপারিশ পত্র আর চীনা চায়ের স্বাদ-গন্ধে হেস্টিংস সাহেব তো বেজায় খুশি।সঙ্গে সঙ্গে বজবজের গঙ্গার ধারে ৬৫০ বিঘা জমির বরাদ্দ করলেন আছিওর জন্য। শর্ত দিলেন এই জমিতে আখের চাষ এবং সুগার মিল তৈরি করতে হবে।তখন এই বিস্তীর্ণ এলাকার মালিক বর্ধমানের মহারাজা।গভর্নর এর হুকুমে তিনি ৬৫০ বিঘা জমির পাট্টা দিলেন টাং আছিও কে, বাৎসরিক ৪৫ টাকা খাজনার বিনিময়ে।
আছিও চীন দেশে ফিরে গিয়ে আরো ১১০ জন চীনা শ্রমিককে নিয়ে এসে, ১৭৭৮ সালেই শুরু করেন আখের চাষ।সুগার মিল তৈরি করতে লাগে তিন বছর।এরপর ১৭৮১ সাল থেকে শুরু হয় ভারতবর্ষের প্রথম সুগার মিল।বাংলা ভাষায়ও নতুন শব্দ জুড়ে যায়-চীনা মালিকের তৈরি সুগারের নামকরণ হয় "চিনি"।অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক যে কারখানা চালু হবার দু বছরের মধ্যেই ১৭৮৩ সালে আছিও সাহেবের মৃত্যু হয়।কিন্তু ততদিনে আছিও সাহেবের নামে বজবজের কাছে এই জায়গাটির নাম হয়ে গেছে " অছিপুর"।
এরপর আমরা যাচ্ছি টেরিটিবাজারের চায়না টাউন এ।আবার পরে ফিরে আসবো অছিপুর।গল্ফ গ্রীন থেকে বেড়িয়ে সকাল সাতটার মধ্যে পৌঁছেছি সানইয়াত সেন স্ট্রিট, টেরিটিবাজার। পেটে ছুঁচোর ডন বৈঠক চলছে।কুছ পরোয়া নেহি! পৌঁছে গেছি স্বর্গের রন্ধন শিল্পীদের ঠিকানায়।
আপনারা কতজন জানেন জানিনা, বিশুদ্ধ, অতি উত্তম ঘরোয়া চীনা প্রাতরাশের স্বর্গ হচ্ছে টেরিটিবাজার এবং ট্যাংড়ার কালীমন্দির সংলগ্ন এলাকা।এখানে ঘরে প্রস্তুত চীনা খাবার, অথেন্টিক চীনা মশলা দিয়ে তৈরি করে ঘরের গিন্নিরা যে চৈনিক প্রাতরাশ পরিবেশন করেন, ভূ ভারতে এর তুলনা নেই।চৈনিক রন্ধনকে কেবলমাত্র উদরপূর্তির খোরাক হিসাবে দেখলে সেটি হবে নিতান্ত মূর্খের চিন্তা।চৈনিক রন্ধন প্রণালী নিজেই বিশ্ব বিখ্যাত।এখানের খাবারের স্বাদ যে শুধু ফাটাফাটি তাই নয়, দামের দিক থেকেও কমের দিকে।ঘুরে ঘুরে প্রথমে দেখে নিলাম কি কি খাদ্যবস্তু পাওয়া যাচ্ছে।বলা যেতে পারে কি পাওয়া যাচ্ছে না! মাথা খারাপ হবার যোগাড়।মোমো ই কত রকমের- ফ্রাইড মোমো, স্টিম মোমো,পরক ফ্রাইড মোমো, পরক স্টিম মোমো। পরিচিত আইটেম ফিস সুইমাই বা ডাম্পলিং এর সঙ্গে আছে ভেজ ডাম্পলিং, প্রন ডাম্পলিং।একটি আইটেমে পেট ভরাতে হলে পাবেন রেড মিট পাও(ছোট) এবং ঝাই পাও(বড়)।এখানে শেষ নয়- আছে চিকেন অনটন, মিট বল, ফিস বল, পরক বল স্যুপ।চমৎকার ঘরে তৈরি পনির বা টফু নিয়ে এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক বসে আছেন।নিতে পারেন মেই কো পান(রাইস পুডিং)। এক শিশি তেলে ডোবানো সর্ষে শাক বা হামছই নিয়ে নিলাম, ঘরে গিয়ে দেখবো ডাক্তারনি কি বানান এটা দিয়ে!পর্যবেক্ষণ হয়ে গেলে খেতে বসলাম এক থালা ধোঁয়া ওঠা আতপ চালের ভাত ও চীনা সসেজ লাপচিয়ং দিয়ে।পাশেই দাঁড়িয়ে খাবার ব্যবস্থা আছে।এই লাপচিয়ং এর এত নাম আগে শুনেছি যে, ভেবেই এসেছিলাম, গরম ভাত আর লাপচিয়ং খেতেই হবে।স্বাদগ্রন্থি গুলিতে যে অপূর্ব শিহরণ খেলে গেল, যে অসাধারণ আবেশে চোখ প্রায় বুজে আসছিল, সেখানে নিঃসন্দেহে চায়না টাউনের গরম ভাত ও লাপচিয়ং এর মিশ্রণকে রসনার মহাকাব্য বলা যায়।
তথ্যসূত্র: Interment of Chinese Indians- Wikipedia
Https://en.m.wikipedia.org>wiki>Interment
ডা: তিলক পুরকায়স্থ ,CEQ 2/3, CENTRAL HOSPITAL KALLA, ASANSOL 713340.
