আমদের ওয়েবসাইটে পড়ুন--https://wordpress.com/view/thekoulal.wordpress.com
বিশ্ব-ইতিহাস ও লোকসংস্কৃতি
ভারতীয় চীনাদের খোঁজে: কলকাতার এক বিস্মৃত অধ্যায়!
দ্বিতীয় পর্ব : মানুষ যখন দেবতা।
ডা: তিলক পুরকায়স্থ
সান ইয়াৎ সেন স্ট্রীটের ভোর বাজারের ফুটপাথে ভরপেট প্রাতরাশ খেয়ে পেট ও দিল, দুটিই ভরপুর খুশ। স্থানীয় বাজারে আরো কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করলাম, কিছু ছবি তোলা হলো।এরপর চললাম স্থানীয় দর্শনীয় স্থানগুলো দেখতে।দর্শনীয় স্থান বলতে দেখলাম, চীনাদের ঘরদোর গুলি নববর্ষ উপলক্ষে কাগজের মালা, বেলুন এবং চীনা লণ্ঠন দিয়ে সাজিয়েছে। বেলুন, লণ্ঠন সব লাল রঙের।আশ্চর্য হয়ে যেতে হয় যে টেরিটিবাজার, চায়না টাউনের মতন ছোট জায়গাতেও নয় নয় করে বর্তমানে সর্বমোট ছটি চীনা মন্দির বা উপাসনা স্থল আছে।চীন বা চীনা বলতেই আমাদের মানস পটে উঠে আসে বর্তমানের সমৃদ্ধশালী লাল চীনের ছবি, যেখানে ধর্ম এখনও একান্তই ব্যক্তিগত স্তরে পালিত হয়। সেখানে কলকাতায় এত চীনা মন্দির কেন ? টেরিটিবাজার ছাড়াও পূর্ব কলকাতার ট্যাংরাতে চীনা মন্দির আছে, এমন কি চীনা কালী মন্দির ও দেখা যায়।এত মন্দিরের কারণ কি?
এই বিষয়টি নিয়ে চমৎকার বিশ্লেষণ করলেন টুং
অন চার্চে উপস্থিত এক প্রাজ্ঞ, সৌম্য বয়স্ক চীনা ভদ্রলোক।
লাল চীনের জনসাধারণের মানসিকতার সঙ্গে ভারতীয় চীনাদের মানসিকতার অনেক ফারাক আছে, যেটা একান্তই স্বাভাবিক।এ দেশের চীনারা সেই সব অভিবাসীদের বংশোদ্ভূত যারা ছিলেন কৃষি শ্রমিক, ছুতোর মিস্ত্রি, জুতো তৈরির মিস্ত্রি ইত্যাদি, অর্থাৎ সমাজের খেটে খাওয়া নিম্নবিত্ত মানুষ।পেটের দায়ে বিদেশে এলেও তাঁরা সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন তাঁদের নিজস্ব সংস্কৃতি, ধর্ম, পৌরাণিক গাঁথা, বিশ্বাস, তাঁদের নিজস্ব দেব দেবী ইত্যাদি।
সুবৃহৎ চিনদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আগত অভিবাসীরা নিজেদের প্রথা মতন দৈনন্দিন জীবনযাপন থেকে দেব-দেবীর পূজা, সবই করতেন।যেহেতু এখনও ভারতীয়রা, চীনাদের সেভাবে আপন করে নেয়নি, তাই নতুন প্রজন্মও বাপ ঠাকুর্দার প্রচলিত মত ও পথ আরো জোরে আঁকড়ে আছে।খ্রিস্টান দের সঙ্গে, বৌদ্ধ ধর্মে , কনফুসিও ধর্মে, তাও ধর্মে বিশ্বাসী মানুষ, সব মিলে মিশে একাকার।
