হা মরি বাংলা ভাষা!
বাংলাভাষাঃ সাহিত্যের ভাষা থেকে জীবন-জীবিকার ভাষা করতে দেয়নি পশ্চিমবাংলার ভদ্দরলোকেরা!!
২১শে ফেব্রুয়ারি।আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। সকাল থেকে শুরু হয়ে গেছে পাড়ার মোড়ে মোড়ে অনুষ্ঠান।বাংলাভাষা এই।বাংলাভাষা তাই।গলাবাজি,নাচ-গান কবিতা-আবৃত্তি।ভাষাশহীদদের জন্য কুম্ভীরাশ্রু।বাংলাভাষা নিয়ে কত রঙ বাহারি আক্ষেপ।তারপর যথা পূর্বং তথা পরং।পানাপুকুরের সেই একই রূপ।ফি বছরের চেনা নাট্যদৃশ্যের পুনরাবৃত্তি!! হা মরি বাংলাভাষা!!
আচ্ছা-- সত্যি করে বলুনতো--বাংলাভাষার সার্বিক উন্নতি কি আমরা মন প্রাণ থেকে কোনদিন চেয়েছি? চাই কি বাংলা আমাদের সরকারি ও দরকারি ভাষা হয়ে উঠুক? বাংলা হয়ে উঠুক যেমন প্রাণের ভাষা তেমনি মানের ভাষা,তেমনি জীবন-জীবিকার ভাষা?সত্যি কথা বললে অনেকের গায়ে ফোস্কা পড়বে জানি।নেহাৎ স্কুল-কলেজে বাংলাভাষাটা পড়ানো হয় তাই রক্ষে! না হলে বাংলা শিখে হাতে ভিক্ষের ঝুলি।বলুন কোন কাজে লাগবে বাংলা?আমি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা নিয়ে পড়তাম তখন অনেকেই আমাকে ব্যঙ্গ করে বলতো 'বাংলার বাগ"! সেদিন রাগ হলেও আজ বুঝি কথাটা কত বাস্তব! তাই আমার ছেলেকে বলি আর যা শিখবে বাবা শেখো, কিন্তু বাংলা নৈব নৈব চ!তবে হ্যাঁ পারোতো কিছু লিখো! পেটে ছুঁচোয় ডন মারলেও মন ভরবে!
আসলে বাংলাভাষা জনম দুখিনী। খ্রিষ্টীয় দশম শতাব্দী বা তার পূর্বে এই ভাষার জন্ম হলেও প্রাচীন বা মধ্যযুগে এই ভাষা রাষ্ট্রিয় ভাষা হয়ে ওঠেনি।পাল-সেন আমলে নিঃসন্দেহে রাষ্ট্রভাষা ছিল সংস্কৃত।মধ্যযুগের সূচনা পর্ব থেকে রাষ্ট্রভাষা পরিবর্তিত হয়ে ফারশিভাষাতে পরিণত হয়।একসময় জীবন জীবিকার ভাষা ছিল ফারশি।ফারশিভাষা জানা লোকের কদরই ছিল আলাদা।মধ্যযুগের ভদ্রলোকেরা তাই ফারশি শিখতো।আগে যেমন সংস্কৃত ছিল জীবন জীবিকার ভাষা।ফারশি জানা লোকের কদর আদর সমাদর তখন বরাবর।এই কারণে মেয়েদের কুমারীব্রত সেঁজুতিব্রতে ফারশি জানা বরের কামনা করা হয়েছে বারবার।পলাশির যুদ্ধের পর থেকে অবস্থা পালটাতে শুরু করে।ইংরেজরা রাজশক্তির নিয়ামক হয়ে ওঠে।শুরু হয় ইংরেজি ভাষার চর্চা।সমস্ত ক্ষেত্রে ইংরেজির প্রয়োগ শুরু হয় ব্যাপকমাত্রায়।স্বাধীন ভারতে ইংরেজিভাষার মহিমা অপ্রতিহত গতিতে বেড়ে চলেছে।সেখানে বাংলা পড়ে আছে বাংলাতেই।
