বর্গি এলো দেশে
উত্থান ও পতন,আলো আর অন্ধকার,সৃষ্টি এবং ধ্বংস—এই বোধহয় ইতিহাসের নিয়তি।কালের কাটাকুটির কুটিল খেলা।ইতিহাস তো মহাকালের চিত্রগুপ্ত।অন্তহীন সময়ের সে লিপিকার।তার খেরোর খাতায় ঘটনার কত ঘনঘটা।চমকপ্রদ আর অপ্রত্যাশিত!
কে জানতো-সুদূর মহারাষ্ট্রে উত্থিত বর্গিহাঙ্গামার ঘূর্ণিঝড় দক্ষিণবঙ্গে একদিন আছড়ে পড়বে।সবকিছু ছারখার করে দেবে।একটা আস্ত নগরের ঘটবে মৃত্যু।বিস্মৃতির অতল সাগরে তলিয়ে যাবে তার গৌরবের ইতিকথা।ইতিহাসের পাতায় নামটি শুধু টিকে থাকবেঃ ইন্দ্রাণী।
সপ্তমাতৃকার অন্যতম দেবী।তাঁর নামাঙ্কিত ইন্দ্রাণীনগর।কবিকঙ্কন মুকুন্দরাম চক্রবর্তী এই নগরদেবীকে বন্দনা করেছিলেন তাঁর চন্ডীমঙ্গল কাব্যে----
‘ সম্মুখে ইন্দ্রাণী...ভুবনে দুর্লভ জানি......দৈব নাশে যাহার শরণে’।
কাটোয়ার শাঁখাইঘাট থেকে দাঁইহাটের ভাউসিং।গঙ্গার তীর বরাবর একদা গড়ে উঠেছিল বাণিজ্য আর তীর্থনগরী ইন্দ্রাণী।আবুলফজলের ‘আকবরনামা’য় উল্লিখিত ইন্দ্রায়িনপরগনা।গঙ্গার তীরে গগনচুম্বী কত দেবালয়!ঘাটে ঘাটে শত শত পুণ্যার্থীদের স্নান।পুজোর ব্যস্ততা।সুরেলা ঘন্টাধ্বনি।হাটে হাটে হরেক পশরার বিকিকিনি।নগরিয়ারা আত্মশ্লাঘায় হেঁয়ালি করে বলতো—
বারঘাট তেরহাট তিন চন্ডী তিনেশ্বর।
ইহা যে বলিতে পারে ইন্দ্রাণীতে তার ঘর।।
তেরহাটের ঐশ্বর্য ছড়িয়ে পড়েছিল বৃহৎ বঙ্গে।বারঘাটের নাম ছড়িয়েছিল সারা ভারতবর্ষে।সেই বার ঘাটের অন্যতম ইন্দ্রেশ্বরঘাট।কবি কৃত্তিবাস তাঁর রামায়ণকাব্যে লিখেছিলেন—
ইন্দ্রেশ্বর ঘাটে যেবা নর স্নান করে।
অযুত বৎসর থাকে সে স্বর্গপুরে।।
কিন্তু এই ঐশ্বর্য,এই নামই হয়েছিল তার কাল।পতনের কারণ।লুঠেরা বর্গিরদল সম্পদের লোভেই ছুটে এসেছিল।ইন্দ্রাণীতে গেড়েছিল ঘাঁটি।দক্ষিণবঙ্গে লুঠপাট-অত্যাচার-সন্ত্রাস করে বিভীষিকা কায়েম করেছিল।তছনচ করে দিয়েছিল কত সাজানো সংসার!
