Sunday, October 16, 2016

LOKKHI OLOKKHI PUJO EK LOUKIK KRISHI UTSOB


     


              লক্ষ্মী অলক্ষ্মীর পুজো এক লৌকিক কৃষি উৎসব




সোনার থালার মতো পুর্ণিমার চাঁদ উঠেছে  পুব আকাশে।মাঠে মাঠে ছড়ানো মুঠো মুঠো চাঁদের হাসি।সোনামুখি সবুজ  ধানখেত।আজ যে কোজাগরী লক্ষ্মীপুজো।রাতভর জাগরণ।যে শুয়ে থাকে তার ভাগ্যতে পড়বে গেরো।  প্রহর জাগো রে...।সম্পদ সৌভাগ্য সমৃদ্ধির দেবী আসেন চুপি চুপি।যে ঘরে জ্বলবে আলো,থাকবে শান্তি--- সেখানেই পড়বে লক্ষ্মীর পদচিহ্ন।ঘর দুয়োর হেসে উঠবে। লক্ষ্মীর প্যাঁজ আর লতাপাতার আল্পনা পাবে প্রাণ।ছায়া ছায়া গাছপালার ফাঁক দিয়ে নিকোনো উঠোনে ঝরবে জোৎস্নার চন্দন।


 প্রদোষকালে ঘটে-পটে প্রতিমায় শুরু লক্ষ্মী  পুজন।কোথাও বা ব্যতিক্রমী কলাবউ পুজো। আটনের নীচে কলার পেটো দিয়ে বানানো ময়ূরপঙ্খী নাও। বাঙালীর বাণিজ্য বসতির বিলুপ্তপ্রায় স্মৃতি ।পাশে সাতটি বাকারি মানে গোলা।তাতে রাখা-- ধান-শষ্য- সোনা-দানা ফল-মাকড় ইত্যাদি।চূড় করা নৈবেদ্য।চিঁড়ে সিঁড়ি খই তিল মুড়ি আর নারকোলের সুবাসিত নাড়ু।আধপাকা নোয়ানো ধানশিশের গুচ্ছ।পিদিমের  নরম আলো।শংখ ঘন্টা কাঁসর ঝাঁজ করতালের আরতি নয়।ঢোলের  মিঠি বাদনে হবে পুজন।লক্ষ্মী বড়ো লক্ষ্মীমন্ত দেবী।ঝগড়াঝাঁটি অশান্তি চেল্লামিল্লি দেখলেই  ফুরুৎ ধাঁ। আর সেই স্থান দখল করবে ভয়ংকরী অলক্ষ্মী।অশান্তির ঝালাপালায় জীবন হবে জেরবার,ছারখার।সবশেষে হাহাকার।

অলক্ষ্মীর কথা না হয় পরেই বলবো।এখন লক্ষ রাখি ঐ লক্ষ্মীতে। সত্যি বলতে কি---শব্দটির মূলেও এই লক্ষ ।মানে ---উদ্দেশ্য অভিপ্রায়।লক্ষ্মীর উপাসনা শুধু অর্থ উপার্জনের জন্য নয়;পরমার্থের অন্বেষণ। ।ঋগবেদে লক্ষ্মী কোন দেবী নন,সৌন্দর্যের প্রতিশব্দ মাত্র। সুন্দরের বৈদিক দেবী শ্রী।পরবর্তীকালে লক্ষ্মীর সাথে এঁটে উঠতে না পেরে শ্রীদেবী এখন পর্দে কা পিছে। তবে হ্যাঁ আমাদের নামের নাকের ডগায়  উপসর্গের মত শ্রীর অবস্থান।শ্রীমান,শ্রীযুক্ত শ্রীমতির উপরেই তার  যত কেরামতি। যদিও অনেকেই এখন  শ্রীহীন  হতে ভালোবাসেন।



পৌরাণিক যুগে লক্ষ্মী ক্রমশ শক্তিশালী দেবী।মহাকাব্য পুরাণাদি থেকে জানা যায় তিনি সমুদ্র গর্ভজাতা অপ্সরী।সুরাসুর মিলে সমুদ্র মন্থন কালে সাগর সেচে তুলে আনা হয়।।চতুর্ভূজা বা দ্বিভূজাদেবীরএক হাতে পদ্ম থাকবেই।তাই তাঁর নাম কমলা পদ্মা ।আবার সাগর থেকে উত্থিত হয়ে তিনি বিষ্ণু বক্ষস্থিতা বলে বিষ্ণুপ্রিয়া। রাতচরা পেঁচা তাঁর বাহন ।প্রাচীন মুদ্রা শিলালেখে এবং মূর্তি পরিকল্পনায় লক্ষ্মী সেই খ্রিস্টপূর্ব যুগ থেকেই রয়েছেন।শক- পার্থীয় শুঙ্গ- কুষাণ-গুপ্ত যুগের সুবর্ণ মুদ্রায় দেবী লক্ষ্মী পদ্মাসনা,বরদা।আবার লক্ষ্মীর অন্যান্য প্রস্তর মূর্তির তুলনায় গজলক্ষ্মী মূর্তি সুপ্রাচীন কাল থেকেই পূজিত হয়ে আসছে।পদ্মাসনা লক্ষ্মীকে দু দিকে এক জোড়া করে দিকহস্তী কুম্ভোদক ঢেলে  অভিষিক্ত করছে।সাঁচী ভারহুতের স্তূপেও গজলক্ষ্মী খোদিত।শুধু হিন্দু ধর্মে নয়; বৌদ্ধ ও জৈনধর্মেও লক্ষ্মীর জনপ্রিয়তা তুঙ্গে।


তবে লক্ষ্মী শুধু পৌরাণিক  দেবী নন ,অনার্যদের আদি দেবী।আর্য সংস্কৃতিতে লক্ষ্মী যদি সম্পদ সৌন্দর্যের দেবী হন প্রাগার্য কালচারে খিদের অন্নই হলো লক্ষ্মী।তাই তিনি কৃষিলক্ষ্মী।মেয়েলি ব্রতের দেবী,ঘরের লক্ষ্মী,ধান্যলক্ষ্মী।ধান যার আছে সেই ধনবান।বহুব্রীহি মানেই ধনী।  রাঢ়-বাংলায় মাঠের ফসল কাটার সময় এলেই লক্ষ্মীর আরাধনা ।চৈতি পৌষালি আর ভাদুরে ফসল  উঠলেই চৈত্র ভাদ্র ও পৌষসংক্রান্তিতে লক্ষ্মী পুজো ঘরে ঘরে।এই তিনবার লক্ষ্মীকে নতুন করে পাততে হবে।আটনে আলপনা দিয়ে লক্ষ্মীর ঘরে ২১ কাঠা ধান দিতে হবে।ধানের মাথায় বসবে চেলির ঘোমটা পরা বেতের কাঠা।চার দিকে বসবে পেঁচা।সামদ্রিক কড়ি।লক্ষ্মীর চিরুনি তামার মুদ্রা আরো কত কি! সঙ্গে নৌকা।এ যেন বাঙালীর প্রত্ন মিউজিয়াম।বধূ পরম্পরায় পূজিত এক জীবন্ত ইতিহাসের সূতিকাগার।লক্ষ্মীর নৈবেদ্য বলতে ভাত ডাল শাক সব্জির সহজিয়া পদাবলী।আর থাকে মায়েদের রান্না করা পরমান্ন।এইতো পরম প্রসাদ।এটাই বাঙালীর চিরকালীন কামনাঃআমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে।শান্ত শিষ্ট বাঙালীর জাতীয় দেবী লক্ষ্মী ছাড়া আর  কে হতে পারেন?


কিন্তু মাঝে মাঝে যে লক্ষ্মীছাড়া হতে হয়। তখন নেমে আসে দুর্ভাগ্য ,বিভ্রাট সর্বনাশ। এইতো জীবন!আমাদের অনেকেরই কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের মতো হতভাগ্যের গান গাওয়ার শক্তি নেই।কন্ঠ উঁচিয়ে বলতেও পারি না" হাস্যমুখে অদৃষ্টেরে করবো মোরা পরিহাস"। সেই কারণেইতো অলক্ষ্মীর পুজো,ভয়ে ভক্তিতে। তবে এর উৎস বহু প্রাচীন।একসময় পূর্ববাংলার  ঘরে ঘরে আশ্বিনসংক্রান্তিতে মেতে উঠতো গাড়শিব্রতে।কেউ বলেন  গাড়শি নাকি ফারসি শব্দ।অন্যরা দাবী করেন গাড়শি আসলে গৃহস্থ শব্দের বিকৃত উচ্চারণ।শব্দ নিয়ে বিতর্ক থাকলেও অর্থে কিন্তু  সেই অলক্ষ্মী তাড়িয়ে লক্ষ্মী পুজো। ।ক্ষেত্রসমীক্ষায় দেখেছি---আশ্বিন সংক্রান্তির খুব ভোর বেলায় উঠে  ব্রতীরা বাসি কাপড়ে  মাঠ থেকে শব্জি নিয়ে আসেন।তারপর বাড়িতে পাট-ঝাঁট না দিয়ে আমানি মানে শব্জি কাটাকুটো করে  সিধে গঙ্গা বা পুকুরে ভুখ ভুখ করে ডুব। । বাড়ি এসে রান্না বান্নায় মনোনিবেশ।নানারকম তরিতরকারি থাকলেও তেঁতুল মেশানো একটা ডাল থাকবেই।আগের দিন রাতে নেমন্তন্ন করতে হবে  কাককে।রান্না হয়ে গেলে কলাপাতায় সব ধরনের খাবার আগে কাককে খাওয়াতে হবে।ভারি মজার এই ব্রতটি।সাঁজের বেলায় জ্বেলে দিতে হবে কলার পেটো দিয়ে বানানো চেরাগ।সেই চেরাগের আলোয় দূর হবে অলক্ষ্মী অমঙ্গল দারিদ্র।



