Friday, May 27, 2016

SUTOY BONA NARIR VUBAN

                     

                           সুতোয় বোনা নারীর ভুবন

 

 



 পল্লির মহিলা-মহল।নিঝুম দুপুর বেলা আর মিস্টি মিস্টি সাঁজবেলাগুলো একসময় ভরে উঠতো বউ-ঝিদের সূত্রশিল্প সাধনায়।  গ্রামে গ্রামে তখন  বিজলি বাতি জ্বলে ওঠেনি। আঁধার নামলেই  রাত-ঝিঁ ঝিঁ আর  মেঠোশিয়ালের  হুক্কাহুয়া ডাক।টিভি  তখন স্বপ্ন। কম্পিউটার মোবাইল ফোনতো আরও দুঃস্বপ্ন!!ঘর-কন্নার ফাঁকে ফাঁকে সূচসুতোর পেন দিয়ে সাদাকাপড়ের জমিতে ফুটিয়ে তুলতেন  টেরা বেঁকা ভাব-সম্প্রসারণ সদৃশ টুকরো টুকরো পদ্য।কয়েকটি শোনাই আপনাদের......
                                        (  ১) পিতার ঘরে পালিত হয়ে
                                                  পরের ঘরে যেতে হয়।
                                                    ধন্য বটে নারীর জীবন
                                                   পরকে আপন করতে হয়।।

                                               (২)  সতীর দেবতা পতি                           
                                                               জীবনের সার
                                                             পূজিতে এসেছি ভবে
                                                                     চরণ তাহার।।

                                           (৩)মাভৈঃ মাভৈঃ ডাকিছে দেবতা
                                                      সাবিত্রী তোমার কিসের ভয়?
                                                   আকাশ অবনী ডাকে প্রতিধ্বনি
                                                          সতী কি কখনো বিধবা হয়?

                                          (৪) সুখের ডালে বসি ডাকিছে পাখিরে
                                              ডাকিছ কি সেই পরম পিতারে?
                                           কি বলে ডাকিস বলে দে আমারে
                                                  ডেকে  দেখি যদি পাইরে।।

                                 আবার রসালো প্রেমের পদ্য অনায়াসে স্থান পেয়েছে.........

                                                    (৫)ভালোবাসার এমনি গুণ
                                                          পানের সঙ্গে যেমন চুন
                                                         বেশি হলে পোড়ে গাল                                                   
                                                              কম হলে লাগে ঝাল।।

উদাহরণ বাড়িয়ে লাভ নেই।দেবদেবির বন্দনা ছাড়াও পতি কেন্দ্রিক ছড়া,ভালোবাসার চুটকি ছড়া,সংসার বিষয়ক ছড়াই বেশি। লেখার পর সেগুলো বাঁধিয়ে-ছাঁদিয়ে মাটির দেওয়ালে শোভা পেত।পোশাকি নাম ছিল কার্পেট।কেউ বলতো দেওয়াল-আসন।শোনা যায় কনে দেখার সময় এগুলো ভারি কাজে লাগতো।বরপক্ষের পছন্দ হলে যাকে বলে স্পেশাল মার্কস পেতেন ভাবী বধূটি।

রবীন্দ্রনাথের বৌঠান কাদম্বরী দেবীর প্রিয়কবি ছিলেন বিহারীলাল।তিনি যখন ঠাকুরবাড়িতে যেতেন তাঁর বসার আসনটিতে কাদম্বরী বুনেছিলেন সারদামঙ্গলের সেই বিখ্যাত পঙতি......

                                     হে যোগেন্দ্র! যোগাসনে
                                            ঢুলু ঢুলু দু-নয়নে
                          বিভোর বিহ্বল মনে কাঁহারে ধেয়াও?

কাদম্বরীর অকাল প্রয়াণে ব্যথিত কবি লিখেছিলেন"সাধের আসন"।বিনিসুতোর বেদনায় গাঁথা সে লিপিমালা।আজ আর সেই শিল্পও নেই......নেই সেই মনন মানসিকতা ।খুব স্বাভাবিক।হয়তো এর মধ্যে কেউ আবিস্কার করতেই পারেন এক বিশেষ সময়ের বেদনাদীর্ণ নারি ভাবনার প্রকাশ।পতিকে ঘিরে সতী হয়ে ওঠার বাসনা কালান্তরের সকালে এগুলি বাসি জঞ্জাল বৈ তো কিছু নয়।কোন কোন মাটির বাড়িতে উই পোকায় ক্ষত বিক্ষত দু একটা নমুনা মা দিদিমার স্মৃতি বলে আটকে রেখেছেন কেউ কেউ।তবু  গ্রাম বাংলার দুপুর আছে...সন্ধ্যে আছে...।এখন সেখানে ঝংক্রিত হয়  বাংলাসিরিয়ালের মেকি সুর আর সস্তা সংলাপ!! এতেই বুঁদ  হয়ে থাকেন অধিকাংশ গ্রাম্য বউ-ঝিরা।

Monday, May 23, 2016

CHACHE DHALA TAMRO-MUDRA

                             
                                ছাঁচে ঢালা তাম্রমুদ্রা




মঙ্গলকোটের অন্যতম প্রত্নরত্ন সংগ্রাহক সেখ আসরাফ আলি।এখানকার বিভিন্ন প্রত্নস্থল থেকে তিনি বিবিধ পুরা দ্রব্য সংগ্রহ করেছেন। যেমন তাম্রাশ্মীয় যুগ থেকে ঐতিহাসিকযুগের নানা ধরনের কৌলাল অর্থাৎ মাটির জিনিষপত্র ,টেরাকোটা ফলক ,মাটির সিল. বিডস, হাতির দাঁত ও পাথরের নানা শৌখিন দ্রব্যাদি এবং মুদ্রা। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য  বেশ কিছু ছাঁচে ঢালা তাম্রমুদ্রা অর্থাৎ কপার কাস্ট কয়েন্স।আশরাফের সংগ্রহটি বেশ সমৃদ্ধ।বর্গাকার মুদ্রা ৬৭ টি।আয়তকার মুদ্রা ২২ টি এবং বিচিত্র আকৃতির ১৩টি।



ঐতিহাসিকেরা মনে করেন ছাঁচে ঢালা তাম্রমুদ্রা প্রধানত মৌর্য-শুঙ্গ-কুষাণ-গুপ্তযুগে চালু ছিল।এই মুদ্রাগুলিতে কোন লিপি নেই।নেই কোন রাজার নাম বা দেব দেবির প্রতিকৃতি।বরং তৎকালীন লোকজীবনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগ রয়েছে ।মুদ্রাগুলিতে পড়েছে কৃষিভিত্তিক সমাজ জীবনের ছাপ।মুদ্রায় বেশকিছু জীব-জন্তুর প্রতিকৃতির ছাপ আছে।যেমন হাতি,ষাঁড়,ঘোড়া,সাপ উট ইত্যাদি।কিছু মদ্রায় রয়েছে তৎকালীন যুগে প্রচলিত ধর্মবিশ্বাসের ছাপ বা সাংকেতিক চিহ্ন।যেমন ক্রশ চিহ্ন,স্তূপ , স্বস্তিক চিহ্ন,যজ্ঞবেদী,রেলিং দেওয়া গাছ,বা বোধি বৃক্ষ ইত্যাদি।আরও নানা ধরনের দুর্বোধ্য সাংকেতিক চিহ্ন মুদ্রাগুলিতে দেখা যায়।এর সঙ্গে অদ্ভুত মিল রয়েছে গ্রামগঞ্জে ঘরের দরজায় বা মন্দিরে  আঁকা সাংকেতিক চিহ্নগুলির সঙ্গে ।বিশেষজ্ঞরা মনে করেন মুদ্রাগুলি মাটির ছাঁচে গলিত তামা ঢেলে বানানো হতো।আসরাফের সংগৃহীত মুদ্রাগুলির গড় ওজন ৩.৫৭ গ্রাম।পশ্চিমবঙ্গের নানা স্থান থেকে এই ধরনের মুদ্রা প্রচুর পাওয়া গেছে  যেমন চন্দ্রকেতুগড়,বোড়াল,পোখরানা ইত্র্যাদি,।

কাটোয়ার মঙ্গলকোট ছাড়াও কপারকাস্ট কয়েন মিলেছে কেতুগ্রামের আনখোনার মাঝিডাঙ্গা থেকে।
সাংকেতিক চিহ্নটা দেখুন

কৌলাল পত্রিকার সৌজন্যে

NATUNGRAMER PURATON DARU SHILPO

                           নতুনগ্রামের পুরাতন দারুশিল্প

মেলায় পুতুল বিক্রী করছেন বিখ্যাত শিল্পী জীবানন্দ ভাস্কর



হাওড়া-ব্যান্ডেল -কাটোয়া রেল শাখায় অগ্রদ্বীপ স্টেশন।এখানে নেমে  রাস্তা ক্রশ করে পাকা সরান ধরে কিছুটা হাঁটলেই পৌঁছে যাবেন নতুনগ্রামে।ভ্যানে বা রিক্সায় যেতে পারেন।আর পাঁচটা সাধারণ অজ পাড়াগাঁএর মতো হলেও অনেকেই জানেন ---নতুনগ্রামের খ্যাতি স্থানীয় ছুতোরদের তৈরি হরেক কিসিমের কাঠের পুতুলের জন্য।এর সূত্র ধরেই নতুনগ্রামের সূত্রধরদের নাম-ডাক,যা রাজ্যের সীমানা অতক্রম করে  লোকশিল্পের আন্তর্জাতিক অঙিনাকে করেছে স্পর্শ। সেই প্রাচীন লোকজ দারুশিল্প ও শিল্পীদের হাল হকিকতের সুলুক সন্ধান এই লেখায়............


                                                           এক

-'বিশ্বকর্মার ব্যাটা ' ছুতোররা রাঢ়-বাংলার এক প্রাচীন শিল্পী জাত।কাঠের তৈরী লাঙল,মই,গোরুর গাড়ি,পালকি-পালঙ্ক,নৌকো ইত্যাদি নির্মাণের পাশাপাশি তালের কাঁড়ি ,কাঠ-বাঁশ-কাবারি দিয়ে ঘরের" চাল ওঠানো" ছাঁটামো তৈরী ,দরজা -জানলা, ঠাকুরের সিংহা্‌সন,ঢাক-ঢোলের খোল তৈরির মতো প্রাত্যহিক প্রযুক্তিগুলি এদের হাতে যেন  কথা বলে ওঠে।ছুতোরগিন্নিরাও কোন অংশে  কম যান না!ধান থেকে চিঁড়ে চ্যাপটা করা কিম্বা চাল থেকে মুড়ি ভাজায় দক্ষ শিল্পী।কবি কঙ্কণ মুকুন্দরাম চক্রবর্তী লিখেছেন..
..

                                 
 ছুতোর নগর মাঝে /             চিঁড়ে কুটে মুড়ি ভাজে/                                                              কেহ করে চিত্র নির্মাণ।।




পুতুলে কাগজের পটি



এ তো গেল মুদ্রার এক পিঠ।অন্যদিকে দারু বিগ্রহ ,অলংকৃত কাষ্ঠদ্রব্য,দরজা জানলায় খোদাই চিত্র, চন্ডিমন্ডপ বা বাংলা বাড়ির ষড়দল-পরদল-কোনাচি-শুঁড়ো-ঠেকনো-খুঁটিতে নকশাবহুল অলংকররণসহ রথ, পুতুল নির্মাণে রাঢ়ীয় সূত্রধরদের সৃজনশীলতা --এককথায় লা-জবাব।কালের করাল গ্রাসে অনেক কিছুই  হারিয়ে গেছে।তবু যে টুকু টিকে আছে তা গর্ব করার মতো।জানবার এবং জানাবার মতো। যেমন এই নতুনগাঁয়ের পুতুলশিল্প।গড়নে চিত্রণে অলংকরণে এবং সার্বিক আবেদনে মুগ্ধ হয়ে  সাধারণ মানুষই যখন স্বতোপ্রণোদিত হয়ে পুতুল কেনেন তখন শিল্পরসিক তো পরের কথা।কারণটা সহজেই অনুমেয়।এই শিল্পের পশ্চাতে রয়েছে এতদাঞ্চলের সূত্রধরদের বংশ পরম্পরায় সংশ্লিষ্ট বিষয়ে নিবিড় অনুশীলন  ও তাতে পেশাদারি দক্ষতা অর্জন।


রাঢ়ীয় সূত্রধরদের একটি বিশেষ থাক বর্ধমেন্যা।বৃহত্তর কাটোয়া মহকুমার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে এরা বসবাস করেন।কাটোয়া পাটুলি দাঁইহাট করজগ্রাম শ্রীখন্ড হাটপাড়া কেতুগ্রাম মিত্রটিকুরী পিলসোয়াঁ প্রভৃতি প্রাচীন জনপদে পুরুষাণুক্রমে বসবাস করে আসছেন।কাঠের কাজের পাশাপাশি কেউ কেউ মৃৎশিল্পে সুনাম অর্জন করেছেন।বিশিষ্ট লোকসংস্কৃতিবিদ ও ক্ষেত্রসমীক্ষক তারাপদ সাঁতরা এতদাঞ্চলের বিখ্যাত সূত্রধরদের নাম-ধাম জ্ঞাপক একটি মূল্যবান লোকছড়া সংগ্রহ করেছিলেন।যাতে বলা হয়েছে....