সত্তর দশকের জনপ্রিয় হিন্দিছবি ‘শোলে’।কুখ্যাত ডাকু গব্বর সিং’র ডায়লগটাএখনো লোকের মুখে মুখেঃ...শো যা বাচ্চে-না তো গব্বর সিং আ যায়েগা
আর গ্রাম-বাংলার দুরন্ত শিশুদের ঘুম পাড়াতে গিয়ে মা এখনো সুর করে ছড়া কাটেন—
ছেলে ঘুমালো পাড়া জুড়ালো বর্গি এলো দেশে।
বর্গি!মারাঠা লুঠেরা’বার্গির সৈন্য’।এখন যেমন কোবরা,সি আর পি,প্যারামিলিটারি ফোর্স ইত্যাদি।অষ্টাদশ শতকের মারাঠা সেনাবাহিনীর তেমনি বার্গির আর শিলাদার।ঘোড়ায় চেপে যুদ্ধ করতো। অস্ত্র আর ঘোড়া যোগাতো মারাঠা সরকার।বাকি টাকাটা মানুষের উপর অত্যাচার করে,লুঠপাট করে সংগ্রহ করতো।
অষ্টাদশ শতকের চারের দশক।মোঘল সূর্য পশ্চিম পাটে।সিং’হাসনে দুর্বল সম্রাট মহম্মদ শাহ।এদিকে মারাঠারাজ শাহুর প্রধানমন্ত্রী পেশোয়া বালাজী রাও।মারাঠা চানক্য।মোঘল শাসনাধীন রাজ্যগুলির জন্য চৌথ বাবদ অর্থ চাইলেন।কোথায় পাবেন মোঘলসম্রাট? অধীনস্ত প্রদেশগুলি বার্ষিক কিছু হাততোলা অর্থ দিয়েই দায়সারে।সুতরাং সম্রাট বললেন—ও টাকা তোমরাই তুলে নাও।
মারাঠারাজ শাহু এবার নাগপুরের রঘুজি ভোঁসলেকে চৌথ আদায় করার দায়িত্ব দিলেন।রঘুজি আবার তার প্রধানমন্ত্রী ভাস্কর কোহলাতকারকে নিযুক্ত করলেন।কোঙ্কনী ব্রাহ্মন।যেমন বুদ্ধিমান তেমনি চিতার মতো ধূর্ত আর ধুরন্ধর।লোকে একডাকে চিনতো ভাস্কর পন্ডিত নামে।চৌথ আদায়ে সঙ্গে নিলেন বাইশজন বাছাই করা মারাঠা সর্দার।যেমন ধামধরমা,হিরামন কাসি,গঙ্গাজি আমড়া,সিমন্ত যোসি,শিবাজি কোহরা, কেশর সিং প্রমুখ।যেন এক একটা ভয়ংকর ডাকু সর্দার।হিংস্র আর লুঠেরা।সঙ্গে বিশ হাজার খতরনাক বর্গিসেনা।চৌথ আদায়ের উদ্দেশে তারা যাত্রা শুরু করলো।গন্তব্য রাঢ়-বাংলা।সময়টা ১৭৪২ খৃস্টাব্দ।
দুই
আলিবর্দি খাঁ।বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার নবাব।অপ্রতিদ্বন্দ্বী অকুতোভয় শাসক।সিং’হাসনের কাঁটা সরফরাজ খাঁকে হত্যা করেছেন।দিল্লিকে করেন থোরাই কেয়ার।উড়িষ্যায় বিদ্রোহ দমন করতে ছুটে গেছেন।সঙ্গে বেগমসাহেবা আর আদরের নাতি কিশোর সিরাজ।সেই সঙ্গে বিশাল সৈন্যবাহিনী।
উড়িষ্যায় বিদ্রোহ দমন করে বিজয়ী নবাব বর্ধমানের রানিসায়রের পাড়ে তাঁবু ফেললেন।রনক্লান্ত সৈন্যরা কয়েকদিন বিশ্রাম নিয়ে বিজয়গর্বে ফিরে যাবে মুর্শিদাবাদে।চলছে খানা-পিনা,গান-বাজনার এলাহি আয়োজন।