 অনেকেই বলেন গাড়ুব্রত আসলে  দশমহাবিদ্যার অন্যতম ধূমাবতীর পুজো।এই বিদ্যাদেবী  নাকি সতীর চিতার উত্থিত ধূম থেকে নির্গত হয়েছিলেন।প্রচন্ড খিদেয় নিজের স্বামী মানে শিবকেই কড়মড়িয়েই খেয়েছিলেন।পরে শিবের কাছে তালাক পেয়ে চিরকালের  বিধবা।এনার হাতে থাকে দেবী শীতলার মতো ঝাঁটা আর পতাকায় আঁকা অমঙ্গলের বার্তাবহ কাকের চিত্র।গাড়ুব্রতে ধূমাবতীর প্রভাব থাকতেই পারে ।তবে অলক্ষ্মীর প্রসঙ্গকে অস্বীকার যায় না।অনেক স্থানে গাড়শি ব্রতের দিন কাক ডাকার আগে বাড়ির সকলে ঊঠে  গায়ে হলুদ মেখে নেন।মাটি দিয়ে তৈরি করে  একটা আস্ত শূকর মূর্তি।কুলো বাজিয়ে সেই শূকর বলি দিয়ে ফেলে দিয়ে আসেন তেমাথা রাস্তায়। কালীপুজোর রাতে অনেক স্থানে লক্ষ্মী পুজো হয়।তবে লক্ষ্মীপুজোর আগেই  অলক্ষ্মীর পুজো। সে এক দেখার জিনিষ।


 লক্ষ্মী-নারায়ণ-কুবের তিন পুতুল বানানো হয় পিটুলি মানে চাল-বাঁটা দিয়ে।প্রথমটিকে সিঁদূরের প্রলেপ দেওয়া হয়।এটি লক্ষ্মী।দ্বিতীয়টিকে নীল রঙের চূর্ণ দিয়ে নারায়ণ  আর কুবের পুতুলকে দেওয়া হয় অপরাজিতাপাতা বাঁটার প্রলেপ।পুতুলগুলি বসানো হয় কলার পেটোতে ।শুরু হয় লক্ষ্মীপুজোর আয়োজন।অবশ্যই তার আগে অলক্ষ্মী পুজো করে বিদেয় করতে হবে।'একটি গোবরের পুতুলকে কালো রঙে ভুত করে মেয়েদের ঝরে পরা চুলের নুড়ি গোবর আর মোমবাতি জ্বেলে বাঁহাত দিয়ে পুজো। এরপর কুলোর উলটো পিঠে চাপিয়ে কাঁসর বাজিয়ে অলক্ষ্মী বিসর্জন। তারপর লক্ষ্মীপুজোয় বসতে হবে।

    এই অলক্ষ্মী পুজোকেই অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর অনার্যদের পূজিত আদি শষ্যলক্ষ্মী বলেছেন তাঁর বহুল প্রচলিত বাংলার ব্রত গ্রন্থে ।তাঁর মতে এই সবুজ হলুদ লাল রঙের তিনটি পুতুল প্রাগার্য লক্ষ্মী পুজোর নিদর্শন। আসলে শষ্যের তিন প্রকার রূপ।সবুজ হলো শষ্যের প্রথম রূপ। তারপর সেই শষ্যের পাক রঙ ধরে। শেষে পরিপূর্ণ পক্ক।লাল রঙের  লক্ষ্মীপুতুল সেই ঝুনট পাকা শষ্যের প্রতীক।এই আদিম লক্ষ্মীপুজো শুধু বাংলায় নয়;বাংলার বাইরেও প্রচলিত ছিল।যেমন মেক্রিকোর পুরাণেও রয়েছে শষ্য রক্ষয়িত্রী তিন বর্ণের তিন দেবতার কথা।পরবর্তীকালে এই আদিম লক্ষ্মীপুজোই অলক্ষ্মী বলে পরিত্যক্ত হয়েছে।এই অলক্ষ্মী পুজোর সঙ্গে মিল আছে ঝাড়খন্ড বাংলা সীমান্তে ডোম সম্রদায় পূজিত এঁটু ঠাকুরের ।উচ্ছিষ্ট পরিত্যক্ত আবর্জনা বাসি পচা খাবার দাবার দিয়ে এই দেবতার পুজো করেন ডোমেরা।বর্ণহিন্দু উচ্চ সমাজে দুর্গাপুজোর সময় কোথাও কোথাও বিজয়াদশমীর সাঁজবেলায়  এমনি এক দেবীর পুজো হয়।নাম তার উচ্ছিষ্টা  চন্ডালিনী।নাথ সম্প্রদায়গত চক্রবর্তী বামুন চার দিনের বাসি ফুল বেলপাতা দিয়ে দেবী পুজো করেন ----ওঁ নমঃ উচ্ছিষ্ঠা চন্ডালিন্যৈঃ নমঃ মন্ত্রে।


অবনীন্দ্রনাথের মতে কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোর মধ্যে  অনেকখানি টিকে আছে সেই আদিম অনার্যলক্ষ্মীর  স্মৃতি।পুজোর উপকরণগুলি দেখলেই বোঝা যায়।কোজাগর মানে কে জাগে।এই মায়াবী পূর্ণিমার রাতে যারা জেগে থাকেন ,পাশা অর্থাৎ দ্যূতক্রীড়া করেন দেবী তাঁকে বর দান করেন।বোঝ ঠ্যালা! যে লক্ষ্মীকে নিয়ে এত বড়ো বড়ো  কথা সেখানেই জুয়া খেলা!!!!তবে কি ডাল মে কুচ কালা হ্যায়!  অনেকেরই সেই গল্পটা জানা আছে।জগৎ  শেঠের ধনী হবার গপ্পো।বিদ্যা বুদ্ধির খাতিরে দিল্লীতে ডাক পড়লো শেঠ মশাইএর।সম্রাট তার বুদ্ধি চাতুর্যের খুব প্রশংশা করে বললেন  কি চাই আপনার? মায়ের শেখানো বুলি শেঠ আওড়ে গেলেনঃ দিল্লীতে কোজাগরী রাতে কেউ যেন আলো না জ্বালে।সম্রাট বললেন  ঠিক আছে।এদিকে কোজাগরী রাতে সারা দিল্লী অন্ধকার হয়ে রইলো শুধু আলো জ্বলছে  শেঠের বাড়িতে।দেবী লক্ষ্মী  জগৎ ভ্রমণে বেরিয়ে দেখতে পেলেন দিল্লীতে সব অন্ধকার শুধুমাত্র জগৎএর বাড়িতেই আলো জ্বলছে।দেবী বললেন আমাকে একটু আশ্রয় দেবেন?শেঠের মা দেবীর ছলনা বুঝতে পেরে বললেন আপনি বসুন আমি যতক্ষণ না ফিরে আসছি ততক্ষণ থাকুন।।শেঠের মা  লক্ষ্মীকে পুত্রের কাছে  চিরস্থায়ী করার জন্য যমুনার জলে প্রাণ দিলেন।


এই কিংবদন্তীর একাধিক তাৎপর্য থাকতেই পারে।তবে সারারাত জেগে উৎসবের কথাটা বেশ ভালোই বোঝা যায়।আরো বোঝা যায় আদিম কৃষি উৎসব ক্রমশ বিদেয় হয়েছে।প্রবেশ করেছেন পৌরাণিক লক্ষ্মী।   কোজাগরী পূর্ণিমার মূল বৈশিষ্ট্য ছিল সারারাত ধরে রঙিন উৎসব ।এর সঙ্গে মিল রয়েছে মেক্রিকো পেরু দেশের শষ্য উৎসবের।শারদ পূর্ণিমায় সেখানকার আদিবাসীরা ভুট্টার ছড়াকে পুজো করে।নানা খাবার তৈরী করে শষ্যদেবীর কাছে নিবেদন করে।সঙ্গে থাকে একটি সিদ্ধ করা ব্যাঙ।শেষে থাকে কুমারী বলির ঘটনা।আর সারা রাত ধরে চলে মেয়েদের এলোচুলে নৃত্য।  আজও কোজাগরী পূর্ণিমার মত্ততার রাত্রিতে জোৎস্না প্লাবিত মাঠের দিকে তাকালে সেই বিলীয়মান  কৃষি উৎসবের কথাই মনে পড়ে।

 সৌজন্যঃ সংবাদ পত্রিকায় প্রকাশিত
 ছবি ঃ নেট ও নিজস্ব

Tuesday, October 11, 2016

PROTNO-PITH MONGALKOT
















                              প্রত্ন-পীঠ মঙ্গলকোট

                                           

