নতুনগ্রামের পুরাতন দারুশিল্প
মেলায় পুতুল বিক্রী করছেন বিখ্যাত শিল্পী জীবানন্দ ভাস্কর |
হাওড়া-ব্যান্ডেল -কাটোয়া রেল শাখায় অগ্রদ্বীপ স্টেশন।এখানে নেমে রাস্তা ক্রশ করে পাকা সরান ধরে কিছুটা হাঁটলেই পৌঁছে যাবেন নতুনগ্রামে।ভ্যানে বা রিক্সায় যেতে পারেন।আর পাঁচটা সাধারণ অজ পাড়াগাঁএর মতো হলেও অনেকেই জানেন ---নতুনগ্রামের খ্যাতি স্থানীয় ছুতোরদের তৈরি হরেক কিসিমের কাঠের পুতুলের জন্য।এর সূত্র ধরেই নতুনগ্রামের সূত্রধরদের নাম-ডাক,যা রাজ্যের সীমানা অতক্রম করে লোকশিল্পের আন্তর্জাতিক অঙিনাকে করেছে স্পর্শ। সেই প্রাচীন লোকজ দারুশিল্প ও শিল্পীদের হাল হকিকতের সুলুক সন্ধান এই লেখায়............
এক
-'বিশ্বকর্মার ব্যাটা ' ছুতোররা রাঢ়-বাংলার এক প্রাচীন শিল্পী জাত।কাঠের তৈরী লাঙল,মই,গোরুর গাড়ি,পালকি-পালঙ্ক,নৌকো ইত্যাদি নির্মাণের পাশাপাশি তালের কাঁড়ি ,কাঠ-বাঁশ-কাবারি দিয়ে ঘরের" চাল ওঠানো" ছাঁটামো তৈরী ,দরজা -জানলা, ঠাকুরের সিংহা্সন,ঢাক-ঢোলের খোল তৈরির মতো প্রাত্যহিক প্রযুক্তিগুলি এদের হাতে যেন কথা বলে ওঠে।ছুতোরগিন্নিরাও কোন অংশে কম যান না!ধান থেকে চিঁড়ে চ্যাপটা করা কিম্বা চাল থেকে মুড়ি ভাজায় দক্ষ শিল্পী।কবি কঙ্কণ মুকুন্দরাম চক্রবর্তী লিখেছেন....
ছুতোর নগর মাঝে / চিঁড়ে কুটে মুড়ি ভাজে/ কেহ করে চিত্র নির্মাণ।।
পুতুলে কাগজের পটি |
এ তো গেল মুদ্রার এক পিঠ।অন্যদিকে দারু বিগ্রহ ,অলংকৃত কাষ্ঠদ্রব্য,দরজা জানলায় খোদাই চিত্র, চন্ডিমন্ডপ বা বাংলা বাড়ির ষড়দল-পরদল-কোনাচি-শুঁড়ো-ঠেকনো-খুঁটিতে নকশাবহুল অলংকররণসহ রথ, পুতুল নির্মাণে রাঢ়ীয় সূত্রধরদের সৃজনশীলতা --এককথায় লা-জবাব।কালের করাল গ্রাসে অনেক কিছুই হারিয়ে গেছে।তবু যে টুকু টিকে আছে তা গর্ব করার মতো।জানবার এবং জানাবার মতো। যেমন এই নতুনগাঁয়ের পুতুলশিল্প।গড়নে চিত্রণে অলংকরণে এবং সার্বিক আবেদনে মুগ্ধ হয়ে সাধারণ মানুষই যখন স্বতোপ্রণোদিত হয়ে পুতুল কেনেন তখন শিল্পরসিক তো পরের কথা।কারণটা সহজেই অনুমেয়।এই শিল্পের পশ্চাতে রয়েছে এতদাঞ্চলের সূত্রধরদের বংশ পরম্পরায় সংশ্লিষ্ট বিষয়ে নিবিড় অনুশীলন ও তাতে পেশাদারি দক্ষতা অর্জন।
রাঢ়ীয় সূত্রধরদের একটি বিশেষ থাক বর্ধমেন্যা।বৃহত্তর কাটোয়া মহকুমার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে এরা বসবাস করেন।কাটোয়া পাটুলি দাঁইহাট করজগ্রাম শ্রীখন্ড হাটপাড়া কেতুগ্রাম মিত্রটিকুরী পিলসোয়াঁ প্রভৃতি প্রাচীন জনপদে পুরুষাণুক্রমে বসবাস করে আসছেন।কাঠের কাজের পাশাপাশি কেউ কেউ মৃৎশিল্পে সুনাম অর্জন করেছেন।বিশিষ্ট লোকসংস্কৃতিবিদ ও ক্ষেত্রসমীক্ষক তারাপদ সাঁতরা এতদাঞ্চলের বিখ্যাত সূত্রধরদের নাম-ধাম জ্ঞাপক একটি মূল্যবান লোকছড়া সংগ্রহ করেছিলেন।যাতে বলা হয়েছে....
