Friday, June 10, 2016

JAMAISASTIR SATKAHON

জামাইষষ্ঠীর সাতকাহন


                                            জামাইষষ্ঠীরপুজো


রাঢ় অঞ্চলের কোন প্রাচীন গ্রামে এসেছেন আর ষষ্ঠীতলা বা ষষ্ঠীর ডাঙায় একবার যাবেন না --তা কি কখনও হয়? ষষ্ঠীতলা মানেই আদ্দি কালের পাকুড় লাকুড় গাছ।ঝাঁকুমাকু বট বিরিক্ষিতলা।গোল করে বাঁধানো বেদী।ওখানেই অবহেলায় অনাদরে পড়ে আছে কোন এক বিস্মৃত যুগের দেব দেবীর ভাঙা চোরা দেহ।কাটা হাত পা।ক্ষত বিক্ষত নাক-মুখ।তাতে আবার কয়েক প্রস্থ সিঁদূরের প্রলেপ।বুঝতেই পারছেন--এরাই ষষ্ঠী জ্ঞানে বা্রো মাস ফুল জল পাচ্ছেন। ঠিকই ধরেছেন এ হলো গিয়ে গ্রামের পুরা সম্পদের মিউজিয়াম!

 একটু এগিয়ে চলুন।এই পুকুরটার নাম ষাট পুকুর।মানে ষষ্ঠীর পুকুর।পুকুরপাড়ের বসতির মধ্যে চন্ডী,দুর্গা,কার্তিক,গণষার সঙ্গে কয়েকজন ষষ্ঠিচরণেরও সাক্ষাৎ পেয়ে যাবেন।এদিকে বাচ্ছা ছেলে বিসম খেয়েছে।মা  বলছেন বালাই ষাট!! ওদিকে পাশের বাড়িতে শুরু হয়েছে দু'পক্ষের গন্ডোগোল।গর্জানি আর শাসানি।...'আয় শালারা!তোদেরষষ্ঠী পুজো করে দি দ্যাখ!

-------চমকে ওঠার পালা!
গ্রামের ষষ্ঠীতলা

 এবার নিশ্চয় বুঝতে পে্রেছেন--ষষ্ঠী এমনি এক দেবী; গ্রামজীবনের সঙ্গে যেন অর্ধনারীশ্বরের দড়িতে বাঁধা। ষষ্ঠী শব্দটি এসেছে ষষ্ঠ মানে ছয় থেকে।এক অদ্ভুত দেবী। যার শরীর জুড়ে একখান অংক।তাও সাত হলে না হয় বুঝতাম।সপ্তর্ষি,সপ্তনদি,সপ্তপদী,সপ্তমাতৃকা --এ সবেরতো ঘোরালো তত্ত্ব কথা আছে।প্রতি মাসের শুক্লা ষষ্ঠী তিথিতে  দেবীর আরাধনা। এইটুকু শুধু মিল।অবিশ্যি দেবী শুধু একাই যে ছক্কা মারেন তা নয়।ষষ্ঠীর বর ষড়ানন মানে ছ'মুখো কার্তিক। দেবসেনাপতির সঙ্গে দেবসেনা ।জোড়ি নম্বর এক।পরিচিতি মিলছে ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে।দেবী ভাগবতে।ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে দেবীর ভক্ত আবার যে সে লোক নন;রাজা প্রিয়ব্রত। তিনি ষষ্ঠী পুজো করে মৃত সন্তানদের জীবিত অবস্থায় ফিরে পেয়েছিলেন।আর সেই থেকেই নাকি হিন্দু সমাজে প্রতি মাসের শুক্লা ষষ্ঠী তিথিতে ষষ্ঠীপুজো প্রচলিত হয়েছে।