এমন সময় গুপ্তচর এসে জানালো সংবাদটা।নবাবের ঠোঁটে অবজ্ঞার হাসি।দশ লক্ষ টাকার দাবিপত্র নিয়ে ভাস্কর পন্ডিতের দূত তখনও নতমস্তকে দাঁড়িয়ে।নবাবের হাসিটা আরও চওড়া হলো।সেনাপতি মুস্থাফাখাঁর পরামর্শে ভাস্করকে গ্রেপ্তার করার নির্দেশ দিলেন উদ্ধত আলিবর্দি।
১৫ই এপ্রিল বর্ধমানে প্রবেশ করে নবাব সৈন্য।কয়েকটা দিন কেটে গেল।গভীর রাত।অনেকেই নিদ্রালু।সুরাচ্ছন্ন।এমন সময় পঙ্গপালের মতো তাঁবুর চারপাশ অতর্কিতে ছেঁকে ধরলো মারহাট্টা বর্গিরা।বর্ধমান শহরের মহল্লায় মহল্লায় তখন আবালবৃদ্ধবনিতাদের ভয়ার্ত আর্তনাদ!আগুনের লেলিহান শিখা।যে যেদিকে পারছে পালিয়ে যাচ্ছে।নবাব কার্যত দিশেহারা।আকস্মিক আক্রমনে বিভ্রান্ত।সেনারা সবকিছু ছেড়ে নবাব ও তার ফ্যামিলিকে রক্ষা করতে ব্যস্ত।
দিনেরবেলায় সব ফাঁকা।কোথাও কিছু নেই।তবু দলে দলে লোক বর্ধমান ছাড়ছে।নবাব বুঝতে পারলেন মারাঠারা গেরিলা যুদ্ধে ওস্তাদ।এখুন তারা অন্তরালে থেকে পর্যবেক্ষণ করছে।
এদিকে শুরু হয়েছে তীব্র খাদ্য সংকট।এক সপ্তাহের উপর বর্ধমানে আটকা পড়েছেন।নবাব তাঁর সেনাপতিদের নিয়ে পরামর্শ করলেন।এখান থেকে যেমন করেই হোক-কাটোয়া পৌঁছাতে হবে।ওখানে কাটোয়া আর শাঁখাই দুর্গে রয়েছে প্রচুর অশ্ত্রশস্ত্র,সৈন্যসামন্ত।আছে বিরাট এক শস্যগোলা।সুতরাং খাবারের কোনো অভাব হবে না।
বর্ধমান-কাটোয়া বর্তমান বাসরুট-৫৮কিমি দৈর্ঘ্য।তখন কাঁচা রাস্তা।চলতো উটের গাড়ি।নবাব ও তার পরিবারকে ব্যারিকেড করে ২৩শে এপ্রিল নবাবসৈন্য কাটোয়ার উদ্দেশে রওনা দিল।সৈন্যরা যত এগুতে থাকলো বর্গির দল কোথা থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে এসে আক্রমন করতে থাকলো।যা থাকে কেড়ে নিয়ে মিলিয়ে যায় বাতাসের মতো।রাস্তার দুপাশের গ্রামগুলিতে চালায় হানাদারি।আতঙ্কে আর গুজবে মানুষ তখন যেদিকে পারছে ছুটছে।
নিগন সরাই’র রাস্তায় মারাঠারা হঠাৎ চারদিক থেকে বেগমের শিবিকাকে ঘিরে ধরে।সৈন্যাধ্যক্ষ ওমর খানের পুত্র মোসাহেব খাঁ বীর বিক্রমে যুদ্ধ করে বেগমসাহেবাকে রক্ষা করলো নিজের প্রাণের বিনিময়ে।ঘোড়া থেকে পড়ে যান মিরহাবিব।মারাঠাদের হাতে বন্দী হন।এই মিরহাবিবই পরবর্তী সময়ে বর্গিহাঙ্গামার ত্রাস হয়ে উঠেছিল সমগ্র দক্ষিণবঙ্গে।
বর্ধমান থেকে কাটোয়া-ওইটুকু রাস্তা সৈন্যদের পৌঁছাতে সময় লেগেছিল তিন দিন তিন রাত।ক্ষুধার্ত,ক্লান্ত সৈন্যরা শুধু নন,নবাবসাহেবও কলার এঁটে সিদ্ধ খেয়ে কোনোরকমে প্রাণ ধারণ করেন।গঙ্গারামের মহারাষ্ট্রপুরাণ কাব্যগ্রন্থে লেখা আছে—