বর্ধমান জেলা হয়গো ছেরান্দি।
সূত্রধর দশঘর পরমানন্দ।।
ঝামটপুরে রহেগো রামাইচন্দ্র।
পেনেরায় ঘর কুন্ডু গৌরাঙ্গ।।
কোপার পাল হয় গঙ্গারাম।
কন্দর্পশীল হয় কেতুগ্রাম।
তেঁতুলের পো নন্দ দত্ত।
বহরানের দে চৈতন্য খ্যাত ।
জেয়োপাড়ার সাগর কর।
এই মত ঘর সূত্রধর।।
(Brick Temples of Bengal Ed..Jerge Michell Ch: On Architects and Builders ,Tarapada Santra page 53-62)
শুধু পুতুল আর পুতুল |
বিস্তারিত আলোচনা এখানে অপ্রাসঙ্গিক।শুধুমাত্র একটি তথ্য জানিয়ে রাখি।ক্ষেত্রসমীক্ষায় জানাযায় যে কেতুগ্রাম থানার কোপার গঙ্গারাম পালের লতায় পাতায় উত্তর পুরুষেরা এখনও নিকটবর্তী হাটপাড়া মিত্রটিকুরী গ্রামে বসবাস করছেন।এখানকার সূত্রধরেরা তৈরি করে আসছেন প্রাচীন ঐতিয্যবাহী কালকেপাতা মুখোশ। যা রাঢ়-বাংলার অন্যতম লোকনৃত্য রাক্ষস নাচের মুখোশ বলে পরিচিতি পেয়েছে ।
দ্বিতীয়ত,রাঢ়ীয় সূত্রধরদের আর একটি অন্যতম থাক ভাস্কর।এরা কাঠের পাশাপাশি পাথর খোদাইএ দক্ষ।পাল-সেনযুগ অথবা তার আগে থেকে শুরু করে উনিশ শতকের সমকালীন বৃহত্তর কাটোয়া মহকুমার বিভিন্ন স্থান থেকে যে সব প্রস্তর বিগ্রহ আবিস্কৃত হয়েছে তার সিংহভাগ যে স্থানীয় ভাস্করদের সৃষ্টি ,সন্দেহ নেই।কাটোয়ার গোকুল ভাস্কর কিম্বা দাঁইহাটের নবীন ভাস্করের নাম অনেকেই শুনেছেন।সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হলো --নতুনগাঁয়ের কাষ্ঠশিল্পীদের অধিকাংশই দাবী করেন তাদের পূর্বপুরুষরা ছিলেন দাঁহাটের বিখ্যাত ভাস্করগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত।সময়ান্তরে পাথরের কাজে আর তেমন চাহিদা না থাকায় তারা পরবর্তী কালে নতুনগাঁয়ে কাষ্ঠশিল্পকে অবলম্বন করতে বাধ্য হন।
গ্রামের কিশোরদের রন-পা পড়ে বিনোদন |
কাজেই নতুনগ্রামের কাষ্ঠশিল্পের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো বৈচিত্রের সঙ্গে সাবেকিয়ানা।ঐতিয্যের সঙ্গে মুন্সিয়ানা।তক্ষণের সঙ্গে চিত্রণের সুসম্পাদনা।নানা ধরনের খেলনা পুতুলসহ ভাস্কর্য সংস্কৃতির খোদাই ঐতিয্যকে যেমন সযত্নে লালন করে চলেছেন শিল্পীরা ,তেমনি যুগের প্রয়োজনে নিত্যনতুন পরীক্ষা নিরীক্ষার মুখোমুখি হতে হচ্ছে।এর ফলে সৃষ্টি হচ্ছে বৈচিত্রময় নানা ধরনের পুতুল ও মডেল।কিন্তু নতুনগাঁয়ের পুতুলের যে আদি ও অকৃত্রিম বৈশিষ্ট্য যথা রঙের কাজ,তুলির সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম টান এবং পটুয়াসুলভ টানা টানা চোখ...এর থেকে শিল্পীরা বিন্দুমাত্র বিচ্যুত হননি।