কোন সন্দেহ নেই,দেবী ষষ্ঠী সন্তান দায়িনী।সন্তান পালিনী দেবী।আবার শুধু পৌরাণিক দেবী নন;মান্ধাতার আমলের লোকদেবী।আরও প্রাচীন;ব্রতের দেবী।পরে আমরা এ বিষয়ে বিস্তৃত আলোচনায় আসবো।আপাতত জানিয়ে রাখি প্রত্নযুগের এই দেবীকে পৌরাণিক রূপ-সাগরে স্নান করিয়ে নতুন রূপে উপস্থাপিত করা হয়েছে। দেবী দুর্গার সঙ্গে একীভূত করা হয়েছে।মহাষষ্ঠীর সকালেই তো দেবী দুর্গার সংকল্প।
ষষ্ঠী পুতুল

দেশি বিদেশি পন্ডিতেরা দাবি করেছেন হিন্দু ধর্মের বারোয়ানাই অ-বৈদিক কালচার থেকে গৃহীত।পুজোপাঠ,ভূত-প্রেতে বিশ্বাস,পূর্বপুরুষপুজো,পরজন্মে বিশ্বাস,আত্মা এ সব ধারণাগুলি এসেছে অস্ট্রিক-দ্রাবিড় ইত্যাদি মিশ্র সংস্কৃতি থেকে।ষষ্ঠীও একইভাবে ছাড়পত্র পেয়েছে।প্রখ্যাত লোকসংস্কৃতিবিদ আশুতোষ ভট্টাচার্য মনে করেছেন সুদূর প্রাচীন কাল থেকেই সমাজে শিশুরক্ষক দেবীর অস্তিত্ব ছিল।হরপ্পা সভ্যতায় কতকগুলি ক্ষুদ্রাকৃতি মাতৃমূর্তি পাওয়া গেছে।এই দেবীরা ছিলেন মূলত গৃহদেবী।অন্যদিকে নবজাত শিশুর রক্ষয়িত্রী।পরবর্তীকালে এই সমস্ত মাতৃকামূর্তি থেকেই ষষ্ঠীর উদ্ভব।তবে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন হিসাবে ষষ্ঠী্র মূর্তি বিশেষ একটা মেলেনি।কবি কৃষ্ণরাম দাসের ষষ্ঠী্মঙ্গলকাব্যের  ভূমিকা লিখতে গিয়ে ড.সত্যনারায়ণ ভট্টাচার্য জানিয়েছেন --উড়িষ্যায় বালেশ্বর জেলা থেকে একটি ষষ্ঠী মূর্তি মিলেছে।দেবীর কোলে শিশুসন্তান।বাঁকুড়ার পাঁচমুড়ো কিম্বা সোনামুখিতে স্থানীয় কুম্ভকারেরা এক ধরণের মাটির পুতুল তৈরী করেন।নাম ষষ্ঠীপুতুল বা যো পুতুল।এগুলি ষষ্ঠীতলায় মানত হিসাবে দেওয়া হয়।পুতুলগুলি স্রেফ আঙুল টিপে তৈরি। ষষ্ঠীর কোলে এক বা দুই কিম্বা দশের অধিক শিশু থাকে।কালো বা লাল দু'রঙেরই হয়।চোখে মুখে গড়নে প্রত্ন পুতুলের মায়াবি বিন্যাস।আদিমতার ছাপ।সুতরাং ষষ্ঠীর উপস্থিতি সেই সুপ্রাচীনকালেই।আজও যার অস্তিত্ব টিকে আছে বাংলার বিলীয়মান পুতুল শিল্পে।

পৌরাণিক দেবী হিসাবে ষষ্ঠী -দুর্গা,লক্ষ্মী,সরস্বতীর মতোই ।কোন পার্থক্য নেই।তাঁর সম্পর্কে ধ্যানমন্ত্রগুলির সার কথা হল-গৌরবর্ণা দ্বিভূজা দেবী।উত্তম বসন ও অলঙ্কার পরিহিতা। চন্দ্রাননা ও কৃষ্ণমার্জার বাহনা।পীনোন্নত পয়োধরা।কোলে একাধিক শিশুপুত্র।অনেকের মতে দেবীর বিড়াল বাহনার মূলে রয়েছে দেবী জগদ্ধাত্রীর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ।কেননা বিড়াল বাঘ না হলেও বাঘের মাসি বলে সুপরিচিত।স্বামী নির্মলানন্দ তাঁর 'দেব-দেবী ও তাদের বাহন'গ্রন্থে লিখেছেন যে বিড়াল হলো প্রজনন শক্তির প্রতীক।আর বিড়ালির দুগ্ধ নাকি স্ত্রীরোগের আরোগ্যলাভের অন্যতম মেডিসিন।এমন প্রাচীন লোকবিশ্বাসের সূত্র ধরেই নাকি ষষ্ঠীর বাহন বিড়াল।