                                                   বর্ধমান জেলা হয়গো ছেরান্দি।
                                                   সূত্রধর দশঘর পরমানন্দ।।
                                                   ঝামটপুরে রহেগো রামাইচন্দ্র।
                                                   পেনেরায় ঘর কুন্ডু গৌরাঙ্গ।।                                           
                                                   কোপার পাল হয় গঙ্গারাম।
                                                     কন্দর্পশীল হয়  কেতুগ্রাম।
                                                      তেঁতুলের পো নন্দ দত্ত।
                                                  বহরানের দে চৈতন্য খ্যাত ।
                                                    জেয়োপাড়ার সাগর কর।
                                                   এই মত ঘর সূত্রধর।।                           

(Brick   Temples of Bengal  Ed..Jerge Michell Ch: On  Architects and Builders ,Tarapada  Santra page 53-62)

শুধু পুতুল আর পুতুল



বিস্তারিত আলোচনা এখানে অপ্রাসঙ্গিক।শুধুমাত্র একটি তথ্য জানিয়ে রাখি।ক্ষেত্রসমীক্ষায় জানাযায় যে কেতুগ্রাম থানার কোপার গঙ্গারাম পালের লতায় পাতায় উত্তর পুরুষেরা এখনও নিকটবর্তী হাটপাড়া মিত্রটিকুরী গ্রামে বসবাস করছেন।এখানকার সূত্রধরেরা তৈরি করে আসছেন প্রাচীন ঐতিয্যবাহী কালকেপাতা মুখোশ। যা  রাঢ়-বাংলার অন্যতম লোকনৃত্য রাক্ষস নাচের মুখোশ বলে পরিচিতি পেয়েছে ।


দ্বিতীয়ত,রাঢ়ীয় সূত্রধরদের আর একটি অন্যতম থাক ভাস্কর।এরা কাঠের পাশাপাশি পাথর খোদাইএ দক্ষ।পাল-সেনযুগ  অথবা তার আগে থেকে  শুরু করে  উনিশ শতকের সমকালীন বৃহত্তর কাটোয়া মহকুমার বিভিন্ন স্থান থেকে যে সব প্রস্তর বিগ্রহ আবিস্কৃত হয়েছে তার সিংহভাগ যে স্থানীয় ভাস্করদের সৃষ্টি ,সন্দেহ নেই।কাটোয়ার গোকুল ভাস্কর কিম্বা দাঁইহাটের নবীন ভাস্করের নাম অনেকেই শুনেছেন।সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হলো --নতুনগাঁয়ের কাষ্ঠশিল্পীদের অধিকাংশই দাবী করেন তাদের পূর্বপুরুষরা ছিলেন দাঁহাটের বিখ্যাত  ভাস্করগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত।সময়ান্তরে পাথরের কাজে আর তেমন চাহিদা না থাকায় তারা পরবর্তী কালে নতুনগাঁয়ে কাষ্ঠশিল্পকে অবলম্বন করতে বাধ্য হন।



গ্রামের কিশোরদের রন-পা পড়ে বিনোদন





কাজেই নতুনগ্রামের কাষ্ঠশিল্পের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো বৈচিত্রের সঙ্গে সাবেকিয়ানা।ঐতিয্যের সঙ্গে মুন্সিয়ানা।তক্ষণের সঙ্গে চিত্রণের সুসম্পাদনা।নানা ধরনের খেলনা পুতুলসহ ভাস্কর্য সংস্কৃতির খোদাই ঐতিয্যকে যেমন সযত্নে লালন করে চলেছেন শিল্পীরা ,তেমনি যুগের প্রয়োজনে নিত্যনতুন পরীক্ষা নিরীক্ষার মুখোমুখি হতে হচ্ছে।এর ফলে সৃষ্টি হচ্ছে বৈচিত্রময় নানা ধরনের পুতুল ও মডেল।কিন্তু নতুনগাঁয়ের পুতুলের যে আদি ও অকৃত্রিম বৈশিষ্ট্য যথা রঙের কাজ,তুলির সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম টান এবং পটুয়াসুলভ টানা টানা চোখ...এর থেকে শিল্পীরা বিন্দুমাত্র বিচ্যুত হননি।


 

                                                      দুই
প্রবীণা শাশুড়ি এখনো পুতুল গড়েন


বরিষ্ঠ লোকগবেষক বিনয় ঘোষ ১৯৬৯ সালের ডিসেম্বর  মাসে নতুনগ্রামে এসেছিলেন।মূলত অল ইন্ডিয়া হ্যান্ডি ক্র্যাফটস বোর্ডের তাগিদে--দারুশিল্পীদের নিয়ে ক্ষেত্রসমীক্ষা করতে। সেই সময় তিনি ১৫-১৬ ঘর শিল্পী পরিবার লক্ষ করেছিলেন।অধ্যাপক ঘোষের প্রদত্ত বিবরণ থেকে জানা যায় -শিল্পীরা মূলত তখন লক্ষ্মী পেঁচা ও গৌরাঙ্গের মূর্তি তৈরি করতেন।কাঠ হিসাবে ব্যবহৃত হতো পিটুলি আমড়া শিমূল ও ছাতিম।স্থানীয় পুজোর সময় ,রাসের মেলায় এইসব কাঠের পুতুল বিক্রি হতো।শিল্পীদের আর্থিক অবস্থা ছিল শোচনীয়।শুধুমাত্র শম্ভুনাথ ভাস্কর রাষ্ট্রপতি পুরস্কার পাওয়ার জন্য তাঁর মাসিক আয় ছিল গড়ে ২০০ টাকা।


অধ্যাপক ঘোষের এই সমীক্ষা প্রায় সাতচল্লিশ বছর আগেকার।স্বভাবতই গঙ্গা দিয়ে যেমন অনেক জল গড়িয়েছে ,তেমনি দারুশিল্পে এসেছে স্বাভাবিক পরিবর্তন,পরিমার্জন,বিয়োজন এবং সংযোজন।আমাদের ক্ষেত্রসমীক্ষা বছর তিনেক আগেকার।এখন প্রায় ৪০ ঘর পরিবারের দুইশতাধিক শিল্পী কাজ করছেন।শুধু সূত্রধরেরা নন,অন্যান্য জনজাতিও এই পেশায় এসেছেন।বিয়োজন হয়েছে রাম সীতা মহাদেবের মূর্তি।সংযোজন ঘটেছে বড়  বড় মডেলের কৃষাণ-কৃষাণি,সাঁওতাল দম্পতি।সবচেয়ে লক্ষ্যনীয় বিষয় হলো প্রায় পঞ্চাশ শতাংশ  মহিলা এই পে্ষার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছেন।
বর্তমানে তিন ধরণেরে কাজ হয় (১)পুতুল(২)কাঠখোদাই(৩)বিগ্রহ।তবে বিগ্রহ তৈরির ধারাটি প্রায় অবলুপ্তির পথে।নতুনগ্রামে বর্তমানে এই ধারার শেষ শিল্পী জীবানন্দ ভাস্কর।তিনি জানিয়েছেন যে দু ফুট লম্বা গৌরাঙ্গ মূর্তির জন্য চাই সিজন করা নিমকাঠের গুঁড়ি।সময় লাগে তিন মাস।বিক্রি হয় ছয় সাত হাজার টাকার মধ্যে।অর্ডার আর আসে না বললেই চলে।কিন্তু সাবেকি পুতুলের কাজ হয় বারোমাস।চাহিদার দিক থেকে প্রথমেই  ঊঠে আসে পেঁচা।তিন- চার -ছয় এবং দশ ইঞ্চি লম্বা পেঁচার চাহিদা সারা বাংলা জুড়ে।দুই রকমের পেঁচা তৈরি হয়,যথা ডানা ছাড়া এবং দুসাইডে সামান্য মাটি ধরিয়ে ডানাযুক্ত পেঁচা।লক্ষ্মীর প্রতীক পেঁচা।বছরে তিনবার এই লক্ষ্মীপেঁচার পুজো।ভাদ্র -পৌষ ও চৈত্র মাসে।সেই কারণে ত্রিবেণী খাগড়া দক্ষিণেশ্বর  কালিঘাট বড়বাজার প্রভৃতি অঞ্চল থেকে ক্রেতারা পাইকারি মূল্যে পেঁচাগুলি কিনে নিয়ে যান।কালিঘাটের পুতুল বলে যারা আত্মতৃপ্তি অনুভব করেন তাদের অবগতির জন্য জানাই এই পুতুলগুলির সঙ্গে কালিঘাটের যোগ একান্তই বাণিজ্যিক।ধর্মীয় স্থানে বিক্রীবাটা ভালো হতো বলে এতদ অঞ্চল থেকে অনেক শিল্পী কালিঘাটে নোঙর করেন।যেমন গিয়েছিলেন একসময় পটুয়ারা।সেই সূত্রেই কালিঘাটের পটের মতোই নতুনগাঁয়ের পুতুলের নামকরণ হয়েছিল--কালিঘাটের পুতুল ।
দারু বিগ্রহঃমহাপ্রভু ও সীতাদেবী


সাবেকি ঘরাণার দুই হাত তুলে সংকীর্তনরত গৌর নিতাই মূর্তির চাহিদাও তুঙ্গে।এগুলি আট থেকে দশ ইঞ্চির।গৌর- নিতাইর যুগল দারু বিগ্রহের উপাসনা এই অঞ্চল থেকেই ছড়িয়ে পড়ে বাংলা ও বহির্বাংলায়।অধিকাংশ মূর্তি তৈরি হতো এই অঞ্চলে।তারই ক্ষুদ্রতম সংস্করণ এই গৌর নিতাই পুতুল।বাংলার তৃণমূলস্তরেও বৈষ্ণবধর্ম যে কী গভীরভাবে প্রভাব বিস্তার করেছিল এই পুতুলগুলি তার প্রমাণ।১০-১২-১৫ ইঞ্চির  একক গৌরাঙ্গ মূর্তিও শিল্পীরা বানান।এই মূর্তির নাম নটরাজ বা গৌর-নাগরী ।ডান হাত উপরের দিকে  অভয়মুদ্রায়উত্থিত।বামহাত নাচের ভঙ্গিমায় কটিদেশে।এই মূর্তির প্রবর্তক ষোড়শ  শতাব্দির শ্রীখন্ডের প্রখ্যাত বৈষ্ণব সাধক কবি নরহরি সরকার।তিনি ষোড়শ শতকের শেষে তিনটি বড় গৌর নাগরী মূর্তি বানিয়ে বড়টি কাটোয়ায় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।আজও সেই গৌরাঙ্গ বিগ্রহ পূজিত হচ্ছে কাটোয়ায়।প্রসঙ্গত--বিষ্ণুপ্রিয়া সেবিত নবদ্বীপধামের ধামেশ্বর বিগ্রহটিও দাঁইহাটের সূত্রধরই নির্মাণ করেছিলেন।
গৌরাঙ্গ ছাড়াও গণেশ রাধাকৃষ্ণ(৮-১০ ইঞ্চি) তৈরি হয়।নতুনগাঁয়ের কাঠপুতুলের অন্য চরিত্র বউ পুতুল। ছোট্ট ছেলে-মেয়েরা বিশেষকরে মেয়েদের পুতুলখেলার অন্যতম উপকরণ ছিল বউপুতুল।কাঁচা হলুদ গায়ের রঙ।সবুজ শাড়ি কুঁচি করে পরা।সলজ্জ নববধূ।দিঘল টানা চোখে মায়াবি বিস্ময়।এই পুতুলের জনপ্রিয়তা ধরা পড়েছে বহুল প্রচলিত লোকসংগীতে...