দুই
প্রবীণা শাশুড়ি এখনো পুতুল গড়েন |
বরিষ্ঠ লোকগবেষক বিনয় ঘোষ ১৯৬৯ সালের ডিসেম্বর মাসে নতুনগ্রামে এসেছিলেন।মূলত অল ইন্ডিয়া হ্যান্ডি ক্র্যাফটস বোর্ডের তাগিদে--দারুশিল্পীদের নিয়ে ক্ষেত্রসমীক্ষা করতে। সেই সময় তিনি ১৫-১৬ ঘর শিল্পী পরিবার লক্ষ করেছিলেন।অধ্যাপক ঘোষের প্রদত্ত বিবরণ থেকে জানা যায় -শিল্পীরা মূলত তখন লক্ষ্মী পেঁচা ও গৌরাঙ্গের মূর্তি তৈরি করতেন।কাঠ হিসাবে ব্যবহৃত হতো পিটুলি আমড়া শিমূল ও ছাতিম।স্থানীয় পুজোর সময় ,রাসের মেলায় এইসব কাঠের পুতুল বিক্রি হতো।শিল্পীদের আর্থিক অবস্থা ছিল শোচনীয়।শুধুমাত্র শম্ভুনাথ ভাস্কর রাষ্ট্রপতি পুরস্কার পাওয়ার জন্য তাঁর মাসিক আয় ছিল গড়ে ২০০ টাকা।
অধ্যাপক ঘোষের এই সমীক্ষা প্রায় সাতচল্লিশ বছর আগেকার।স্বভাবতই গঙ্গা দিয়ে যেমন অনেক জল গড়িয়েছে ,তেমনি দারুশিল্পে এসেছে স্বাভাবিক পরিবর্তন,পরিমার্জন,বিয়োজন এবং সংযোজন।আমাদের ক্ষেত্রসমীক্ষা বছর তিনেক আগেকার।এখন প্রায় ৪০ ঘর পরিবারের দুইশতাধিক শিল্পী কাজ করছেন।শুধু সূত্রধরেরা নন,অন্যান্য জনজাতিও এই পেশায় এসেছেন।বিয়োজন হয়েছে রাম সীতা মহাদেবের মূর্তি।সংযোজন ঘটেছে বড় বড় মডেলের কৃষাণ-কৃষাণি,সাঁওতাল দম্পতি।সবচেয়ে লক্ষ্যনীয় বিষয় হলো প্রায় পঞ্চাশ শতাংশ মহিলা এই পে্ষার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছেন।
বর্তমানে তিন ধরণেরে কাজ হয় (১)পুতুল(২)কাঠখোদাই(৩)বিগ্রহ।তবে বিগ্রহ তৈরির ধারাটি প্রায় অবলুপ্তির পথে।নতুনগ্রামে বর্তমানে এই ধারার শেষ শিল্পী জীবানন্দ ভাস্কর।তিনি জানিয়েছেন যে দু ফুট লম্বা গৌরাঙ্গ মূর্তির জন্য চাই সিজন করা নিমকাঠের গুঁড়ি।সময় লাগে তিন মাস।বিক্রি হয় ছয় সাত হাজার টাকার মধ্যে।অর্ডার আর আসে না বললেই চলে।কিন্তু সাবেকি পুতুলের কাজ হয় বারোমাস।চাহিদার দিক থেকে প্রথমেই ঊঠে আসে পেঁচা।তিন- চার -ছয় এবং দশ ইঞ্চি লম্বা পেঁচার চাহিদা সারা বাংলা জুড়ে।