প্রত্নতীর্থ মঙ্গলকোট।দেবভূমি মঙ্গলকোট।হিন্দু-বৌদ্ধ-জৈন-সুফি-ইসলাম-লোকায়ত  ধর্মের মিলনক্ষেত্র  উজানি মঙ্গলকোট।সেই সুদূর প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে শুরু করে  মৌর্য-শুঙ্গ-কুষাণ-গুপ্ত-পাল-সেনপর্ব থেকে মধ্যযুগ হয়ে একেবারে হাল আমলেও মঙ্গলকোট আছে  সেই মঙ্গলকোটেই।আষ্টে-পৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে ইতিকথার বাঁধন। জড়িয়ে আছে কিংবদন্তির রাজা বিক্রমাদিত্যের রাজ কাহিনি।তাঁর সঙ্গে অষ্টাদশ আউলিয়ার সংগ্রাম ও পরাজয়ের এক বেদনা-বিধুর আলেখ্য। ছড়িয়ে আছে চণ্ডীমঙ্গলকাব্যের ধনপতি শ্রীমন্ত সদাগর লহনা খুল্লনা আর মা মঙ্গলচন্ডীকে নিয়ে  ইতিউতি স্মৃতি গাথা। মৌন হয়ে আছে অজয় কুনুর নদির তীরে একদা মোঘল-পাঠানদের যুদ্ধ-কথা,মোঘলসম্রাট শাজাহানের সংগে সুফিসাধক হামিদ বাঙ্গালীর জ্ঞান-গর্ভ বাতচিত,সুলতান হোসেন শাহার বিলীয়মান কীর্তি...সবমিলিয়ে বাঙ্লার ইতিহাস তথা সংস্কৃতিতে মঙ্গলকোট এক জমজমাট অধ্যায়।


অথচ  সংবাদপত্রের পাতায় বা টিভির স্ক্রিনে মাঝে মাঝে ভেসে ওঠে  --- রাজনৈতিক হানাহানিতে মত্ত মঙ্গলকোটের ঘোর অমঙ্গলের সংবাদ।নিজেদের মধ্যে দলাদলি হানাহানি খুনোখুনির জঘ্ন্ন খবর। সেখানে মঙ্গলশঙ্খ নিনাদের পরিবর্তে গোলাগুলি ছোঁড়ার হাড়হিম সংবাদ। এদিকে মঙ্গলকোট শুধু বাংলা বা ভারতবর্ষ নয়,সমগ্র  বিশ্বের প্রত্নমানচিত্রে এক উজ্জ্বল নাম।সেই সিন্ধুসভ্যতা উত্তর তাম্রাশ্মীয় যুগ থেকে আজ পর্যন্ত নিরবচ্ছিন্ন জনবসতির অস্তিত্ব বর্তমান মঙ্গলকোটে...ছয় বর্গ কিমি প্রসারিত এমন প্রত্নক্ষেত্র  বিশ্বে বিরল দৃষ্টান্তের অধিকারী। এই সংবাদের খবর রাখে ক-জন!
গোটা গ্রামটিকেই বলা যেতে পারে প্রত্নডাঙার উপর বসানো।  গ্রামে  রাস্তা তৈরি করার সময় মূল ডাঙা বিচ্ছিন্ন হয়ে একাধিক ডাঙায় পরিণত।  সুতরাং মঙ্গলকোট মানেই প্রত্ন-রত্ন প্রসবিনী খনি।সামান্য মাটি খুঁড়লেই বেরিয়ে আসে  মাটির তৈরি প্রত্নসুন্দরীর মুখমন্ডল,মাটির পুতুল টেরাকোটা মূর্তি, ছাঁচে ঢালা তাম্রমুদ্রা, নানা ধরনের সিল ,সিলমোহর, পুঁতি, খেলনা আর বিভিন্ন যুগের ভাঙাচোরা তৈজসপত্রাদি। হাতবদল হয়ে দেদার পুরা সম্পদ হয়ে যাচ্ছে পাচার।কুনুর নদির গর্ভ থেকে মিলেছে একাধিক প্রস্তরমূর্তি যেমন কুষাণ পর্বের গণধরমূর্তি,পাল সেন আমলের একাধিক ত্রিবিক্রম বিষ্ণুবিগ্রহ,মহিষমর্দিনী দুর্গা ইত্যাদি।এগুলির অধিকাংশ  সংরক্ষিত আছে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় মিউজিয়ামে। প্রত্নডাঙাগুলির উপর যত্র-তত্র অপরিকল্পিত বসতি গড়ে উঠছে বা উঠছে।প্রশাসনের এ বিষয়ে  ভ্রুক্ষেপ নেই।নেই ইতিহাস আর ঐতিয্যকে বাঁচানোর জন্য সংগঠিত আন্দোলন।অথচ যথাযথ সরকারি পরিকল্পনা থাকলে শুধুমাত্র মঙ্গলকোটের ইতিহাস আর পুরাকীর্তি নিয়ে খুলে যেতে পারে  পশ্চিমবঙ্গের পর্যটন শিল্পের এক নয়া দিগন্ত। গতানুগতিক গ্রাম্য অর্থনীতিতে আসতে পারে পরিবর্তন।মুছে যাবে বাঙালীর ইতিহাস বিমুখতার অপবাদ।  আমরা কবে ভাববো এসব কথা!
মঙ্গলকোট কুনুর নদির অববাহিকায় অবস্থিত।উজানি কোগ্রামের কাছে কুনুর অজয় নদির সঙ্গম---যা মঙ্গলকাব্যে ভ্রমরার দহ নামে বিখ্যাত।এখানকার বণিকরা অজয় কুনুর আর গঙ্গাপথ ধরে সমুদ্র বাণিজ্যযাত্রা করে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির চুড়ায় উঠেছিল।মঙ্গলকাব্যে যার প্রমাণ রয়েছে। মঙ্গলকোটে প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখননে প্রাপ্ত পুরাসম্পদও সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সাক্ষ্য দেয় ।  অনেকেই বলেন মঙ্গলকোটের নামকরণ নাকি মোঘলদের অনুষঙ্গে।একেবারে ভ্রান্ত ধারনা।মঙ্গলকোটের সঙ্গে জড়িয়ে আছে উজানির দেবী মঙ্গলচণ্ডীর নাম।বৃহদ্ধর্মপুরাণে বলা হয়েছে উজ্জয়নি বা উজানিপুরের মঙ্গলকোষ্ঠপীঠে দেবী মঙ্গলচণ্ডীর অবস্থান।
                                 উজ্জয়িন্যাং যথাপূর্ব্যাং পীঠং মঙ্গলকোষ্টকম।
                                শুভা মন্ডলচন্ডাখ্যা যত্রাহং বরদায়িনী।।১,০১,১৪


নানাভাবে আবিস্কৃত মঙ্গলকোটের পুরাসম্পদগুলি শৌখিন পুরাসংগ্রাহক বা ক্ষেত্রসমীক্ষকরা অনেকদিন আগে থেকে সংগ্রহ করে চলেছেন।এককড়ি দাস ,প্রয়াত কেশবচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়,মুহম্মদ আয়ুব হোসেন আসরাফ আলি প্রমুখদের নাম সর্বাগ্রে উল্লেখ্য।এদের সংগৃহীত পুরাসম্পদ রাজ্যপ্রত্নতত্ত্ব সংগ্রহালয়ে ,কাটোয়া মহকুমা গ্রন্থাগারে কিম্বা ব্যক্তিগত সংগ্রহে রয়েছে।পাশাপাশি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরাতত্ত্ব বিভাগ কতৃর্ক অধ্যাপক অমিতা রায় ও অধ্যাপক সমীর কুমার মুখোপাধ্যায়ের যৌথ নেতৃত্বে ১৯৮৬ সাল থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত মঙ্গলকোটের বিক্রমাদিত্যের ডাঙা,মনুমিঞার ডাঙা ও কাছারি ডাঙা উৎখনিত হয়।এর ফলে খ্রিষ্ট পূর্ব ১২০০ শতক থেকে খ্রিষ্টীয় ১৮০০ শতক পর্যন্ত মোট তিন হাজার বছরের বর্ণময় বঙ্গসভ্যতার ধারাবাহিক প্রত্ন নিদর্শন আবিস্কৃত হয়।


 হরপ্পা বা সিন্ধু সভ্যতা প্রাক-বৈদিক।সিন্ধু নদের উপত্যকায় গড়ে উঠেছিল এই নাগরিক সভ্যতাটি। পাথরের সঙ্গে তামার ব্যবহার ফলে প্রাগৈতিহাসিক জীবনযাত্রায় এসেছিল অভূতপূর্ব পরিবর্তন।এই কারণেই বলা হয় তাম্রাশ্মীয় সভ্যতা।আর্যদের আক্রমণ বা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ফলে হরপ্পা সভ্যতার বিনাশ ঘটে--এমনটাই মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।অনেকেই মনে করেন গঙ্গাপথ ধরে নাকি "উত্তর হরপ্পা সভ্যতা" ছড়িয়ে পরেছিল রাঢ় অঞ্চলে।বিষয়টা বিতর্কিত হলেও একটা কথা দিনের আলোর মত স্পষ্ট মঙ্গলকোট থেকে মাত্র ৩০ কিমি দূরে পান্ডুরাজার ঢিবি উৎখননে প্রাপ্ত পুরা নিদর্শনে প্রমাণিত হলো--রাঢ় অঞ্চলে হরপ্পা সভ্যতার সমকালীন  কৃষিকেন্দ্রিক তাম্রাশ্মীয় সভ্যতা গড়ে উঠেছিল।রেডিও কার্বণ  পরীক্ষা দ্বারা প্রমাণিত পান্ডুরাজার ঢিবিতে আদি জনবসতি গড়ে উঠেছিল খ্রিষ্ট পূর্ব ১৭০০ অব্দে।নিঃসন্দেহে আদি বাঙালীর আদি বঙ্গসংস্কৃতির সূতিকাগার।এই সভ্যতা শুধু পান্ডুরাজার ঢিবিতেই সীমাবদ্ধ থাকেনি।অজয়-দামোদর-ময়ূরাক্ষী কোপাই-কুনুর-খড়ি নদির অববাহিকার রাঢ় অঞ্চলে  ছড়িয়ে পড়েছিল।যার দৃষ্টান্ত---বীরভূমের বাহিরি, বর্ধমান জেলার বড়োবেলুন আমারুন এবং  বৃহত্তর মঙ্গলকোট ইত্যাদি। মঙ্গলকোটএ  প্রাপ্ত পুরাসম্পদের রেডিও কার্বন পরীক্ষায় প্রমাণিত এখানকার আদি জনবসতি খ্রিষ্টপূর্ব ৯৪০ অব্দের।শুধু তাই নয়---তামার সঙ্গে মঙ্গলকোটবাসীরা সেই সময় থেকে লোহার ব্যবহার করতে শিখে গিয়েছিল।এইকারনেই পন্ডিতরা মঙ্গলকোট সভ্যতাকে তাম্র-লৌহ সভ্যতা বলে চিহ্নিত করেছেন।শুধু জীবনযাত্রার মানের পরিবর্তন নয়্‌--- রাঢ়ের  সমাজ অর্থনীতিতে এসেছিল গভীর পরিবর্তন।
 

