ইন্দ্রাণী-দাঁইহাট ও মারাঠি লুঠেরা ভাস্কর পন্ডিতের দুর্গা পুজো
বারো ঘাট তেরো হাট।তিন চন্ডী তিনেশ্বর।আর এটা যে বলতে পারে-দাঁইহাট-ইন্দ্রাণীতে তার ঘর।একটি লোকপ্রিয় প্রবাদ-বা লোকধাঁধা। আর এই ধাঁধায় বাঁধা পড়েছে এক বিলুপ্ত নগরীর আত্ম-কথন।কাটোয়ার শাঁখাই ঘাট থেকে ভাউসিং-দাঁইহাট ।সাত কিমি ব্যাপী গঙ্গার পশ্চিম তীরবরাবর প্রসারিত প্রাচীন গাঙ্গেয় নগরী--ইন্দ্রাণী।বর্তমানে শহর কাটোয়ার একাংশ ও দাঁইহাটের বৃহদংশ যার অন্তর্ভুক্ত।
হাট মানেই বিকিকিনির গঞ্জ-বাজার।হাট মানে শুধু দাঁইহাট নয়;আতুহাট,ঘোষহাট-পানুহাট-মোড়লহাট-একাইহাট-বিকিহাট-বীরহাট-পাতাইহাট ইত্যাদি।হাটে হাটে চলে চাল-ডাল-তেল-গুড় লবণ ভুঁষিমাল-কৃষিজ সম্পদের বেচা-কেনা। সঙ্গে তাঁত রেশম গাড়া বস্ত্র ।পাথর কাঁসাপিতলের ঘর-গেরস্থালির বাসন-কোসন।পাথর কাঠ-ধাতুর মনোহর দেববিগ্রহ।নীলকুঠি,চিনির কুঠি,সোনারুপোর বিপণি ।বড়ো বড়ো আড়ত। মহাজনি কারবার। টোল চতুষ্পাঠী।মন্দির মসজিদ-গির্জা । সুন্দরী বারাঙ্গনা, সতীদাহ অন্তর্জলিযাত্রা-গঙ্গায় সন্তান বিসর্জন--- কি ছিলনা ইন্দ্রাণীতে।গঙ্গার ঘাটগুলো নিছকই স্নানের ঘাট নয়।সমুদ্র বাণিজ্যের যেন ছোট ছোট বন্দর।সবমিলিয়ে প্রাচীনযুগ থেকেই জমজমাট এক বাণিজ্য-নগরী ইন্দ্রাণী।মোঘল সম্রাট আকবরের আমলে সরকার সুলেমানাবাদের অন্তর্গতএক বিশিষ্ট পরগনা।মহামতি আকবর এখান থেকে বাৎসরিক রাজস্ব পেতেন ৫,৮২,১২০ দাম।রূপ ডেকে আনে কলঙ্ক।সমৃদ্ধি বহে আনে সর্বনাশ! অর্থ- প্রাচুর্যের চোরাস্রোতে ঢোকে বিলাসিতা। ক্ষয় আর দুর্বলতা।ইন্দ্রাণীতেও তার ব্যতিক্রম হয়নি।
অষ্টাদশ শতকের চারের দশক।আলিবর্দির নবাবি সিংহাসন তখন টলমল।উড়িষ্যায় বিদ্রোহ ঘোষণা করেছেন দুর্দান্ত দুর্দানা বেগম।তাঁর স্বামী দ্বিতীয়মুর্শিদকুলি খাঁ।উদ্ধত জামাতা বাকর আলি।ক্রুদ্ধআলিবর্দি ১৭৪১ সালে শীতকালে বিদ্রোহ দমন করতে গেলেন। নিজ জামাতা সৌলদজঙ্গকে উড়িষ্যার সিংহাসনে বসিয়ে ১৭৪২ সালের এপ্রিল মাসে প্রবেশ করলেন বর্ধমানে।এদিকে ভাস্কর পন্ডিতের নেতৃত্বে প্রায় চল্লিশ হাজার বার্গির সেনা বর্ধমানের রানি সায়রের পাড়ে নবাবকে ছেঁকে ধরলেন পঙ্গপালের মতো। চৌথ বাবদ দশ লক্ষ রুপিয়া মেটাতে হবে জলদি।