দুই রকমের পেঁচা তৈরি হয়,যথা ডানা ছাড়া এবং দুসাইডে সামান্য মাটি ধরিয়ে ডানাযুক্ত পেঁচা।লক্ষ্মীর প্রতীক পেঁচা।বছরে তিনবার এই লক্ষ্মীপেঁচার পুজো।ভাদ্র -পৌষ ও চৈত্র মাসে।সেই কারণে ত্রিবেণী খাগড়া দক্ষিণেশ্বর কালিঘাট বড়বাজার প্রভৃতি অঞ্চল থেকে ক্রেতারা পাইকারি মূল্যে পেঁচাগুলি কিনে নিয়ে যান।কালিঘাটের পুতুল বলে যারা আত্মতৃপ্তি অনুভব করেন তাদের অবগতির জন্য জানাই এই পুতুলগুলির সঙ্গে কালিঘাটের যোগ একান্তই বাণিজ্যিক।ধর্মীয় স্থানে বিক্রীবাটা ভালো হতো বলে এতদ অঞ্চল থেকে অনেক শিল্পী কালিঘাটে নোঙর করেন।যেমন গিয়েছিলেন একসময় পটুয়ারা।সেই সূত্রেই কালিঘাটের পটের মতোই নতুনগাঁয়ের পুতুলের নামকরণ হয়েছিল--কালিঘাটের পুতুল ।
দারু বিগ্রহঃমহাপ্রভু ও সীতাদেবী |
সাবেকি ঘরাণার দুই হাত তুলে সংকীর্তনরত গৌর নিতাই মূর্তির চাহিদাও তুঙ্গে।এগুলি আট থেকে দশ ইঞ্চির।গৌর- নিতাইর যুগল দারু বিগ্রহের উপাসনা এই অঞ্চল থেকেই ছড়িয়ে পড়ে বাংলা ও বহির্বাংলায়।অধিকাংশ মূর্তি তৈরি হতো এই অঞ্চলে।তারই ক্ষুদ্রতম সংস্করণ এই গৌর নিতাই পুতুল।বাংলার তৃণমূলস্তরেও বৈষ্ণবধর্ম যে কী গভীরভাবে প্রভাব বিস্তার করেছিল এই পুতুলগুলি তার প্রমাণ।১০-১২-১৫ ইঞ্চির একক গৌরাঙ্গ মূর্তিও শিল্পীরা বানান।এই মূর্তির নাম নটরাজ বা গৌর-নাগরী ।ডান হাত উপরের দিকে অভয়মুদ্রায়উত্থিত।বামহাত নাচের ভঙ্গিমায় কটিদেশে।এই মূর্তির প্রবর্তক ষোড়শ শতাব্দির শ্রীখন্ডের প্রখ্যাত বৈষ্ণব সাধক কবি নরহরি সরকার।তিনি ষোড়শ শতকের শেষে তিনটি বড় গৌর নাগরী মূর্তি বানিয়ে বড়টি কাটোয়ায় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।আজও সেই গৌরাঙ্গ বিগ্রহ পূজিত হচ্ছে কাটোয়ায়।প্রসঙ্গত--বিষ্ণুপ্রিয়া সেবিত নবদ্বীপধামের ধামেশ্বর বিগ্রহটিও দাঁইহাটের সূত্রধরই নির্মাণ করেছিলেন।
গৌরাঙ্গ ছাড়াও গণেশ রাধাকৃষ্ণ(৮-১০ ইঞ্চি) তৈরি হয়।নতুনগাঁয়ের কাঠপুতুলের অন্য চরিত্র বউ পুতুল। ছোট্ট ছেলে-মেয়েরা বিশেষকরে মেয়েদের পুতুলখেলার অন্যতম উপকরণ ছিল বউপুতুল।কাঁচা হলুদ গায়ের রঙ।সবুজ শাড়ি কুঁচি করে পরা।সলজ্জ নববধূ।দিঘল টানা চোখে মায়াবি বিস্ময়।এই পুতুলের জনপ্রিয়তা ধরা পড়েছে বহুল প্রচলিত লোকসংগীতে...