এই সেই কালোবিড়াল



অনেকেই আবার বৌদ্ধ হারিতীর সঙ্গে ষষ্ঠীকে একাকার করে দিয়েছেন।কিন্তু হারিতী বড়ো ভয়ংকরী শিশু নিধনকারী যক্ষিণী। তাকে পুজো না করলে রেহাই নেই।যাকে বলে ভয়ে ভক্তি -তাই আদায় করে হারিতী।আর ষষ্ঠী হলেন শিশু রক্ষয়িত্রী।কল্যাণকারী মাতৃমূর্তি।শিশুকে যদি কেউ আঘাত করে ,অপমান করে তাতেই তিনি ভয়ংকর রেগে উঠবেন।জৈনধর্মের শিশুরক্ষক দেবী নৈগমেসার সঙ্গে অদ্ভুত মিল রয়েছে ষষ্ঠীর।ইনিও শিশুর কল্যাণকারী দেবী।
ব্রতের দেবী হিসাবে ষষ্ঠী আরও আরও পুরানো। এই দেবী এসেছে আমাদের আদিমাতৃতান্ত্রিক  সমাজ থেকে।এই কারণে ষষ্ঠীকে বুড়ি বলা হয়।কবিকঙ্কণ মুকুন্দরাম চক্রবর্তী তাঁর চন্ডীমঙ্গল কাব্যে ষষ্ঠী সম্পর্কে লিখেছেন...।

                                            দুয়ারে বান্ধিল জাল বেত্র উপনাদে।
                                            ফেড়িয়া চালের খড় জ্বালিল আঁতুরি।
                                           গো-মুন্ডে থুইয়া দ্বার পূজে ষষ্ঠী বুড়ি।।

পশ্চিমরাঢ় অঞ্চল প্রাচীন জনবসতির অন্যতম কেন্দ্র।এখনো সেখানে বুড়ি নামাঙ্কিত সুপ্রাচীন লোকদেবীর পুজো হয়।যেমন খুনিয়াবুড়ি,মেলা বুড়ি,ভাঁড়রা বুড়ি।আর আশানসোলের জাগ্রতা ঘাঘরবুড়ির নাম আশাকরি অনেকেই শুনেছেন।
এবার আসি ব্রত কথায়।ব্রত-এমন এক ধরণের মেয়েলি আচার-কৃত্য,পুজো অনুষ্ঠান যা নির্দিষ্ট তিথি মেনে পালিত হয়।এই পুজো মূলত প্রজনন শক্তির।গুহ্য যাদু শক্তির।সব ধরণের বিপদ আপদ থেকে মুক্ত হবার জন্য পুজো।এছাড়া সাংসারিক সুখ স্বাছন্দ্য কামনাতো আছেই । আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে।পরিণত বয়সে স্বামীর কোলে মাথা রেখে স্বর্গ লাভের দুর্মদ বাসনা।
আশানশোলের ঘাঘর বুড়ি


ব্রত আর ব্রাত্য শব্দদু'টি বৈদিক সাহিত্যের শেষ পর্যায়ে রয়েছে।মেয়েলি এই ব্রতের সঙ্গে বৈদিক বা পৌরাণিক ধর্মের কোন মিল নেই।পন্ডিতেরা অনুমান করেছেন অনার্য মহিলাদের ধর্মীয় সংস্কৃতি ব্রতের মধ্যেই টিকে আছে।আর্যরা  এই ধর্মটিকে বিশেষ পাত্তা দিতেন না।হয়তো আর্য সমাজের একাংশ বা অনার্যরা এই ব্রতধর্ম পালন করতো বলে তাদেরকে ব্রাত্য বলা হতো।ঐতিহাসিক নীহাররঞ্জন রায় মন্তব্য করেছেন--"ঋগবেদীয় আর্যরা ছিলেন  যজ্ঞধর্মী।যজ্ঞধর্মী আর্যদের বাহিরে যাহারা ব্রতধর্ম পালন করিতেন ,ব্রতের গুহ্য যাদু শক্তি বা ম্যাজিকে বিশ্বাস করিতেন তাহারাই হয়তো ছিলেন ব্রাত্য"