                         
                                          ও দাদা পায়ে পড়ি রে
  
                                     
                                            মেলা থেকে বউ এনে দে 
                                                               খেলা করে রে...

বর্তমানে বউ পুতুলের জনপ্রিয়তা ক্রমহ্রাসমান।
নতুনগ্রামের খোদাই দারু দুর্গা
                          





খোদাইমূর্তির বিভিন্ন আকৃতির হয়।ছয় বাই আড়াই ফুট,চার বাই দুই ফুট মাপের আয়তকার সমতল পাটায় খোদাইর মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হয় রাধাকৃষ্ণ,মহিষাসুরমর্দিনি দেবী দুর্গা কালি দশানন রাবণ রাম-রাবণের যুদ্ধ ইত্যাদি। গত কয়েক বছর ধরে কলকাতা ও শহরতলিতে থিমের পুজো চালু হওয়ায় বাংলার মৃতপ্রায় লোকশিল্পগুলি খানিকটা অক্সিজেন পেয়েছে ।ডোকরা,শঙ্খপ্রভৃতি লোকশিল্পগুলির মতো নতুনগ্রামের কাঠপুতুলগুলিও প্রাণ  ফিরে পেয়েছে।ফলে খোদাই মূর্তির পাশাপাশি ৩-৫ ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট মডেল তৈরি হতে থাকে।এছাড়া তৈরি হচ্ছে নানা আধুনিক পুতুল যেমন রাজা রানি,চাষি-চাষি বউ,সাঁওতাল দম্পতি গো মানব,বিভিন্ন ধরণের মুখোশ ইত্যাদি।

          
এইতো সংসার
                                           তিন                       


এই পুতুল নির্মাণে ব্যবহৃত হয় বিভিন্ন ধরণের নরম কাঠ,যেমন আমড়া,সোনাঝুরি,পিটালি,গামার ইত্যাদি।স্থানীয় কাঠমিল থেকে কিনে আনা হয়।বর্তমানে প্রতি  কিউবিক সোনাঝুরি কাঠ ৪০০ টাকা,গামার ৫০০ টাকা।এই কাঠ খোদাইএর কাজে ব্যবহৃত হয় বেশি।এক কিউবিক সোনাঝুরি শিমূলকাঠে ৪০ টির মতো প্রমাণ সাইজের পুতুল বানানো যায়।কাঠ ভালো করে সিজন করে নিতে হবে।যন্ত্রপাতি যা লাগে তা হলো করাত কুরুল বাটালি বাসলে হাতুড়ি ইত্যাদি।গৌর-নিতাই পুতুলের ঊর্ধবাহু হাতদুটি পেরেক  ঠুঁকে এঁটে দিতে হয়।এই কাজ পুরুষ শিল্পীরাই করে থাকেন।এরপর মহিলা শিল্পীরা নারকেলের ছোবরা দিয়ে ভালো করে ঘষে নেন।হাত লাগায় বাড়ির ছেলে-মেয়েরাও।ঘষার পর গোবর মাটির হালকা প্রলেপ দেওয়া হয়।এরপর খবরের কাগজের পটি মারা হয় কাঁই আঁঠা মেশানো মাটির গোলা দিয়ে।খটখটে করে শুকিয়ে নিয়ে বোলানো হয় খড়িমাটি।শুরু হয় রঙের কাজ।এই শিল্পে রঙের চিত্রণ অতি গুরুত্বপূর্ণ।ব্যবহৃত হত হয়  এর জন্য নানা সাইজের তুলি।তুলির সূক্ষ্ম টানে  ফুটিয়ে তোলা হয় অর্ধেক বাঁশপাতার মতো চোখের ভ্রু।ঢুলুঢুলু দু নয়ন।কাপড়ের ভাঁজের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম রেখাচিত্রের বক্রতা।সাবলীল,স্বচ্ছন্দ,সহজ ঋজু ভঙ্গিমায় রেখা অঙ্কিত।এইদিক থেকে দেখলে বাংলার পটচিত্রের সঙ্গে এক অদ্ভুৎ সাদৃশ্য লক্ষ করাযায়।দু ধরনের রঙ এখনো প্রয়োগ করা হয়।জল রঙ ও তেল রঙ।জল রঙ শুকিয়ে নেওয়ার পর সাবু মাখিয়ে বার্নিশ বা ঘামতেল দিলে পুতুলগুলি চকচকিয়ে ওঠে।ইদানিং অবশ্য তেলরঙের চলই বেশি।



পুতুলের কাজ মেয়েরা করলেও খোদাইএর কাজ করেন শুধুমাত্র পুরুষেরা।কাঠের গুঁড়ি কিনে নিয়ে  সাইজ করে চিরিয়ে নেওয়া হয়।পাটা বানানোর পর বাটালি দিয়ে খোদাই করা হয়।অবশেষে গালা স্পিরিট এবং কাঠের ন্যাচারাল কালার মিশিয়ে পালিশ করা হয়।মোটামুটি সাড়ে ছয় বাই আড়াই ফুট আকৃতির কাঠ খোদাইএর জন্য লাগে পাঁচ থেকে ছয় কিউবিক গামার কাঠ।এক থেকে দেড় মাস পরিশ্রম করতে হয়।বিক্রি হয় ১৫-২০ হাজার টাকায়।খোদাইএর কাজ মূলত অর্ডার ভিত্তিক।এর কোন স্থানীয় মার্কেট নেই।অবশ্য রাজ্য হস্তশিল্প মেলায় এগুলি বিক্রি করার সুযোগ আছে।পুতুল বিক্রি হয় নবদ্বীপ শান্তিপুরের রাসমেলায়।শ্রীখন্ডের।মাটিয়ারি প্রভৃতি মেলায়।এছাড়া বাংলার বিভিন্ন স্থান থেকে পাইকারি ক্রেতারা পুতুল কিনতে আসেন নতুনগ্রামে।


                       শিল্পীদের কাছ থেকে প্রাপ্ত পাইকারি বাজার দর(২০১২-১৩)
                        পেঁচা ৩ ইঞ্চি প্রতি ১০০ পিস.......................................৬০০ টাকা
                          পেঁচা ৪ ইঞ্চি প্রতি ১০০ পিস...............................১০০০ টাকা
                           গৌরাঙ্গ ৬ ইঞ্চি প্রতি ১০০ পিস.........................৭০০ টাকা
                            গৌরাঙ্গ ১০ ইঞ্চি প্রতি ১০০ পিস..............................১০০০ টাকা ।
                            গণেশ ৮ ইঞ্চি প্রতি পিস.....................................১৫টাকা।
                             রাধাকৃষ্ণ ১০ ইঞ্চি প্রতি পিস............................৩০ টাকা।
                      

     পেঁচারা  উঁকি মারছে
             
কৃষ্ণ ৮ ইঞ্চি প্রতি পিস.................................১৫ টাকা।
                                                       লাভ থাকে ২০ শতাংশ


                                                     চার




এবার শিল্পীদের কথা।আগেই বলেছি পুতুল শিল্পের অধিকাংশ কারিগর মহিলা।রাধারানি সূত্রধর, সাগরী সূত্রধ্‌র ছায়া সূত্রধর ,পুস্পবালা প্রমুখ শিল্পীদের বাপের বাড়ি ভিন গাঁয়ে।বিবাহসূত্রে নতুনগ্রামের বধূ।শাশুড়ি আর  ননদের কাছে দু বছরেই কাজ শিখে পেশাদারি দক্ষতা অর্জন করেছেন।খোদাই শিল্পের কারিগরদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যরা হলেন জীবানন্দ ভাস্কর ভক্ত ভাস্কর নিমাই সূত্রধর ছবিরানি ভাস্কর প্রমুখ।শম্ভুনাথ ভাস্কর রাবণের মূর্তি খোদাই করে্ রাষ্ট্রপতি পুরস্কার ,পেয়েছিলেন।তাঁর ভাইপো ভক্তদাস পেয়েছেন রাজ্য সরকারের পুরস্কার।১৯৮৬ সালে ক্রাফট এন্ড কাউন্সিল অব ওয়েস্ট বেঙ্গলের সৌজন্যে বনকাপাসির শোলাশিল্পী আদিত্য মালাকার,দেরিয়াপুরের ডোকরা শিল্পী হারাধন কর্মকার,বাঁকুড়ার শঙ্খশিল্পী রবি নন্দি সহ ভক্তবাবু আমেরিকার ফিলাডেলফিয়া শহরে কাঠের পুতুলের প্রদর্শনী করেছিলেন ।ভক্তবাবুর তৈরি নতুনগ্রামের পুতুলের আদলে নির্মিত দুর্গা প্রতিমার জন্য কাঁকুরগাছির ইয়াংস্টার ক্লাব ২০০১  সালে এশিয়ান পেন্টস শারদ সম্মান লাভ করে।ইদানিং মফস্বলের পুজো প্যান্ডেলগুলিতেও নুতুনগাঁয়ের পুতুলেরা সাদরে স্থান পাচ্ছে।এহো বাহ্য---মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক বাংলা নোটস বইএর প্রচ্ছদে নতুনগ্রামের পেঁচা স্থান পেয়েছে।
শিল্পীরা অধিকাংশই নিরক্ষর।প্রাথমিকস্তর পর্যন্ত পড়াশুনো করেছেন মাত্র ৩০ শতাংশ।মাধ্যমিক পাশ করেছেন মাত্র ১৫ জন।একজন সরকারি চাকরি পেয়েছেন।নাম জয়ন্ত সূত্রধর।


গতশতকের সাতের দশক থেকে পুতুলশিল্পের বিবর্তন আসে।এই পরিবর্তনে সহায়তা করেন লোকসংস্কৃতিবিদ বিনয় ঘোষ,শিল্পী প্রভাস কুমার সেন,শ্রীমতী রুবি পাল প্রমুখ।এখন ডানা পেঁচা,পেঁচার ভিতরে আর একটি ছোট্ট পেঁচা ,লক্ষ্মী মূর্তি ইত্যাদি নতুন ধরনের পুতুল তৈরি হচ্ছে। ১৯৯৫ সালে রাজ্যসরকারের উদ্যোগে জীবানন্দ ভাস্করের শিক্ষকতায় শুরু হয়েছিল  পুতুলশিল্পীদের জন্য ট্রেনিংস্কুল।রাজ্য ও  কেন্দ্রীয় সরকারের যৌথ উদ্যোগে এবং স্বর্গীয় স্বামী জানকীদাস কাঠিয়াবাবার দান করা জমিতে ২০০৮ সালে শুরু হয়েছে Natungram Wood Curvings Cluster Society র গৃহ।এর সম্পাদক হলেন মাণিক সূত্রধর।৬০ টি পরিবার এই সোসাইটির  অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন।সাম্প্রতিক রাজ্যসরকারের আমলেও প্রভূত উন্নতি হয়েছে নতুনগ্রামের কাষ্ঠশিল্পীদের।


অন্যান্য লোকশিল্পীদের তুলনায় দারুশিল্পীরা অপেক্ষাকৃত ভালো আছেন।সরকারি উদ্যোগে আয়োজিত বছরে অন্তত ৫ টি হস্তশিল্প মেলায় পুতুলশিল্পীরা অংশগ্রহণ করেন।বিক্রীও ভালো

              শম্ভুনাথ ভাস্করের সরকারি মানপত্র
হয়।রাজ্যসরকারি উদ্যোগে নতুনগ্রামেই বসছে পুতুলশিল্পের মেলা।পরিবার পিছু গড়ে আয় ৭ থেকে ৮ হাজার টাকা।তবে মহিলাশিল্পীদের আক্ষেপ----ছেলে পিলের হাতে কাঁচা পয়সা আসার  সুবাদে  লেখাপড়া শিখতে চাইছে না ।এদিকে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পুতুলের দামও বাড়ছে না।এই সময় আরও বেশি করে সরকারি সহায়তা প্রয়োজন।মান্ধাতার আমলের প্রচার ও বিপণনের ব্যবস্থাটি ঢেলে সাজানোর প্রয়োজন  আছে বলে অনেকেই মনে করেন।

ক্ষেত্রসমীক্ষায় যাঁরা সাহায্য সহযোগিতা করেছেন তাঁদের কৃতজ্ঞতা জানাই।
গ্রন্থঋণ...পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি/বিনয় ঘোষ।
পুরালোকবার্তার সম্পাদক শ্রী সোমনাথ রায়কে জানাই কৃতজ্ঞতা।
ঘরকন্নার ফাঁকে ফাঁকে