কলার আইঠ্যা যত আনিল তুলিয়া।
তাহা আনি সব লোকে খায় সিজাইয়া।।
বিষম বিপত্য বড় বিপরীত হইলো।
অন্যপরে কা কথা নবাব সাহেব খাই।।
বিধ্বস্ত ক্ষুধার্ত সৈন্যরা কাটোয়ায় এসে পৌঁছালো।কিন্তু তার আগেই কাটোয়ার শস্য ভান্ডার পুড়িয়ে দিয়ে ইন্দ্রাণী দখল করে নেয় মারাঠারা।আলিবর্দি খাঁ কাটোয়ার দুর্গে অবস্থান করলেন।মুর্শিদাবাদ থেকে এলো সৈন্য-সামন্ত।অস্ত্র-শস্ত্র আর প্রচুর খাদ্য রসদ।ভাস্করকে আক্রমন করার প্রস্তুতি এবার।
ভাস্কর দাঁইহাট থেকে পিছোতে শুরু করলেন এবং একসময় সিদ্ধান্ত নিলেন স্বদেশেই ফিরে যাবেন।কিন্তু মিরহাবিবের পরামর্শে বাছাই করা সৈন্য নিয়ে রাতের অন্ধকারে গঙ্গা পেরিয়ে সোজা মুর্শিদাবাদ।এক দুঃসাহসিক অভিযান!জগৎশেঠের কুঠি থেকে প্রায় দুকোটি টাকা ও বহু মূল্যবান দ্রব্যাদি লুন্ঠন করে দাঁইহাটে ফিরে এলেন।
তিন
এক একটি ঘটনা যেমন মানুষের জীবন আমূল পালটিয়ে দেয়,তেমনি ঘটনা বা দুর্ঘটনার জেরে যুগ ও জাতির জীবনে আসে পরিবর্তন।ঘটে কালান্তর।শুরু হয় এক নয়া ইতিহাস।
ভাস্করের ঐ দুঃসাহসিক অভিযানের গুরত্ব উপলব্ধি করে মুর্শিদাবাদ রক্ষার জন্য নবাব স্বসৈন্যে পলায়ন করলেন।ভাস্কর মওকা বুঝে শাঁখাই কাটোয়া দুর্গের দখল নিলেন।বর্ধমান রাজাদের গঙ্গা-নিবাস,মাণিকচাঁদের বাড়ি এক কথায় ইন্দ্রাণীর সবকিছু চলে এলো বর্গিদের হাতের মুঠোয়।
মিরহাবিবের পরামর্শে দাঁইহাটের বুড়োরানির ঘাটে নৌকার সেতু তৈরি হলো।শাঁখাই থেকে ভাউসিং বর্গিদের সৈন্যদেরশিবির গড়ে উঠলো।ইন্দ্রাণীর জমিদার ব্যবসাদাররা তখন থরহরি কম্পমান।নিয়মিত নজরানা আসতে লাগলো।
শুরু হলো ব্যাপক লুন্ঠনলীলা।একদিকে ভাগীরথী পেরিয়ে নদিয়া-মুর্শিদাবাদ জেলার গাঁ-গঞ্জ।অন্যদিকে ভাগীরথীর তীর ধরে হুগলি জেলা।কলকাতাকে বাঁচানোর জন্য ইংরেজ আর জমিদাররা মিলে গড়খাত কাটলো।মারাঠা-ডিচ নামে এটি বিখ্যাত।বর্ধমান ও বীরভূম জেলার বিস্তীর্ণ জনপদে নেমে এলো বর্গিদের নিদারুণ অত্যাচার।স্থানীয় চোর-ডাকাত-সমাজবিরোধীরাও যোগ দিয়ে অবস্থা ভয়াবহ করে তোলে।সাধারণ মানুষের তো কথাই নেই,স্বয়ং বর্ধমানরাজ চিত্রসেন ভয়ে কোথায় লুকিয়ে পড়লেন।নবাবি শাসন কার্যত শেষ।দক্ষিণবঙ্গ মুক্তাঞ্চলে পরিনত হলো।যেন শয়তানের অভিশাপ নেমে এলো।দেশের দন্ডমুন্ডের মালিক হলেন ভাস্কর পন্ডিত।ইদ্রাণীর প্রাণকেন্দ্র সেদিনের ‘দাঞিহাট’।ভাগীরথী আর দুর্ভেদ্য গড়খাত(দেওয়ানগঞ্জ হয়ে দাঁইহাট উচ্চ বিদ্যালয়ের পাশ দিয়ে খনন করা শাহা জঙলি গড়খাত)বেষ্টিত নিরাপদ ভূখন্ড।ধনী,জ্ঞানী,গুণী,মানী লোকের ছিল বাসভূমি।