মঙ্গলকোট উৎখননে মঙ্গলকোটের অধিবাসীদের সাংস্কৃতিক জীবনধারার ক্রমবিকাশ ও অগ্রগতির মোট সাতটি স্তর ভিত্তিক বিন্যাস প্রত্নবিজ্ঞানীদ্বয় লক্ষ করেছেন।প্রথম পর্বের সময়কাল খ্রিষ্ট পূর্ব ১২০০ থেকে খ্রিষ্ট পূর্ব ৬০০ অব্দ।এই পর্বের উল্লেখযোগ্য পুরা নিদর্শন লাল-কালো কৌলাল আর্থাৎ মাটির তৈরি নানা ধরনের জিনিষ-পত্রাদি।এই পর্বের আর একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্যের কথা আগেই বলেছি----লোহার ব্যবহার।দ্বিতীয় স্তর খুবই গুরুত্বপূর্ণ।একদিকে তাম্রপ্রস্তর যুগের অবসান অপর দিকে আদি ঐতিহাসিক যুগের অভ্যুদয়।এরই মধ্যবর্তী সময়কাল। সময় কাল খ্রি.পূ.৬০০ অব্দ থেকে খ্রি.পূ.৩০০ অব্দ।এই পর্বে মিলেছে বেশ কিছু পোড়া মাটির নারীমূর্তি,বিডস ,হাড়ের তৈরি যন্ত্রপাতি।তৃতীয়পর্ব ঐতিহাসিক মৌর্য-শুঙ্গ যুগ।এই পর্বে লাল-কালো কৌলালের অবলুপ্তি ঘটার সাথে সাথে উত্তর ভারতীয় মসৃণ  চিক্কন কৃষ্ণ কৌলালের আবির্ভাব ঘটেছে।এই সময় থেকে উত্তর ও মধ্য ভারতের কৃষ্টি ও সংস্কৃতির যোগ শুরু হয়েছিল মঙ্গলকোটের। এই যোগ কুষাণ ও গুপ্তযুগে আরও নিবিড় হয়ে ওঠে। এই সময় থেকে মিলেছে সিলভার পাঞ্চ কয়েন ও ঢালাই তাম্র মুদ্রা।শুঙ্গযুগের  অন্যতম বৈশিষ্ট্য টেরাকোটা পঞ্চচূড়া যক্ষিণী  মূর্তি।  মিলেছে সরকারি ও প্রাইভেট কালেক্টরদের উদ্যোগে।পাওয়া গেছে ঘোড়ায় চড়া যোদ্ধাবেশী দেবী মূর্তি।বেহালায় রাজ্য প্রত্নতত্ত্ব সংগ্রহালয়ে মঙ্গলকোট থেকে প্রাপ্ত অনুরূপ আর একটি টেরাকোটা ফলক আছে। মন্তব্য করা হয়েছে... Female divinity on horse back.Mangalkot Dt .Burdwan.3rd cent.A.D.(Treasures of The State Archaelogical Museum West  Bengal  plate no 10) টেরাকোটা যক্ষিণী মূর্তিগুলি বেশ অভিনব ।প্রশস্ত নিতম্ব,ক্ষীণ কটী,সমুন্নত উত্থিত পয়োধর,সুকেশী ,সর্বালঙ্কারে ভূষিতা এবং বস্ত্র পরিহিতা হলেও অনেকের যৌনাঙ্গ প্রদর্শিত---এমন দেবীই যক্ষিণী।মাথার খোঁপা বিশেষ বৈশিষ্ট্য যুক্ত।খোঁপার আকৃতি চূড়া বা পাখির মতো।হেয়ার পিন দিয়ে আঁটা।হেয়ার পিনের সংখ্যা দশ বা বারোটি।পিনগুলি আকৃতিতে যুদ্ধাস্ত্র বা আয়ুধের মতো।এরা অনেক সময় অপদেবী রূপে পূজিতা হয়েছেন।শুধু হিন্দু ধর্মে নয়,যক্ষ যক্ষিণী পুজো জৈন ও বৌদ্ধ ধর্মে ব্যাপক মাত্রাতে অনুপ্রবেশ করেছিল।গাঙ্গেয় বাংলার বিবিধ প্রত্নক্ষেত্র থেকে যেমন তমলুক চন্দ্রকেতুগড় আনখোনা ফরাক্কা মঙ্গলকোটে পাওয়া গেছে।আসরাফের সংগ্রহে একটি যক্ষিণীর মুখমন্ডলে আড়াআড়ি দাগ কেটে ভয়ংকরী রূপে দেখা্নো হয়েছে।


চতুর্থ পর্ব কুষাণযুগ।এই সময় থেকে মঙ্গলকোটে শুরু হয় নগরায়ণ।সর্বভারতীয় কুষাণ সভ্যতার প্রভাব পড়ে মঙ্গলকোটে।ইটের স্থাপত্য দেখা যায়।আবিস্কৃত ইটের আকার ছিল 40x27x7 সেমি। বাড়িঘরের সঙ্গে যুক্ত ছিল কুয়ো ,পয়ঃপ্রণালী।এই স্তরে আবিস্কৃত হয়েছে প্রচুর সিলমোহর,পোড়া মাটির ফলক।পঞ্চমস্তর --গুপ্তযুগ।এই সময়ে প্রচুর সিলমোহর পাওয়া গেছে।তার মধ্যে দেখা যায় নানা ধরনের প্রতীক ও চিহ্ন।যেমন বেড়ার মধ্যে গাছ,স্তূপ,পূর্ণ কুম্ভ ধ্বজা,শঙ্খ,ষাঁড় ইত্যাদি।আসরাফের সংগ্রহে প্রায় পঞ্চাশ টির অধিক সিল-মোহর রয়েছে ।যা কাটোয়া থেকে প্রকাশিত কৌলাল পত্রিকায় ধারাবাহিক ভাবে এর বিবরণ প্রকাশিত হয়েছিল।আসরাফের সংগ্রহে  আরও একটি মূল্যবান সিলমোহর রয়েছে ।গুপ্ত ব্রাহ্মী বর্ণে খোদিত রুদ্রদাসস্য নামাঙ্কিত শিলমোহর।এছাড়া তিন মুখো একটি বিরল শ্রেণীর  শিলমোহর দেখা যায়।কোন কাজে  এগুলি ব্যবহৃত হতো তা এখনো বোঝা যায়নি।নানা ধরনের পুঁতির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো কারনেলিয়ান আগেট স্ফটিক চ্যালসিডনি কাঁচ হাতির দাঁতের তৈরি নানান সামগ্রী।এই সময় থেকে প্রচুর পরিমাণে কপার কাস্ট মুদ্রা মেলে।ঐতিহাসিকেরা মনে করেন ছাঁচে ঢালা তাম্রমুদ্রা প্রধানত মৌর্য-শুঙ্গ-কুষাণ-গুপ্তযুগে চালু ছিল।এই মুদ্রাগুলিতে কোন লিপি নেই।নেই কোন রাজার নাম বা দেব দেবির প্রতিকৃতি।বরং তৎকালীন লোকজীবনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগ রয়েছে ।মুদ্রাগুলিতে পড়েছে কৃষিভিত্তিক সমাজ জীবনের ছাপ।মুদ্রায় বেশকিছু জীব-জন্তুর প্রতিকৃতির ছাপ আছে।যেমন হাতি,ষাঁড়,ঘোড়া,সাপ, উট ইত্যাদি।



কিছু মদ্রায় রয়েছে তৎকালীন যুগে প্রচলিত ধর্মবিশ্বাসের ছাপ বা সাংকেতিক চিহ্ন।যেমন ক্রশ চিহ্ন,স্তূপ , স্বস্তিক চিহ্ন,যজ্ঞবেদী,রেলিং দেওয়া গাছ,বা বোধি বৃক্ষ ইত্যাদি।আরও নানা ধরনের দুর্বোধ্য সাংকেতিক চিহ্ন মুদ্রাগুলিতে দেখা যায়।এর সঙ্গে অদ্ভুত মিল রয়েছে গ্রামগঞ্জে ঘরের দরজায় আঁকা সাংকেতিক চিহ্নগুলির সঙ্গে ।বিশেষজ্ঞরা মনে করেন মুদ্রাগুলি মাটির ছাঁচে গলিত তামা ঢেলে বানানো হতো।আসরাফ ,আয়ুব হোসেন ও বর্তমান প্রতিবেদকের  সংগৃহীত মুদ্রাগুলির গড় ওজন ৩.৫৭ গ্রাম।পশ্চিমবঙ্গের নানা স্থান থেকে এই ধরনের মুদ্রা প্রচুর পাওয়া গেছে  যেমন চন্দ্রকেতুগড়,বোড়াল,পোখরানা।কাটোয়ার মঙ্গলকোট ছাড়াও কপারকাস্ট কয়েন মিলেছে কেতুগ্রামের আনখোনার মাঝিডাঙ্গা থেকে। মঙ্গলকোটের গুপ্ত পরবর্তী ষষ্ঠ ও সপ্তম স্তর দুটি খুবই বিক্ষিপ্ত অবস্থায়  পাওয়া গেছে।উল্লেখযোগ্য প্রত্ন নিদর্শন তেমন মেলেনি।এরপরেও মঙ্গলকোটে উৎখনন করা হয়েছে বিক্ষিপ্ত ভাবে।