ছবি --লেখক

Thursday, May 19, 2016

BORGI ELO DESE

 বর্গি এলো দেশে





উত্থান ও পতন,আলো আর অন্ধকার,সৃষ্টি এবং ধ্বংস—এই বোধহয় ইতিহাসের নিয়তি।কালের কাটাকুটির কুটিল খেলা।ইতিহাস তো মহাকালের চিত্রগুপ্ত।অন্তহীন সময়ের সে লিপিকার।তার খেরোর খাতায় ঘটনার কত ঘনঘটা।চমকপ্রদ আর অপ্রত্যাশিত!
কে জানতো-সুদূর মহারাষ্ট্রে উত্থিত বর্গিহাঙ্গামার ঘূর্ণিঝড় দক্ষিণবঙ্গে একদিন আছড়ে পড়বে।সবকিছু ছারখার করে দেবে।একটা আস্ত নগরের ঘটবে মৃত্যু।বিস্মৃতির অতল সাগরে তলিয়ে যাবে তার গৌরবের ইতিকথা।ইতিহাসের পাতায় নামটি শুধু টিকে থাকবেঃ ইন্দ্রাণী।
সপ্তমাতৃকার অন্যতম দেবী।তাঁর নামাঙ্কিত ইন্দ্রাণীনগর।কবিকঙ্কন মুকুন্দরাম চক্রবর্তী এই নগরদেবীকে বন্দনা করেছিলেন তাঁর চন্ডীমঙ্গল কাব্যে----
‘                            সম্মুখে ইন্দ্রাণী...ভুবনে দুর্লভ জানি......দৈব নাশে যাহার শরণে’।
কাটোয়ার শাঁখাইঘাট থেকে দাঁইহাটের ভাউসিং।গঙ্গার তীর বরাবর একদা গড়ে উঠেছিল বাণিজ্য আর তীর্থনগরী ইন্দ্রাণী।আবুলফজলের ‘আকবরনামা’য় উল্লিখিত ইন্দ্রায়িনপরগনা।গঙ্গার তীরে গগনচুম্বী কত দেবালয়!ঘাটে ঘাটে শত শত পুণ্যার্থীদের স্নান।পুজোর ব্যস্ততা।সুরেলা ঘন্টাধ্বনি।হাটে হাটে হরেক পশরার বিকিকিনি।নগরিয়ারা আত্মশ্লাঘায় হেঁয়ালি করে বলতো—
                                       বারঘাট তেরহাট তিন চন্ডী তিনেশ্বর।
                                      ইহা যে বলিতে পারে ইন্দ্রাণীতে তার ঘর।।
তেরহাটের ঐশ্বর্য ছড়িয়ে পড়েছিল বৃহৎ বঙ্গে।বারঘাটের নাম ছড়িয়েছিল সারা ভারতবর্ষে।সেই বার ঘাটের অন্যতম ইন্দ্রেশ্বরঘাট।কবি কৃত্তিবাস তাঁর রামায়ণকাব্যে লিখেছিলেন—
                                                ইন্দ্রেশ্বর ঘাটে যেবা নর স্নান করে।
                                                 অযুত বৎসর থাকে সে স্বর্গপুরে।।
কিন্তু এই ঐশ্বর্য,এই নামই হয়েছিল তার কাল।পতনের কারণ।লুঠেরা বর্গিরদল সম্পদের লোভেই ছুটে এসেছিল।ইন্দ্রাণীতে গেড়েছিল ঘাঁটি।দক্ষিণবঙ্গে লুঠপাট-অত্যাচার-সন্ত্রাস করে বিভীষিকা কায়েম করেছিল।তছনচ করে দিয়েছিল কত সাজানো সংসার!
সত্তর দশকের জনপ্রিয় হিন্দিছবি ‘শোলে’।কুখ্যাত ডাকু গব্বর সিং’র ডায়লগটাএখনো লোকের মুখে মুখেঃ...শো যা বাচ্চে-না তো গব্বর সিং আ যায়েগা
আর গ্রাম-বাংলার দুরন্ত শিশুদের ঘুম পাড়াতে গিয়ে মা এখনো সুর করে ছড়া কাটেন—
                       ছেলে ঘুমালো পাড়া জুড়ালো বর্গি এলো দেশে।

বর্গি!মারাঠা লুঠেরা’বার্গির সৈন্য’।এখন যেমন কোবরা,সি আর পি,প্যারামিলিটারি ফোর্স ইত্যাদি।অষ্টাদশ শতকের মারাঠা সেনাবাহিনীর তেমনি বার্গির আর শিলাদার।ঘোড়ায় চেপে যুদ্ধ করতো। অস্ত্র আর ঘোড়া যোগাতো মারাঠা সরকার।বাকি টাকাটা মানুষের উপর অত্যাচার করে,লুঠপাট করে সংগ্রহ করতো।
অষ্টাদশ শতকের চারের দশক।মোঘল সূর্য পশ্চিম পাটে।সিং’হাসনে দুর্বল সম্রাট মহম্মদ শাহ।এদিকে মারাঠারাজ শাহুর প্রধানমন্ত্রী পেশোয়া বালাজী রাও।মারাঠা চানক্য।মোঘল শাসনাধীন রাজ্যগুলির জন্য চৌথ বাবদ অর্থ চাইলেন।কোথায় পাবেন মোঘলসম্রাট? অধীনস্ত প্রদেশগুলি বার্ষিক কিছু হাততোলা অর্থ দিয়েই দায়সারে।সুতরাং সম্রাট বললেন—ও টাকা তোমরাই তুলে নাও।

মারাঠারাজ শাহু এবার নাগপুরের রঘুজি ভোঁসলেকে চৌথ আদায় করার দায়িত্ব দিলেন।রঘুজি আবার তার প্রধানমন্ত্রী ভাস্কর কোহলাতকারকে নিযুক্ত করলেন।কোঙ্কনী ব্রাহ্মন।যেমন বুদ্ধিমান তেমনি চিতার মতো ধূর্ত আর ধুরন্ধর।লোকে একডাকে চিনতো ভাস্কর পন্ডিত নামে।চৌথ আদায়ে সঙ্গে নিলেন বাইশজন বাছাই করা মারাঠা সর্দার।যেমন ধামধরমা,হিরামন কাসি,গঙ্গাজি আমড়া,সিমন্ত যোসি,শিবাজি কোহরা, কেশর সিং প্রমুখ।যেন এক একটা ভয়ংকর ডাকু সর্দার।হিংস্র আর লুঠেরা।সঙ্গে বিশ হাজার খতরনাক বর্গিসেনা।চৌথ আদায়ের উদ্দেশে তারা যাত্রা শুরু করলো।গন্তব্য রাঢ়-বাংলা।সময়টা ১৭৪২ খৃস্টাব্দ।

                                      দুই                     
         

আলিবর্দি খাঁ।বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার নবাব।অপ্রতিদ্বন্দ্বী অকুতোভয় শাসক।সিং’হাসনের কাঁটা সরফরাজ খাঁকে হত্যা করেছেন।দিল্লিকে করেন থোরাই কেয়ার।উড়িষ্যায় বিদ্রোহ দমন করতে ছুটে গেছেন।সঙ্গে বেগমসাহেবা আর আদরের নাতি কিশোর সিরাজ।সেই সঙ্গে বিশাল সৈন্যবাহিনী।

উড়িষ্যায় বিদ্রোহ দমন করে বিজয়ী নবাব বর্ধমানের রানিসায়রের পাড়ে তাঁবু ফেললেন।রনক্লান্ত সৈন্যরা কয়েকদিন বিশ্রাম নিয়ে বিজয়গর্বে ফিরে যাবে মুর্শিদাবাদে।চলছে খানা-পিনা,গান-বাজনার এলাহি আয়োজন।
এমন সময় গুপ্তচর এসে জানালো সংবাদটা।নবাবের ঠোঁটে অবজ্ঞার হাসি।দশ লক্ষ টাকার দাবিপত্র নিয়ে ভাস্কর পন্ডিতের দূত তখনও নতমস্তকে দাঁড়িয়ে।নবাবের হাসিটা আরও চওড়া হলো।সেনাপতি মুস্থাফাখাঁর পরামর্শে ভাস্করকে গ্রেপ্তার করার নির্দেশ দিলেন উদ্ধত আলিবর্দি।

১৫ই এপ্রিল বর্ধমানে প্রবেশ করে নবাব সৈন্য।কয়েকটা দিন কেটে গেল।গভীর রাত।অনেকেই নিদ্রালু।সুরাচ্ছন্ন।এমন সময় পঙ্গপালের মতো তাঁবুর চারপাশ অতর্কিতে ছেঁকে ধরলো মারহাট্টা বর্গিরা।বর্ধমান শহরের মহল্লায় মহল্লায় তখন আবালবৃদ্ধবনিতাদের ভয়ার্ত আর্তনাদ!আগুনের লেলিহান শিখা।যে যেদিকে পারছে পালিয়ে যাচ্ছে।নবাব কার্যত দিশেহারা।আকস্মিক আক্রমনে বিভ্রান্ত।সেনারা সবকিছু ছেড়ে নবাব ও তার ফ্যামিলিকে রক্ষা করতে ব্যস্ত।
দিনেরবেলায় সব ফাঁকা।কোথাও কিছু নেই।তবু দলে দলে লোক বর্ধমান ছাড়ছে।নবাব বুঝতে পারলেন মারাঠারা গেরিলা যুদ্ধে ওস্তাদ।এখুন তারা অন্তরালে থেকে পর্যবেক্ষণ করছে।
এদিকে শুরু হয়েছে তীব্র খাদ্য সংকট।এক সপ্তাহের উপর বর্ধমানে আটকা পড়েছেন।নবাব তাঁর সেনাপতিদের নিয়ে পরামর্শ করলেন।এখান থেকে যেমন করেই হোক-কাটোয়া পৌঁছাতে হবে।ওখানে কাটোয়া আর শাঁখাই দুর্গে রয়েছে প্রচুর অশ্ত্রশস্ত্র,সৈন্যসামন্ত।আছে বিরাট এক শস্যগোলা।সুতরাং খাবারের কোনো অভাব হবে না।
বর্ধমান-কাটোয়া বর্তমান বাসরুট-৫৮কিমি দৈর্ঘ্য।তখন কাঁচা রাস্তা।চলতো উটের গাড়ি।নবাব ও তার পরিবারকে ব্যারিকেড করে ২৩শে এপ্রিল নবাবসৈন্য কাটোয়ার উদ্দেশে রওনা দিল।সৈন্যরা যত এগুতে থাকলো বর্গির দল কোথা থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে এসে আক্রমন করতে থাকলো।যা থাকে কেড়ে নিয়ে মিলিয়ে যায় বাতাসের মতো।রাস্তার দুপাশের গ্রামগুলিতে চালায় হানাদারি।আতঙ্কে আর গুজবে মানুষ তখন যেদিকে পারছে ছুটছে।

নিগন সরাই’র রাস্তায় মারাঠারা হঠাৎ চারদিক থেকে বেগমের শিবিকাকে ঘিরে ধরে।সৈন্যাধ্যক্ষ ওমর খানের পুত্র মোসাহেব খাঁ বীর বিক্রমে যুদ্ধ করে বেগমসাহেবাকে রক্ষা করলো নিজের প্রাণের বিনিময়ে।ঘোড়া থেকে পড়ে যান মিরহাবিব।মারাঠাদের হাতে বন্দী হন।এই মিরহাবিবই পরবর্তী সময়ে বর্গিহাঙ্গামার ত্রাস হয়ে উঠেছিল সমগ্র দক্ষিণবঙ্গে।
বর্ধমান থেকে কাটোয়া-ওইটুকু রাস্তা সৈন্যদের পৌঁছাতে সময় লেগেছিল তিন দিন তিন রাত।ক্ষুধার্ত,ক্লান্ত সৈন্যরা শুধু নন,নবাবসাহেবও কলার এঁটে সিদ্ধ খেয়ে কোনোরকমে প্রাণ ধারণ করেন।গঙ্গারামের মহারাষ্ট্রপুরাণ কাব্যগ্রন্থে লেখা আছে—
                                                   কলার আইঠ্যা যত আনিল তুলিয়া।
                                                   তাহা আনি সব লোকে খায় সিজাইয়া।।
                                                   বিষম বিপত্য বড় বিপরীত হইলো।
                                                   অন্যপরে কা কথা নবাব সাহেব খাই।।

