বাথুয়া শাক। ভাল নাম কাঁকবতী। মানে কঙ্কাবতী।একে নিয়ে রাঢ় অঞ্চলে প্রচলিত লোকজ রূপকথার গল্প ‘সাত ভাইএর বোন কাঁকবতী’।বাংলা লোকসাহিত্যের এক অসামান্য দৃষ্টান্ত।
কাঁকবতী
সাতভাইএর বোন কাঁকবতী।চাঁদ পারা মুখখানা।টানাটানা চোখ।কাঁচা হলুদের মতো সোনার বরণ।একঢাল কালো চুলে জলভরা শাওন মেঘের রঙ।ও যখন পদ্মদিঘিতে নাইতে যায়-পদ্মফুলেরা আনন্দে দোলায় মাথা।ভোমরারদল মধু খাওয়া ভুলে যায়।চারপাশে ঘুরে ঘুরে গুনগুন স্বরে গান করে।কপালে তার কুমকুমের ফোঁটা।ঝিকমিকিয়ে ওঠে অবাক রাতের তারারা।সাতভাই ওকে খুবই ভালোবাসে।কিনে দেয় নানা খেলনা।হাতি,ঘোড়া,বর-বউ পুতুল,ডুরেল শাড়ি,কাচের চুড়ি আরও কত কী!বাপ-মা মরা মেয়ে তো,আদরটা তাই জম্পেশ।সাতভাই আদর করে আর বলে, ‘বোনের বিয়ে দেবো অচিন দেশের রাজপুত্তুরের সঙ্গে।সে আসবে তেপান্তরের মাঠ ভেঙে।টগবগিয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে।কাঁকবতীকে নিয়ে উড়ে যাবে ঐ নী্ল আকাশের পথে।পক্ষীরাজের পিঠে চড়ে।
কী মজা! কী মজা!!
সাতভায়ের সাতবঊ হিংসায় রাগে জ্বলে পুড়ে মরে।বলে, ‘আদিখ্যেতা দেখলে পিত্তি জ্বলে যায়।বোন আর কারুর নেই যেন!আকাশের চাঁদ চাইলে পেড়ে দিতে হয় বুঝি!’
ঢঙ দেখে রেগে টং ওঠে ওরা।
কিন্তু মনের কথা থাকে মনে মনে।প্রকাশ্যে বললেই বিপদ।স্বামী তো নয়;যেন মানুষ খুন করা ভয়ংকর আসামি!মনের কথা ফাঁস হলেই বনবাস নিশ্চিন্তি।অতএব চুপ করে থাকাই ভালো।তারপর ঝোপ বুঝে কোপ মেরে আগাছার করতে হবে নিকেশ।ঈশাণ কোনে টি্কটিকি ডেকে ওঠেঃ ঠিক...ঠিক!
দেখতে দেখতে আশ্বিন মাস এসে হাজির।নানা রঙে আকাশটা নিকানো।নদির তীরে তীরে কাশফুলের সাদা হাসির ঢেউ।শিশির ভেজা হিমেল বাতাসে শিউলি ফুলের মন কেমন করা গন্ধ।সাতভাই এইসময় যায় দূর দেশে বাণিজ্যি করতে।নদিতে ভাসলো মধুকর ডিঙা।কাঁকবতীর দু চোখের নদিও উথাল-পাথাল।‘হেই ভগবান!দাদারা যেন তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে আসে।আর কিচ্ছুটি চাই না গো!’
অনেক দিন কেটে গেল।দাদারা বাণিজ্য সেরে বাড়ি ফেরেনি।রাতে শুয়ে শুয়ে কেবলি কাঁদে।ওর কান্না দেখে গাছপালারা কাঁদে।রাতের আকাশের মুখ ভার হয়।এদিকে সকাল হতেই বউদিরা ঝাঁঝিয়ে বলল, ‘এবার থেকে তোমাকে রান্না করতে হবে বাপু।আমাদের পালা শেষ।তোমার শুরু’।
--আমি যে রান্না জানিনা।
--তাহলে ঢেঁকিশালে যাও।
--কি করবো?
--কচি খুঁকি নাকি?আজোল গোদা!
--অন্ন গিলবে না অন্ন?