ইতিহাস মানে অতীতের  স্মৃতি রোমন্থন নয়--অমোঘ শিকড়ের টান। রোমান্স বিলাসী জীবন বিমুখতা নয়-অস্তিত্বের নিবিড় বন্ধন। জীবন সংগ্রামের প্রেরণা । ইতিমধ্যে চর্যাগীতিকে  উড়িয়ারা তাদের ভাষার প্রাচীন সাহিত্য নিদর্শন বলে দাবী করে  কেন্দ্রীয় সরকারের কাছ থেকে  ধ্রুপদী ভাষার মর্যাদা আদায় করে নিয়েছে।বাংলাভাষা  তার ধ্রুপদী  মর্যাদা হারাতে বসেছে।এরপর নাকি রসগোল্লারও আবিস্কারের দাবীদার  উড়িয়ারা। একের পর এক  অতীত ঐতিয্য আমাদের হাতছাড়া হতে চলেছে।এটাই স্বাভাবিক ।কেননা সেই হরপ্পাসভ্যতার সমকালীন বাঙালীদের আদি ঠিকানা পান্ডুরাজার ঢিবি বা মঙ্গলকোট  সম্পর্কেই আমরা ঘোরতর উদাসীন।রসগোল্লা তো অনেক পরের বিষয়।বাঙালীর এই  আত্মঘাতী আত্মবিস্মৃতির মানসিকতা কবে লুপ্ত হবে??
সৌজন্যঃ সংবাদ পত্রিকায় প্রকাশিত




 email drswapankrthakur@gmail.com

Saturday, October 08, 2016

BORGI LUTHERA VASKOR PONDITER OSOMAPTO DURGAPUJO

                ইন্দ্রাণী-দাঁইহাট ও মারাঠি লুঠেরা ভাস্কর পন্ডিতের দুর্গা  পুজো
                                    







বারো ঘাট তেরো হাট।তিন চন্ডী তিনেশ্বর।আর এটা  যে বলতে পারে-দাঁইহাট-ইন্দ্রাণীতে তার ঘর।একটি লোকপ্রিয় প্রবাদ-বা লোকধাঁধা।  আর এই ধাঁধায় বাঁধা পড়েছে এক বিলুপ্ত নগরীর আত্ম-কথন।কাটোয়ার শাঁখাই  ঘাট থেকে ভাউসিং-দাঁইহাট ।সাত কিমি ব্যাপী গঙ্গার পশ্চিম তীরবরাবর  প্রসারিত  প্রাচীন গাঙ্গেয় নগরী--ইন্দ্রাণী।বর্তমানে  শহর কাটোয়ার একাংশ  ও দাঁইহাটের বৃহদংশ যার অন্তর্ভুক্ত।


হাট মানেই বিকিকিনির গঞ্জ-বাজার।হাট মানে শুধু দাঁইহাট নয়;আতুহাট,ঘোষহাট-পানুহাট-মোড়লহাট-একাইহাট-বিকিহাট-বীরহাট-পাতাইহাট ইত্যাদি।হাটে হাটে চলে চাল-ডাল-তেল-গুড় লবণ ভুঁষিমাল-কৃষিজ সম্পদের বেচা-কেনা। সঙ্গে তাঁত রেশম গাড়া বস্ত্র ।পাথর কাঁসাপিতলের ঘর-গেরস্থালির বাসন-কোসন।পাথর কাঠ-ধাতুর  মনোহর  দেববিগ্রহ।নীলকুঠি,চিনির কুঠি,সোনারুপোর বিপণি ।বড়ো বড়ো আড়ত। মহাজনি কারবার। টোল চতুষ্পাঠী।মন্দির মসজিদ-গির্জা । সুন্দরী বারাঙ্গনা, সতীদাহ অন্তর্জলিযাত্রা-গঙ্গায় সন্তান বিসর্জন--- কি ছিলনা ইন্দ্রাণীতে।গঙ্গার ঘাটগুলো  নিছকই স্নানের ঘাট নয়।সমুদ্র বাণিজ্যের  যেন ছোট ছোট বন্দর।সবমিলিয়ে প্রাচীনযুগ থেকেই জমজমাট এক  বাণিজ্য-নগরী ইন্দ্রাণী।মোঘল সম্রাট আকবরের আমলে সরকার সুলেমানাবাদের অন্তর্গতএক বিশিষ্ট পরগনা।মহামতি আকবর এখান থেকে বাৎসরিক রাজস্ব পেতেন ৫,৮২,১২০ দাম।রূপ ডেকে আনে কলঙ্ক।সমৃদ্ধি বহে আনে সর্বনাশ! অর্থ- প্রাচুর্যের চোরাস্রোতে ঢোকে বিলাসিতা। ক্ষয় আর দুর্বলতা।ইন্দ্রাণীতেও তার ব্যতিক্রম হয়নি।



অষ্টাদশ শতকের চারের দশক।আলিবর্দির নবাবি সিংহাসন তখন টলমল।উড়িষ্যায় বিদ্রোহ ঘোষণা করেছেন দুর্দান্ত দুর্দানা বেগম।তাঁর স্বামী দ্বিতীয়মুর্শিদকুলি খাঁ।উদ্ধত জামাতা বাকর আলি।ক্রুদ্ধআলিবর্দি ১৭৪১ সালে শীতকালে বিদ্রোহ দমন করতে গেলেন। নিজ জামাতা সৌলদজঙ্গকে উড়িষ্যার সিংহাসনে বসিয়ে ১৭৪২ সালের এপ্রিল মাসে প্রবেশ করলেন বর্ধমানে।এদিকে ভাস্কর পন্ডিতের নেতৃত্বে প্রায় চল্লিশ হাজার বার্গির সেনা বর্ধমানের রানি সায়রের পাড়ে নবাবকে ছেঁকে ধরলেন পঙ্গপালের মতো। চৌথ বাবদ দশ লক্ষ রুপিয়া মেটাতে হবে জলদি।এটাই তাদের দাবী।মামার বাড়ির আবদার আর কী! সে দাবী ফুৎকারে উড়িয়ে দিলেন বিরক্ত নবাব।কিন্তু পরিস্থিতি বদলে গেল গিরগিটির মতো।ভয়ংকর বর্গি  সেনাদের গেরিলাযুদ্ধের গরলে নবাব বাহিনীর ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা।কোন রকমে কাটোয়ায় এসে পড়ি কি মরি বলে মুর্শিদাবাদে ছুট লাগালেন।এদিকে ভাস্কর পন্ডিত তার দূরন্ত বর্গিবাহিনী নিয়ে দাঁইহাটে গাড়লেন ঘাঁটি ।


বর্ধমানরাজাদের বাসভবনটি হয়ে উঠলো বর্গিদের প্রশাসনিক ভবন।শুরু হলো লুঠ-পাট।অগ্নিদাহ।নারীর উপর বলৎকার।দাঁইহাটের গঙ্গায় মাটিয়ারির সঙ্গে যুক্ত করা হলো নৌকা দিয়ে ভাসমান সেতু।হাঙ্গামা ছড়িয়ে পড়লো পূর্ববঙ্গেও। এ- আলিবাবা আর চল্লিশ চোরের চিচিং ফাঁকের কিসসা নয়।চল্লিশ হাজার খতরনাক বর্গিসেনার হাড়হিম করা অত্যাচারের কাহিনী। ইতিকথা ছাড়িয়ে ছড়িয়ে আছে বাংলার হাটে-মাঠে-বাটে-ঘাটে কিংবদন্তী আর জনশ্রুতি রূপে।হুগলিজয় করে সেখান থেকে মির হবিব নিয়ে এলেন যুদ্ধজাহাজ।সমগ্র দক্ষিণবংগের হত্তাকর্তা বিধাতা হয়ে উঠেন  কোহলৎকর ভাস্কর পন্ডিত। নবাবি শাসন হয়ে পড়লো সুপ্ত লুপ্ত অন্তর্হিত।ব্যপ্ত হলো বর্গিদের দাপট।বঙ্গজুড়ে নেমে এলো--ত্রাস-বিভীষিকা ।শয়তানের অভিশাপ।এর পরই ভাস্কর দাঁইহাটে আয়োজন করেন  বড়ো মাপের দুর্গাপুজো।সে এক এলাহি ব্যাপার।সে কথায় আসছি।তার আগে ইন্দ্রাণী সম্পর্কে কয়েকটি তথ্য  জানানো প্রয়োজন।


