শিবের গাজনঃআদি বোলান ও কয়েকটি প্রাচীন লোকনৃত্য
দেবাদিদেব মহাদেব।তিনি শুধু মহাকাল রুদ্র নন,নটরাজ।নাচ গানের আদি দেবতা।নাচুনি বেহুলা তাঁকে নাচ দেখিয়ে সন্তুষ্ট করেন ।মৃত পতি লখিন্দরের প্রাণও আদায় করে ফিরেছিলেন।শিব আরাধনা বারোমাস হলেও রোদে কাঠ ফাটা চোত মাসে গাঁ-গঞ্জে এলাহি ব্যাপার।এই সময়তো সুর তোলে ঢাক-কাঁসির যুগলবন্দি।ঢোল-নাল মাদল-খোল-মৃদঙ্গ-ক্যাসিও খঞ্জনি-ঝাঁজর -আড়বাঁশির সুরে গ্রাম-বাংলা নাচে গানে মেতে ওঠে। শিবের সার্বজনীন গাজনোৎসব বলে কথা!ধুলো ভাঙার গান,খেস্যাগান,বাধাইগান,এছাড়া হরেক রকমের বোলান গান ইত্যাদিতো রয়েছেই।এর উপর নানা ধরণের প্রাচীন লোকনৃত্যে জমজমাট হয়ে ওঠে শিবের গাজন সংস্কৃতি।
শৈব সাধনার প্রত্ন-স্মৃতি শুধু হরপ্পা সভ্যতায় নয়,বৈদিক যুগের নিন্দিত শিশ্ন উপাসনায় নিহিত আছে।বাংলাদেশে শিবের উপাসনা মূলত লিঙ্গমূর্তিতে হয়।লিঙ্গের অপর নাম শিশ্ন।ঋকবেদে শিশ্নদেব শব্দটিএকাধিকবার উল্লিখিত. ।আর্যরা এই শিশ্নদেবকে একেবারেই পছন্দ করতেন না। আবার ঋকবেদে শিব নামে একদল লোকের কথা জানা যায়।পন্ডিতেরা অনুমান করেছেন এই শিব নামের লোকেরাই হয়তো শিশ্নদেবের পুজো করতেন।হয়তো তার থেকেই দেবতার নাম হয়েছে শিব।পরবর্তীকালে এই শিব হয়ে ওঠেন সবচেয়ে জনপ্রিয় লোকদেবতা। ব্রাত্যজন মানে গাঁ-জনের কাছে যার পুজোর মন্ত্র বলতে স্রেফ ঐ নাচ আর গান।বৃহদ্ধর্মপুরাণে অবশ্য চৈত্রমাসে শিবের উৎসব সম্পর্কে বলা হয়েছে..."চৈত্রমাসে কি ক্ষত্রিয় কি বৈশ্য,কি শূদ্র...দেহ পীড়ন পূর্বক নৃত্যগীত মহোৎসব সহকারে ভক্তিপূর্বক শিবোৎসব করিবে"।আরও বলা হয়েছে "ভক্তি সহকারে নৃত্যামোদে রাত্রি জাগরণ বিধেয়"।নাচে গানে রাত্রি জাগরণে শিবের গাজন উৎসব যে কত প্রাচীন তা বোঝা যায় পুরাণের বর্ণনা থেকে।তাছাড়া শিব শ্মশানচারী দেবতা।শিবের সঙ্গে শব যে যুক্ত হবে এতে আর আশ্চর্য কোথায়।গাঁ-জনের এই শিব সাধনায় তাই আত্মগোপন করে আছে কত বিস্মৃত যুগের লোকাচার।জীবন সংগ্রামের এক অনিবার্য প্রেরণা।পাশাপাশি তাদের আশা আকাঙ্ক্ষা কামনা বাসনা অভাব অভিযোগ ঘাত প্রতিঘাত,সংগ্রাম-উত্তরণের বিচিত্র প্রাণধর্ম প্রকাশিত হয়েছে গাজন কেন্দ্রিক প্রাচীন লোকসংগীত আদি বোলান গানে ও কয়েকটি সুপ্রাচীন লোকনৃত্যে।
নরমুন্ড নিয়ে নাচ গানশিবের গাজনের অন্যতম আকর্ষণ নরমুন্ড নিয়ে নাচ গান।কয়েক জন সন্যাসী বংশ পরম্পরায় চৈত্রমাসের প্রথম দিকে কয়েকটি নরমুন্ড সংগ্রহ করে আনেন।এদের মধ্যে থাকেন একজন ওস্তাদ।নরমুন্ডগুলিকে ভালো করে পরিষ্কার করে নিয়ে তেল সিঁদূর মাখানো হয়।তারপর প্রতিদিন নিয়ম করে দেওয়া হয় মদ আর ভাজা ছোলার নৈবেদ্য। নানা রহস্যময় আচার কৃত্যে নরমুন্ডর পুজো করেন ওস্তাদ।