বিধ্বস্ত ক্ষুধার্ত সৈন্যরা কাটোয়ায় এসে পৌঁছালো।কিন্তু তার আগেই কাটোয়ার শস্য ভান্ডার পুড়িয়ে দিয়ে ইন্দ্রাণী দখল করে নেয় মারাঠারা।আলিবর্দি খাঁ কাটোয়ার দুর্গে অবস্থান করলেন।মুর্শিদাবাদ থেকে এলো সৈন্য-সামন্ত।অস্ত্র-শস্ত্র আর প্রচুর খাদ্য রসদ।ভাস্করকে আক্রমন করার প্রস্তুতি এবার।

ভাস্কর দাঁইহাট থেকে পিছোতে শুরু করলেন এবং একসময় সিদ্ধান্ত নিলেন স্বদেশেই ফিরে যাবেন।কিন্তু মিরহাবিবের পরামর্শে বাছাই করা সৈন্য নিয়ে রাতের অন্ধকারে গঙ্গা পেরিয়ে সোজা মুর্শিদাবাদ।এক দুঃসাহসিক অভিযান!জগৎশেঠের কুঠি থেকে প্রায় দুকোটি টাকা ও বহু মূল্যবান দ্রব্যাদি লুন্ঠন করে দাঁইহাটে ফিরে এলেন।


        
                                        তিন



এক একটি ঘটনা যেমন মানুষের জীবন আমূল পালটিয়ে দেয়,তেমনি ঘটনা বা দুর্ঘটনার জেরে যুগ ও জাতির জীবনে আসে পরিবর্তন।ঘটে কালান্তর।শুরু হয় এক নয়া ইতিহাস।

ভাস্করের ঐ দুঃসাহসিক অভিযানের গুরত্ব উপলব্ধি করে মুর্শিদাবাদ রক্ষার জন্য নবাব স্বসৈন্যে পলায়ন করলেন।ভাস্কর মওকা বুঝে শাঁখাই কাটোয়া দুর্গের দখল নিলেন।বর্ধমান রাজাদের গঙ্গা-নিবাস,মাণিকচাঁদের বাড়ি এক কথায় ইন্দ্রাণীর সবকিছু চলে এলো বর্গিদের হাতের মুঠোয়।

মিরহাবিবের পরামর্শে দাঁইহাটের বুড়োরানির ঘাটে নৌকার সেতু তৈরি হলো।শাঁখাই থেকে ভাউসিং বর্গিদের সৈন্যদেরশিবির গড়ে উঠলো।ইন্দ্রাণীর জমিদার ব্যবসাদাররা তখন থরহরি কম্পমান।নিয়মিত নজরানা আসতে লাগলো।
শুরু হলো ব্যাপক লুন্ঠনলীলা।একদিকে ভাগীরথী পেরিয়ে নদিয়া-মুর্শিদাবাদ জেলার গাঁ-গঞ্জ।অন্যদিকে ভাগীরথীর তীর ধরে হুগলি জেলা।কলকাতাকে বাঁচানোর জন্য ইংরেজ আর জমিদাররা মিলে গড়খাত কাটলো।মারাঠা-ডিচ নামে এটি বিখ্যাত।বর্ধমান ও বীরভূম জেলার বিস্তীর্ণ জনপদে নেমে এলো বর্গিদের নিদারুণ অত্যাচার।স্থানীয় চোর-ডাকাত-সমাজবিরোধীরাও যোগ দিয়ে অবস্থা ভয়াবহ করে তোলে।সাধারণ মানুষের তো কথাই নেই,স্বয়ং বর্ধমানরাজ চিত্রসেন ভয়ে কোথায় লুকিয়ে পড়লেন।নবাবি শাসন কার্যত শেষ।দক্ষিণবঙ্গ মুক্তাঞ্চলে পরিনত হলো।যেন শয়তানের অভিশাপ নেমে এলো।দেশের দন্ডমুন্ডের মালিক হলেন ভাস্কর পন্ডিত।ইদ্রাণীর প্রাণকেন্দ্র সেদিনের ‘দাঞিহাট’।ভাগীরথী আর দুর্ভেদ্য গড়খাত(দেওয়ানগঞ্জ হয়ে দাঁইহাট উচ্চ বিদ্যালয়ের পাশ দিয়ে খনন করা শাহা জঙলি গড়খাত)বেষ্টিত নিরাপদ ভূখন্ড।ধনী,জ্ঞানী,গুণী,মানী লোকের ছিল বাসভূমি।

সকাল থেকে শুরু গ্রাম-দখল আর লুঠপাট।বর্গিরা দলে দলে বিভক্ত হয়ে ঘোড়ায় চেপে আর চকচকে খোলা তলোয়ার নিয়ে গ্রামে গ্রামে ঢুকে পড়তো তড়িৎ গতিতে।মুখে হারা হারা(হর হর)র হাড়হিম করা আওয়াজ!গ্রামে ঢুকেই জ্বলন্ত মশাল দিয়ে কয়েকটি বাড়িতে পর পর আগুন।আতঙ্কিত গ্রামবাসীরা অসহায়ভাবে যে যেদিকে পারছে ছুটছে।বর্গিরা সোনা,রুপো।টাকা-পয়সা যা পাচ্ছে কেড়ে নিচ্ছে।না পেলে নাকে জল ভরে অথবা পুকুরে চুবিয়ে ধরছে।কারো কারো হাত-পা কেটে দিচ্ছে।সুন্দরী মেয়েদের পিছমোড়া করে বেঁধে একদল সৈন্য তখন ধর্ষণ করছে।সমসাময়িক কবি গঙ্গারাম লিখেছেন—
                                     ভালো ভালো স্ত্রীলোক যত ধইরা লইয়া জাএ।
                                          আঙ্গুষ্ঠে দড়ি বাঁধি দেয় তার গলাএ।।
                                         একজন ছাড়ে তারে আর জনা ধরে।
                                             রমণের ভরে ত্রাহি শব্দ করে।।
এ তো গাঁ’এর ভিতরের ছবি।এবার মাঠের বা রাস্তার কথা।আতঙ্কে ভয়ে সবাই পালাচ্ছে।কিন্তু কোথায় যাবে?গর্ভবতী মহিলা,ক্ষুধার্ত শিশু,পুথি-বগলে ঘটি বামুন,সোনার বেনে,গন্ধবণিক,কাঁসারি প্রভৃতি বর্গির ভয়ে পালাচ্ছে।গোঁসাই বৈষ্ণব মাহান্তরা আবার চৌপালায় চড়ে বোচকা বুচকি নিয়ে ধাবমান।কেউ যাচ্ছে পুবে।কেউ বা পসচিমে।এমন সময় বর্গির দল তাদেরকে ঘিরে ধরে।টাকা-পয়সার সঙ্গে লুঠ করে নিয়ে যায় তাদের ঘরের মা-বোনেদের।সমসাময়িক কবি ভারতচন্দ্র রায় তাঁর অন্নদামঙ্গল কাব্যে লিখেছেন—
                                                    কাটিল বিস্তর লোক গ্রাম গ্রাম পুড়ি।
                                                      লুটিয়া লইলো ধন ঝিউড়ি বহুরি।।

কাটোয়া,পানুহাট,মোড়লহাট,বিকিহাট,বেড়া,পাতাইহাট,আতাইহাট,দাঁইহাট,ভাউসিং,অগ্রদ্বীপ,ঘোড়ানাশ,মুস্থল,সিঙি,বাক্সা,চাড়ুল,পাটুলী,করুইকৈথন,কাগাঁ,মৌগাঁ,যাজিগ্রাম,ননগর,কোশিগ্রাম,কোপা,কেতুগ্রাম,কাঁদরা,সালারসহ -সোনারুন্দি,বর্ধমান- কাটোয়ার রাস্তার দুপাশের গ্রামগুলি বর্গিহাঙ্গামায় যেন নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল।কাটোয়া অঞ্চলের ধনী ও সম্ভ্রান্ত মুসলমানেরা পূর্ববঙ্গে পলায়ন করেন।অনেক হিন্দু জমিদার,বণিক,ধনাঢ্য ব্যক্তিরা কলকাতায় থিতু হয়েছিলেন।এমন রাষ্ট্রবিপ্লব রাঢ়ের ইতিহাসে খুব কমই দেখা গেছে।বর্তমানেও অবশ্য গ্রাম-দখলের রাজনীতি ফিরে এসেছে।ভিন্ন মাত্রায়।ভিন্ন আঙ্গিকে।

এদিকে বর্ষার বিদায়।এল শরৎকাল।আকাশে বাতাসে আনন্দময়ীর আগমনি।ভাস্কর মনস্থির করলেন এবার দশেরা উৎসব দুর্গাপুজোর মধ্য দিয়ে নিস্পন্ন হবে।ইন্দ্রাণী পরগনার সকল জমিদারকে খবর দেওয়া হলো।ভয়ে ভক্তিতে তারা নজরানা দিয়ে উৎসবে যোগ দিলো।দাঁইহাটে তখন বর্গিরা উৎসবে মেতে উঠলো।
নবাব আলিবর্দি খাঁ শুধু এই সুযোগটার জন্য অপেক্ষা করছিলেন কয়েক মাস ধরে।গঙ্গার ওপাড়ে বল্লভপাড়া ও বসতপুরের মাঝামাঝি ছাউনির ডাঙায় বিপুল সৈন্য সমাবেশ করলেন।ভাস্করও প্রস্তুত দাঁইহাটে।উভয়পক্ষের কামান বর্ষণে উত্তাল হয়ে উঠলো গঙ্গাগর্ভ।নবাব বুঝতে পারলেন এইভাবে যুদ্ধ করা নি্রর্থক।আবার সোজাসুজি গঙ্গা পেরিয়ে দাঁইহাটে ঢোকা বোকামি ছাড়া আর কিছুই নয়।তাই রাতের অন্ধকারে উদ্ধারণপুরে গঙ্গা পেরিয়ে সোজা শাঁখাই ঘাটে সৈন্যদের নিয়ে আসা হলো।

কানায় কানায় ভরা দুরন্ত অজয় আর গঙ্গা।সুতরাং সেতু বানিয়ে পার হওয়া ছাড়া গতি নেই।সৈন্যদের পদভারে হুড়মুড় করে সেতু গেলো ভেঙে।অনেক সৈন্য ভেসে গেল নদির স্রোতে।বাকিরা অদম্য মনোবল নিয়ে প্রবল বিক্রমে দাঁইহাটের পথে...

                    ------আল্লা হো আকবর!!
     -                     -----হারা হারা.........

দুপক্ষের তীব্র চিৎকারে বেধে গেল তুমুল রন।অতর্কিত আক্রমনে দিশেহারা ভাস্কর।নবমীর পুজো ফেলেই মহারাষ্ট্রের পথে ঘোরা ছোটালেন দ্রুতবেগে।

                                    চার


১৭৪৩ খ্রিস্টাব্দ।স্বয়ং রঘুজি ভোঁসলে আর ভাস্কর পন্ডিত প্রতিশোধ নিতে হাজির হলো দাঁইহাটে।এদিকে দিল্লির মোঘল সম্রাটের কাছে আবেদনের ভিত্তিতে পেশোয়া বালাজিবাজিরাও সসৈন্যে হাজির মুর্শিদাবাদে।

একেই বলে জোড়া ফলার আক্রমন।শাঁখের করাত.৩১শে মার্চ নবাব পেশোয়ারের সঙ্গে ২২লক্ষ টাকার বিনিময়ে চুক্তি করে মুক্তি চাইলেন।উভয় বাহিনী মিলে রঘুজি ও ভাস্করকে এ যাত্রায় বাংলা ছাড়া করলো।
১৭৪৪খ্রিস্টাব্দ।অপমানাহত রঘুজি ভাস্করকে পুনরায় বাংলায় পাঠালেন।আবার দাঁইহাটকে কেন্দ্র করে শুরু হলো বর্গিহাঙ্গামা।নবাব এবার চরম সিদ্ধান্ত নিলেন।সন্ধির নাম করে ভাস্করকে বহরমপুরের সন্নিকটে মানকরার শিবিরে আহ্বান করলেন।জানালেন ভাস্করের কথা মতোই সন্ধি হবে।বিনাশকালে বিপরীত বুদ্ধি।অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসই তার কাল হলো।সহজেই পাতা ফাঁদএ পা দিলেন।আর সেই সুযোগে নিরস্ত্র ভাস্করকে নির্মম ভাবে হত্যা করলো নবাবসৈন্য।

