কাটামুন্ডর দুর্গাপুজো: এক উলট দেবীপুরাণ
দুর্গা দুর্গতি নাশিনী।দশ প্রহরণধারিণী।মহিষমর্দিনী সিংহবাহিনী। সিংহ কখনো শ্বেত বর্ণের খানিকটা ঘোড়ার মতও দেখতে। কখনো বা নরসিংহের আদলে গঠিত এক অদ্ভুত পৌরাণিক জীব।উত্তরবঙ্গে বিশেষকরে কোচবিহারের রাজাদের পূজিত দেবী দুর্গা ভয়ংকরী। যোদ্ধাবেশে অসুর নিধনে রত। সঙ্গে উদ্ধত জয়া বিজয়া।সিংহের পাশা পাশি একটা তাগড়াই বাঘ অসুরের হাতকে কামড়ে ধরেছে।দেবীর হস্ত সংখ্যা নিয়ে নানা পুরাণে নানা কথা। দ্বিভূজা ,চতুর্ভূজা অষ্টভূজা দশভূজা অষ্টাদশ কিম্বা সহস্রভূজা।গায়ের রঙ তপ্ত কাঞ্চন বা অতসী মানে তিসী ফুলের মতো।কখনো বা ঘোর লালবর্ণের দেবী।সাধারণত মহিষাসুর সহ কার্তিক গণেষাদি কিম্বা হরগৌরী --এই পারিবারিক মূর্তিতেই পূজিত হন।
কোন সন্দেহ নেই দেবী দুর্গার মধ্যে প্রাচীন সংস্কৃতি মিলেমিশে একাকার।কৃষিদেবী বৃক্ষদেবী ,নগরের দুর্গ রক্ষয়িত্রী দেবীরূপে তাঁকে অনায়াসে সনাক্ত করা যায়।আদ্দিকালের লোকদেবীরাও দুর্গার মধ্যে আত্মগোপন করে আছেন।যেমন--লৌকিক বনদুর্গার পুজো আজো বহাল তবিয়তে টিকে আছে।কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় দুর্গার বিরল ব্যতিক্রমী শুধুমাত্র এক মুন্ডরূপের পুজো মূলত রাঢ় দেশের গোপভূমি অঞ্চলে জাঁক-জমকের সঙ্গে অনুষ্ঠিত হয়ে চলেছে। নেই মহিষাসুর,নেই মহিষ,নেই সিংহ বা বাঘ। পুত্র কন্যাদের কথা না হয় বাদই দেওয়া গেল।কেবলমাত্র গলা অব্দি কাটাএক নারীমুন্ড। দুর্গা রূপে পূজিত হচ্ছেন।যদিও দুর্গার এই ব্যতিক্রমী রূপটি সম্পর্কে কোন শাস্ত্রীয়
ব্যাখ্যা নেই।
অবশ্য দশমহাবিদ্যার ছিন্নমস্তার কথা এই প্রসঙ্গে উঠতেই পারে।তবে সেখানে ছিন্নমুন্ড থাকলেও দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখানো হয়েছে মাত্র।দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার এক বিস্তৃত অঞ্চলে একজোড়া মুন্ডমূর্তি বারা ঠাকুর হিসাবে পূজিত হোন।অনেকেই বলেন জোড়া মুন্ডের একটি ব্যাঘ্রদেবতা দক্ষিণ রায়ের ।অপরটি মহিলামূর্তি দেবী নারায়ণীর।শধু লৌকিক বারা ঠাকুর নয়;মনসার মুন্ডমূর্তি পূজিত হয় কালনা থানার উপলমতি উদয়পুরে।।সুতরাং এদিক থেকে দেখলে দুর্গার মুন্ডমূর্তি কোন ব্যাতিক্রমী বিষয় নয়,আগেই বলেছি বহু লৌকিক দেবী দুর্গার মধ্যে মিশে আছে । সুতরাং প্রাচীন মুন্ডমূর্তির পুজোর রীতি এই দুর্গাপুজোর মধ্যে কোনরকমে বেঁচে বর্তে আছে।
অনেকেই বলেন মুন্ডপুজো আসলে প্রাচীন মুখোস পুজোর দৃষ্টান্ত। প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকেই ধর্ম সংস্কৃতিতে মুখোসের ব্যবহার চলে আসছে।মুখোস হলো মুখঢাকা মুখ।মুখের আবরণ বা ছদ্মমুখ।প্রাচীন গ্রীসে ইউরোপে এশিয়ার নানা উপজাতি ধর্মীয় কার্যকলাপে মুখোস ব্যবহার করে থাকেন।আমাদের দেশে কালকে পাতার শৈব সন্যাসীরা কালীর মুখোস পরে নাচানাচি করেন।