এটাই তাদের দাবী।মামার বাড়ির আবদার আর কী! সে দাবী ফুৎকারে উড়িয়ে দিলেন বিরক্ত নবাব।কিন্তু পরিস্থিতি বদলে গেল গিরগিটির মতো।ভয়ংকর বর্গি সেনাদের গেরিলাযুদ্ধের গরলে নবাব বাহিনীর ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা।কোন রকমে কাটোয়ায় এসে পড়ি কি মরি বলে মুর্শিদাবাদে ছুট লাগালেন।এদিকে ভাস্কর পন্ডিত তার দূরন্ত বর্গিবাহিনী নিয়ে দাঁইহাটে গাড়লেন ঘাঁটি ।
বর্ধমানরাজাদের বাসভবনটি হয়ে উঠলো বর্গিদের প্রশাসনিক ভবন।শুরু হলো লুঠ-পাট।অগ্নিদাহ।নারীর উপর বলৎকার।দাঁইহাটের গঙ্গায় মাটিয়ারির সঙ্গে যুক্ত করা হলো নৌকা দিয়ে ভাসমান সেতু।হাঙ্গামা ছড়িয়ে পড়লো পূর্ববঙ্গেও। এ- আলিবাবা আর চল্লিশ চোরের চিচিং ফাঁকের কিসসা নয়।চল্লিশ হাজার খতরনাক বর্গিসেনার হাড়হিম করা অত্যাচারের কাহিনী। ইতিকথা ছাড়িয়ে ছড়িয়ে আছে বাংলার হাটে-মাঠে-বাটে-ঘাটে কিংবদন্তী আর জনশ্রুতি রূপে।হুগলিজয় করে সেখান থেকে মির হবিব নিয়ে এলেন যুদ্ধজাহাজ।সমগ্র দক্ষিণবংগের হত্তাকর্তা বিধাতা হয়ে উঠেন কোহলৎকর ভাস্কর পন্ডিত। নবাবি শাসন হয়ে পড়লো সুপ্ত লুপ্ত অন্তর্হিত।ব্যপ্ত হলো বর্গিদের দাপট।বঙ্গজুড়ে নেমে এলো--ত্রাস-বিভীষিকা ।শয়তানের অভিশাপ।এর পরই ভাস্কর দাঁইহাটে আয়োজন করেন বড়ো মাপের দুর্গাপুজো।সে এক এলাহি ব্যাপার।সে কথায় আসছি।তার আগে ইন্দ্রাণী সম্পর্কে কয়েকটি তথ্য জানানো প্রয়োজন।
ইন্দ্রাণী এক নদীর নাম।সপ্তমাতৃকার এক জননী। লোকপুরাণের নায়িকা।আর কান টানলে যেমন মাথা আসে তেমনি নায়িকা থাকলেই নায়ক আসবেন।সুতরাং ইন্দ্রাণীর পাশেই হাজির হলেন স্বর্গের রাজা ইন্দ্র।ভগীরথ গঙ্গাদেবীকে আনছিলেন মর্ত্যে শাঁখ বাজিয়ে। এদিকে ইন্দ্রের নির্দেশে দেবতারাও শঙ্খধ্বনি করতে লাগলেন কাটোয়ার অজয়-গঙ্গার মোহানার তীরে। নাম হলো শঙ্খধ্বনি ঘাট।মানে শাঁখাই ঘাট।কাটোয়ার পাশ দিয়ে সুরুধনি প্রবাহিত হতেই রাজা ইন্দ্র প্রথমে গঙ্গা নাইলেন।ঘাটের নাম হলো ইন্দ্রেশ্বর ঘাট।এই ঘাটের কথা লিখে কামাল করে দিয়েছেনপ্রাক চৈতন্যযুগের কবি কৃত্তিবাস ওঝা।