বড়ো গূঢ় নিত্যানন্দচরিত
বৈষ্ণব মহাজন লিখেছেন যদি গৌর না জন্মাতো তাহলে "রাধার মহিমা প্রেমরস সীমা জগতে জানিত কে!"আবার গৌরভক্তরা মনে করেন মহাপ্রভুকে জানতে বা বুঝতে নিত্যানন্দই ভরসা।তিনি দয়াল-ঠাকুর। গৌরভক্তি প্রেমদাতা।তাঁর কৃপাতেই গৌরসুন্দর ধরা দেবেন।ভক্তরা তাই সবার আগেই ঘোষণা করেন-- জয় নিতাই। কিন্তু নিত্যানন্দকে জানা কি এতই সোজা! সত্যি কথা বলতে কি-- মহাপ্রভুকে জানা বা বোঝার অন্তত চেষ্টাটুকু করা যায়;কিন্তু পদে পদে যিনি বিপরীত তাঁকে বোঝা কার্যত অসম্ভব! ফলে সহজেই হাল ছেড়ে দিয়ে নিত্যানন্দ বিরোধী হয়ে যাওয়াটাই স্বাভাবিক। যেমনটি হয়েছিল তাঁর সমকালে। তাঁর জীবনকাহিনীর মতো তিনি নিজেই এক মহারহস্যময় চরিত্রের দৃষ্টান্ত। বড়ো গূঢ় নিত্যানন্দ!
বস্তুত,গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্মে এক নিঃশ্বাসে উচ্চারিত দুটি নাম গৌর-নিতাই। আজও গৌর-নিতাই'র দারু বিগ্রহ বাংলার বহু মন্দিরে ও বাড়িতে নিত্য সেবিত।তবে মহাপ্রভুর নামে প্রচারিত গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্ম বলতে যা আমরা বুঝি তাহলো নিত্যানন্দ প্রচারিত বৈষ্ণবধর্ম। মহাপ্রভুকে তিনিই অখন্ড বঙ্গদেশে জনপ্রিয় করে তুলেছিলেন।সমাজের উচ্চবর্ণের ব্রাহ্মণ কায়স্থ বৈদ্য থেকে শুরু করে প্রান্তিক তৃণমূলস্তরেও বৈষ্ণবধর্মকে জনপ্রিয় করে তোলার কৃতিত্বের অধিকারী নিত্যানন্দ।
আবার বঙ্গদেশে তাঁর নেতৃত্বে গুরুবাদ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।তিনি অধিকাংশ বৈষ্ণবপদকর্তাকে পদ রচনায় অনুপ্রাণিত করেছিলেন।তাঁর অনুগামীরাই তাঁর উৎসাহে চৈতন্যজীবনী সাহিত্য রচনা করলেও তিনি নিজে রয়ে গেছেন নেপথ্যে।
অদ্ভুত বৈপরীত্যময় নিত্যানন্দের চরিত্র।সন্ন্যাসজীবন থেকে মুক্তি নিয়ে সংসারী হয়েছিলেন।সন্ন্যাসীর কৌপিনবস্ত্র পরিত্যাগ করে রাজবেশ পরিধান করেছিলেন।তিনি নিজেই যেন মূর্তিমান এক বিতর্ক ।অথচ সেকালের মতো একালেও তিনি যেন নির্বাসিত এক বৈষ্ণবসাধক।রহস্যময় তাঁর ব্যক্তিজীবন।সমকালে তাঁকে বুঝেছিলেন গুটিকয়েক ব্যক্তি।যার মধ্যে শ্রীচৈতন্যদেব ছিলেন অন্যতম।অথচ সত্যিকারের গণনায়ক বলতে যা বোঝায় মহাপ্রভু নন স্বয়ং নিত্যানন্দ ।একথা মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করেছেন একালের বৈষ্ণবপণ্ডিত-গবেষকরা।