  রাঢ়াঞ্চলের এক শক্তিশালী ব্রতের দেবী ষষ্ঠী।বটতলাই হলো ষষ্ঠীর আটন।এই কারণে তাঁকে বটবিটপবিলাসী বলা হয়েছে।বর্ণহিন্দু নবশাখ গোষ্ঠীর মহিলারা ষষ্ঠীর ব্রত করলেও তথাকথিত অন্ত্যজ সম্প্রদায়ের রমণীরা শুধুমাত্র অরণ্য ও শীতলা ষষ্ঠী ব্রত পালন করেন।তবে সন্তান প্রসব করার ছয় দিন পরে ষেটেরা বা ষষ্ঠীপুজো গ্রামাঞ্চলের হিন্দুমাত্রই পালন করে থাকেন।মধ্যযুগীয় বাংলাকাব্যে শিশুজন্মের পর ষেটেরা ,আটকলাই, নর্তা, একতির্সা প্রভৃতি উৎসব পালন করার বিস্তৃত বর্ণনা রয়েছে।শিশু জন্মের ছয় দিনের মাথায় গো-ভাগার থেকে গো-মুন্ড নিয়ে এসে আঁতুরঘরের দরজায় পোঁতা হতো।এখন আর লোকাচারটি পালিত না হলেও এই দিনে প্রথম মায়ে-ছা'য়ে স্নান করার বিধি আছে।

 বারো মাসেই ষষ্ঠীব্রত পালন করার বিধি।যেমন বৈশাখমাসে ধূলাষষ্ঠী।জষ্ঠিতে অরণ্য।আষাঢ়ে কোড়া।শ্রাবণে নোটন,ভাদ্রে মন্থন বা চাপড়া।আশ্বিনে দুর্গা ষষ্ঠী।কার্তিকে গোটা,অঘ্রানে মূলা,পৌষে পাটাই। মাঘমাসে শীতলা ।ফাল্গুনে অশোক আর চৈত্রে নীলষষ্ঠী। অরণ্যষষ্ঠীর পুজোর উপকরণে বিস্মৃত যুগের উপাচার।সাতটি সতেজ বাঁশপাতা,গোটা ফল ৫-৭ টি।তালেরপাখা একটি।একগুচ্ছ দূর্বাঘাস।দই-হলুদ-তেল।ষষ্ঠীর ডোর বা সুতো।।যে সব মহিলাদের কন্যাসন্তান হয়েছে ও প্রথম ষষ্ঠী ব্রত পালন করবেন --তাদের লাগবে সাতটি ডালি।তাতে সাতটি গোটা ফল ও সাতটি তালের পাখা।আর পুত্রসন্তান হলে লাগবে ৯টি পাখা ও ডালি।পুজোর পর ঐ ডালিগুলি বাচ্ছাদের মধ্যে বিতরণ করতে হবে।দই তেল হলুদের যাদু ফোঁটা দেবেন মা তাদের সন্তানের  ও জামাতার কপালে।কেউ অনুপস্থিত থাকলে তার উদ্দেশে প্রতীকী ফোঁটা পড়বে বাড়ির বড়ঘরের দরজার বাজুর উপরে।এই পুজো যে প্রজননের ও সতেজ জীবনের কামনায় তা বোঝা যায় পুজোর উপকরণ দেখে।তবে তালপাখার বিষয়ে অন্য কাহানি আছে।