কোথাও চামুন্ডার মুখোস পরা হয়।ক্ষীরগ্রামে দেবী যোগ্যাদ্যার পুজোয় মুখোস পরে মোরনাচ করা হয়।কাঠ শোলা মাটি দিয়ে এই মুখোসগুলি নির্মিত হয়।ছৌনাচে বিভিন্ন দেবদেবীর মুখোস আজও দেখা যায়। দুর্গা মুখোশ অন্যতম দৃষ্টান্ত মঙ্গলকোটের প্রত্নক্ষেত্র থেকে একাধিক মাটির তৈরি প্রতীকী মুখোশ অথবা মুন্ড মূর্তি মিলেছে । তবে পোড়া মাটির নয়।কাঁচা মাটির।উচ্চতা পাঁচ ইঞ্চির মতো।বিশেষজ্ঞরা বলেন প্রাচীনকালে লোকায়ত দেব-দেবীর থানে এই মুখোশ বা মুন্ডমূর্তি ছলন হিসাবে দেওয়ার প্রথা ছিল।পুরুষালি মুখ।নাকের গঠনটি লক্ষ্য করার মতো।মুখোশ্রীতে মায়াবি আদিমতা।এই ধরনের একাধিক প্রত্ন -মুন্ডমূর্তি কাটোয়া মহকুমা গ্রন্থাগারে সংরক্ষিত আছে।
মুখোস বা মুন্ডমূর্তির দুর্গাপুজো মূলত বাঁকুড়ার কয়েকটি গ্রামে আর বর্ধমান জেলার আউসগ্রাম থানা যা প্রাচীনকালের গোপভূমি অঞ্চলের দু একটি গ্রামে এখনো টিকে রয়েছে ।যেমন দিগনগরের রায় পরিবারে ,মঙ্গলকোটের পালিগ্রামে আর কেতুগ্রাম থানার গোমাইগ্রামে।গোমাইএর পুজোটির আদি উৎস গোপভূমি।পরে এ বিষয়ে বিস্তারিত বলা হয়েছে।এই পুজোগুলি কাটা মুন্ডর পুজো নামে সুপরিচিত।লোকশ্রুতিগুলি বেশ মজার এবং যথেষ্ট ভাবনার খোরাক যোগায়।দেবী দুর্গা নাকি তার কাটা মুন্ড দেখিয়ে বিভ্রান্ত করেছিলেন মহিষাসুরকে।অসুর দেবীকে মৃত ভেবে যুদ্ধ পরিত্যাগ করেছিলেন।
এই গল্পে মহিষাসুর হত্যার কোন প্রসঙ্গ নেই।নেই দশভূজা দুর্গার গল্প। তবে অনেক স্থানে যেমন দিগনগরের রায় বাড়ির কাটামুন্ডের সঙ্গে পুর্ণাঙ্গ জয়া বিজয়ার মূর্তি আছে। সব মিলিয়ে এ এক অন্য ছিন্নমস্তার কাহিনী।
কেতুগ্রামের গোমাইএর কাটামুন্ড মায়ের আবার ভিন্ন জনশ্রুতি।গ্রামের কোঁয়ার সদগোপদের এই দেবী কাটামুন্ড মা।এরা ছিলেন প্রাচীন গোপভূমির অমরাগড় দিগনগর প্রভৃতি অঞ্চলের ডাকসাইটে ভূস্বামী। এরা নাঙ্গল ধরে না ,কলম ধরা জাত।এদের দাপটে বাঘে গোরুতে একসময়ে এক ঘাটে জল খেত।প্রায় তিনশ বছর আগে এদেরই পূর্বপুরুষ হরগোবিন্দ রায় অমরাগড় থেকে গোমাই এ চলে আসেন জমিদারি প্রাপ্তির সূত্র।একদিন তিনি শরতের দুপুরে কেতুগ্রাম থেকে ফিরছিলেন গোমাই।নির্জন মাঠে ঠাকুরপুকুরের ধারে বিরিক্ষি বটতলা।ভাদরমাসের রোদ চরা দুপুরে তিনি ক্লান্তি মেটাবার জন্য বটতলায় বসলেন।শরীর মন শীতল হলো ,পুকুরে পদ্মফুল আর পদ্মপাতার যেন বন লেগেছে।তৃষ্ণা মেটাবার জন্য পুকুরের জল আঁচলা ভরে পানকরতেই একটা অলৌকিক দৃশ্য দেখে চমকে উঠলেন।একি মায়া না মতিভ্রম।পদ্মফুলের মাঝে এ্কটা আস্ত নারীর মুখমন্ডল। পদ্মের মতোই সরোবরে ভাসছে ।কাছে যেতেই সেই পদ্মমুখ জলের তলায় ধীরে ধীরে তলিয়ে যায়।তিনি বিশ্বাস অবিশ্বাসের দোলায় দুলতে থাকেন।ভোর রাতে স্বপন দেখলেন ঃ ওরে হরগোবিন্দ তুই ঠিকই দেখেছিস ।আমি দেবী দুর্গা ।যে রূপে তুই আমাকে দেখেছিস সেই রূপেই কর পূজা।অনুরূপ স্বপ্ন দেখলেন পার্শবর্তী শিবলুন গ্রামের মৃৎশিল্পী গোপাল সূত্রধরের পূর্বপুরুষ।আর সেই শুরু।উভয় বংশ পরম্পরার সহযোগিতায় আজও অনুষ্ঠিত হয়ে চলেছে গোমাইএর জাগ্রতা কাটামুন্ডর পুজো।