নিত্যানন্দের ব্যক্তিজীবন বড় রহস্যময়।ভাবতে আশ্চর্য লাগে শিষ্য বৃন্দাবনদাসকে চৈতন্যভাগবতকাব্য রচনার অনুপ্রেরণা যেমন যুগিয়েছিলেন তেমনি চৈতন্যজীবনী রচনার মুখ্য উপাদানগুলি যুগিয়েছিলেন। সেখানে নিত্যানন্দের কথা খুবই কম।শুধু জানা যায় নিত্যানন্দের বীরভূমজেলার একচক্রাগ্রামে জন্ম।বাবা-মুকুন্দ ওঝা।মা-পদ্মাবতী।রাঢ়ীয়শ্রেণির ব্রাহ্মণ। বন্দ্যোপাধ্যায় কৌলিক পদবি। গ্রামে পরিচিতি ছিল হাড়াই পণ্ডিত নামে।পুজো আর্চা নিয়ে থাকতেন। বলরাম দাসের প্রেমবিলাস থেকে অতিরিক্ত আরও কয়েকটি অতরিক্ত তথ্য জানা যায়।যেমন গৃহজীবনে নিত্যানন্দের নাম ছিল চিদানন্দ।তাঁর আরও কয়েকটি ভাই ছিল।নিত্যানন্দের জন্ম হয়েছিল মাঘমাসের শুক্লপক্ষের ত্রয়োদশীতিথীতে। বৃন্দাবন দাস লিখেছেন--
মাঘমাসে শুক্লা ত্রয়োদশী শুভদিনে।
পদ্মাবতী গর্ভে একচাকা নামে গ্রামে।।
গবেষকদের মতে নিত্যানন্দ মহাপ্রভুর চেয়ে বয়সে বছর দশেকের বড় ছিলেন।সেই সূত্রে তাঁর জন্ম আনুমানিক ১৪৭৬/৭৭ খ্রিষ্টাব্দ।বাল্যকাল থেকে নিত্যানন্দ ধর্মীয় নাট-গীতে অনুরক্ত ছিলেন। কিশোর অবস্থায় উপনয়ন সংস্কারের পর তিনি এক সন্যাসীর সঙ্গে পলায়ন করেন। সহজেই অনুমান করা যায় নিত্যানন্দ অতি ছোট থেকেই সন্যাসজীবনের প্রতি আসক্ত ছিলেন। তিনি সন্ন্যাস গ্রহণ করে তীর্থে তীর্থে পরিব্রাজক হয়ে ঘুরে বেড়ান।গয়া-কাশি প্রয়াগ-মথুরা রঙ্গনাথ দণ্ডকবন ত্রিমল্ল বেঙ্কটনাথ কন্যকানগরী মাহিস্মতী হরিদ্বার ইত্যাদি তীর্থস্থানে প্রায় কুড়ি বৎসর কাটান।
দুটি দশকের এই বিচিত্র জীবন সম্পর্কে কোন তথ্য জানা যায় না।বরাবর তিনি এ সম্পর্কে মৌন রয়ে গেছেন। দুটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য অবশ্য জানা গেছে প্রথমতঃ তিনি অবধূত অর্থাৎ তান্ত্রিক সন্ন্যাসী ছিলেন।ভক্তিরত্নাকর থেকে জানা যায়-- তিনি পুরীসম্প্রদায়ের শিষ্য ছিলেন ।লক্ষীপতিপুরীর নিকট দীক্ষা লাভ করেছিলেন।কেউ কেউ বলেন নিত্যানন্দ শংকর সম্প্রদায়ের সারদামঠে দীক্ষিত সন্ন্যাসী।তবে এসম্পর্কে কোন সুনির্দিষ্ট তথ্যাদি নেই দ্বি্তীয়তঃ নিত্যানন্দ ছিলেন বেশে অবধূত। আকারে মহামল্ল এবং ভোজনপানে বীরাচারী।নবদ্বীপে বৈষ্ণব পরিকরদের সঙ্গে সাক্ষাৎকারের সময় মদ্যপানের কথা প্রকাশ্যেই বলেন।বৃন্দাবন দাস লিখেছেন--
মধু আন মধু আন বলি প্রভু ডাকে।
হুঙ্কার শুনিতে যেন দুই কর্ণ ফাটে।।
নিত্যানন্দ বীরাচারি তান্ত্রিক অবধূত সাধক হলেও প্রকৃতিতে ছিলেন কৃষ্ণপ্রেমী।আর একটি বৈশিষ্ট্য হলো নিত্যানন্দ শিশুর মতো সরল অকপট।ক্ষণে রুষ্ট ক্ষণে তুষ্ট।এমন বিচিত্র স্বভাবের ছিলেন নিত্যানন্দ।