ইন্দ্রাণী এক নদীর নাম।সপ্তমাতৃকার এক জননী।  লোকপুরাণের  নায়িকা।আর কান টানলে যেমন মাথা আসে তেমনি নায়িকা থাকলেই নায়ক আসবেন।সুতরাং ইন্দ্রাণীর পাশেই হাজির হলেন স্বর্গের রাজা ইন্দ্র।ভগীরথ গঙ্গাদেবীকে আনছিলেন মর্ত্যে  শাঁখ বাজিয়ে। এদিকে ইন্দ্রের নির্দেশে দেবতারাও শঙ্খধ্বনি করতে লাগলেন কাটোয়ার অজয়-গঙ্গার মোহানার তীরে। নাম হলো শঙ্খধ্বনি ঘাট।মানে শাঁখাই ঘাট।কাটোয়ার পাশ দিয়ে সুরুধনি প্রবাহিত হতেই রাজা ইন্দ্র প্রথমে গঙ্গা নাইলেন।ঘাটের নাম হলো ইন্দ্রেশ্বর ঘাট।এই ঘাটের কথা লিখে কামাল করে দিয়েছেনপ্রাক চৈতন্যযুগের কবি কৃত্তিবাস ওঝা।ইন্দ্রেশ্বর ঘাটে যে বা নর স্নান করে /অযুত বৎসর থাকে সে স্বর্গপুরে।। নবম শতকের মহাভরতের টীকাকার নীলকণ্ঠ বাচস্পতি মশাই আবার লিখে দিলেন এই ঘাটের মাথায় বসে সুন্দরী শচী নাকি সহস্র বছর ধ্যান করে ইন্দ্রকে পতিরূপে বাগিয়েছিলেন।এখানেই গড়ে উঠেছিল ইন্দ্রাণীর মন্দির।কবিকঙ্কন মুকুন্দ সেই নগরদেবীকে বন্দনা করে লিখেছিলেন---ভুবন মোহিনী মাগো ইন্দ্রাণী জননী জাগো দৈব নাশে তব শরণে।ইন্দ্রাণীর ভূমিপুত্র কবি কাশীরাম দাস তাঁর অমৃতসম মহাভারতে  লিখেছিলেন---
                                
                                 ইন্দ্রাণী নামেতে দেশ পূর্বাপর স্থিতি।
                                  দ্বাদশ তীর্থে যথা বৈসে ভাগীরথী।



আজ হারিয়ে গেছে সব কিছু ...মন্দির গেছে বিস্মৃতির গর্ভে।গঙ্গা চলে গেছে দূরে---বহুদূরে।শুধু রেখে গেছে তার ভালোবাসার অভিজ্ঞানটিকে -----ইঁদের পুকুর।এখন বাঁশ ঝাড় ঘেরা নিছকই এক এঁদো পুকুর। এক সময় ইন্দ্রদ্বাদশীর দিনে কিশোরী মেয়েরা প্রথম প্রণয় পুরুষ ইন্দর ঠাকুরের একটি মাটির মূর্তি গড়ে তাকে মাথায় নিয়ে ডুব দিত  ইঁদের পুকুরে।উঠে আসতো যেন এক পূর্ণ নারী হয়ে!!

 


শৈব শাক্ত সুফি রামায়েত বৈষ্ণব সাধনার ঘাঁটি হয়ে ঊঠেছিল ইন্দ্রাণীতীর্থ।তিনেশ্বর হলেন তিন বিখ্যাত শিবলিঙ্গ--চন্দ্রেশ্বর।ঘোষেশ্বর আর ইন্দ্রেশ্বর।একাধিক চন্ডির অস্তিত্ব আজও রয়েছে।আছে বদর শাহের মাজার।বেড়াগ্রামে মাটি খুঁড়তে গিয়ে পাওয়া গেল জৈন তাম্রশাসন।এতে খোদিত হয়েছে স্বর্গস্থানতুল্য ইন্দ্রাণী তীর্থের মহিমা।জেমস লঙ সাহেব গঙ্গা পথে ফিরছিলেন কলকাতা।দাঁইহাটের পাশ দিয়ে যেতে হঠাৎ তাঁর নজরে পড়লো এক ডুবন্ত প্রস্তরমন্দিরের প্রতিষ্ঠাফলক।রতনে রতন চেনে।ফলকটি তিনি এসিয়াটিক সোসাইটিতে জমা দিলেন।লিপির পাঠোদ্ধারে বোঝা গেল এ মন্দির পালযুগের প্রথম দিকের ।সপ্তম-অষ্টম শতকের।আর যারা কচু চেনে --তারা মন্দিরের অলংকরণগুল চুরি করে সাফ করে দিলো।দেওয়ানগঞ্জে দেওয়ান মাণিকচাঁদ আর এক রাজবাড়ি হাঁকালেন।বাঁধালেন গঙ্গার ঘাট--মাণিকচাঁদের ঘাট তথা অতিবড়ো ঠাট।এইতো আটের দশকের কথা।খবরটা এখনও বাসি হয়ে যাইনি।বিকিহাটের বকুলতলায় পড়ে থাকা ভগ্ন বিষ্ণুর পাদপীঠে খোদিরত লেখ  থেকে জানা গেল  পালযুগের জনৈক বণিক বসন্ত সিংহের  কথা।যিনি  হয়তো বিখ্যাত ভৃগু সিংহের উত্তর-পুরুষ।যাঁর নাম অনুসারেই আজকের ভাউ সিং জনপদ।


সপ্তদশ শতকে বর্ধমান রাজাদের উত্থান।তাঁদের দাক্ষিণ্য বর্ধমান ছাড়িয়ে ইন্দ্রাণী-দাঁইহাটে হয়ে গেল ক্রমবর্ধমান।দাঁইহাট হলো বর্ধমান রাজাদের ধর্মীয় রাজধানী।গঙ্গাবাসক্ষেত্র। ঠিক যেমন দ্বাদশ শতকে  সেন রাজাদের ধর্মীয় রাজধানী হয়েছিল গঙ্গাহৃদি নবদ্বীপ। তেমনি দাঁইহাটের গঙ্গার তীরে গড়ে উঠলো রাজঅট্টালিকা।বাঁধানো ঘাট। রাজা রানির সাধের দেবালয় ।গড়ে উঠলো ছোট বড়ো মন্দির।যেমন কিশোর-কিশোরীমন্দির।বিকিহাটে প্রতিষ্ঠিত হলো হরগৌরীর প্রস্তরবিগ্রহ।রাজাদের সমাধি সৌধ।বর্ধমান জেলার অন্যতম পুরাকীর্তি সমাজবাটী।  ১৭৪০ সালে প্রয়াত হয়েছিলেন মহারাজ কীর্তিচন্দ্র রায়।তাঁর অন্ত্যেষ্টি ক্রিয়ার স্মারক এই  সমাজ বাটি। ইন্দ্রাণী দাঁইহাটের সমৃদ্ধি যখন গৌরবের চূড়ায় তখনই হাজির হলো  কালান্তক যম সম বর্গিরা।নবাব আর  বর্ধমান রাজশক্তিকে তাড়িয়ে  তারাই হয়ে উঠলো বঙ্গেশ্বর।রাজধানী ---একালের দাঁইহাট।


১৭৪২ সালের সেপ্টেম্বর মাস।রাজধানী দাঁইহাটে দুর্গাপুজো হবে আর পুজো করবেন স্বয়ং ভাস্কর পন্ডিত। চারদিকে সাজো সাজো রব।নবাবের টিকিটি পর্যন্ত দেখা নেই।মির হবিব যেন নাগপুরের সর্দার রঘুজির দেওয়ান।ইন্দ্রাণীর জমিদাররা ভাস্করের পুজোর জন্য নজরানা নিয়ে আসছে।পালে পালে ছাগ মেষ আসছে।দুর্গার সামনে বলি দেওয়া হবে।রাজবাড়িতে তৈরি হচ্ছে দেখার মতো দুর্গা প্রতিমা। চারদিকে সাজো সাজো রব।এলাহি ব্যাপার।কবি গঙ্গারাম  তাঁর মহারাষ্ট্রপুরাণে এসম্পর্কে চমৎকার লিখেছেন---
                                 এইরূপে কুমোর প্রতিমা বানাইয়া।
                              ভাস্করের ঠাঁই তারা গেল বিদায় হইয়া।।
                              তারপর উপাদএ সামগ্রী আইলো যত।
                               ভার বান্ধিতে বোঝাএ কত শত।।
                              ভাস্কর করিবে পূজা বলি দেবার তরে ।
                             ছাগ মহিষ আইসে কত হাজারে হাজারে।।


সেদিন ছিল ২৬ শে সেপ্টেম্বর।দুর্গাসপ্তমীর পুজো।সারা বাংলার সঙ্গে দাঁইহাটবাসীও ভয়ে ভক্তিতে   মত্ত।ভাস্করের দুর্গাপুজোয় অঢেল খানাপিনার আয়োজন।মদের ফোয়ারা ছুটছে।চলছে বাঈজিদের নাচা-গানা। দেদারফুর্তি। নবাব এই সুযোগটার জন্য ওৎ পেতেছিলেন।বিপুল সংখ্যক সৈন্য সমাবেশ করে উদ্ধারণপুরে গঙ্গা পার হলেন। দিনের আলোয় তারা মিলিয়ে গেল ভুতের মতো।মহাষ্টমীর সন্ধিপূজা  বেজে উঠলো গ্রাম-গ্রামান্তরে।সকলেই দেবিপ্রাঙ্গণে হাজির।এই অবসরে সৈন্যরা আবার সমবেত হলো শাঁখাইএর অজয় তীরে।ঘোর অন্ধকার রজনী।নগরবাসীরা মাতৃ আরাধনায় মগ্ন।ধীরে পেরুতে হবে অজয়নদী।আশ্বিনের দুর্বিনীত অজয় গঙ্গার ভয়াবহ সঙ্গমস্থল।পেরুতে হবে সকলকে।তারপর দাঁইহাটে গিয়ে অতর্কিতে আক্রমণ করতে হবে উৎসব বিগলিত বর্গিদের।চুপিসারে তৈরি হলো নৌকার সেতু।কিন্তু বিধি বাম। হাতি ঘোড়া আর সৈন্যদের পদভারে সেতু গেল মড় মড় করে ভেঙে।হাতি ঘোড়া  যুদ্ধের রসদ আর অসংখ্য সৈন্য গেল জলের তোড়ে  ভেসে।বিপুল লোকসান।প্রায় ১৫০০ সৈন্যের ঘটলো সলিল সমাধি।জেমস গ্র্যান্ট ডাফ সাহেব তাঁর সুবিখ্যাত গ্রন্থ এ হিস্ট্রি অব মারাঠায় লিখেছেন..."Fifteen hundred men were plunged into the Adjee and totaly lost." ".