গাঁয়ের ভিন সিমানায় যে কোন গাছের মগ ডালে নরমুন্ডগুলি তুলে রেখে দেওয়া হয়.২৭-২৮ শে চৈত্রের নিশিরাতে ঐ নরমুন্ডগুলিকে পুনরায় তেল সিঁদূর মাখিয়ে চোখে কাজল পরানো হয়।এবার সেগুলিকে শিবের গাজনতলায় এনে সন্যাসীরা একধরণের প্রহেলিকাময় গান করেন।ঢাক কাঁসির বাজনার তালে তালে জমে ওঠে সেই প্রাচীন গান।উত্তররাঢ়ে প্রায় ৫০ টি শিবের গাজনের ক্ষেত্রসমীক্ষাসূত্রে যে গান আমরা সংগ্রহ করেছি তার কাঠামো ও সুর প্রায় একই।কাটোয়ার একটি গ্রাম থেকে সংগৃহীত আদি বোলানের নমুনা...।
এসো মা গো সরস্বতী বসো গো মা পাশে
কি বোলে বোলান গাইবো বুড়ো শিবের কাছে।।1
রাই সরু সরষে সরু,সরু গঙ্গার বালি।
মেটিরির রাম-সীতা বন্দন,জুড়ানপুরের কালী।।
উলোর ভুঁইয়ে ধুলো রে ভাই,মটরের ভুঁইয়ে খই
কালকে পাতা সেজে এলাম মড়ার মাথা কই?
কাটোয়ার ঐ গঞ্জে যাবো বটবৃক্ষতলা।
এইখানেতে নিতাই গৌর করেছিল খেলা।।
কোন মাছুনির মাছ খেয়োছো দাউনি মাছের কড়ি
সেই মাছুনি গাল পেরেছে বাছা ধুলোয় গড়াগড়ি।।
যতগুলি বোলান গাইলাম আরও গাইতে পারি
ওস্তাদের নাম পাঁচু মোড়ল চাঁরুল গাঁয়ে বাড়ি।।
এই আদি বোলান এখনও শোনা যায় কাটোয়ার ঘোষেশ্বরতলায় ,শ্রীখন্ডের ভূতনাথতলায় নিগনের লিঙ্গেশ্বর ,মাঝিগ্রামের কালিন্দী শিবের গাজনে কেতুগ্রামে ইত্যাদি স্থানে।
কালকে পাতার নাচ
কালকেপাতা মানে দেবী কালির মুখোশ পরা বা মুখ আঁকা এক শ্রেণীর শৈব সন্যাসী।এরাও মূলত নরমুন্ড নিয়ে নাচ ও গান করে থাকেন। বংশানুক্রমিকভাবে শিবের গাজনতলায় নাচ গান করে থাকেন।বৃহত্তর কাটোয়া মহকুমার কয়েকটি গ্রামে কালকে পাতা শৈব-সন্যাসীদের দেখা মেলে।যেমন কবি কাশীরাম দাসের জন্মভূমি সিঙ্গি গ্রামে,শ্রীখন্ড,কেতুগ্রাম ,কাটোয়া থানার আখড়া গ্রামে,গুড়পাড়া ইত্যাদি।আচার্য রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী রাঢ়ের গ্রাম দেবতা শীর্ষক প্রবন্ধে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বলেছেন যে কালিকার পাতারা পিশাচ বেশে মৃত
নরদেহ নিয়ে নৃত্য করে ।অনুষ্ঠানটির পোষাকি নাম মড়া খেলা।তিনি লিখেছেন--"কালিকা পাতারা আস্ত মড়া-মনুষ্যের শবদেহ-অনেক সময় গলিত শব -আনিয়া মন্দিরের ওঠানে উপস্থিত হইয়া ঢাকের বাদ্য ও ধূপের ধূঁয়াসহ বিকট পৈশাচিক নৃত্যের অভিনয় করে"।তিনি আরও বলেছেন যে বিখ্যাত ওয়াডেল সাহেব তাঁর Lamaism or Buddhism in Tibet নামক গ্রন্থে লামাদের অনুষ্ঠিত যে সকল পৈশাচিক অভিনয়ের সচিত্র বিবরণ প্রকাশ করেছেন যা তিব্বত নেপাল ভুটানে প্রচলিত ছিল তার সংগে অদ্ভুৎ মিল দেখতে পাওয়া যায় এই কালকে পাতা সন্যাসীদের নাচ ও গানে। শ্রীখন্ডের ভূতনাথের গাজনে কালকে পাতারা মানত করে অনেক সময় সন্যাসী হন।সারাদিন উপোস থেকে মাঝ রাতে কুম্ভকারের কাছে মুখ চিত্রিত করে আসেন।আখড়া গ্রামের কালকে পাতারা এক ধরণের বিচিত্র শোলার মুখোশ ব্যবহার করেন।শিবের স্নান যাত্রায় অংশ গ্রহণ করে বিশেষ মুদ্রায় নাচেন আর প্রহেলিকাময় গান করেন।