ইন্দ্রেশ্বর ঘাটে যে বা নর স্নান করে /অযুত বৎসর থাকে সে স্বর্গপুরে।। নবম শতকের মহাভরতের টীকাকার নীলকণ্ঠ বাচস্পতি মশাই আবার লিখে দিলেন এই ঘাটের মাথায় বসে সুন্দরী শচী নাকি সহস্র বছর ধ্যান করে ইন্দ্রকে পতিরূপে বাগিয়েছিলেন।এখানেই গড়ে উঠেছিল ইন্দ্রাণীর মন্দির।কবিকঙ্কন মুকুন্দ সেই নগরদেবীকে বন্দনা করে লিখেছিলেন---ভুবন মোহিনী মাগো ইন্দ্রাণী জননী জাগো দৈব নাশে তব শরণে।ইন্দ্রাণীর ভূমিপুত্র কবি কাশীরাম দাস তাঁর অমৃতসম মহাভারতে লিখেছিলেন---
ইন্দ্রাণী নামেতে দেশ পূর্বাপর স্থিতি।
দ্বাদশ তীর্থে যথা বৈসে ভাগীরথী।
আজ হারিয়ে গেছে সব কিছু ...মন্দির গেছে বিস্মৃতির গর্ভে।গঙ্গা চলে গেছে দূরে---বহুদূরে।শুধু রেখে গেছে তার ভালোবাসার অভিজ্ঞানটিকে -----ইঁদের পুকুর।এখন বাঁশ ঝাড় ঘেরা নিছকই এক এঁদো পুকুর। এক সময় ইন্দ্রদ্বাদশীর দিনে কিশোরী মেয়েরা প্রথম প্রণয় পুরুষ ইন্দর ঠাকুরের একটি মাটির মূর্তি গড়ে তাকে মাথায় নিয়ে ডুব দিত ইঁদের পুকুরে।উঠে আসতো যেন এক পূর্ণ নারী হয়ে!!
শৈব শাক্ত সুফি রামায়েত বৈষ্ণব সাধনার ঘাঁটি হয়ে ঊঠেছিল ইন্দ্রাণীতীর্থ।তিনেশ্বর হলেন তিন বিখ্যাত শিবলিঙ্গ--চন্দ্রেশ্বর।ঘোষেশ্বর আর ইন্দ্রেশ্বর।একাধিক চন্ডির অস্তিত্ব আজও রয়েছে।আছে বদর শাহের মাজার।বেড়াগ্রামে মাটি খুঁড়তে গিয়ে পাওয়া গেল জৈন তাম্রশাসন।এতে খোদিত হয়েছে স্বর্গস্থানতুল্য ইন্দ্রাণী তীর্থের মহিমা।জেমস লঙ সাহেব গঙ্গা পথে ফিরছিলেন কলকাতা।দাঁইহাটের পাশ দিয়ে যেতে হঠাৎ তাঁর নজরে পড়লো এক ডুবন্ত প্রস্তরমন্দিরের প্রতিষ্ঠাফলক।রতনে রতন চেনে।ফলকটি তিনি এসিয়াটিক সোসাইটিতে জমা দিলেন।লিপির পাঠোদ্ধারে বোঝা গেল এ মন্দির পালযুগের প্রথম দিকের ।সপ্তম-অষ্টম শতকের।আর যারা কচু চেনে --তারা মন্দিরের অলংকরণগুল চুরি করে সাফ করে দিলো।দেওয়ানগঞ্জে দেওয়ান মাণিকচাঁদ আর এক রাজবাড়ি হাঁকালেন।বাঁধালেন গঙ্গার ঘাট--মাণিকচাঁদের ঘাট তথা অতিবড়ো ঠাট।এইতো আটের দশকের কথা।খবরটা এখনও বাসি হয়ে যাইনি।বিকিহাটের বকুলতলায় পড়ে থাকা ভগ্ন বিষ্ণুর পাদপীঠে খোদিরত লেখ থেকে জানা গেল পালযুগের জনৈক বণিক বসন্ত সিংহের কথা।যিনি হয়তো বিখ্যাত ভৃগু সিংহের উত্তর-পুরুষ।যাঁর নাম অনুসারেই আজকের ভাউ সিং জনপদ।
