হারিয়ে গেল ডালের বড়ি
ড.স্বপনকুমার ঠাকুর
বড়া আর বড়ির মধ্যে যতই অমিল থাক একটি জায়গায় তাদের দারুন মিল।উভয়েই বটিকা শব্দ থেকে উদ্ভূত।তবে বড়া বেশ বড় সড়।নাদুস নুদুস চেহারার।।ডালের বড়া থেকে শুরু করে তালের বড়া ছানার বড়া বাঙালির রসনায় রসের অমিত্তি।বড়ি সেই তুলনায় নেহাৎ বেঁটে খাটো চেহারার।অনেকের না-পসন্দ!তবে হলে কী হবে! বড়ি নিয়ে মাঘ-ফাগুনে বাঙলীর আগ্রহ উদ্দীপনা এক সময় ছিল বহুত বড়িয়া।
তবে দিন-কাল পাল্টেছে।আজকাল বড়ি নিয়ে বাঙালীর আর তেমন বাড়াবাড়ি কি লক্ষ করি? সুক্তো টক ঝোল আর রসার অলঙ্কার ছিল এই বড়ি।বিয়ে থা ভোজবাড়ি মানেই হিং দেওয়া বড়ি। কালোজিরে পোস্ত ছেটানো বড়ির কদর আদর। মহাপ্রভুর খাবার মেনুতে ফুলবড়ি হলেই তিনি খুশি হতেন।ভোজ-কাজ অন্নপ্রাশনে বড়ি মাস্ট।এখন সেসব কোথায় গেল?এখন বাজারে যে বড়ি মেলে তাতে আবার চাল-গুঁড়ির ঢিপ।আসল বড়ি মেলে কই?
একসময় এই মাঘ ফাগুনে মা দিদিমারা বড়ি দিতেন।গাঁ-গঞ্জে ধানের জমির আলে খুবি করে কলাই বুনে দিত।এরই নাম ছিল আলকলাই।এই কলাই যাঁতায় ভেঙে নিয়ে তেল মাখিয়ে চটে ঘষে নেওয়া হতো খোসা ছাড়াবার জন্য।গেরস্থ সংসারে লোকের অভাব নেই।বেশ কড়া পাকের রোদ উঠেছে।সুতরাং এই সময়ে বড়ি দিতে হবে।রাতে পাঁচসের কলাই ভিজিয়ে মুলো ঘষার পালা শুরু হতো টকুইয়ে।কিম্বা পাকা চালকুমরো,পাকা লাঊ ইত্যাদি।আমার দিদিমা বিশেষজ্ঞ ছিলেন বাঁধাকপির বড়ির।কালোজিরে পোস্ত সহযোগে সেই বড়ির আস্বাদ আজও অনুভব করি।
ডালের সঙ্গে আনাজের অনুপাত হলো ৩ঃ১।কলাইডালে আনাজ মিশিয়ে এবার ফাঁটার পালা।যত পারতো ফাঁটতো।তারপর এক বাটি জলে ফেলে দেখে নিত বড়ি ঠিক বেঁধেছে কিনা।যতক্ষণ না ঠিক হতো ততক্ষণ চলতো ফাঁটাফাঁটি ।কলাইডাল ছাড়াও মুসুরি বা মটরডালের বড়ি হলেও এতে আনাজ দিত না কেউ।এছজাড়া বড়িসমাজে এরা অতটা কুলীনও নয়।আমার এক মুসলমান বন্ধুর বাড়িতে দেখেছিলাম পিঁয়াজ মেশানো বড়ি দিতে।ত্তবে স্বাদ গ্রহণ করার সৌভাগ্য হয়নি।
ফাঁটাতো হলো--এবার বড়ি দেওয়ার পালা।তার আগে দড়ির খাটটিকে বেশ ভালো করে ঝেড়ে ঝুড়ে প্রস্তুত করা হয়েছে। এখন যত্ন করে বড়ি দেওয়ার পালা।আমার ঠাকুরদাদা ঠাকুমা থাকতেন বাংলাদেশে রঙপুরে।ওখানেই স্কুলে পণ্ডিতি করতেন ঠাকুরদা।ঠাকুমা বলতেন ওখানে আবার বড়ি দেওয়ার সময় তেল সিঁদুর ধান দূর্বা দিয়ে প্রথমে ডাল দিয়ে বুড়ো আর বুড়ি বানিয়ে পুজো করা হতো।এরাই বড়ির জনক বা দেবদেবী।তবে এই প্রথা এই বঙ্গে কোথাও দেখিনি।আপনারা কি দেখেছেন? তবে হ্যাঁ ! বড়িতে যাতে কেউ নজর না দেয় তার জন্য বড়ির নাকে গেঁথে দিত লালটুকটুকে পাকা লঙ্কা।
বড়িতে রোদ খাইয়ে বয়াম ভরে রাখা হতো।গ্রাম অঞ্চলে বর্ষাকালে আনাজ কোথা? সুতরাং বড়িতো আছেই তবে ভাবনা কিসের।আর আমরা বাপু রাঢ়ি লোক।কিছু না হোক একটু পোস্ত আর তেঁতুলের টক দিলেই আমাদের ভোজ।তো টক মজাতে বড়ির জুড়ি মেলা ভার! গয়না বড়ি তো রোদে জিলিপির প্যাঁচ দেওয়া।একটা ন্যাকড়ায় ডাল ভরে সামান্য একটু ফুটো করে চাপ দিয়ে গয়না বড়ি হতো।চূড় বালা কানের দুল ইত্যাদি আকারের।তবে শিল্পী ছাড়া এই বড়ি দেওয়া কি সম্ভব? আজ বাঙালীর জীবন থেকে একে একে অপসৃত হচ্ছে তার সাবেক ঐতিয্য।বড়ি দেওয়া আর দেখতে পাইনা।ওই এক আদজন! একটা থালায় মিক্সিতে খানিকটা ডাল বেঁটে এবরো খেবরো বড়ি দিচ্ছেন নিজের সখে.।
ছবিঃনেটের সৌজন্যে।
খুব ভালো লাগল!
ReplyDeleteধন্যবাদ
Delete