সকাল থেকে শুরু গ্রাম-দখল আর লুঠপাট।বর্গিরা দলে দলে বিভক্ত হয়ে ঘোড়ায় চেপে আর চকচকে খোলা তলোয়ার নিয়ে গ্রামে গ্রামে ঢুকে পড়তো তড়িৎ গতিতে।মুখে হারা হারা(হর হর)র হাড়হিম করা আওয়াজ!গ্রামে ঢুকেই জ্বলন্ত মশাল দিয়ে কয়েকটি বাড়িতে পর পর আগুন।আতঙ্কিত গ্রামবাসীরা অসহায়ভাবে যে যেদিকে পারছে ছুটছে।বর্গিরা সোনা,রুপো।টাকা-পয়সা যা পাচ্ছে কেড়ে নিচ্ছে।না পেলে নাকে জল ভরে অথবা পুকুরে চুবিয়ে ধরছে।কারো কারো হাত-পা কেটে দিচ্ছে।সুন্দরী মেয়েদের পিছমোড়া করে বেঁধে একদল সৈন্য তখন ধর্ষণ করছে।সমসাময়িক কবি গঙ্গারাম লিখেছেন—
ভালো ভালো স্ত্রীলোক যত ধইরা লইয়া জাএ।
আঙ্গুষ্ঠে দড়ি বাঁধি দেয় তার গলাএ।।
একজন ছাড়ে তারে আর জনা ধরে।
রমণের ভরে ত্রাহি শব্দ করে।।
এ তো গাঁ’এর ভিতরের ছবি।এবার মাঠের বা রাস্তার কথা।আতঙ্কে ভয়ে সবাই পালাচ্ছে।কিন্তু কোথায় যাবে?গর্ভবতী মহিলা,ক্ষুধার্ত শিশু,পুথি-বগলে ঘটি বামুন,সোনার বেনে,গন্ধবণিক,কাঁসারি প্রভৃতি বর্গির ভয়ে পালাচ্ছে।গোঁসাই বৈষ্ণব মাহান্তরা আবার চৌপালায় চড়ে বোচকা বুচকি নিয়ে ধাবমান।কেউ যাচ্ছে পুবে।কেউ বা পসচিমে।এমন সময় বর্গির দল তাদেরকে ঘিরে ধরে।টাকা-পয়সার সঙ্গে লুঠ করে নিয়ে যায় তাদের ঘরের মা-বোনেদের।সমসাময়িক কবি ভারতচন্দ্র রায় তাঁর অন্নদামঙ্গল কাব্যে লিখেছেন—
কাটিল বিস্তর লোক গ্রাম গ্রাম পুড়ি।
লুটিয়া লইলো ধন ঝিউড়ি বহুরি।।
কাটোয়া,পানুহাট,মোড়লহাট,বিকিহাট,বেড়া,পাতাইহাট,আতাইহাট,দাঁইহাট,ভাউসিং,অগ্রদ্বীপ,ঘোড়ানাশ,মুস্থল,সিঙি,বাক্সা,চাড়ুল,পাটুলী,করুইকৈথন,কাগাঁ,মৌগাঁ,যাজিগ্রাম,ননগর,কোশিগ্রাম,কোপা,কেতুগ্রাম,কাঁদরা,সালারসহ -সোনারুন্দি,বর্ধমান- কাটোয়ার রাস্তার দুপাশের গ্রামগুলি বর্গিহাঙ্গামায় যেন নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল।কাটোয়া অঞ্চলের ধনী ও সম্ভ্রান্ত মুসলমানেরা পূর্ববঙ্গে পলায়ন করেন।অনেক হিন্দু জমিদার,বণিক,ধনাঢ্য ব্যক্তিরা কলকাতায় থিতু হয়েছিলেন।এমন রাষ্ট্রবিপ্লব রাঢ়ের ইতিহাসে খুব কমই দেখা গেছে।বর্তমানেও অবশ্য গ্রাম-দখলের রাজনীতি ফিরে এসেছে।ভিন্ন মাত্রায়।ভিন্ন আঙ্গিকে।