ও দাদা পায়ে পড়ি রে
মেলা থেকে বউ এনে দে
খেলা করে রে...
বর্তমানে বউ পুতুলের জনপ্রিয়তা ক্রমহ্রাসমান।
নতুনগ্রামের খোদাই দারু দুর্গা |
খোদাইমূর্তির বিভিন্ন আকৃতির হয়।ছয় বাই আড়াই ফুট,চার বাই দুই ফুট মাপের আয়তকার সমতল পাটায় খোদাইর মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হয় রাধাকৃষ্ণ,মহিষাসুরমর্দিনি দেবী দুর্গা কালি দশানন রাবণ রাম-রাবণের যুদ্ধ ইত্যাদি। গত কয়েক বছর ধরে কলকাতা ও শহরতলিতে থিমের পুজো চালু হওয়ায় বাংলার মৃতপ্রায় লোকশিল্পগুলি খানিকটা অক্সিজেন পেয়েছে ।ডোকরা,শঙ্খপ্রভৃতি লোকশিল্পগুলির মতো নতুনগ্রামের কাঠপুতুলগুলিও প্রাণ ফিরে পেয়েছে।ফলে খোদাই মূর্তির পাশাপাশি ৩-৫ ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট মডেল তৈরি হতে থাকে।এছাড়া তৈরি হচ্ছে নানা আধুনিক পুতুল যেমন রাজা রানি,চাষি-চাষি বউ,সাঁওতাল দম্পতি গো মানব,বিভিন্ন ধরণের মুখোশ ইত্যাদি।
এইতো সংসার |
এই পুতুল নির্মাণে ব্যবহৃত হয় বিভিন্ন ধরণের নরম কাঠ,যেমন আমড়া,সোনাঝুরি,পিটালি,গামার ইত্যাদি।স্থানীয় কাঠমিল থেকে কিনে আনা হয়।বর্তমানে প্রতি কিউবিক সোনাঝুরি কাঠ ৪০০ টাকা,গামার ৫০০ টাকা।এই কাঠ খোদাইএর কাজে ব্যবহৃত হয় বেশি।এক কিউবিক সোনাঝুরি শিমূলকাঠে ৪০ টির মতো প্রমাণ সাইজের পুতুল বানানো যায়।কাঠ ভালো করে সিজন করে নিতে হবে।যন্ত্রপাতি যা লাগে তা হলো করাত কুরুল বাটালি বাসলে হাতুড়ি ইত্যাদি।গৌর-নিতাই পুতুলের ঊর্ধবাহু হাতদুটি পেরেক ঠুঁকে এঁটে দিতে হয়।এই কাজ পুরুষ শিল্পীরাই করে থাকেন।এরপর মহিলা শিল্পীরা নারকেলের ছোবরা দিয়ে ভালো করে ঘষে নেন।হাত লাগায় বাড়ির ছেলে-মেয়েরাও।ঘষার পর গোবর মাটির হালকা প্রলেপ দেওয়া হয়।এরপর খবরের কাগজের পটি মারা হয় কাঁই আঁঠা মেশানো মাটির গোলা দিয়ে।খটখটে করে শুকিয়ে নিয়ে বোলানো হয় খড়িমাটি।শুরু হয় রঙের কাজ।এই শিল্পে রঙের চিত্রণ অতি গুরুত্বপূর্ণ।ব্যবহৃত হত হয় এর জন্য নানা সাইজের তুলি।তুলির সূক্ষ্ম টানে ফুটিয়ে তোলা হয় অর্ধেক বাঁশপাতার মতো চোখের ভ্রু।ঢুলুঢুলু দু নয়ন।কাপড়ের ভাঁজের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম রেখাচিত্রের বক্রতা।সাবলীল,স্বচ্ছন্দ,সহজ ঋজু ভঙ্গিমায় রেখা অঙ্কিত।এইদিক থেকে দেখলে বাংলার পটচিত্রের সঙ্গে এক অদ্ভুৎ সাদৃশ্য লক্ষ করাযায়।দু ধরনের রঙ এখনো প্রয়োগ করা হয়।জল রঙ ও তেল রঙ।জল রঙ শুকিয়ে নেওয়ার পর সাবু মাখিয়ে বার্নিশ বা ঘামতেল দিলে পুতুলগুলি চকচকিয়ে ওঠে।ইদানিং অবশ্য তেলরঙের চলই বেশি।