১৭৪৫ খ্রিস্টাব্দে রঘুজি ভাস্কর হত্যার প্রতিশোধ নিতে বিপুল সৈন্য নিয়ে মুর্শিদাবাদে প্রবেশ করলেন।নবাবসৈন্য মারাঠাদের তাড়া করলে যাজিগ্রামের নিকট শ্রীনিবাস আচার্যের স্মৃতি বিজড়িত রানিদিঘির পারে তুমুল যুদ্ধ শুরু হলো।এই যুদ্ধে রঘুজি একরকম পরাজিত হয়ে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করতে বাধ্য হন।ননগর যাজিগ্রামের রানিদিঘি ওরফে সিপাইদিঘি সেই ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষ্য দিচ্ছে।

রঘুজি এই অপমান কোনদিন ভুলতে পারেননি।এবার মিরহাবিবের পৃষ্টপোষকতায় তঞ্জী ও বিম্বজিকে বাংলা আক্রমনের জন্য পাঠালেন।এইভাবে ১৭৫১ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাস পর্যন্ত বর্গিহাঙ্গামা মাঝে মঝে চলতেই থাকলো।চতুর মিরহাবিব সন্ধির প্রস্তাব পাঠালেন।নিরুপায় হয়ে বৃদ্ধ নবাব আলিবর্দি খাঁ কাটোয়ার শিবিরে মে মাসে একটি সন্ধিচুক্তি স্বাক্ষর করলেন।শর্তানুসারে মিরহাবিব হলেন উড়িষ্যার সহকারী শাসনকর্তা।বাৎসরিক ১২লক্ষ টাকা রাজস্ব পেলেন রঘুজি।এই কাটোয়া সন্ধির ফলে প্রায় এক দশকের ভয়াবহ বর্গিহাঙ্গামার পরিসমাপ্তি ঘটে।
বর্গিহাঙ্গামায় ইন্দ্রাণীর সম্ভ্রান্ত লোকেরা বাস ওঠালেন।ধ্বংস হয়ে গেল কৃষি আর কুটীরশিল্পের সুপ্রাচীন গৌরব।বারঘাট,তেরহাট ঢেকে গেল বিস্মৃতিতে।বর্ধমানের রাজারা দাঁইহাট থেকে গঙ্গাবাস ওঠালেন।পাদপ্রদীপের আলোয় ক্রমশ উদভাসিত হয়ে উঠলো অম্বিকা-কালনা।ইন্দ্রাণীজনপদ ঢেকে গেল ঘন বন-জঙ্গলে।শ্বাপদ সংকুল জন্তু জানোয়ারে।তারপর একসময়ে প্রবল বন্যায় ভাগীরথীও ইন্দ্রাণীকে ত্যাগ করলো।নগর ইন্দ্রাণীর ঘটলো বিলুপ্তি।

ঐ যে দেখছেন----ভাঙা দেওয়ালটুকু! ওটা বর্ধমানরাজাদের বিরাট গঙ্গাবাস ভবনের শেষ চিহ্ন।নিচে জননী জাহ্নবী।বাঁধানো ঘাট--বারদুয়ারী।ডান দিকে রাজাদের সমাধি স্মারক--সমাজবাড়ি।কিশোর-কিশোরী মন্দির।আজ গঙ্গা অভিমানে দূরে সরে গেছে।গাছ-গাছালি আর আত্মবিস্মৃতির পলিতে চাপা পড়ে ইতিকথা!বঙ্গে বর্গি হাঙ্গামার স্মারক চিহ্ন রাজবাড়িটা ভাঙতে ভাঙতে শুধু এইটুকু!!একটা বোবা জিজ্ঞাসা চিহ্নের মত দাঁড়িয়ে!অচিরে হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়বে।আত্মবিস্মৃত বাঙালী শুধু নিদ্রালু সন্তানদের ঘুম পারাতে পারাতে বলবে---

                             খোকা ঘুমালো পাড়া জুড়ালো বর্গি এলো দেশে।
                            বুলবুলিতে ধান খেয়েছে খাজনা দেবো কিসে।।
 ছবিঃ ইন্টারনেট ফারুক আহমেদ ও নিজদ্ব

Tuesday, May 17, 2016

KHERUYAR JORA VISHNU MURTI

                                    খেড়ুয়ার জোড়া বিষ্ণুমূর্তি



 এপাড়ে  মঙ্গলকোট থানার খেড়ুয়াগ্রাম। ওপাড়ে কেতুগ্রামের গনফুল।মাঝখানে বহে যায় দুরন্ত অজয়।এখন অবশ্য নদী শুকিয়ে কাঠ।ধূ ধূ বালুচর। নদীর গর্ভ থেকে বালি কাটা শুরু হয়েছে জোরকদমে ।সামনেই  বর্ষা ।নাওয়া খাওয়া ভুলে  মেশিন দিয়ে  হরদম বালি কাটা হচ্ছে। বড় বড়  লরি নেমে পড়ছে অজয়ের গাভায়। তারপর বালি বোঝাই করে হু হু গতিতে  ছোটে  নদিয়া হুগলির পথে প্রান্তরে।খেড়ুয়ার বালিঘাটের এই হলো গিয়ে প্রাত্যহিক চিত্রনাট্য।

দিনতিনেক আগে  ভোরবেলায় বালি কাটতে গিয়ে  পাওয়া গেল জোড়া বিষ্ণুমুর্তি। ঘোর কৃষ্ণ বর্ণের পাথর। দহের জলে চান করিয়ে সামান্য ঘি মাখাতেই সে কি রঙের জেল্লা!অক্ষতপ্রায় প্রথম  মূর্তির উচ্চতা তিন ফুট।অপর মূর্তিটি বালি কাটার যন্ত্রে  মুখ ও বুকের অংশ  বেশ কিছুটা  ক্ষত বিক্ষত। উচ্চতা প্রায় পৌনে তিন ফুট। দুটি মূর্তি একই ধরনের।চালির উপরি ভাগে সুগঠিত কীর্তিমুখ।দুপাশে বিদ্যাধর ও বিদ্যাধরী।তাদের পায়ের উপরে বসে আছে আরো এক জোড়া মূর্তি।চালির  প্রান্তে কিন্নর কিন্নরী গণধরেরা রয়েছে।অলঙ্করণ হিসাবে সিংহ হাতির  প্রচলিত মোটিফ ব্যবহৃত হয়েছে।বিষ্ণু সমপাদস্থানিক ভঙ্গিমায় দন্ডায়মান। তাঁর দু পাশে লক্ষ্মী ও সরস্বতী।তাঁদের আবার দুই সহচরী দু পাশ থেকে উঁকি মারছেন! বিষ্ণুর উপরের ডানহাতে গদা বাম হাতে চক্র  নিচের বাম হাতে শঙ্খ আর ডানহাতে পদ্ম।রথাকৃতি পাদপীঠ। সেখানে ঠাঁই মিলেছে বিষ্ণু বাহন গড়ুরের।বিশেষজ্ঞদের মতে মূর্তি দুটি ভোগবিষ্ণু ও ত্রিবিক্রম রূপের।দশম থেকে দ্বাদশ শতকের এই মূর্তি।বালি- শ্রমিকরাই মূর্তিদুটি উদ্ধার করে বালি ঘাটে রাখেন।পরে বেলা আটটার দিকে খেড়ুয়া গ্রামবাসীরা মূর্তি তুলে নিয়ে গিয়ে গ্রামের ভিতরে এক নির্মীয়মান শিবমন্দিরে রেখে যথারীতি পুজো আচ্চা শুরু করে

দেন।মঙ্গলকোট থানার পুলিশ মূর্তি উদ্ধার করতে এলে গ্রামবাসীদের বাধা পান।গ্রামবাসীরা বলেন 'মূর্তি তাদের গ্রামেই থাকবে।পুলিশকে তারা মুচলেকা দিয়ে জানিয়েছে মূর্তিদ্বয়ের যাবতীয় দায়ভার গ্রামবাসীদের'। অনেকেই বলেন মূর্তিদুটিকে যথাযথ সংরক্ষণ করে গ্রামে রাখাই যেতে পারে। এই অঞ্চলে একাধিক বিষ্ণু মূর্তি মিলেছে।এতে এলাকার  পর্যটনের  একটা নতুন দিক খুলে যেতে পারে। ইতিমধ্যেই গ্রামবাসীরা মন্দির গড়ার জন্য সচেষ্ট হয়েছেন এবং মূর্তিদুটি দেখভালের জন্য রাত পাহাড়ার ব্যাবস্থা করেছেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য খেড়ুয়া গ্রামের অজয়নদী থেকে বছর কুড়ি আগে প্রায় সাড়ে চারফুট লম্বা আর একটি বিষ্ণু মূর্তি উদ্ধার করা হয়েছিল।মূর্তিটি গ্রামেই পূজিত হচ্ছে।
গণফুলের বাঁশের জঙ্গল

Sunday, May 15, 2016

MONGALKOTER JAIN NAIGAMESA


 মঙ্গলকোটের জৈনমূর্তি নৈগমেশ


জৈন শিশুরক্ষক দেবতা নৈগমেশ।অর্ধেক পশু অর্ধেক মানব।মুখমন্ডল ছাগল ভেড়া কিংবা শিঙওয়ালা প্রাণীর। গ্রিক বা রোমান মূর্তির সঙ্গে সাদৃশ্যযুক্ত।পুরুষ ও নারী উভয় মূর্তিই দেখা যায়।জৈনধর্মগ্রন্থ কল্পসূত্র ,নেমিনাথচরিত প্রভৃতি গ্রন্থ থেকে জানা যায় যে নৈগমেশ আসলে ইন্দ্রের পদাতিক বাহিনীর সেনাপতি।জৈন পুরাণ অনুসারে ইন্দ্রের আদেশে নৈগমেশ ব্রাহ্মণী দেবানন্দের গর্ভ থেকে জৈন তীর্থংকর মহাবীরের ভ্রুণ ক্ষত্রিয়া ত্রিশলার গর্ভে প্রতিস্থাপিত করেন।পরবর্তীকালে জৈনধর্মে শিশুরক্ষক দেবতা  বা দেবী হিসাবে নৈগমেশ  পূজিত হতে থাকে।
বর্ধমান জেলার মঙ্গলকোটের প্রত্নডাঙাগুলি উৎখননে আবিস্কৃত হয়েছে খ্রি.পূ.প্রথম সহস্রাব্দ থেকে খ্রিস্টিয় অষ্টাদশ শতক অবধি নিরবছিন্ন মানববসতির নানা প্রত্নস্মারক।এখানকার চতুর্থ স্তর থেকে  কুষাণযুগের একটি নৈগমেশ মূর্তি পাওয়া গেছে বলে দাবি করা হয়।মথুরা থেকে কুষাণযুগের একাধিক নৈগমেশ মুর্তি পাওয়া গেছে।উত্তরপ্রদেশের অহিছত্র,রাজঘাট,বিহারের বৈশালী প্রত্নস্থল থেকে প্রায় ১২ টির মতো নৈগমেশের টেরাকোটা ফলক আবিস্কৃত হয়েছে বলে বিশেষজ্ঞরা দাবি করেন।
মঙ্গলকোটের প্রত্নস্থল থেকে লোকগবেষক ও প্রত্ন অনুসন্ধিৎসু মুহম্মদ আয়ুব হোসেন প্রায় দু ইঞ্চি লম্বা একটি মাটির সিল সংগ্রহ করেন।সিলে খোদিত মূর্তিটিকে অনেক  প্রত্নতাত্ত্বিক মনে করেন নৈগমেশের মূর্তি। এটি দেবী্মূর্তি।বাম হাত কটি সংলগ্ন,মনে হচ্ছে ঘট জাতীয় কিছু কোমরে ধরে রেখেছেন।ডান হাত প্রসারিত।কলসি বা ঘট থেকে কিছু বস্তু ছড়িয়ে দিচ্ছেন ভূমিতে।পা  পর্যন্ত ঢাকা কাপড়।মুখটি ছাগল বা ভেড়ার।নিচে ব্রাহ্মী লিপিতে উৎকীর্ণ প জাতীয় অক্ষর।ভেঙে চুরে যাওয়ায় ঠিক মত পড়া যায় না।  অনেকে মনে করেন জৈনধর্মাশ্রিত অবাঙালী বণিকরাই  তাদের বাণিজ্যদ্রব্যে এই সিল ব্যবহার করতেন।একাধিক কারণে সিলটি গুরুত্বপূর্ণ।
প্রথমত--নৈগমশের প্রস্তর বা টেরাকোটার মূর্তি মিললেও সিলে উৎকীর্ণ এই মূর্তি ফলকটি সম্ভবত রাঢ় অঞ্চলে প্রথম দৃষ্টান্ত।দ্বিতীয়ত---রাঢ় অঞ্চলে জৈনধর্মের প্রসার ও ব্যপ্তি শুধুমাত্র মূর্তিগত সাক্ষ্য নির্ভর ছিল।মঙ্গলকোটে পাওয়া গেছে  একাধিক  শান্তিনাথের বিগ্রহ। পুরুলিয়া বাঁকুড়া থেকে প্রচুর জৈন মূর্তি  মন্দির তথা প্রত্নস্মারক মিললেও সিলে উৎকীর্ণ  কোন মূর্তি মিলেছে বলে জানা নেই।