তর্ক উঠতেই পারে এ নিয়ে।বলতেই পারেন মধ্যযুগে গৌড়বঙ্গের সুলতানদের সহায়তা পেয়েছিল বাংলাভাষা।রুকনুদ্দিন বারবাক শাহ হোশেন শাহ থেকে শুরু করে তাঁদের লস্করদের পৃষ্ঠপোষকতায় মধ্যযুগীয় বাংলাপাঞ্চালীসাহিত্যের অভূতপূর্ব বিকাশ ঘটেছিল।কিন্তু গৌড়াধিপরা কি বাংলাভাষাকে কোন সরকারি কাজে প্রয়োগ করেছিলেন? তাঁরা কবিদের পৃষ্টপোষকতা করেছিলেন।কবির গলায় ঝুলিয়ে দিয়েছেন সুবর্ণের হার?বঙ্গভাষার মর্যাদা সেই অর্থে কোথায় বাড়লো?রাজকাজ্জ্যে বাংলাটা কী লাগতো শুনি?বাংলাভাষা সেই সাহিত্যের জটাজালেই আবদ্ধ হয়ে রইলো।রাষ্ট্রের স্বীকৃতি পেল কি?
বাংলাভাষার উদ্ভব হয়েছে মাগধী অপভ্রংশ থেকে। সেই কারণে বোধহয় রাঢ়ী উপভাষাতেই বাংলাভাষার আদি প্রাণশক্তি নিহিত আছে। স্বাভাবিকভাবেই পশ্চিমবংলাতেই বাংলাভাষার বিকাশ বিস্তার হয়েছিল প্রাচীন কাল থেকেই।কিন্তু কি আশ্চর্য !এই পশ্চিমবাংলাতেই বাংলাভাষা চরম অবহেলার শিকার।কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বাংলাভাষার জন্য যে আন্দোলন শুরু করেছিলেন সেই আন্দোলন বর্তমানে স্তিমিত। এখনো অফিস আদালতে বাংলাভাষাকে ব্যবহার করতে গেলে কোথায় যেন আত্মহীনমন্যতা গ্রাস করে।এইতো সংবাদপত্রে দেখছিলাম প্রশাসনিক আমলারা আবার ইংরাজিতে কথা বলতে উৎসাহিত করছেন কর্মচারীদের।আর সেটাই পিঠ চাপড়ানো খবর হচ্ছে সংবাদপত্রে!আসলে বাংলা ভাষাকে অবজ্ঞা করাই আমাদের ভদ্রলোকেদের সংস্কার গৌরব।বাংলা পড়বে বাঙলাতে যাদের কিছু হবে না বলেই।আমার ছেলের বাংলাটা ঠিক আসে না বলে আত্মতৃপ্তি অনুভব করি।এইতো চলে আসছে সেই প্রাচীন কাল থেকেই।আজও তার ব্যতিক্রম নেই।
তবে পশ্চিমবঙ্গ যা পারেনি পুর্ববাংলা তা করে দেখিয়েছে। এখানেই বাঙালী হিসাবে সান্ত্বনা।বাংলাভাষার জন্য ওরা প্রাণ দিয়েছে।শহীদ হয়েছে।ওদের রাষ্ট্রভাষা বাংলা।ওদের জন্যই নেট দুনিয়াই বাংলা এখন সর্বত্রগামী। সুতরাং ওরা ভাষার জন্য প্রাণ দেবে।শহীদ হবে আর আমরা মোড়ে মোড়ে বাংলাভাষার জন্য কুম্ভীরাশ্রু ফেলবো।
হা মরি বাংলা ভাষা!
ছবিঃনেটের সৌজন্যে।।
No comments:
Post a Comment