রাক্ষস নাচ
মূলত কেতুগ্রাম অঞ্চলে শিবের গাজনের প্রথম দিন অর্থাৎ ২৭ কিম্বা ২৮ শে চৈত্র সকালবেলায় শিবের গাজনতলায় শুরু হয় ঐতিয্যবাহী রাক্ষস নাচ।এই নাচ করেন মূলত শ্রমজীবীরা।রাক্ষস বলা হলেও আদতে রাক্ষসী।ভয়ংকর তার দেহ।লাল তার চোখ।মুখে ঝুলকালি।তাতে হলুদের ফোঁটা।লকলকে জিভ বেরিয়ে আসছে।করাল দংষ্ট্রারেখা।রক্ত লাঞ্ছিতা।গায়ে লাল-কালো পোষাক।পয়োভারে টলমল।লম্বা লম্বা টিনের হাত।কোমর অব্দি আছড়ে পড়া চুলের ঢেউ।কটিদেশে ছোট-বড়ো ঘাঘর ঘন্টা।ঠাকুরমার ঝুলি থেকে বেরিয়ে পড়া ভংকর দত্যি দানব যেন।উড়ন বাজিয়ে ঢাকিদারের সলম্ফ তেহাই।শুরু হয় রাক্ষস নাচ।পাঁচমিনিটের লোকনৃত্যের রোমাঞ্চকর এক চিত্রনাট্য।।একক বা যৌথ নাচের মেঠো আসর প্রতিটি শিবের গাজনতলায়।গবেষকরা বলেন রাক্ষস নাচ আসলে প্রাচীন কালকেপাতা নাচ থেকে হুবহু টোকা।কিন্তু কালকেপাতা আর যাই হোক মুখোশ পরা বাধ্যতা মূলক নয়।রাক্ষস নাচে মুখোশ থাকবেই।এই মুখোশ তৈরি করেন স্থানীয় সূত্রধরেরাএকটি প্রমাণ সাইজের কঞ্চির ঝুরির মধ্যে মুখ চোখের ছিদ্র করে কাগজএর পটি মারা হয়।তারপর মাটির গোলা দিয়ে জমি তৈরি করে জিভ কান ইত্যাদি বানানো হয়।রঙের কাজ হয়ে গেলে সে এক দেখবার জিনিষ।এই নাচ পাঁচ থেকে দশ মিনিটের।তবে এদের হাতে নরমুন্ড থাকে না।
শকুন নাচ-গান
কেতুগ্রাম কাটোয়া অঞ্চলের শিবের গাজনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য পোরো বোলান আর শকুন নাচ।পোরো মানে পুরাতন।কালকেপাতার মতো শৈব সন্যাসীদের নাচ গান।অনেকে আবার মনে করেন বৌদ্ধ বজ্রযানী সম্প্রদায়ের এক বিশেষ ধর্মীয় আচার-কৃত্য যা পরবর্তীকালে শৈবসাধনাতে অনুপ্রবেশ করেছে।অনুষ্ঠানটি দুটি ভাগে বিভক্ত নাচ আর গানে।দলে ২০-২৫ জন শিল্পী থাকেন।একজন ওস্তাদ বা মূল গায়েন থাকেন।ফাগুনমাসে তিনি নরমুন্ড সংগ্রহ করেন।গাছে টাঙিয়ে রাখেন।গাজুনে সন্যাসীদের মতো পুজো আচ্চা করেন।এরপর শিবের ফল উৎসবের গভীর রাতে সাজগোছ করেন।একজন শিব সাজেন।বাকিরা কালী বা ভূত পেত্নী।লাল রঙ দিয়ে চোখ আঁকা হয়।পরনে লাল-কালো ঘাঘরা।কোমরে ঘণ্টা নেউর।হাতে চকচকে তলোয়ার,রাম-দা ,হেঁসো টাঙি।একজন শাঁখ বাজান।মদ খেয়ে সব বেসামাল।গভীর রাতে এদের আগমন।মুখে তারস্বরে শিওবের নাম।ঢাকিদার একটি বাঁধা তাল বাজিয়ে তাদেরকে গাজনতলায় নিয়ে আসে।এবার মড়ার মাথাগুলিকে আসরের মাঝে রেখে গোল হয়ে হয়ে বসে শুরু করে বিলম্বিত লয়ে করুণ সঙ্গীত।বিশেষ বাজনার ছাঁদে জমে ওঠে এই পালাগান। যেমন পালার নাম হরিশচন্দ্র বা শ্মশান মিলন।