  ষষ্ঠী আসলে আদিতে বনদেবী ছিলেন।অরণ্যের আধিষ্ঠাত্রী ।জষ্ঠি মাসের তাপ দগ্ধ দহনে পুড়ে খাক মাঠ-ঘাট বন-বাদাড়।মেয়েরা বৃষ্টি কামনায় , উত্তম ফসল প্রাপ্তির আশায় বনে গিয়ে গান গেয়ে আর পুজো দিয়ে বনদেবীকে সন্তুষ্ট করতো।যাতে নেমে আসে বৃষ্টি।নারী আর কৃষি যখন সমার্থক হয়ে উঠলো তখন থেকেই অরণ্যের দেবী হয়ে উঠলেন প্রজননের দেবী।নারীর ফসল অর্থাৎ সন্তান রক্ষয়িত্রী।রাঢ় অঞ্চলে তাই শুধু মায়েরাই ষষ্ঠীর ব্রত করেন না --কৃষি জমির ও ষষ্ঠীপুজো হয় ।এর নাম গাবরষষ্ঠী।ভাদ্র সংক্রান্তিতে ধানের জমির এক কোনে এই গাবর ষষ্ঠীর পুজো আজও পালিত হয়।রঘুনন্দনের তিথিতত্ত্ব থেকে জানা যায় জ্যৈষ্ঠ মাসের শুক্লা তিথিতে মহিলারা অরণ্যে গিয়ে পাখা হাতে বিন্দ্যবাসিনী স্কন্দ ষষ্ঠীর পুজো করতো।এ পুজো গ্রামের বা বাড়ির ভিতরে হতো না ,বনভূমি বা অরণ্যের মধ্যেই নিস্পন্ন হতো।এই কারণেই এর নাম অরণ্যষষ্ঠী।
মা ষষ্ঠী

   অরণ্যষষ্ঠী উপলক্ষ্যে বহুল প্রচলিত লোকগল্পটির মধ্যেও সেই অরণ্যের আবহ।নিটোল পশু প্রেমের গল্প বলতে যা বোঝায় ব্রতকথাটি তাই।গল্পের অন্যতম চরিত্র বেণেবাড়ির ছোট বউ।খাবার জিনিষে তার বড়ো লোভ।খুবই নোলা আর খাই খাই বাই।ষষ্ঠী পুজোর আয়োজন চলছে ।নানা লোভনীয় ফল-মূল মিস্টি ইত্যাদি।লোভ আর সংবরণ করতে পারলে না ছোট বউ।ফাঁকা নির্জন দেখেই কয়েকটা মন্ডা মেঠাই টপাটপ মুখে পুরে নিল।আর দোষ চাপিয়ে দিল ঐ নিশকেলে বিড়ালটার উপর।বিড়াল গেল বেজায় চটে।সে তো যে সে বিড়াল নয়।মা ষষ্ঠীর বাহন।অতএব সেও ফন্দি আঁটতে লাগলো।ছোট বউ সন্তান প্রসব করেই একটু খানি ঘুমুতেই বিড়াল ছেলে মুখে করে বনে দিল চম্পট।এমনি করে সাত ছেলে গেল হারিয়ে।ছোট বউ তখন হাহাকার করে বনে বনে বেড়াতে লাগলো।মা ষষ্ঠীর বড়ো দয়া হলো।বামনির বেশ ধরে এসে বউকে জিজ্ঞেস করে জানলো সব কথা।বিড়ালের উপর দোষ চাপিয়ে সে ঠিক করে নি তাও জানালে।নিজের পরিচয় দিয়ে পুজো করার পরামর্শ দিলে বনের মধ্যে। চালু হয়ে গেল ষষ্ঠীপুজো।সুতরাং বোঝাই যায় গোটা কাহিনির প্রেক্ষিত রচনাকরেছে বনভূমি আর বনের পশু।তাই কোন সন্দেহ থাকে না ষষ্ঠীর বুনো চরিত্র নিয়ে। 