এদিকে বর্ষার বিদায়।এল শরৎকাল।আকাশে বাতাসে আনন্দময়ীর আগমনি।ভাস্কর মনস্থির করলেন এবার দশেরা উৎসব দুর্গাপুজোর মধ্য দিয়ে নিস্পন্ন হবে।ইন্দ্রাণী পরগনার সকল জমিদারকে খবর দেওয়া হলো।ভয়ে ভক্তিতে তারা নজরানা দিয়ে উৎসবে যোগ দিলো।দাঁইহাটে তখন বর্গিরা উৎসবে মেতে উঠলো।
নবাব আলিবর্দি খাঁ শুধু এই সুযোগটার জন্য অপেক্ষা করছিলেন কয়েক মাস ধরে।গঙ্গার ওপাড়ে বল্লভপাড়া ও বসতপুরের মাঝামাঝি ছাউনির ডাঙায় বিপুল সৈন্য সমাবেশ করলেন।ভাস্করও প্রস্তুত দাঁইহাটে।উভয়পক্ষের কামান বর্ষণে উত্তাল হয়ে উঠলো গঙ্গাগর্ভ।নবাব বুঝতে পারলেন এইভাবে যুদ্ধ করা নি্রর্থক।আবার সোজাসুজি গঙ্গা পেরিয়ে দাঁইহাটে ঢোকা বোকামি ছাড়া আর কিছুই নয়।তাই রাতের অন্ধকারে উদ্ধারণপুরে গঙ্গা পেরিয়ে সোজা শাঁখাই ঘাটে সৈন্যদের নিয়ে আসা হলো।
কানায় কানায় ভরা দুরন্ত অজয় আর গঙ্গা।সুতরাং সেতু বানিয়ে পার হওয়া ছাড়া গতি নেই।সৈন্যদের পদভারে হুড়মুড় করে সেতু গেলো ভেঙে।অনেক সৈন্য ভেসে গেল নদির স্রোতে।বাকিরা অদম্য মনোবল নিয়ে প্রবল বিক্রমে দাঁইহাটের পথে...
------আল্লা হো আকবর!!
- -----হারা হারা.........
দুপক্ষের তীব্র চিৎকারে বেধে গেল তুমুল রন।অতর্কিত আক্রমনে দিশেহারা ভাস্কর।নবমীর পুজো ফেলেই মহারাষ্ট্রের পথে ঘোরা ছোটালেন দ্রুতবেগে।
চার
১৭৪৩ খ্রিস্টাব্দ।স্বয়ং রঘুজি ভোঁসলে আর ভাস্কর পন্ডিত প্রতিশোধ নিতে হাজির হলো দাঁইহাটে।এদিকে দিল্লির মোঘল সম্রাটের কাছে আবেদনের ভিত্তিতে পেশোয়া বালাজিবাজিরাও সসৈন্যে হাজির মুর্শিদাবাদে।
একেই বলে জোড়া ফলার আক্রমন।শাঁখের করাত.৩১শে মার্চ নবাব পেশোয়ারের সঙ্গে ২২লক্ষ টাকার বিনিময়ে চুক্তি করে মুক্তি চাইলেন।উভয় বাহিনী মিলে রঘুজি ও ভাস্করকে এ যাত্রায় বাংলা ছাড়া করলো।
১৭৪৪খ্রিস্টাব্দ।অপমানাহত রঘুজি ভাস্করকে পুনরায় বাংলায় পাঠালেন।আবার দাঁইহাটকে কেন্দ্র করে শুরু হলো বর্গিহাঙ্গামা।নবাব এবার চরম সিদ্ধান্ত নিলেন।সন্ধির নাম করে ভাস্করকে বহরমপুরের সন্নিকটে মানকরার শিবিরে আহ্বান করলেন।জানালেন ভাস্করের কথা মতোই সন্ধি হবে।বিনাশকালে বিপরীত বুদ্ধি।অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসই তার কাল হলো।সহজেই পাতা ফাঁদএ পা দিলেন।আর সেই সুযোগে নিরস্ত্র ভাস্করকে নির্মম ভাবে হত্যা করলো নবাবসৈন্য।