দারুণ বিধিরে ওরে ও বিধি
বড়ো বাদ সাধিলি,ওরে বড়ো বাদ সাধিলি
আজ কোল ভরাধন কোলের মাণিক
কেন হরে নিলি।।(ধুয়ো)
১)প্রথমে বন্দনা করি (২) করি গণেষের চরণ
তারপরে বন্দনা করি মা কালীর চরণ।।
২) হরিশ্চন্দ্রের শ্মশান মিলন(২) গাইবো বোলান।
অকালেতে প্রাণের রতন হারালো জীবন।।ধু
৩)মাঠের মধ্যে বট বিরিক্ষি সেইতো মাঠের মাথা
একলা মায়ের পুত হারালে মা দাঁড়াবে কোথা।।ধু
৪)ওরে বাছা রোহিতাস্য (২) জীবনের জীবন
একবার মা বলে ডাকরে বাছা জুড়োবে রে মন।।ধু
৫)মৃত পুত্র কোলে লয়ে আমি এক নারী
দয়া করো ও পাটুনি পুত্র সৎকার করি।।ইত্যাদি।।
এই গানে প্রতিটি কলির শেষে ধুয়োতে ফিরে আসতে হয়।প্রতি কলির ২ চিহিন্ত পঙতি দুবার গাইতে হয় দু রকম সুরে।প্রথম বার গাওয়ার পার বাজনার জন্য ছাড় থাকে।ঢাকিদার আট মাত্রার কাহারবা দুই দুই ছন্দে বাজান।ধাগধাদি/নাকতিন/তা....../গেরেগেরে...।।অনেকেই বলেন গানের সুরে দরবারি কানাড়ার প্রভাব পড়েছে।তারপরে বন্দনা করি মা কালীর চরণ।।
২) হরিশ্চন্দ্রের শ্মশান মিলন(২) গাইবো বোলান।
অকালেতে প্রাণের রতন হারালো জীবন।।ধু
৩)মাঠের মধ্যে বট বিরিক্ষি সেইতো মাঠের মাথা
একলা মায়ের পুত হারালে মা দাঁড়াবে কোথা।।ধু
৪)ওরে বাছা রোহিতাস্য (২) জীবনের জীবন
একবার মা বলে ডাকরে বাছা জুড়োবে রে মন।।ধু
৫)মৃত পুত্র কোলে লয়ে আমি এক নারী
দয়া করো ও পাটুনি পুত্র সৎকার করি।।ইত্যাদি।।
গানের শেষে শুরু হবে শকুন নাচ।নরমুন্ডগুলি একজায়গায় রেখে সকলেই গোলাকারে দাঁড়াবে।এরা শকুন।বৃত্তের বাইরে দুজন শিয়াল।নাচের আসর হয়ে উঠবে শ্মশানক্ষেত্র ।ঢাকিদার প্রথমে দ্রুতলয়ে ছক্কা বাজাবে।শিল্পীরা দুহাত প্রসারিত করে নাচবে ,যেন মনে হবে তারা আকাশে উড়ছে।বাজনার লয় অনুসারে ধীর থেকে দ্রুত লয়ে তাদের ওড়ার ভঙ্গি।এবার দ্বিতীয়পর্ব শুরু।নরমাংস খাওয়ার জন্য শকুনরা আকাশ ছেড়ে শ্মশানে বসবে।এটা অত্যন্ত নাটকীয় ও চমকপ্রদ।এখানেও কাহারবা ছন্দে ঢাক বাজে। সঙ্গে কাঁসির ঠেকা।ধীর থেকে দ্রুত লয়ে।তালটি
হলোঃধিনাক নাতিন তিনাক তা//নাক তিন তিন তিনাক তা//মাতানের তেহাইয়ে একটি একটি করে শকুন বসবে।সকলের বসা হয়ে গেলে মাটি ঘেঁষে বিশেষ মুদ্রায় শকুনরা এগিয়ে যাবে নরমুন্ডের দিকে।তখনকার ঠেকাটি হল...। ধিধি নাকধিনা তিতিনাকতিনা।।শিয়াল ও দ্রুত ছুটে আসে।শকুনরা ছিটকে যায়।এইভাবে শিয়াল আর শকুনের লড়াই এ জমে ওঠে এই লোকনৃত্যটি।নাচের শেষে শকুনের দল শিয়ালের বাধা অতক্রম করে দখল নেয় নরমুন্ডের।ঢাকিদার বাজাতে থাকেন ধাধিন না তিন ধাধিন ধিনা /ধাগধিনাধিন নাতিন তিনা।।
No comments:
Post a Comment