  এবার তাহলে লাখ টাকার প্রশ্নটি ---এই বনদেবীর পুজোয় জামাইবাবু এল কি করে?একটা কথা বলে নি অরণ্যষষ্ঠীতে কুমারী মেয়ের কোন ভূমিকা নেই।অনেকেই বলেছেন কন্যার সন্তান লাভের আশায় শাশুড়ি মায়ের এই জামাতা সংবর্ধনা। একসময় শশুড়বাড়িতে অধিকাংশ বউ'র কপালে জুটতো লাঞ্ছনা গঞ্জনা।তার উপর যদি বউ'র বাচ্ছা কাচ্ছা না হতো অত্যাচারের মাত্রাটি কোথায় গিয়ে পৌঁছাত সহজেই অনুমান করা যায়।এই কারনেই জামাইকে তোয়াজ করার বিষয়টি এসে পড়ে।তাছাড়া শশুড় শাশুড়ির কাছে জামাতাও পুত্র।সারা বছরে ষষ্ঠী পুজোয় নিজের সন্তানদের মঙ্গল কামনাই হয়ে ওঠে মুখ্য। বেচারা জামাই থাকে বাইরে।তাই শুধু মাত্র অরণ্যষষ্ঠীতেই জামাইদের এই স্পেশাল খাতির।কোন কোন গবেষক আবার মনে করেন জষ্ঠিমাসের কৃষ্ণপক্ষের  সাবিত্রী চতুর্দশী তিথিতে স্ত্রীরা স্বামীদের দীর্ঘজীবন কামনা করে যমের আরাধনা করতেন। এই লোকাচারটির সূত্র ধরেই কলকাতার বাবু সংস্কৃতিতে নাকি জামাই ষষ্ঠীর অনুপ্রবেশ।বাল্যবিবাহ--সতীদাহ ইত্যাদি ঘটনার অনুষঙ্গ ধরেই হয়তো  এক সময় খুব স্বাভাবিক ভাবেই শাশুড়িমাতা জামাইবাবাজীবনের দীর্ঘজীবন কামনা করতেন।সেই থেকেই অরণ্যষষ্ঠীতে জামাইবাবাজিরা ঢুকে পড়েছেন।

   এখন জামাইষষ্ঠী মানেই খাদ্যের উৎসব।আম-জাম-লিচু-কাঁঠালের ফলার।ইলিশ-পাবদা-তিংরি-মিংরি গলদা চিংড়ির লোভনীয় রেসেপি।খাসি-পাঁঠা মুরগির মাংসের রকমারি বাংরেজিপদাবলী।লুচি মিস্টি পরোটা পুরির পুরোপুরি নাস্তা।তত্ত্ব-তালাস।উপহার বিনিময়।গ্রামে গ্রামে যাত্রাভিনয়-কবিগান।শহরে শালাশালিদের নিয়ে জামাইবাবুর সিনেমা দেখার রসপূর্ণ চিত্রনাট্য।আমাদের প্রথম  সবাক চলচিত্রটির নাম জামাইষষ্ঠী।কে জানে এটা কাকতালিয় কিনা!

এখনও প্রতিবছরই দেখি এই বিশেষ দিনটিতে দিগন্ত ঘেঁষা বটতলায় সকালের দিকে মেয়েলি জটলা......বাঁশপাতা গোটাফল আর তালপাতার পাখার কোলাজ.........ব্রতকথা পাঠের সুরেলা কোরাস..
....
শুনতে শুনতে মনের পর্দায় ভেসে ওঠে কোন এক বিস্মৃত যুগের কয়েকটা ঝাপসা চিত্রমুহূর্ত।সেই গহন বনে দহন বেলায় বনদেবীর আরাধনা...কালো বেড়ালের চকিত রূপ.........সেই  সন্তান হারানো পুত্রবধূটির করুণ বিলাপ...ম্যাজিক সুত্রবন্ধনীর মায়াবি বিশ্বাস....হঠাৎ তাল কেটে যায় শাশুড়িমায়ের ডাকে;এসো বাবা ষষ্ঠীর ফোঁটা নিয়ে যাও।বাস্তবে ফিরে আসি। চেয়ে দেখি--পুজোর থালাহাতে গিন্নি!

আজ যে জামাইষষ্ঠী!!
 
জামাইবাবু জিন্দাবাদ
ছবিঃ নেট ও নিজস্ব




PROTNO-SAMRAT

https://thekoulal.wordpress.com কৌলাল ওয়েবসাইটেও পড়তে পারেন।আর দেখতে পারেন মনের মতো ছবি।                                              ...