কাঁকবতী হু হু করে কাঁদে।
ছোটবউ ঝামটা মেরে বলল, ‘ন্যাকামি বাদ দাও।ঢেঁকিশালে চল।আমি পাড় দেব।গড়ে ধান দেবে তুমি’।
কাঁকবতী অগত্যা রাজি হলো।কিন্তু অন্যমনস্ক হতেই তার কচি হাতে পড়ল ঢেঁকির কঠিন আঘাত।হাত্টা গেল ছেঁচে।রক্তারক্তি কান্ড।ককিয়ে কেঁদে উঠলো কাঁকবতী, ‘দাদাগো...’
বউরা বুঝলো সাংঘাতিক বিপদ।এই কথা যদি স্বামীদের কানে ওঠে তাহলে আর রক্ষে নেই!সবাই মিলে গুপ্ত ষড়যন্ত্র করে কাঁকবতীকে ঢেঁকির গড়ে ভরে দিল।তারপর থেঁতলে থেঁতলে খুন করে বাড়ির বাইরে সাত হাত গর্ত করে মৃতদেহটিকে মাটি চাপা দিল।সাতবউ পা ছড়িয়ে কাঁদতে বসলো, ‘ওগো আমাদের কাঁকবতীকে বাঘে খেলো গো!আমাদের কী হবে গো!!
দু চার দিন যেতে না যেতেই বউরা দেখলো ওখানে কী সুন্দর শাক হয়েছে।কচি কচি ।সবুজ শাক।পাড়ার বউঝিরা শাক তুলতে এলো লুকিয়ে।হাত দিতেই শাক বলে উঠলো—
তুলো না তুলোনা পাতা
লাগবে মোর প্রাণে ব্যথা।
বউদিরা মেরে করলো ক্ষতি
সাতভাইএর বোন কঙ্কাবতী।
সবাই চিৎকার করে বলে উঠলো, তুমি কাঁকবতী!!
কাঁকবতী বললো,চুপ চুপ!গোড়া উপড়ে দাও।বেরিয়ে যেতে পারি মাটি থেকে।এবার মাটি থেকে বেরিয়ে এসে সব কথা খুলে বললে ওদের।সবাই ছি ছি করলো।
বউরা মাথা হেঁট করে সব শুনলে।কিন্তু আবার তারা ষড়যন্ত্র করতে লাগলো।কাঁকবতীকে বললো,চল আমরা বনদেবতাকে পুজো দিয়ে আসি।তাহলে তোমার দাদারা বাণিজ্য সেরে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরবে।
কাঁকবতীর আর তর সইছে না।বউরা তখন পুজোর নৈবেদ্য আর কাঁকবতীকে সঙ্গে নিয়ে বহুদূরে এক গভীর বনে গেল।তারপর সুযোগ বুঝে তাকে হত্যা করে কাঁকন নদির ধারে পুঁতে দিল।কান্নাকাটি করে পাড়া-পড়শিদের জানিয়ে দিল-কাঁকবতীকে কুমিরে খেয়েছে।
এদিকে কাঁকবতী একটা বড়ো ঝঁকুমাকু বটগাছ হয়ে উঠলো।অনেক দিন পরে সাতভাই বাণিজ্য সেরে নদির তীরে নৌকা লাগালো।ভাইরা বললো এই বটের ছাওয়ায় বসে কিছু খাওয়া যাক।খাওয়ার জন্য বটপাতা ভাঙতেই গাছ বললো—
ভেঙো না ভেঙো না পাতা
লাগবে মোর প্রাণে ব্যথা
বউদিরা মেরে করলো ক্ষতি
সাতভাইএর বোন কঙ্কাবতী।
দাদারা বুঝতে পারলো বউদের অপকীর্তি।কাঁকবতীকে মুক্ত করে ভাবতে শুরু করলো বউদের কিভাবে জব্দ করা যায়।
এদিকে স্বামীরা বাড়ি ফিরতেই বউদের কী আনন্দ!আর কাঁকবতীর জন্য শুরু করে দিল মেকি কান্না।বড় ভাই ধমক দিল-চুলোয় যাক কাঁকবতী।এখন দু মানুষ ভর খাল কর।সোনাদানা মোহর এসব রাখতে হবে না?
খাল কাটা শেষ।ভাইরা তাদের বউদের বললে-তোমরা সব নীচে নামো।ওপর থেকে আমরা মালপত্তর দেবো আর তোমরা সাজাবে।
গর্তে নামল সাতবউ।হঠাৎ করে দেখতে পেলো সাতভাইএর মাঝে কঙ্কাবতী।মিটিমিটি হাসছে।
ভাইরা তখন মাটি পাথর ইট ঝপাঝপ করে গর্তের মুখে ঢালতে লাগলো।
No comments:
Post a Comment