 সকলেই ভেঙে  পড়লেন।শুধু ভেঙে পড়লেন না নবাব।যেমন করেই হোক বর্গিদের তিনি বাংলা ছাড়া করবেন।কঠোর প্রতিজ্ঞায় তিনি অটল।কর্তব্যে অবিচল।তাই অতি সন্তর্পণে আবার সেতু মেরা মতির কাজ শুরু হলো।কাজ শেষ হতেই সৈন্যরা নির্বিঘ্নে অজয় পার হল।এবার নব উদ্যমে নবাবি সেনা দাঁইহাটের পথে ধাবিত।ইতিমধ্যে বর্গিরা খবর পেয়ে দলে দলে তখন ঘোড়া ছুটিয়ে  মহারাষ্ট্রের পথে।  দাঁইহাটের পূজা প্রাঙ্গন তখন বর্গি আর নবাবি সেনার রণাঙ্গনে পরিণত।নবমীর প্রভাতে লন্ড-ভন্ড হয়ে গেল দেবী পুজো।অসংখ্য বর্গি সেনা মারা গেল।যেন দেবীপূজায় নরবলির মহা আয়োজন।ভাস্কর পন্ডিত বিপদ বুঝে আগেই পলায়ন করেছিলেন।কথিত আছে তাঁর কাছে  ছিল এক সোনার দুর্গা প্রতিমা।বিধর্মীরা পূজার পবিত্রতা নষ্ট করে দেবে বলে নাকি সেই স্বর্ণপ্রতিমাটিকে গঙ্গার জলে ভাসিয়ে দিয়েছিলেন।নবমীতেই দশমীর বাজনা বাজিয়ে ফিরে গিয়েছিলেন মহারাষ্ট্রে।কঠোর প্রতিজ্ঞা করেছিলেন দাঁইহাটের মাটিতে।রক্তের হোলি খেলবেন এই বাংলায়।আজও সেই দুর্গাপূজা আসে।ভাঙাচোরা বাড়িটাতেই।লোকমুখে যার পরিচিতি --ভাস্কর পন্ডিতের দুর্গাপুজো।


ঐ যে দেখছেন----ভাঙা দেওয়ালটুকু! ওটাই বর্ধমানরাজাদের বিরাট গঙ্গাবাস ভবনের শেষ চিহ্ন।ওখানে আজও রয়েছে গোলা বর্ষণের ক্ষতচিহ্ন।নিচে জননী জাহ্নবীর  পরিত্যক্ত নদিখাত।বাঁধানো ঘাট--বারদুয়ারী।ডান দিকে রাজাদের সমাধি স্মারক--সমাজবাড়ি।কিশোর-কিশোরী মন্দির।আজ গঙ্গা অভিমানে দূরে সরে গেছে।গাছ-গাছালি আর আত্মবিস্মৃতির পলিতে চাপা পড়ে ইতিকথা!বঙ্গে বর্গি হাঙ্গামার স্মারক চিহ্ন রাজবাড়িটা ভাঙতে ভাঙতে শুধু এইটুকু!!একটা বোবা জিজ্ঞাসা চিহ্নের মত  বেবাক দাঁড়িয়ে!অচিরে হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়বে।আত্মবিস্মৃত বাঙালী শুধু নিদ্রালু সন্তানদের ঘুম পারাতে পারাতে বলবে-----
                         খোকা ঘুমালো পাড়া জুড়ালো বর্গি এলো দেশে।
                         বুলবুলিতে ধান খেয়েছে খাজনা দেবো কিসে।।


শুধু পুজোর এই চারটি দিন ইতিহাসের বিবর্ণ পাতা থেকে বেরিয়ে আসবে বর্গিরা...ভাস্কর পন্ডিত...আর স্মৃতির ক্যানভাসে উজ্জ্বল হয়ে উঠবে  অতীতের ইন্দ্রাণী-দাঁইহাট।।






 সৌজন্য ঃদৈনিক সংবাদে প্রকাশিত

Sunday, October 02, 2016

KAATA MUNDOR DURGAPUJO EK ULOT DEBIPURAN

              







 

       কাটামুন্ডর দুর্গাপুজো:  এক উলট দেবীপুরাণ

                                  


দুর্গা দুর্গতি নাশিনী।দশ প্রহরণধারিণী।মহিষমর্দিনী সিংহবাহিনী। সিংহ কখনো শ্বেত বর্ণের  খানিকটা ঘোড়ার মতও দেখতে। কখনো বা নরসিংহের আদলে গঠিত এক অদ্ভুত পৌরাণিক জীব।উত্তরবঙ্গে বিশেষকরে কোচবিহারের রাজাদের পূজিত দেবী দুর্গা ভয়ংকরী। যোদ্ধাবেশে অসুর নিধনে রত। সঙ্গে উদ্ধত  জয়া বিজয়া।সিংহের পাশা পাশি  একটা তাগড়াই বাঘ অসুরের হাতকে কামড়ে ধরেছে।দেবীর হস্ত  সংখ্যা নিয়ে নানা পুরাণে নানা কথা। দ্বিভূজা ,চতুর্ভূজা অষ্টভূজা   দশভূজা অষ্টাদশ কিম্বা সহস্রভূজা।গায়ের রঙ তপ্ত কাঞ্চন বা অতসী মানে তিসী ফুলের মতো।কখনো বা ঘোর লালবর্ণের দেবী।সাধারণত মহিষাসুর সহ কার্তিক গণেষাদি কিম্বা হরগৌরী  --এই পারিবারিক মূর্তিতেই পূজিত হন।



 কোন সন্দেহ নেই দেবী দুর্গার মধ্যে  প্রাচীন সংস্কৃতি মিলেমিশে একাকার।কৃষিদেবী বৃক্ষদেবী ,নগরের দুর্গ রক্ষয়িত্রী দেবীরূপে তাঁকে অনায়াসে সনাক্ত করা যায়।আদ্দিকালের লোকদেবীরাও দুর্গার মধ্যে আত্মগোপন করে আছেন।যেমন--লৌকিক বনদুর্গার পুজো আজো বহাল তবিয়তে টিকে আছে।কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় দুর্গার  বিরল ব্যতিক্রমী  শুধুমাত্র এক মুন্ডরূপের পুজো মূলত রাঢ় দেশের গোপভূমি অঞ্চলে জাঁক-জমকের সঙ্গে অনুষ্ঠিত হয়ে চলেছে। নেই মহিষাসুর,নেই মহিষ,নেই সিংহ বা বাঘ। পুত্র কন্যাদের কথা না হয় বাদই দেওয়া গেল।কেবলমাত্র গলা অব্দি কাটাএক নারীমুন্ড। দুর্গা রূপে পূজিত হচ্ছেন।যদিও দুর্গার এই ব্যতিক্রমী রূপটি সম্পর্কে কোন শাস্ত্রীয়

ব্যাখ্যা নেই।


অবশ্য দশমহাবিদ্যার ছিন্নমস্তার কথা এই প্রসঙ্গে উঠতেই পারে।তবে সেখানে ছিন্নমুন্ড থাকলেও দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখানো হয়েছে মাত্র।দক্ষিণ  চব্বিশ পরগনার এক বিস্তৃত অঞ্চলে একজোড়া মুন্ডমূর্তি বারা ঠাকুর হিসাবে পূজিত হোন।অনেকেই বলেন জোড়া মুন্ডের একটি ব্যাঘ্রদেবতা দক্ষিণ রায়ের ।অপরটি মহিলামূর্তি দেবী নারায়ণীর।শধু লৌকিক বারা ঠাকুর নয়;মনসার মুন্ডমূর্তি পূজিত হয় কালনা থানার উপলমতি উদয়পুরে।।সুতরাং এদিক থেকে দেখলে দুর্গার মুন্ডমূর্তি কোন ব্যাতিক্রমী বিষয় নয়,আগেই বলেছি  বহু লৌকিক দেবী দুর্গার মধ্যে মিশে আছে ।  সুতরাং প্রাচীন  মুন্ডমূর্তির পুজোর রীতি  এই দুর্গাপুজোর মধ্যে কোনরকমে  বেঁচে বর্তে আছে।


 অনেকেই বলেন মুন্ডপুজো আসলে প্রাচীন মুখোস পুজোর দৃষ্টান্ত। প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকেই ধর্ম সংস্কৃতিতে মুখোসের ব্যবহার চলে আসছে।মুখোস হলো মুখঢাকা মুখ।মুখের আবরণ বা ছদ্মমুখ।প্রাচীন গ্রীসে ইউরোপে এশিয়ার নানা উপজাতি ধর্মীয় কার্যকলাপে মুখোস ব্যবহার করে থাকেন।আমাদের দেশে কালকে পাতার শৈব  সন্যাসীরা কালীর মুখোস পরে  নাচানাচি করেন।কোথাও চামুন্ডার মুখোস পরা হয়।ক্ষীরগ্রামে  দেবী যোগ্যাদ্যার পুজোয় মুখোস পরে  মোরনাচ করা হয়।কাঠ শোলা মাটি দিয়ে এই মুখোসগুলি নির্মিত হয়।ছৌনাচে বিভিন্ন দেবদেবীর মুখোস আজও দেখা যায়। দুর্গা মুখোশ অন্যতম দৃষ্টান্ত মঙ্গলকোটের প্রত্নক্ষেত্র থেকে একাধিক মাটির তৈরি প্রতীকী মুখোশ অথবা মুন্ড মূর্তি মিলেছে । তবে পোড়া মাটির নয়।কাঁচা মাটির।উচ্চতা পাঁচ ইঞ্চির মতো।বিশেষজ্ঞরা বলেন প্রাচীনকালে লোকায়ত দেব-দেবীর থানে এই মুখোশ বা মুন্ডমূর্তি ছলন হিসাবে দেওয়ার প্রথা ছিল।পুরুষালি মুখ।নাকের গঠনটি লক্ষ্য করার মতো।মুখোশ্রীতে মায়াবি আদিমতা।এই ধরনের একাধিক প্রত্ন -মুন্ডমূর্তি কাটোয়া মহকুমা গ্রন্থাগারে সংরক্ষিত আছে।