KANKURHATIR VISHNU MURTI

               বিষ্ণু মূর্তিঃ কাটোয়ার কাঁকুরহাটিতে

কাটোয়ার উপকন্ঠে কাঁকুরহাটিতে রেললাইনের কাজের জন্য মাটি কাটতে গিয়ে মিলল পাল-সেন আমলের অক্ষত এক বিষ্ণুমূর্তি।কালো কষ্ঠি পাথরের তৈরি মূর্তিটির উচ্চতা প্রায় পৌনে দু-ফুট।সমপাদস্থানিক ভঙ্গিমায় দন্ডায়মান বিষ্ণু।দুপাশে লক্ষ্মী ও বীণাবাদিকা সরস্বতী।বিষ্ণুর চার হাতের উপরের ডান হাতে গদা,উপরের বাম হাতে চক্র।নিচের বাম হাতে শঙ্খ ডান হাতে পদ্ম।রূপমন্ডন গ্রন্থানুসারে  এটি ভোগবিষ্ণু।ত্রিবিক্রম রীতির।চালির অগ্রভাগে সুগঠিত কীর্তিমুখ,দু পাশে উড়ন্ত বিধ্যাধর বিধ্যাধরী। মুর্তিটি বর্তমানে কাঁকুরহাটি গ্রামের বাগদি পাড়ায় পূজিত হচ্ছে।

অজয়ের গ্রাসে কাঁকুরহাটি গ্রাম

ITIHASER PREKKHITE DAINHAT HIGH SCHOOL

ইতিহাসের প্রেক্ষিতে দাঁইহাট উচ্চ বিদ্যালয়

দাঁইহাট উচ্চ বিদ্যালয়




                
বারো হাট তেরো ঘাট।এই নিয়েই বর্ধমান জেলার কাটোয়া মহকুমার ইন্দ্রাণী-দাঁইহাট।গঙ্গাতীরবর্তী প্রাচীন ইন্দ্রাণী নগর।সর্বাঙ্গে জড়িয়ে আছে তার গৌরবের ইতিহাস।আবুল ফজলের আকবরনামায় উল্লিখিত সরকার সলিমানাবাদের অন্তর্গত ইন্দ্রায়িন পরগনা।এখান থেকে মোঘলসম্রাট আকবর রাজস্ব পেতেন ৫,৯২,১২০ দাম।তারও বহু আগে থেকে সর্বভারতীয় এক তীর্থক্ষেত্র রূপে সুপরিচিত।সপ্তমাতৃকার অন্যতম দেবী ইন্দ্রাণীর পীঠস্থান।এই ইন্দ্রাণী আর ইন্দ্রেশ্বরঘাটের কথা আছে কবি কৃত্তিবাসের রামায়ণে।বিপ্রদাসের মনসামঙ্গলে।মুকুন্দের চন্ডীমঙ্গলে। আর চৈতন্যজীবনী সাহিত্যে।ইন্দ্রাণীর ভূমিপুত্র কবি কাশীরাম দাস লিখেছিলেন—
                     ইন্দ্রাণী নামেতে দেশ পূর্বাপর স্থিতি।

বর্ধমানের মহারাজ কীর্তিচাঁদ  রায়ের সমাধিসৌধ

                     দ্বাদশ তীর্থে যথা বৈসে ভাগীরথী।।


ইন্দ্রাণী এক সময় বর্ধমান রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করে। দাঁইহাট হয়ে ওঠে তাঁদের গঙ্গাবাস।এখানকার গঙ্গার ঘাটে তাঁদের ধর্ম-কর্ম আর অন্ত্যেষ্টি ক্রিয়া সম্পন্ন হতো।১৭৪০ খ্রি.প্রয়াত মহারাজ কীর্তিচন্দ্র রায়ের সমাধিস্মারক ‘সমাজ-বাড়ি’ জেলার অন্যতম পুরাকীর্তি।রয়েছে রাজবাড়ির ভগ্নাংশ,কিশোর-কিশোরীর মন্দিরসহ প্রাচীন দেববিগ্রহ। গাঙ্গেয় অঞ্চল হওয়ার কারণে ধান পাট গম তৈলবীজ প্রভৃতি কৃষিজ সম্পদের প্রাচুর্য ইর্ষণীয়।নানা কুটী্রশিল্প বিশেষকরে তাঁতবস্ত্র,রেশমশিল্প,ধাতুজ তৈজসপত্রাদি,দারু এবং প্রস্তর ভাস্কর্যের প্রভূত উন্নতি হয়েছিল একসময়।দক্ষিণেশ্বরের ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ পূজিত ভবতারিণী বিগ্রহটি নির্মাণ করেছিলেন দাঁইহাটের ‘কলির বিশ্বকর্মা” নবীন ভাস্কর।হাট-ঘাটের এই প্রাচীন শহরের আর্থিক সমৃদ্ধিতেই সম্ভবত প্রলুব্ধ হয়ে মারাঠা লুঠেরা ভাস্কর পন্ডিত দাঁইহাটেই ঘাঁটি গেড়েছিলেন।দক্ষিণবঙ্গে এক দশক ব্যাপী যে ভয়াবহ বর্গিহাঙ্গামা ছড়িয়ে পড়েছিল তার কেন্দ্রস্থল এই ইন্দ্রাণী-দাঁইহাট।
আবার প্রাচীনকাল থেকে টোল-চতুস্পাঠী-মোক্তব-মাদ্রাসাকে কেন্দ্র করে এই অঞ্চলের সারস্বত সাধনার সিদ্ধি এক গৌরবজনক স্থান অধিকার করে আছে বাংলার সাংস্কৃতিক ইতিহাসে।অনেকেই বলেন দ্বাদশ শতকের অমরকোষের টীকাসর্বস্ব রচয়িতা বন্দ্যঘটীয় সর্বানন্দ ইন্দ্রাণীর শিক্ষাবিদ।সিদ্ধিগ্রামের কবি কাশীরাম দাস ছাড়াও তাঁর অনুজ গদাধর দাস রচনা করেছিলেন জগন্নাথমঙ্গলকাব্য।বেড়া গ্রামের পন্ডিত গোপাল চক্রবর্তী রচনা করেছিলেন সপ্তশতী চন্ডীর উপর টীকাগ্রন্থ।উনিশশতকের দ্বিতীয়ার্ধে দাঁইহাটে পৌরসভা প্রতিষ্ঠার(১৮৬৯)  পাশাপাশি স্থাপিত হয়েছিল একটি বালিকা বিদ্যালয় ও দাঁইহাট মডেল স্কুল ।বালিকাবিদ্যালয়টি কালের গর্ভে হারিয়ে গেলেও আজও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে সেই মডেলস্কুল।  বিবর্তনের সিড়ি ভেঙে ভেঙে্ তার বর্তমান পরিচিতি- দাঁইহাট উচ্চ বিদ্যালয়[উ.মা]।

                                    দুই

বিদ্যালয়ের পাশে ঐতিহাসিক গড়খাত

দাঁইহাটে আধুনিক শিক্ষার প্রদীপটি জ্বালিয়েছিলেন নবজাগরণের অন্যতম পথিকৃৎ স্বয়ং বিদ্যাসাগর মহাশয়।আর সেই দীপাধারের সলতে পাকিয়েছিলেন কাটোয়ার দুই ইতিহাসবিস্মৃত ব্যাপটিস্ট মিশনারি রেভারেন্ড জন চেম্বারলিন ও শ্রীরামপুরের উইলিয়ম কেরির পুত্র জুনিওর দ্যা কেরি।১৮০৪খ্রি.কাটোয়ায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ব্যাপটিস্ট মিশনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্টেশন।মহকুমার বিভিন্ন জনপদসহ দাঁইহাট-দেওয়ানগঞ্জেও তাঁরা স্কুল স্থাপন করেছিলেন।এতদাঞ্চলে সংঘটিত সতীদাহ,গঙ্গায় সন্তান বিসর্জন,জীবন্ত কুষ্ঠরোগিকে পুড়িয়ে মারা,গঙ্গায় অন্তর্জলি প্রভৃতি মধ্যযুগীয় কুসংস্কারপূর্ণ প্রথাগুলির বিরুদ্ধে তাঁরা লাগাতার আন্দোলন করেছিলেন।শহর কাটোয়ায় জুনিয়ার কেরি ১৮৩৭ সালে মহকুমার প্রথম বালিকাবিদ্যালয়টি স্থাপন করেন।দাঁইহাটে প্রথম বালিকা বিদ্যালয়টি স্থাপিত হয়েছিল ১৮৫৮সালে।এই বিদ্যালয়টিরও প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন পন্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর।বিদ্যাসাগর অধ্যাপনার পাশাপাশি একসময় দক্ষিণবঙ্গের শিক্ষাপরিদর্শকের কর্মভার গ্রহণ করেছিলেন। তাঁর উদ্যোগে বর্ধমান জেলায়  ২৬.0৮.১৮৫৫ থেকে২৯.১০.১৮৫৫ পর্যন্ত পাঁচটি সরকারি অর্থাৎমডেলস্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। সেগুলি হলো জৌগ্রাম,আমাদপুর,মানকর,দাঁইহাট ও খন্ডঘোষ।কাটোয়া মহকুমায় সরকারি উদ্যোগে স্থাপিত প্রথম বিদ্যালয় এই দাঁইহাট মডেলস্কুল।যা ১৮৫৫ সালের ২৯ শে অক্টোবর বিদ্যাসাগর মহাশয় কতৃক প্রতিষ্ঠিত হয়।গবেষক ড.যোগজীবন গোস্বামীর সৌজন্যে প্রাপ্ত,রাজ্যলেখ্যাগারে সংরক্ষিত একটি নথিতে দেখা যায় বিদ্যাসাগরমহাশয়ের স্বাক্ষরিত বর্ধমান জেলার পাঁচটি মডেলস্কুলের বেতনের বিল। প্রতিটি স্কুলের প্রধানশিক্ষকের বেতন ২৫ টাকা,সেকেন্ড টিচারের বেতন ২০ টাকা।সারভেন্ট ৩টাকা এবং অন্যান্য খরচ ২টা্কাসহ মোট ৫০ টাকার বিল।১৮৫৬-৫৭ সালের ডিপিয়াই রেকর্ড অনুসারে দাঁইহাট মডেলস্কুলের হিন্দু ছাত্র সংখ্যা ৯৯জন,মুসলমান ১জন এবং অন্যান্য ১ জন।সবমিলিয়ে ১০১ জন।ছাত্র উপস্থিতির হার গড়ে ৭১জন।১৮৫৬ সালে একটি সরকারি প্রতিবেদন থেকে জানা যায় দাঁইহাট মডেল স্কুলে মাটিয়ারি থেকে পড়তে আস্তো ৩০ জন ছাত্র!
             ।must, however, mention that
             nearly     opposite to Metyaree, across the river,
             at a place called by the people Dyhattec (in the Burdwan district), but which I
             suppose must correspond with the place called DyneLat in the assistant inspector's
             reports, there is a model school. Although 30 boys from Metyaree attend this
             school, and it is not more than three miles off, yet as the river is dangerous at
             this point in the rains, and as the parents of these children intend on that account
             to withdraw them from the Dinehaut or Dyhattee school, I see no objection to
             comply with the earnest prayer of the Metyaree people, who piteously complain
             that " their village has 200 families of the writer caste without one good school