সপ্তদশ শতকে বর্ধমান রাজাদের উত্থান।তাঁদের দাক্ষিণ্য বর্ধমান ছাড়িয়ে ইন্দ্রাণী-দাঁইহাটে হয়ে গেল ক্রমবর্ধমান।দাঁইহাট হলো বর্ধমান রাজাদের ধর্মীয় রাজধানী।গঙ্গাবাসক্ষেত্র। ঠিক যেমন দ্বাদশ শতকে সেন রাজাদের ধর্মীয় রাজধানী হয়েছিল গঙ্গাহৃদি নবদ্বীপ। তেমনি দাঁইহাটের গঙ্গার তীরে গড়ে উঠলো রাজঅট্টালিকা।বাঁধানো ঘাট। রাজা রানির সাধের দেবালয় ।গড়ে উঠলো ছোট বড়ো মন্দির।যেমন কিশোর-কিশোরীমন্দির।বিকিহাটে প্রতিষ্ঠিত হলো হরগৌরীর প্রস্তরবিগ্রহ।রাজাদের সমাধি সৌধ।বর্ধমান জেলার অন্যতম পুরাকীর্তি সমাজবাটী। ১৭৪০ সালে প্রয়াত হয়েছিলেন মহারাজ কীর্তিচন্দ্র রায়।তাঁর অন্ত্যেষ্টি ক্রিয়ার স্মারক এই সমাজ বাটি। ইন্দ্রাণী দাঁইহাটের সমৃদ্ধি যখন গৌরবের চূড়ায় তখনই হাজির হলো কালান্তক যম সম বর্গিরা।নবাব আর বর্ধমান রাজশক্তিকে তাড়িয়ে তারাই হয়ে উঠলো বঙ্গেশ্বর।রাজধানী ---একালের দাঁইহাট।
১৭৪২ সালের সেপ্টেম্বর মাস।রাজধানী দাঁইহাটে দুর্গাপুজো হবে আর পুজো করবেন স্বয়ং ভাস্কর পন্ডিত। চারদিকে সাজো সাজো রব।নবাবের টিকিটি পর্যন্ত দেখা নেই।মির হবিব যেন নাগপুরের সর্দার রঘুজির দেওয়ান।ইন্দ্রাণীর জমিদাররা ভাস্করের পুজোর জন্য নজরানা নিয়ে আসছে।পালে পালে ছাগ মেষ আসছে।দুর্গার সামনে বলি দেওয়া হবে।রাজবাড়িতে তৈরি হচ্ছে দেখার মতো দুর্গা প্রতিমা। চারদিকে সাজো সাজো রব।এলাহি ব্যাপার।কবি গঙ্গারাম তাঁর মহারাষ্ট্রপুরাণে এসম্পর্কে চমৎকার লিখেছেন---
এইরূপে কুমোর প্রতিমা বানাইয়া।
ভাস্করের ঠাঁই তারা গেল বিদায় হইয়া।।
তারপর উপাদএ সামগ্রী আইলো যত।
ভার বান্ধিতে বোঝাএ কত শত।।
ভাস্কর করিবে পূজা বলি দেবার তরে ।
ছাগ মহিষ আইসে কত হাজারে হাজারে।।
সেদিন ছিল ২৬ শে সেপ্টেম্বর।দুর্গাসপ্তমীর পুজো।সারা বাংলার সঙ্গে দাঁইহাটবাসীও ভয়ে ভক্তিতে মত্ত।ভাস্করের দুর্গাপুজোয় অঢেল খানাপিনার আয়োজন।মদের ফোয়ারা ছুটছে।চলছে বাঈজিদের নাচা-গানা। দেদারফুর্তি। নবাব এই সুযোগটার জন্য ওৎ পেতেছিলেন।বিপুল সংখ্যক সৈন্য সমাবেশ করে উদ্ধারণপুরে গঙ্গা পার হলেন। দিনের আলোয় তারা মিলিয়ে গেল ভুতের মতো।মহাষ্টমীর সন্ধিপূজা বেজে উঠলো গ্রাম-গ্রামান্তরে।সকলেই দেবিপ্রাঙ্গণে হাজির।এই অবসরে সৈন্যরা আবার সমবেত হলো শাঁখাইএর অজয় তীরে।