বৃন্দাবনে সম্ভবত আলাপ হয়েছিল মাধবেন্দ্রপুরীর সঙ্গে।যাঁর কৃষ্ণপ্রেম ছিল কিংবদন্তী তুল্য।বৃন্দাবন দাস লিখেছেন... মাধবেন্দ্র পুরী কথা অকথ্য কথন/মেঘ দরশন মাত্র হন অচেতন।।এই মাধবেন্দ্রপুরীর কাছ থেকে মহাপ্রভুর কথা জানতে পেরেছিলেন সম্ভবত।এই কারণে নিত্যানন্দ নবদ্বীপে নন্দন আচার্যের বাড়িতে আসেন। বৃন্দাবন দাস লিখেছেন--
মহাবধূত বেশ প্রকাণ্ড শরীর।
নিরবধি ভক্তিরসে দেখি মহা ধীর।।
অহর্নিশ বদনে বোলয়ে কৃষ্ণনাম।
ত্রিভুবনে অদ্বিতীয় চৈতন্যের ধাম।
নিজানন্দে ক্ষণে ক্ষণে করয়ে হুঙ্কার।
মহামত্ত যেন বলরাম অবতার।।
নিত্যানন্দ ও মহাপ্রভুর সাক্ষাৎ একটি ঐতিহাসিক ঘটনা।মহাপ্রভু ভাগবতের একটি শ্লোক পাঠ করে নিত্যানন্দের হৃদয় জয় করেনিয়েছিলেন।নিত্যানন্দে্র হৃদয়ে জাগ্রত হয়েছিল অন্তহীন কৃষ্ণপ্রেম।মূর্ছিত নিত্যানন্দকে মহাপ্রভু কোলে করে প্রেমালিঙ্গন দিয়েছিলেন।শচীমাতাও নিত্যানন্দকে দেখে পুরাতন পুত্রশোক ভুলেছিলেন।তিনি যেন বিশ্বরূপ হয়ে ধরা দিয়েছিলেন শচীমাতার কাছে।নবদ্বীপ পর্বে নিত্যানন্দ যেন ক্রমশ গৌরের দ্বিতীয় তনু হয়ে উঠেছিলেন।নাম সংকীর্তনে অংশগ্রহণকরা, কাজীর অন্যায় আদেশের বিরোধিতাকরা,জনগণকে স্বৈরাচারী শাসকের বিপক্ষে এক কাট্টাকরা, জগাই মাধাই'র হাতে চরম লাঞ্ছিত হলেও প্রেমালিঙ্গনে কৃষ্ণপ্রেমে মাতোয়ারা করে তোলেন এই নিত্যানন্দ।মহাপ্রভুর সন্ন্যাস গ্রহণে অভিভাবকের মতো প্রতিটি কাজ সম্পন্ন করে তাঁকে নীলাচলে নিয়ে যাওয়া ,দাক্ষিণাত্য ভ্রমণে সাহায্যকরা ইত্যাদি ক্ষেত্রে তাঁর সদর্থক ভূমিকা লক্ষ করা যায়।
নিত্যানন্দ মহাপ্রভুর সঙ্গে নীলাচলে থাকতে চেয়েছিলেন।কিন্তু মহাপ্রভু বুঝেছিলেন নীলাচলে নিত্যানন্দকে অনেকেই মেনে নিতে পারবে না।তাছাড়া তিনি অদ্বৈত আচার্যসহ নিত্যানন্দকে গৌড়দেশে বৈষ্ণবধর্ম প্রচার করার আদেশ দিয়েছিলেন
।
নিত্যানন্দে আজ্ঞা দিল যাও গৌড়দেশে।
অনর্গল প্রেমভক্তি করহ প্রকাশে।।
এর পর থেকেই নিত্যানন্দের জীবনে আবার পরিবর্তন আসে।নিত্যানন্দের সঙ্গী হলেন রামদাস,গদাধর দাস,পরমেশ্বর দাস প্রমুখ বৈষ্ণবপরিকরবৃন্দ।তিনি আগেই সন্ন্যাসীর দণ্ডকমণ্ডলু ভেঙেছিলেন।এবার কৌপীনবস্ত্র ত্যাগ করলেন।দিব্য পট্টবাসে সজ্জিত হলেন। চৈতন্যভাগবতে রয়েছে--"কাষায় কৌপীন ছাড়ি দিব্য পট্টবাস/ধরেন চন্দনমালা সদাই বিলাস"।তিনি পরিচিত হয়ে উঠলেন কৃষ্ণের অগ্রজ বলরাম হিসাবে।তাঁর প্রধান প্রধান সহচরেরা হয়ে উঠলেন ব্রজের গোপবালক গোপাল।তাঁরাও অদ্ভুত বেশে সজ্জিত হয়ে হয়ে ভাগবতেরযুগকে যেন তাঁদের জীবনে মননে উজ্জীবিত করে তুললেন। বাংলা হয়ে উঠলো বৃন্দাবন।ভাগীরথী হলো যমুনা। বৃন্দাবনদাস লিখেছেন--
-
কারো কোন কর্ম নাই সংকীর্তন বিনে।