প্রথম দিকের চীনা অভিবাসীদের বৃহৎ অংশই এসেছিল ক্যান্টন থেকে, কারণ প্রথম পুরুষ টং আছিও ক্যান্টনিজ ছিলেন।তাই টেরিটিবাজারের বর্তমান চীনাদের বৃহৎ অংশই সেই ক্যান্টনিজদের বংশোদ্ভূত। আর অনেকে এসেছিল ফুজিয়ান প্রদেশ থেকে, যাঁরা সাধারণত হাক্কা নামে পরিচিত ছিল।ক্যান্টনিজ ভাষায় হাক্কা অর্থ বিদেশী, অর্থাৎ বোঝা যাচ্ছে যে বর্তমান ভারতের মতনই সেই সময় চীনাদের মধ্যেও, প্রদেশে প্রদেশে জনসাধারণের মধ্যে বিভেদ বিদ্যমান ছিল।
দীপাঞ্জন ঘোষের লেখাতে পাচ্ছি- টং আছিও র মৃত্যুর পরে চীনারা প্রথমে ধর্মতলার নিকটে কসাইটোলা এবং তার পরে বৌবাজারের কাছে টেরিটিবাজারে এসে বসতি গড়ে তোলেন। পত্তন হয় চীনাপট্টির , বর্তমানের চায়না টাউন। ক্যান্টনিজরা মুখ্যত শুরু করে হোটেল/ রেস্টুরেন্টের ব্যবসা। হাক্কা সম্প্রদায় কাঠের ব্যাবসা এবং জুতোর দোকান খুলে বসে। সাংহাই থেকে আগত অভিবাসীরা কাপড় এবং লন্ড্রির ব্যাবসায় চলে যায়।আর হুপে বলে একটি সম্প্রদায়,চাইনিজ ডেন্টিস্ট হয়ে বসে যায়, হয়তো চীন দেশেও তাঁরা এই ব্যবসা করতো।আর এক বৃহৎ সংখ্যক চীনা চর্ম জাত ব্যাবসার সঙ্গে যুক্ত ছিল। এই চর্ম দ্রব্য ব্যাবসার কারণেই পরে এনারা পূর্ব কলকাতার ট্যাংরায় উঠে যান এবং কলকাতার দ্বিতীয় চায়না টাউন গড়ে ওঠে।উল্লেখযোগ্য যে প্রতিটি সম্প্রদায়ের নিজস্ব ক্লাব এবং চার্চ অর্থাৎ মন্দির ছিল যদিও সেই প্রাচীন মন্দিরগুলি খুঁজে পাইনি।বর্তমানের মন্দিরগুলি ঊনিশ শতকের শেষ থেকে বিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে তৈরি।
কলকাতার চীনা সংস্কৃতির আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক দেখতে পাচ্ছি, উৎসবাদি থেকে ঘর সাজানো, সবকিছুতেই চড়া রঙের ব্যাবহার।এই ব্যাপারটি নিয়ে অনেককেই প্রশ্ন করেছিলাম যার মধ্যে অন্যতম নিউ মার্কেটের 'জিমিস' রেস্টুরেন্টের প্রাক্তন শেফ , বর্তমানে টেরিটিবাজার জি হিং চার্চ এবং ক্লাবের সদস্য এবং ভারতীয় চীনাদের উন্নতি এবং বিভিন্ন চ্যারিটেবল কাজে যুক্ত ৭২ বছরের টগবগে, ঝরঝরে বাংলা বলা যুবক টনি লো।এনাদের কাছ থেকে যতদূর জেনেছি, আপনাদের অবগত করছি।
লাল রঙের ব্যবহার সর্বাধিক দেখা যায় কারণ জীবনের প্রতীক রক্তের বর্ণ গাঢ় লাল।এজন্যই চীনা নববর্ষে বাড়ি ঘর, চীনা লণ্ঠন, কাগজের শিকল, বেলুন, চীনা ভাষায় লেখা অভিনন্দন বার্তা সব লালে লাল।এই লাল রঙের সঙ্গে লাল চীনের কোনো সম্পর্ক নেই।ঝাউ রাজতন্ত্রের প্রতীক হিসেবে লাল রঙকে ধরা হয়।আরেকটা কথা, একটি প্রাচীন বিশ্বাস যে চৈনিক অপদেবতা " নিয়ান" নাকি লাল রঙ সহ্য করতে পারে না।তাই অপদেবতা তাড়াতে ঘরদোর লাল রঙের হয়, যেভাবে আমরা কুলো/ঝাড়ু ইত্যাদি ঘরের সামনে টাঙিয়ে রাখি, সেরকমই আরকি!