পুতুলের কাজ মেয়েরা করলেও খোদাইএর কাজ করেন শুধুমাত্র পুরুষেরা।কাঠের গুঁড়ি কিনে নিয়ে সাইজ করে চিরিয়ে নেওয়া হয়।পাটা বানানোর পর বাটালি দিয়ে খোদাই করা হয়।অবশেষে গালা স্পিরিট এবং কাঠের ন্যাচারাল কালার মিশিয়ে পালিশ করা হয়।মোটামুটি সাড়ে ছয় বাই আড়াই ফুট আকৃতির কাঠ খোদাইএর জন্য লাগে পাঁচ থেকে ছয় কিউবিক গামার কাঠ।এক থেকে দেড় মাস পরিশ্রম করতে হয়।বিক্রি হয় ১৫-২০ হাজার টাকায়।খোদাইএর কাজ মূলত অর্ডার ভিত্তিক।এর কোন স্থানীয় মার্কেট নেই।অবশ্য রাজ্য হস্তশিল্প মেলায় এগুলি বিক্রি করার সুযোগ আছে।পুতুল বিক্রি হয় নবদ্বীপ শান্তিপুরের রাসমেলায়।শ্রীখন্ডের।মাটিয়ারি প্রভৃতি মেলায়।এছাড়া বাংলার বিভিন্ন স্থান থেকে পাইকারি ক্রেতারা পুতুল কিনতে আসেন নতুনগ্রামে।
শিল্পীদের কাছ থেকে প্রাপ্ত পাইকারি বাজার দর(২০১২-১৩)
পেঁচা ৩ ইঞ্চি প্রতি ১০০ পিস.......................................৬০০ টাকা
পেঁচা ৪ ইঞ্চি প্রতি ১০০ পিস...............................১০০০ টাকা
গৌরাঙ্গ ৬ ইঞ্চি প্রতি ১০০ পিস.........................৭০০ টাকা
গৌরাঙ্গ ১০ ইঞ্চি প্রতি ১০০ পিস..............................১০০০ টাকা ।
গণেশ ৮ ইঞ্চি প্রতি পিস.....................................১৫টাকা।
রাধাকৃষ্ণ ১০ ইঞ্চি প্রতি পিস............................৩০ টাকা।
পেঁচারা উঁকি মারছে |
কৃষ্ণ ৮ ইঞ্চি প্রতি পিস.................................১৫ টাকা।
লাভ থাকে ২০ শতাংশ
চার
এবার শিল্পীদের কথা।আগেই বলেছি পুতুল শিল্পের অধিকাংশ কারিগর মহিলা।রাধারানি সূত্রধর, সাগরী সূত্রধ্র ছায়া সূত্রধর ,পুস্পবালা প্রমুখ শিল্পীদের বাপের বাড়ি ভিন গাঁয়ে।বিবাহসূত্রে নতুনগ্রামের বধূ।শাশুড়ি আর ননদের কাছে দু বছরেই কাজ শিখে পেশাদারি দক্ষতা অর্জন করেছেন।খোদাই শিল্পের কারিগরদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যরা হলেন জীবানন্দ ভাস্কর ভক্ত ভাস্কর নিমাই সূত্রধর ছবিরানি ভাস্কর প্রমুখ।শম্ভুনাথ ভাস্কর রাবণের মূর্তি খোদাই করে্ রাষ্ট্রপতি পুরস্কার ,পেয়েছিলেন।তাঁর ভাইপো ভক্তদাস পেয়েছেন রাজ্য সরকারের পুরস্কার।১৯৮৬ সালে ক্রাফট এন্ড কাউন্সিল অব ওয়েস্ট বেঙ্গলের সৌজন্যে বনকাপাসির শোলাশিল্পী আদিত্য মালাকার,দেরিয়াপুরের ডোকরা শিল্পী হারাধন কর্মকার,বাঁকুড়ার শঙ্খশিল্পী রবি নন্দি সহ ভক্তবাবু আমেরিকার ফিলাডেলফিয়া শহরে কাঠের পুতুলের প্রদর্শনী করেছিলেন ।