সাবেকি আদলে গঙ্গা মৃত্তিকা দিয়ে দেবীর মাতৃমুখ তৈরি হয় শিল্পীর বাড়িতে।ষষ্ঠীর দিন প্রবীণ সেবাইতের সামনে দেবীর চক্ষুদা্নে পর একটি পুরানো তামার টাটে বসিয়ে দেবীমুন্ড নিয়ে আসা হয় দেবীমন্ডপে।মাথায় ধরা হয় ঐতিয্যবাহী ছাতা।রাস্তায় ছিটানো হয় গঙ্গার জল।এরপর গর্ভমন্দিরে চালি সদৃশ এক কাঠের সিংহাসনে কাটামুন্ড বসিয়ে বেনারসী শাড়ি আর শোলার কলকা দিয়ে সাজানো হয়।পুজো সংশ্লিষ্ঠ সকলেই নির্দিষ্ট ভূমি পেয়েছেন।সপ্তমীর দিন কলা বৌ আনার আগে সেবাইতরা প্রায় দেড়শো ভরি সোনা আর রুপোর গহনা দিয়ে দেবীকে সজ্জিত করেন। দেবী পুজোর দিনে আরতি হয় না ,অন্নভোগও নেই।প্রসাদ শুধুমাত্র নৈবেদ্যে।সপ্তমীতে আখ চাল-কুমড়ো অষ্টমীর সন্ধিপুজোয় বলি হয় নধর কালো পাঁঠা।নবমীতে হয় বিশেষ বলিদানপর্ব। রাতের দিকে তাৎপর্যপূর্ণ পূর্বপুরুষ পুজো।দশমীর পুজোর বিশেষ আকর্ষণ আবার কুমারীপুজো।দশ বছরের কম বয়স্কা কুমারী মেয়েকে মূলসেবাইত ভান্ডার ঘরে বসিয়ে পুজো করেন।দশমীর দুপুরে দেবীর নিরঞ্জন হয় দেবীপুকুরে। বর্ধমান জেলার আউশগ্রাম থানার জঙ্গলমহলের এক প্রাচীন গ্রাম দেবশালা।এখানে বর্ধমান রাজাদের এক সময় গড়-বাড়ি দুর্গ ছিল।রাজার কর্মচারী ছিলেন কেতুগ্রামের বহরাণ গ্রামের বক্সী সম্প্রদায়।এই উত্তর রাঢ়ীয় কায়স্থরাও মুন্ডমূর্তিতে দেবী দুর্গার পুজো করে থাকেন।এখানেো দেবী দুর্গা কতৃক অসুরকে ছলনা করা ও তাঁর কাটা মুন্ড দেখানোর লোকগল্প প্রচলিত আছে।
এই লোকশ্রুতিগুলি থেকে একটা ইঙ্গিত বেরিয়ে আসে ভয়ংকর যুদ্ধ এবং তার ফলে দেবীর কাটা মুন্ডর কোন ঘটনা। প্রাচীনকালে যুদ্ধে বিজয়ী বীর পরাজিত শত্রুর মাথা কেটে নিয়ে আসতো।এটাই ছিল দস্তুর, এটাই যেন তার বড়ো উপহার।যেমন অনেক পিরের আস্তনার সঙ্গে জড়িয়ে আছে স্থানীয় শাসকশক্তির সঙ্গে মুসলিম গাজির যুদ্ধ এবং তার ফলশ্রুতি স্বরূপ কাটা মুন্ডর করুণ কেচ্ছা।ত্রিবেনীর জাফর খাঁর মাজার ,মঙ্গলকোটের অষ্টাদশ আউলিয়ার মাজারে কান পাতলেই শোনা যাবে কাটামুন্ডর কিসসা।দুর্গার মুন্ড মূর্তির পুজো কি এমনি কোন সুপ্রাচীন যুদ্ধস্মৃতির ইঙ্গিতবাহী?- যেখানে দেবী দুর্গার মহিষাসুর বিজয়ের পরিবর্তে পরাজয়ের উলট পুরাণের গপ্পো লুকিয়ে আছে?লুকিয়ে আছে নারী হত্যার কোন করুণ আলেখ্য?কাটামুন্ডপুজোর স্মৃতি কি তারই কথা বলে ? বিষয়টি নিয়ে ভেবে দেখার প্রয়োজন আছে বৈকি!!
Betfair Casino & Sportsbook Review 2021 - Mapyro
ReplyDeleteBetfair Casino 경산 출장마사지 Review 2021. Includes sports 거제 출장샵 betting, casino 군포 출장샵 games, sports wagering, 안양 출장샵 and 보령 출장안마 more. Booking a stay at Betfair is easy.