ঘোর অন্ধকার রজনী।নগরবাসীরা মাতৃ আরাধনায় মগ্ন।ধীরে পেরুতে হবে অজয়নদী।আশ্বিনের দুর্বিনীত অজয় গঙ্গার ভয়াবহ সঙ্গমস্থল।পেরুতে হবে সকলকে।তারপর দাঁইহাটে গিয়ে অতর্কিতে আক্রমণ করতে হবে উৎসব বিগলিত বর্গিদের।চুপিসারে তৈরি হলো নৌকার সেতু।কিন্তু বিধি বাম। হাতি ঘোড়া আর সৈন্যদের পদভারে সেতু গেল মড় মড় করে ভেঙে।হাতি ঘোড়া যুদ্ধের রসদ আর অসংখ্য সৈন্য গেল জলের তোড়ে ভেসে।বিপুল লোকসান।প্রায় ১৫০০ সৈন্যের ঘটলো সলিল সমাধি।জেমস গ্র্যান্ট ডাফ সাহেব তাঁর সুবিখ্যাত গ্রন্থ এ হিস্ট্রি অব মারাঠায় লিখেছেন..."Fifteen hundred men were plunged into the Adjee and totaly lost." ".
সকলেই ভেঙে পড়লেন।শুধু ভেঙে পড়লেন না নবাব।যেমন করেই হোক বর্গিদের তিনি বাংলা ছাড়া করবেন।কঠোর প্রতিজ্ঞায় তিনি অটল।কর্তব্যে অবিচল।তাই অতি সন্তর্পণে আবার সেতু মেরা মতির কাজ শুরু হলো।কাজ শেষ হতেই সৈন্যরা নির্বিঘ্নে অজয় পার হল।এবার নব উদ্যমে নবাবি সেনা দাঁইহাটের পথে ধাবিত।ইতিমধ্যে বর্গিরা খবর পেয়ে দলে দলে তখন ঘোড়া ছুটিয়ে মহারাষ্ট্রের পথে। দাঁইহাটের পূজা প্রাঙ্গন তখন বর্গি আর নবাবি সেনার রণাঙ্গনে পরিণত।নবমীর প্রভাতে লন্ড-ভন্ড হয়ে গেল দেবী পুজো।অসংখ্য বর্গি সেনা মারা গেল।যেন দেবীপূজায় নরবলির মহা আয়োজন।ভাস্কর পন্ডিত বিপদ বুঝে আগেই পলায়ন করেছিলেন।কথিত আছে তাঁর কাছে ছিল এক সোনার দুর্গা প্রতিমা।বিধর্মীরা পূজার পবিত্রতা নষ্ট করে দেবে বলে নাকি সেই স্বর্ণপ্রতিমাটিকে গঙ্গার জলে ভাসিয়ে দিয়েছিলেন।নবমীতেই দশমীর বাজনা বাজিয়ে ফিরে গিয়েছিলেন মহারাষ্ট্রে।কঠোর প্রতিজ্ঞা করেছিলেন দাঁইহাটের মাটিতে।রক্তের হোলি খেলবেন এই বাংলায়।আজও সেই দুর্গাপূজা আসে।ভাঙাচোরা বাড়িটাতেই।লোকমুখে যার পরিচিতি --ভাস্কর পন্ডিতের দুর্গাপুজো।
ঐ যে দেখছেন----ভাঙা দেওয়ালটুকু! ওটাই বর্ধমানরাজাদের বিরাট গঙ্গাবাস ভবনের শেষ চিহ্ন।ওখানে আজও রয়েছে গোলা বর্ষণের ক্ষতচিহ্ন।নিচে জননী জাহ্নবীর পরিত্যক্ত নদিখাত।বাঁধানো ঘাট--বারদুয়ারী।ডান দিকে রাজাদের সমাধি স্মারক--সমাজবাড়ি।কিশোর-কিশোরী মন্দির।আজ গঙ্গা অভিমানে দূরে সরে গেছে।গাছ-গাছালি আর আত্মবিস্মৃতির পলিতে চাপা পড়ে ইতিকথা!বঙ্গে বর্গি হাঙ্গামার স্মারক চিহ্ন রাজবাড়িটা ভাঙতে ভাঙতে শুধু এইটুকু!!একটা বোবা জিজ্ঞাসা চিহ্নের মত বেবাক দাঁড়িয়ে!অচিরে হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়বে।আত্মবিস্মৃত বাঙালী শুধু নিদ্রালু সন্তানদের ঘুম পারাতে পারাতে বলবে-----