 মুখোস বা মুন্ডমূর্তির দুর্গাপুজো মূলত বাঁকুড়ার কয়েকটি গ্রামে আর বর্ধমান জেলার আউসগ্রাম থানা যা প্রাচীনকালের গোপভূমি অঞ্চলের দু একটি গ্রামে এখনো টিকে  রয়েছে ।যেমন দিগনগরের রায় পরিবারে ,মঙ্গলকোটের পালিগ্রামে আর কেতুগ্রাম থানার গোমাইগ্রামে।গোমাইএর পুজোটির আদি উৎস গোপভূমি।পরে এ বিষয়ে বিস্তারিত বলা হয়েছে।এই পুজোগুলি কাটা  মুন্ডর পুজো নামে সুপরিচিত।লোকশ্রুতিগুলি বেশ মজার এবং যথেষ্ট ভাবনার খোরাক যোগায়।দেবী দুর্গা নাকি তার কাটা মুন্ড দেখিয়ে বিভ্রান্ত করেছিলেন মহিষাসুরকে।অসুর দেবীকে মৃত ভেবে যুদ্ধ পরিত্যাগ করেছিলেন।
এই  গল্পে মহিষাসুর হত্যার কোন প্রসঙ্গ নেই।নেই দশভূজা দুর্গার গল্প। তবে অনেক স্থানে যেমন দিগনগরের রায় বাড়ির কাটামুন্ডের সঙ্গে পুর্ণাঙ্গ জয়া বিজয়ার মূর্তি আছে।  সব মিলিয়ে এ এক অন্য ছিন্নমস্তার কাহিনী।


কেতুগ্রামের গোমাইএর কাটামুন্ড মায়ের আবার ভিন্ন জনশ্রুতি।গ্রামের কোঁয়ার সদগোপদের এই দেবী কাটামুন্ড মা।এরা ছিলেন প্রাচীন গোপভূমির অমরাগড় দিগনগর প্রভৃতি অঞ্চলের ডাকসাইটে ভূস্বামী। এরা নাঙ্গল ধরে না ,কলম ধরা জাত।এদের দাপটে বাঘে গোরুতে  একসময়ে  এক ঘাটে জল খেত।প্রায় তিনশ  বছর আগে  এদেরই পূর্বপুরুষ হরগোবিন্দ রায় অমরাগড় থেকে  গোমাই এ চলে আসেন জমিদারি প্রাপ্তির সূত্র।একদিন তিনি শরতের দুপুরে কেতুগ্রাম থেকে ফিরছিলেন গোমাই।নির্জন মাঠে ঠাকুরপুকুরের ধারে বিরিক্ষি বটতলা।ভাদরমাসের রোদ চরা দুপুরে তিনি ক্লান্তি মেটাবার জন্য বটতলায় বসলেন।শরীর মন শীতল হলো ,পুকুরে পদ্মফুল আর পদ্মপাতার   যেন বন লেগেছে।তৃষ্ণা মেটাবার জন্য পুকুরের জল আঁচলা  ভরে পানকরতেই একটা অলৌকিক দৃশ্য দেখে চমকে উঠলেন।একি মায়া না মতিভ্রম।পদ্মফুলের মাঝে এ্কটা আস্ত নারীর মুখমন্ডল। পদ্মের মতোই  সরোবরে ভাসছে ।কাছে যেতেই সেই পদ্মমুখ জলের তলায় ধীরে ধীরে তলিয়ে যায়।তিনি বিশ্বাস অবিশ্বাসের দোলায় দুলতে থাকেন।ভোর রাতে  স্বপন দেখলেন ঃ ওরে হরগোবিন্দ তুই ঠিকই দেখেছিস ।আমি দেবী দুর্গা ।যে রূপে তুই আমাকে দেখেছিস সেই রূপেই কর পূজা।অনুরূপ স্বপ্ন দেখলেন পার্শবর্তী শিবলুন গ্রামের মৃৎশিল্পী গোপাল সূত্রধরের পূর্বপুরুষ।আর সেই শুরু।উভয় বংশ পরম্পরার সহযোগিতায় আজও অনুষ্ঠিত হয়ে চলেছে গোমাইএর জাগ্রতা কাটামুন্ডর পুজো।


সাবেকি আদলে গঙ্গা মৃত্তিকা দিয়ে দেবীর মাতৃমুখ তৈরি হয় শিল্পীর বাড়িতে।ষষ্ঠীর দিন প্রবীণ সেবাইতের সামনে দেবীর চক্ষুদা্নে পর একটি পুরানো তামার টাটে বসিয়ে দেবীমুন্ড নিয়ে আসা হয়  দেবীমন্ডপে।মাথায় ধরা হয় ঐতিয্যবাহী ছাতা।রাস্তায় ছিটানো হয় গঙ্গার জল।এরপর গর্ভমন্দিরে চালি সদৃশ এক কাঠের সিংহাসনে কাটামুন্ড বসিয়ে বেনারসী শাড়ি আর শোলার কলকা দিয়ে সাজানো হয়।পুজো সংশ্লিষ্ঠ সকলেই নির্দিষ্ট ভূমি পেয়েছেন।সপ্তমীর দিন কলা বৌ আনার আগে সেবাইতরা প্রায় দেড়শো ভরি সোনা আর রুপোর গহনা দিয়ে দেবীকে সজ্জিত করেন। দেবী পুজোর দিনে আরতি হয় না ,অন্নভোগও নেই।প্রসাদ শুধুমাত্র নৈবেদ্যে।সপ্তমীতে আখ চাল-কুমড়ো অষ্টমীর সন্ধিপুজোয় বলি হয় নধর কালো পাঁঠা।নবমীতে হয় বিশেষ বলিদানপর্ব। রাতের দিকে তাৎপর্যপূর্ণ  পূর্বপুরুষ পুজো।দশমীর পুজোর বিশেষ আকর্ষণ আবার কুমারীপুজো।দশ বছরের কম বয়স্কা কুমারী মেয়েকে মূলসেবাইত ভান্ডার ঘরে বসিয়ে পুজো করেন।দশমীর দুপুরে দেবীর নিরঞ্জন হয় দেবীপুকুরে। বর্ধমান জেলার আউশগ্রাম থানার জঙ্গলমহলের এক প্রাচীন গ্রাম দেবশালা।এখানে বর্ধমান রাজাদের এক সময় গড়-বাড়ি দুর্গ ছিল।রাজার কর্মচারী ছিলেন কেতুগ্রামের বহরাণ গ্রামের বক্সী সম্প্রদায়।এই উত্তর রাঢ়ীয় কায়স্থরাও মুন্ডমূর্তিতে দেবী দুর্গার পুজো করে থাকেন।এখানেো দেবী দুর্গা কতৃক অসুরকে ছলনা করা ও তাঁর কাটা মুন্ড দেখানোর লোকগল্প প্রচলিত আছে।


এই  লোকশ্রুতিগুলি থেকে একটা ইঙ্গিত বেরিয়ে আসে  ভয়ংকর যুদ্ধ এবং তার ফলে  দেবীর কাটা মুন্ডর কোন ঘটনা। প্রাচীনকালে যুদ্ধে  বিজয়ী বীর পরাজিত শত্রুর মাথা কেটে নিয়ে আসতো।এটাই ছিল দস্তুর,  এটাই যেন  তার বড়ো উপহার।যেমন অনেক পিরের আস্তনার সঙ্গে জড়িয়ে আছে স্থানীয় শাসকশক্তির সঙ্গে মুসলিম গাজির যুদ্ধ এবং তার ফলশ্রুতি স্বরূপ  কাটা মুন্ডর  করুণ কেচ্ছা।ত্রিবেনীর জাফর খাঁর মাজার ,মঙ্গলকোটের অষ্টাদশ আউলিয়ার  মাজারে কান পাতলেই শোনা  যাবে কাটামুন্ডর  কিসসা।দুর্গার মুন্ড মূর্তির পুজো কি এমনি কোন সুপ্রাচীন  যুদ্ধস্মৃতির ইঙ্গিতবাহী?- যেখানে দেবী দুর্গার মহিষাসুর বিজয়ের পরিবর্তে   পরাজয়ের  উলট পুরাণের গপ্পো লুকিয়ে আছে?লুকিয়ে আছে নারী হত্যার কোন করুণ আলেখ্য?কাটামুন্ডপুজোর  স্মৃতি কি তারই কথা বলে ? বিষয়টি নিয়ে ভেবে দেখার প্রয়োজন আছে বৈকি!!


PROTNO-SAMRAT

https://thekoulal.wordpress.com কৌলাল ওয়েবসাইটেও পড়তে পারেন।আর দেখতে পারেন মনের মতো ছবি।                                              ...