লাল যদি শুভ হয় তবে নীল রং হচ্ছে অশুভ এবং ভূত প্রেতের প্রতীক।অবশ্য নীল নয়না সুন্দরীদের এই লিস্টে রাখা হয় কিনা জানিনা!সাদা রংকে পবিত্রতা বলে ধরা হয়। আবার মৃত্যুর প্রতীক ও সাদা রং। আমরাও তো মৃত্যুর পরসাদা শাড়ি বা কোরা ধুতি পড়ি।কালো রং জীবনদাতা জলের প্রতীক।সবচেয়ে পবিত্র রঙ হলুদ বা সোনালী। হলুদ রঙ ধরিত্রীর প্রতীক।রাজকীয় ঘরবাড়ির ছাদ হলুদ রঙের হয়।
এই দেখুন, কথা হচ্ছিল মন্দির আর ধর্ম নিয়ে, আর কোথায় চলে গেছি।হ্যাঁ, যে কথা বলছিলাম- তাও ধর্মের সঙ্গে হিন্দু ধর্মের বেশ মিল আছে।হিন্দু ধর্মের মতন ঠাকুর দেবতা, স্বর্গ মর্ত, সবই আছে, আমাদেরই ধর্ম বিশ্বাসের মতন তাও ঠাকুর দেবতারাও কেবল স্বর্গে থাকেন।
গৌতম বুদ্ধ ছাড়াও অনেক দেবতা আছেন যেমন চিকিৎসার দেবতা বাওসেং দাদি, যোদ্ধা দেবতা গুয়ান ইউ, মেঘ ও বৃষ্টির দেবতা চীনা ড্রাগন, আমাদের দেবী সরস্বতীর মতন ওয়েন চাঙ, ইনি অবশ্য দেবতা।
এখানে একটি উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হচ্ছে, হিন্দুধর্মে যেমন দেব দেবীরা সবাই পৌরাণিক চরিত্র, চিনদেশে কিন্তু তা নয়।এখানে যেমন অনেক পৌরাণিক দেব দেবী আছেন যথা ড্রাগন, সমুদ্র দেবী লিন মাও লিয়াং ইত্যাদি, তেমনি অনেক দেব দেবী আছেন যাঁরা আদিতে মনুষ্য চরিত্র।পরে এঁদের ওপর দেবত্ব আরোপিত করে দেবতায় উন্নীত করা হয়েছে। স্বয়ং গৌতম বুদ্ধ তো আছেনই, আরো অনেকে আছেন যেমন যোদ্ধা দেবতা গুয়ান য়ু বা কোয়ান টি, যিনি এক বিখ্যাত যোদ্ধা ছিলেন।কাজেই পৌরাণিক দেবতার সঙ্গে অনেক মনুষ্য দেবতা , চীনাধর্মে দেখা যায় ।
আমরা চললাম টেরিটিবাজারের ধারে কাছে এই সকল দেবতা এবং মনুষ্য দেবতাদের মন্দির দর্শনে।
(চলবে.........)
ছবি:
১) অছিপুরের চীনা মন্দিরের প্রধান ফটক , সব লালে লাল- ঝুলে ঝুলে লাল দম মস্ত কলন্দর।
২)টেরিটিবাজারের মন্দিরে চমৎকার কম্যুনিটি হল।
৩) দেবতার অস্ত্র শস্ত্র।
৪)মনুষ্য রুপী দেবতা গুয়ান য়ুর মূর্তি।
৫) মন্দিরের দেওয়ালে আঁকা মানুষ দেবতার ছবি।
তথ্যসূত্র: Interment of Chinese Indians- WikipediaHttps://en.m.wikipedia.org>wiki>Interment
ডা: তিলক পুরকায়স্থ ,CEQ 2/3, CENTRAL HOSPITAL KALLA, ASANSOL 713340.
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের MBBS, MD, মুখ্যত চিকিৎসক, কেন্দ্রীয় সংস্থার উৎকৃষ্ট চিকিৎসা সেবা পদক, লাইফ টাইম আচিভমেন্ট আওয়ার্ড ইত্যাদি প্রাপ্ত।নেশায় ভ্রামনিক , ফটোগ্রাফার এবং শখের লেখক।
বেশ সুন্দর লেখা, তথ্যনির্ভর এবং সুখপাঠ্য।
ReplyDeleteধন্যবাদ
Deleteদারুণ লাগছে প্রতিটা পর্ব 👌
ReplyDelete্ধন্যবাদ
Delete