ভক্তবাবুর তৈরি নতুনগ্রামের পুতুলের আদলে নির্মিত দুর্গা প্রতিমার জন্য কাঁকুরগাছির ইয়াংস্টার ক্লাব ২০০১ সালে এশিয়ান পেন্টস শারদ সম্মান লাভ করে।ইদানিং মফস্বলের পুজো প্যান্ডেলগুলিতেও নুতুনগাঁয়ের পুতুলেরা সাদরে স্থান পাচ্ছে।এহো বাহ্য---মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক বাংলা নোটস বইএর প্রচ্ছদে নতুনগ্রামের পেঁচা স্থান পেয়েছে।
শিল্পীরা অধিকাংশই নিরক্ষর।প্রাথমিকস্তর পর্যন্ত পড়াশুনো করেছেন মাত্র ৩০ শতাংশ।মাধ্যমিক পাশ করেছেন মাত্র ১৫ জন।একজন সরকারি চাকরি পেয়েছেন।নাম জয়ন্ত সূত্রধর।
গতশতকের সাতের দশক থেকে পুতুলশিল্পের বিবর্তন আসে।এই পরিবর্তনে সহায়তা করেন লোকসংস্কৃতিবিদ বিনয় ঘোষ,শিল্পী প্রভাস কুমার সেন,শ্রীমতী রুবি পাল প্রমুখ।এখন ডানা পেঁচা,পেঁচার ভিতরে আর একটি ছোট্ট পেঁচা ,লক্ষ্মী মূর্তি ইত্যাদি নতুন ধরনের পুতুল তৈরি হচ্ছে। ১৯৯৫ সালে রাজ্যসরকারের উদ্যোগে জীবানন্দ ভাস্করের শিক্ষকতায় শুরু হয়েছিল পুতুলশিল্পীদের জন্য ট্রেনিংস্কুল।রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারের যৌথ উদ্যোগে এবং স্বর্গীয় স্বামী জানকীদাস কাঠিয়াবাবার দান করা জমিতে ২০০৮ সালে শুরু হয়েছে Natungram Wood Curvings Cluster Society র গৃহ।এর সম্পাদক হলেন মাণিক সূত্রধর।৬০ টি পরিবার এই সোসাইটির অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন।সাম্প্রতিক রাজ্যসরকারের আমলেও প্রভূত উন্নতি হয়েছে নতুনগ্রামের কাষ্ঠশিল্পীদের।
অন্যান্য লোকশিল্পীদের তুলনায় দারুশিল্পীরা অপেক্ষাকৃত ভালো আছেন।সরকারি উদ্যোগে আয়োজিত বছরে অন্তত ৫ টি হস্তশিল্প মেলায় পুতুলশিল্পীরা অংশগ্রহণ করেন।বিক্রীও ভালো
শম্ভুনাথ ভাস্করের সরকারি মানপত্র |
ক্ষেত্রসমীক্ষায় যাঁরা সাহায্য সহযোগিতা করেছেন তাঁদের কৃতজ্ঞতা জানাই।
গ্রন্থঋণ...পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি/বিনয় ঘোষ।
পুরালোকবার্তার সম্পাদক শ্রী সোমনাথ রায়কে জানাই কৃতজ্ঞতা।
ঘরকন্নার ফাঁকে ফাঁকে |
ছবি --লেখক
Bangla r lokshilper arekti notun dik jana gelo. Kintu Bajar cholti damer theke ekhane lekha dam atyonto kom. Ami proti bochhor kichhu khelna putul, jemon ei Pencha sangraho kore thaki Emporium theke. Tai bujhte parchhi ei sob daridro shilpeeder bhayaboho bhabe bonchito kora hochchhe.
ReplyDeleteএকএবারে সত্য কথা।লাভের গুড় পিঁপড়ে খাচ্ছে।
ReplyDelete