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের MBBS, MD, মুখ্যত চিকিৎসক, কেন্দ্রীয় সংস্থার উৎকৃষ্ট চিকিৎসা সেবা পদক, লাইফ টাইম আচিভমেন্ট আওয়ার্ড ইত্যাদি প্রাপ্ত।নেশায় ভ্রামনিক , ফটোগ্রাফার এবং শখের লেখক।
মেলা চলছে মানে একদিন ঘুরে আসবই। দারুন
ReplyDeleteঅসাধরণ এই লেখাটির জন্য কৌলালের তরফ থেকে লেখককে ধন্যবাদ।
ReplyDeleteThis comment has been removed by the author.
ReplyDeleteলেখাটি খুব ভালো লেগেছে, কারণ মূল্যবান তথ্যের সঙ্গে লেখক কিছু কিছু অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক ও মানবিক প্রশ্ন পেশ করেছেন। যেমন -
ReplyDelete< শুধু তাই নয় এই রাজনৈতিক কর্তারা ১৯৬২ সালে চীন- ভারত যুদ্ধের সময় অসংখ্য নিরীহ, সাধারণ, ছাপোষা ভারতীয় চীনাদের কোনো কারণ না দর্শিয়ে নির্বাসনে পাঠান, ব্রিটিশ জমানার কুখ্যাত রাজস্থানের দেউলি ক্যাম্পে, যার সিংহভাগ ছিল বয়স্ক এবং শিশুরা।১৯৬৭ সাল অবধি বিনা বিচারে, বিনা চার্জে এদের বন্দী করে রাখা হয়, যার বৃহৎ সংখ্যক আর ফিরে আসেননি।সেই দুঃখে, গ্লানিতে বেশিরভাগ ভারতীয় চীনা, খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করে, খ্রিস্টান নাম নিয়ে, এদেশ ত্যাগ করে ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, আমেরিকা পাড়ি দেন, তাই বর্তমানে ইন্ডিয়ান চাইনিজ জনসংখ্যা অত্যন্ত কমে গেছে।>
১৯৬২ সালের যুদ্ধের সময় ও তার পরে শান্তিনিকেতনের 'আশ্রমিক'-রা চীনাভবনের তান-সাহেবকে যেভাবে সামাজিক হেনস্তা করেছিলেন, তা আমি নিজে প্রত্যক্ষ করেছি। তৎকালে তান-সাহেবের বাড়িতে কেউ রেডিও চালালে এইসব নিম্নমানের মানুষরা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করতেন, তান-সাহেব নাকি চীনের হয়ে গুপ্তচরবৃত্তি করছেন! তান-দম্পতি ও তাঁদের সন্তানদের যেন একঘরে করা হয়েছিল!
লেখক এবং কৌলাল-কে ধন্যবাদ জানালাম।
ধন্যবাদ
Deleteঋদ্ধ হলাম । কলকাতায় থেকেও কোনদিন সেখানে যাবার সৌভাগ্য হয় নি । এবার অবশ্যই যেতে হবে ।
ReplyDeleteধন্যবাদ
Delete