খোকা ঘুমালো পাড়া জুড়ালো বর্গি এলো দেশে।
বুলবুলিতে ধান খেয়েছে খাজনা দেবো কিসে।।
শুধু পুজোর এই চারটি দিন ইতিহাসের বিবর্ণ পাতা থেকে বেরিয়ে আসবে বর্গিরা...ভাস্কর পন্ডিত...আর স্মৃতির ক্যানভাসে উজ্জ্বল হয়ে উঠবে অতীতের ইন্দ্রাণী-দাঁইহাট।।
সৌজন্য ঃদৈনিক সংবাদে প্রকাশিত
বারো ঘাট তেরো হাট।তিন চন্ডী তিনেশ্বর।আর এটা যে বলতে পারে-দাঁইহাট-ইন্দ্রাণীতে তার ঘর।একটি লোকপ্রিয় প্রবাদ-বা লোকধাঁধা। আর এই ধাঁধায় বাঁধা পড়েছে এক বিলুপ্ত নগরীর আত্ম-কথন।কাটোয়ার শাঁখাই ঘাট থেকে ভাউসিং-দাঁইহাট ।সাত কিমি ব্যাপী গঙ্গার পশ্চিম তীরবরাবর প্রসারিত প্রাচীন গাঙ্গেয় নগরী--ইন্দ্রাণী।বর্তমানে শহর কাটোয়ার একাংশ ও দাঁইহাটের বৃহদংশ যার অন্তর্ভুক্ত।
হাট মানেই বিকিকিনির গঞ্জ-বাজার।হাট মানে শুধু দাঁইহাট নয়;আতুহাট,ঘোষহাট-পানুহাট-মোড়লহাট-একাইহাট-বিকিহাট-বীরহাট-পাতাইহাট ইত্যাদি।হাটে হাটে চলে চাল-ডাল-তেল-গুড় লবণ ভুঁষিমাল-কৃষিজ সম্পদের বেচা-কেনা। সঙ্গে তাঁত রেশম গাড়া বস্ত্র ।পাথর কাঁসাপিতলের ঘর-গেরস্থালির বাসন-কোসন।পাথর কাঠ-ধাতুর মনোহর দেববিগ্রহ।নীলকুঠি,চিনির কুঠি,সোনারুপোর বিপণি ।বড়ো বড়ো আড়ত। মহাজনি কারবার। টোল চতুষ্পাঠী।মন্দির মসজিদ-গির্জা । সুন্দরী বারাঙ্গনা, সতীদাহ অন্তর্জলিযাত্রা-গঙ্গায় সন্তান বিসর্জন--- কি ছিলনা ইন্দ্রাণীতে।গঙ্গার ঘাটগুলো নিছকই স্নানের ঘাট নয়।সমুদ্র বাণিজ্যের যেন ছোট ছোট বন্দর।সবমিলিয়ে প্রাচীনযুগ থেকেই জমজমাট এক বাণিজ্য-নগরী ইন্দ্রাণী।মোঘল সম্রাট আকবরের আমলে সরকার সুলেমানাবাদের অন্তর্গতএক বিশিষ্ট পরগনা।মহামতি আকবর এখান থেকে বাৎসরিক রাজস্ব পেতেন ৫,৮২,১২০ দাম।রূপ ডেকে আনে কলঙ্ক।সমৃদ্ধি বহে আনে সর্বনাশ! অর্থ- প্রাচুর্যের চোরাস্রোতে ঢোকে বিলাসিতা। ক্ষয় আর দুর্বলতা।ইন্দ্রাণীতেও তার ব্যতিক্রম হয়নি।