১৭৪৫ খ্রিস্টাব্দে রঘুজি ভাস্কর হত্যার প্রতিশোধ নিতে বিপুল সৈন্য নিয়ে মুর্শিদাবাদে প্রবেশ করলেন।নবাবসৈন্য মারাঠাদের তাড়া করলে যাজিগ্রামের নিকট শ্রীনিবাস আচার্যের স্মৃতি বিজড়িত রানিদিঘির পারে তুমুল যুদ্ধ শুরু হলো।এই যুদ্ধে রঘুজি একরকম পরাজিত হয়ে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করতে বাধ্য হন।ননগর যাজিগ্রামের রানিদিঘি ওরফে সিপাইদিঘি সেই ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষ্য দিচ্ছে।
রঘুজি এই অপমান কোনদিন ভুলতে পারেননি।এবার মিরহাবিবের পৃষ্টপোষকতায় তঞ্জী ও বিম্বজিকে বাংলা আক্রমনের জন্য পাঠালেন।এইভাবে ১৭৫১ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাস পর্যন্ত বর্গিহাঙ্গামা মাঝে মঝে চলতেই থাকলো।চতুর মিরহাবিব সন্ধির প্রস্তাব পাঠালেন।নিরুপায় হয়ে বৃদ্ধ নবাব আলিবর্দি খাঁ কাটোয়ার শিবিরে মে মাসে একটি সন্ধিচুক্তি স্বাক্ষর করলেন।শর্তানুসারে মিরহাবিব হলেন উড়িষ্যার সহকারী শাসনকর্তা।বাৎসরিক ১২লক্ষ টাকা রাজস্ব পেলেন রঘুজি।এই কাটোয়া সন্ধির ফলে প্রায় এক দশকের ভয়াবহ বর্গিহাঙ্গামার পরিসমাপ্তি ঘটে।
বর্গিহাঙ্গামায় ইন্দ্রাণীর সম্ভ্রান্ত লোকেরা বাস ওঠালেন।ধ্বংস হয়ে গেল কৃষি আর কুটীরশিল্পের সুপ্রাচীন গৌরব।বারঘাট,তেরহাট ঢেকে গেল বিস্মৃতিতে।বর্ধমানের রাজারা দাঁইহাট থেকে গঙ্গাবাস ওঠালেন।পাদপ্রদীপের আলোয় ক্রমশ উদভাসিত হয়ে উঠলো অম্বিকা-কালনা।ইন্দ্রাণীজনপদ ঢেকে গেল ঘন বন-জঙ্গলে।শ্বাপদ সংকুল জন্তু জানোয়ারে।তারপর একসময়ে প্রবল বন্যায় ভাগীরথীও ইন্দ্রাণীকে ত্যাগ করলো।নগর ইন্দ্রাণীর ঘটলো বিলুপ্তি।
ঐ যে দেখছেন----ভাঙা দেওয়ালটুকু! ওটা বর্ধমানরাজাদের বিরাট গঙ্গাবাস ভবনের শেষ চিহ্ন।নিচে জননী জাহ্নবী।বাঁধানো ঘাট--বারদুয়ারী।ডান দিকে রাজাদের সমাধি স্মারক--সমাজবাড়ি।কিশোর-কিশোরী মন্দির।আজ গঙ্গা অভিমানে দূরে সরে গেছে।গাছ-গাছালি আর আত্মবিস্মৃতির পলিতে চাপা পড়ে ইতিকথা!বঙ্গে বর্গি হাঙ্গামার স্মারক চিহ্ন রাজবাড়িটা ভাঙতে ভাঙতে শুধু এইটুকু!!একটা বোবা জিজ্ঞাসা চিহ্নের মত দাঁড়িয়ে!অচিরে হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়বে।আত্মবিস্মৃত বাঙালী শুধু নিদ্রালু সন্তানদের ঘুম পারাতে পারাতে বলবে---
খোকা ঘুমালো পাড়া জুড়ালো বর্গি এলো দেশে।
বুলবুলিতে ধান খেয়েছে খাজনা দেবো কিসে।।
|
ছবিঃ ইন্টারনেট ফারুক আহমেদ ও নিজদ্ব |