ইতিমধ্যে বেসরকারি উদ্যোগে মহকুমার বিভিন্ন স্থানে বিদ্যালয় স্তাপিত হয়েছিল।কাটোয়ার কাশিরামদাস বিদ্যায়তন,ওকড়সা বিদ্যালয়,কোঁয়ারপুর বিদ্যালয় যার উল্লেখ্য দৃষ্টান্ত।এগুলি ছিল সরকারি পরিদর্শনের আওতাভুক্ত মিডিল ইংরেজি ও মিডিল ভার্নাকুলার স্কুল।পিটারসনের বর্ধমান জেলা গেজিটিয়ার (১৯০৯-১০)থেকে জানাযায় সেইসময় জেলার ১৬টি সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত বিদ্যালয়গুলির মধ্যে কাটোয়া মহকুমার তিনটি স্কুল ছিল যথা কাটোয়ার কাশীরামদাস বিদ্যায়তন,ওকড়সা বিদ্যালয় আর দাঁইহাট হাই ইংলিশ স্কুল।দাঁইহাট মডেলস্কুল কিভাবে দাঁইহাট উচ্চ বিদ্যালয়ে পরিণত হয়েছিল তার  পুরো ইতিহাসটা জানা যায়না।কেননা সাতের দশকে রাজনৈতিক দুস্কৃতিদের লাগানো আগুনে বিদ্যালয়ের বহু প্রাচীন নথিসহ শিক্ষকদের পেশাগত তথ্যাবলি পুড়ে ছাই হয়ে যায়। বিভিন্ন সূত্র থেকে এই তথ্য মেলে যে ১৮৮২ খ্রি. বিদ্যালয়টি ষষ্ঠশ্রেণি পর্যন্ত নিম্ন-ইংরেজি বিদ্যালয় রূপে পরিচিত ছিল।১৮৮৫ খ্রি.মধ্য ইংরেজি বিদ্যালয় হিসাবে স্বীকৃতি পায়।১৮৮৭ খ্রি. দাঁইহাট উচ্চ বিদ্যালয় রূপে আত্মপ্রকাশ করে।১৯৫৯ খ্রি.একাদশ শ্রেণি এবং ১৯৭৬ সালে দ্বাদশ শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হয়।বর্তমানে গভঃস্পনসর বিদ্যালয় রূপে স্বীকৃত।

১৮৮২ থেকে ১৯১৬ খ্রি.অবধি বিদ্যালয়টি চলতো প্রাচীন কালনা-কাটোয়া রোডের পাশে। বর্তমান অশ্বিনীকুমারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বিপরীতে।কাশিমবাজারের রাজা শিক্ষানুরাগী মণীন্দ্রচন্দ্র নন্দী,বর্ধমানরাজ বিজয়চাঁদ মাহাতাব,দাঁইহাটের বিশিষ্ট শিক্ষানুরাগী ও বেদব্যাস পত্রিকার পৃষ্ঠপোষক রাজা হরিনারায়ণ মুখোপাধ্যায় প্রমূখদের  আর্থিক সহায়তায় বর্তমান বিদ্যালয়ের মূল ভবনটি নির্মিত হয় ১৯১৭ সালে।মূল ভবনের দ্বারোদ্ঘাটন করেছিলেন তদানীন্তন বর্ধমান জেলা শাসক মি.ডি.ওয়াইডো সাহেব।১৯২৮ খ্রি.বহিরাগত ছাত্রদের সুবিধার জন্য চালু হয়েছিল গৌরবদীপ্ত “স্বর্ণময়ী ছাত্রাবাস”।ছয়ের দশকে নির্মিত হয় কলা আর বাণিজ্যভবন।আটের দশকে তৈরি হয়েছিল “ঋষিকেশমিত্র শতবর্ষ স্মারককক্ষ”টি।সাতের দশকে তৎকালীন প্রধানশিক্ষক শ্রীমনোরঞ্জন ভট্টাচার্য মহাশয়ের প্রচেষ্টায় বিদ্যালয় সংলগ্ন ঐতিহাসিক গড়খাতসহ ২৪ বিঘা জমি ক্রয় করা হয়েছিল।প্রসঙ্গত- শতাধিক বৎসর পূর্বে রচিত নিবারণচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের “কাটোয়ার ইতিহাস”থেকে জানাযায় রাজা রামমোহন রায়ের পূর্বপুরুষ নিত্যানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়এর  এই গড়বাটিতেই বর্তমান দাঁইহাট উচ্চ বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।সম্প্রতি বিদ্যালয়ের সার্ধশতবর্ষোত্তর উৎসব উদযাপিত হয়েছে সাড়ম্বরে।

                                              তিন                         


এই বিদ্যালয়ের অন্যতম গৌরব তার কৃতি ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য।প্রখ্যাত ঐতিহাসিক রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের শিক্ষাগুরু ঐতিহাসিক কালীপ্রসন্ন বন্দ্যোপাধ্যায় এই বিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। কালীপ্রসন্নর বিখ্যাত দুটি বই  বাঙ্গলার ইতিহাস-নবাবি আমল ও মধ্যযুগে বাঙ্গলা।দেজ পাবলিসার থেকে পুনঃ   মুদ্রিত হয়েছে।প্রখ্যাত চিকিৎসক ,গান্ধিবাদী কংগ্রেস নেতা তথা সমাজসেবী প্রফেসর শচ্চিদানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন এই বিদ্যালয়ের কৃতি ছাত্র.১৯১০ খ্রি দাঁইহাটের নিকটবর্তী নলাহাটি গ্রামে বিখ্যাত বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবারে শচ্চিদানন্দের জন্ম।দাঁইহাট উচ্চবিদ্যালয় থেকে ১৯২৭ সালে এন্ট্রান্স পাস করার পর ফিজিওলজিতে অনার্স নিয়ে প্রেসিডেন্সিতে ভর্তি হন।১৯৩৫ সালে এম.বি.এ.পাশ করেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে।১৯৪৫ সালে ডি.এস.সি.।ডায়াবেটিস রোগের উপর তাঁর গবেষণা আনর্জাতিক মহলে সাড়া ফেলে দেয়।১৯৪২-৪৪ দুবার তিনি গ্রিফিথ মেমোরিয়াল পুরস্কার পান।১৯৫৯ সালে সর্দার প্যাটেল কলেজের বিভাগীয় প্রধান হন।তিনি ছিলেন গান্ধিবাদী নেতা।খদ্দর ও গান্ধী টুপি পরতেন।বিনা পয়সসায় চিকিৎসা করতেন স্বগ্রামসহ সন্নিহিত দরিদ্র গ্রামবাসীদের।প্রেসক্রিপসন লিখতেন বাংলায় আর কলমে ব্যবহার করতেন সবুজ কালি।


দাঁইহাট উচ্চ বিদ্যালয়ের ১৯৪২ সালের এডমিট ছবি...ড,প্রশান্ত কুন্ডুর সৌজন্যে
 অকাল প্রয়াত রাজ্যপ্রত্নতত্ত্ব সংগ্রহালয়ের উপ-অধিকর্তা ড.অমল রায় ছিলেন দাঁইহাট উচ্চ বিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র।এছাড়া বহু কৃতি ছাত্র দেশ বিদেশে বিভিন্ন গুরুত্ত্বপূর্ণ পদে রয়েছেন।বিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র অধুনা সুইডেন প্রবাসী শ্রীপ্রভাসকুমার গাঙ্গুলির আর্থিক দানে নির্মিত হয়েছে বৃহৎ অসিতা লিন্ডা বিল্ডিং।প্রাক্তন ছাত্র বৈদ্যনাথ দাস মহাশয়ের আর্থিক সহযোগিতায় গড়ে উঠেছে “বৈদ্যনাথ বিমলা হল”।এছাড়া এলাকার বিধায়ক,এম.পি,সর্বোপরি সর্বশিক্ষামিশনের আর্থিক দানে অনেকগুলি শ্রেণিকক্ষ নির্মিত হয়েছে।
১৯২৯ সালের সার্টিফিকেট ছবি ড.প্রশান্ত কুন্ডুর সৌজন্যে

বর্তমানে বিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা ১৬০০ জনের অধিক।পঞ্চম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি বয়েজ ইস্কুল।একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিতে ছেলে মেয়ে প্রায় সমান সমান।শিক্ষক-শিক্ষিকা –শিক্ষাকর্মি –পার্শ্বশিক্ষক মিলিয়ে ৪১ জন।বর্তমান প্রধানশিক্ষক অক্লান্ত এক সমাজকর্মী।শিক্ষাদরদি।ছাত্রবৎসল ও সৃজনশীল।তাঁর সুদক্ষ পরিচালনায়,শ্রদ্ধেয় শিক্ষক-শিক্ষিকাদের পাঠদানের আন্তরিকতায়,বিদ্যালয়ের পরিচালন সমিতির সম্মাননীয় সদস্যদের তৎপরতায় ও অভিভাবকদের সক্রিয় সহযোগিতায় বিদ্যালয়ের পঠন-পাঠন প্রক্রিয়া সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হয়।ফলত,মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার ফলাফল বরাবর সন্তোষজনক।উচ্চমাধ্যমিক স্তরে সংস্কৃত,দর্শন,কম্পুটার,প্রভৃতি বিষয় সংযোজন করলে ছাত্র-ছাত্রীদের সুবিধা হবে। সেইসঙ্গে বৃত্তিমূলক কোর্স চালু হলে কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়বে। মহকুমার প্রথম সরকারি বিদ্যালয় হিসাবে হেরিটেজ মর্যাদার স্বীকৃতি আশা করাই যেতে পারে।আশার কথা দাঁইহাটশহরে একটি কলেজ প্রতিষ্ঠার জন্য ইতিমধ্যে  বিদ্যালয় কতৃপক্ষ স্বতোপ্রণোদিত হয়ে তার জমিদান করেছে।এবিষয়ে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছেন মাননীয় প্রধানশিক্ষক,সংশ্লিষ্ট পরিচালনসমিতি ও দাঁইহাটের শিক্ষাপ্রিয় নাগরিকবৃন্দ।

বিদ্যালয় কতৃপক্ষ প্রতি বছর দুঃস্থ-মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদের ৫-৭ শতাংশ ফিস কনশেসন দি্যে থাকেন।শতবার্ষিকী উৎসবের সময় দাতাদের প্রদত্ত অর্থের সুদ থেকে দুঃস্থ ছাত্রছাত্রদের বই কেনার জন্য অর্থ সাহায্য করা হয়।এই বিদ্যালয়ে শিক্ষানুরাগী ব্যক্তিগণ বিবিধ স্মৃতি পুরস্কার বাবদ অর্থ দান করেছেন।এই পুরস্কারের সংখ্যা ১২টি।উক্ত টাকার সুদ থেকে প্রতি তিন বৎসর অন্তর মেধাবীছাত্র-ছাত্রীদের পুরস্কৃত করা হয়।বিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারটিও অমূল্য সম্পদ।পুস্তকের সংখ্যা প্রায় দশ হাজার।এর মধ্যে প্রচুর দুষ্প্রাপ্য বই রয়েছে।বিদ্যালয়ের জুনিয়ার রেডক্রসের উদ্যোগে প্রতি বৎসর শিক্ষামূলক ভ্রমণের আয়োজন করা হয়। বিবিধ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের পাশাপাশি বিদ্যলয়পত্রিকা সম্পুট ও ষাণ্মাসিক দেওয়াল পত্রিকা পত্রপুট প্রকাশিত হয় নিয়মিত।

১৯২২ সালের এডমিট ছবি ড.প্রশান্ত কুন্ডুর সৌজন্যে

এই বিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা ব্লক,মহকুমা,জেলা রাজ্যস্তরে সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় সাফল্য লাভ করে বিদ্যালয়ের সুনাম বৃদ্ধি করে চলেছে।কুইজ প্রতিযোগিতায় ও মকপার্লামেন্টে একাধিকবার জেলা ও রাজ্যস্তরে প্রথম ও চতুর্থ স্থান অধিকার করেছে।খেলাধূলার মান যথেষ্ট ভালো।জেলায় ফুটবল কবাডি প্রতিযোগিতায় কয়েকবার প্রথম স্থান অর্জন করেছে। বিদ্যালয়ের ছাত্র শ্রীমান আবীরকুমার মহান্ত মোহনবাগানের জুনিয়ার ফুটবলটিমে খেলবার সুযোগ পেয়েছে। বিদ্যালয়ের ছাত্রদের নিয়ে গঠিত হয়েছে দাঁইহাট ফুটবল আকাডেমি।এইভাবেই বিদ্যালয় এগিয়ে চলেছে বর্ণাঢ্য অতীত থেকে আরও সম্ভাবনাময় ভবিষৎএর দিকে।সাফল্যের দিগন্ত ছুঁয়ে ছুঁয়ে।
                                  



                                                                                                                    
ছবি  নিজস্ব


 






               

PROTNO-SAMRAT

https://thekoulal.wordpress.com কৌলাল ওয়েবসাইটেও পড়তে পারেন।আর দেখতে পারেন মনের মতো ছবি।                                              ...