সভার গোপাল ভাব বাড়ে ক্ষণে ক্ষণে।।
বেত্র বংশী শিঙ্গা ছাঁদডুরি গুঞ্জাহার।
তাড়খাড়ু হাতে পায়ে নূপুর সভার।।
নিত্যানন্দ এবার বিয়ে করলেন কালনার গৌরীদাস পণ্ডিতের ভ্রাতা সূর্যদাস সরখেলের দুই কন্যা বসুধা ও জাহ্নবাকে।শুরু হলো এক নতুন জীবন।সপ্তগ্রাম অঞ্চলের ধনী বণিকরা তাঁর শিষ্য হলেন।বৈষ্ণবধর্ম এবার পায়ের তলায় মাটি পেল। নিত্যানদ তাঁর পরিকর নিয়ে মহাপ্রভুর নাম ও প্রেমধর্ম প্রচার করতে শুরু করলেন গাঙ্গেয় বাংলায়। বাংলায় বৈষ্ণবধর্মের মহাপ্লাবন বইতে শুরু করলো।
এদিকে নিত্যানন্দের এই জীবন-যাপন বিশেষকরে সন্ন্যাসী থেকে ধনী গৃহস্থ রূপ ও বিচিত্র আচরণ অনেকের কাছে অসহ্য হয়ে উঠলো।তারা বিরূপ সমালোচনা শুরু করলেন।অনেকেই আবার মহাপ্রভুকে মানলেও নিত্যানন্দের কঠোর সমালোচনা করলেন।কৃষ্ণদাস কবিরাজের ভাই শ্যামদাস মহাপ্রভুকে মানলেও নিত্যানন্দের ঘোর বিরোধী ছিলেন।এই কারণে কৃষ্ণদাসের সঙ্গে শ্যামদাসের বনিবনাও হয়নি।বৃন্দাবনদাস নিত্যানন্দ বিরোধীদের একহাত নিয়েছিলেন।বৈষ্ণব সুলভ বিনয় পরিত্যাগ করে নিত্যানন্দ বিরোধীদের মাথায় লাথি পর্যন্ত মারতে চেয়েছিলেন।
আসলে নিত্যানন্দের জীবন বড় রহস্যময়।মহাপ্রভুর প্রয়াণের অন্তত আট দশ বছর পর তিনি প্রয়াত হয়েছিলেন।অথচ তাঁর শেষ জীবন সম্পর্কে কোন তথ্য জানাই যায় না।মহাপ্রভুর শেষ বারো বছরের দিব্যোন্মাদ পর্বটিও সুচারু ভাবে চিত্রিত করেছেন কৃষ্ণদাস কবিরাজ চৈতন্যচরিতামৃত কাব্যে। কিন্তু নিত্যানন্দের ক্ষেত্রে তিনি নীরব।নিত্যানন্দের শেষ জীবনের কোন তথ্যই জানা যায় না।
আগেই বলেছি--নিত্যানন্দের চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল শিশুর মতো সারল্য ।কখনো তিনি বাহ্যজ্ঞান লুপ্ত হয়ে নগ্ন হয়ে যেতেন।কখনো তিনি ঝাঁপিয়ে পড়তেন উদ্দাম গঙ্গাবক্ষে।কখনো শিশুর মতো মালিনীর স্তন পান করেছেন।কখনো তিনি মহাপ্রভুর দণ্ড ভেঙে দিয়েছেন।কখনো রাজকীয় বেশ পরিধান করে নামসঙ্কীর্তনে মত্ত হয়েছেন।কখনো সামান্য ত্রুটির জন্য কাউকে গালিগালাজ করেছেন। তবে পাগলের মতো ভালোবেসেছেন মহাপ্রভুকে।এমনি এক বিচিত্র স্বভাবের মহা সাধক ছিলেন নিত্যানন্দ।সাধারণ লোকের পক্ষে তাঁকে বুঝতে না পারাটাই স্বাভাবিক।তিনি যেন সমস্ত নিয়মের ঊর্ধে উঠে গিয়েছিলেন। নিত্যানন্দভক্তরা বলেন তিনি বেদ-বিধির অতীত।বড়ো গূঢ় নিত্যানন্দ।এই নিত্যানন্দকে বুঝেছিলেন সমকালে হাতেগোনা কয়েকজন ব্যাক্তি।যাঁর মধ্যে মহাপ্রভু ছিলেন অন্যতম।এখনো কি তাঁকে আমরা বুঝতে পেরেছি বা বুঝবার চেষ্টা করি?
No comments:
Post a Comment