অষ্টাদশ শতকের চারের দশক।আলিবর্দির নবাবি সিংহাসন তখন টলমল।উড়িষ্যায় বিদ্রোহ ঘোষণা করেছেন দুর্দান্ত দুর্দানা বেগম।তাঁর স্বামী দ্বিতীয়মুর্শিদকুলি খাঁ।উদ্ধত জামাতা বাকর আলি।ক্রুদ্ধআলিবর্দি ১৭৪১ সালে শীতকালে বিদ্রোহ দমন করতে গেলেন। নিজ জামাতা সৌলদজঙ্গকে উড়িষ্যার সিংহাসনে বসিয়ে ১৭৪২ সালের এপ্রিল মাসে প্রবেশ করলেন বর্ধমানে।এদিকে ভাস্কর পন্ডিতের নেতৃত্বে প্রায় চল্লিশ হাজার বার্গির সেনা বর্ধমানের রানি সায়রের পাড়ে নবাবকে ছেঁকে ধরলেন পঙ্গপালের মতো। চৌথ বাবদ দশ লক্ষ রুপিয়া মেটাতে হবে জলদি।এটাই তাদের দাবী।মামার বাড়ির আবদার আর কী! সে দাবী ফুৎকারে উড়িয়ে দিলেন বিরক্ত নবাব।কিন্তু পরিস্থিতি বদলে গেল গিরগিটির মতো।ভয়ংকর বর্গি সেনাদের গেরিলাযুদ্ধের গরলে নবাব বাহিনীর ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা।কোন রকমে কাটোয়ায় এসে পড়ি কি মরি বলে মুর্শিদাবাদে ছুট লাগালেন।এদিকে ভাস্কর পন্ডিত তার দূরন্ত বর্গিবাহিনী নিয়ে দাঁইহাটে গাড়লেন ঘাঁটি ।
বর্ধমানরাজাদের বাসভবনটি হয়ে উঠলো বর্গিদের প্রশাসনিক ভবন।শুরু হলো লুঠ-পাট।অগ্নিদাহ।নারীর উপর বলৎকার।দাঁইহাটের গঙ্গায় মাটিয়ারির সঙ্গে যুক্ত করা হলো নৌকা দিয়ে ভাসমান সেতু।হাঙ্গামা ছড়িয়ে পড়লো পূর্ববঙ্গেও। এ- আলিবাবা আর চল্লিশ চোরের চিচিং ফাঁকের কিসসা নয়।চল্লিশ হাজার খতরনাক বর্গিসেনার হাড়হিম করা অত্যাচারের কাহিনী। ইতিকথা ছাড়িয়ে ছড়িয়ে আছে বাংলার হাটে-মাঠে-বাটে-ঘাটে কিংবদন্তী আর জনশ্রুতি রূপে।হুগলিজয় করে সেখান থেকে মির হবিব নিয়ে এলেন যুদ্ধজাহাজ।সমগ্র দক্ষিণবংগের হত্তাকর্তা বিধাতা হয়ে উঠেন কোহলৎকর ভাস্কর পন্ডিত। নবাবি শাসন হয়ে পড়লো সুপ্ত লুপ্ত অন্তর্হিত।ব্যপ্ত হলো বর্গিদের দাপট।বঙ্গজুড়ে নেমে এলো--ত্রাস-বিভীষিকা ।শয়তানের অভিশাপ।এর পরই ভাস্কর দাঁইহাটে আয়োজন করেন বড়ো মাপের দুর্গাপুজো।সে এক এলাহি ব্যাপার।সে কথায় আসছি।তার আগে ইন্দ্রাণী সম্পর্কে কয়েকটি তথ্য জানানো প্রয়োজন।
ইন্দ্রাণী এক নদীর নাম।সপ্তমাতৃকার এক জননী। লোকপুরাণের নায়িকা।আর কান টানলে যেমন মাথা আসে তেমনি নায়িকা থাকলেই নায়ক আসবেন।সুতরাং ইন্দ্রাণীর পাশেই হাজির হলেন স্বর্গের রাজা ইন্দ্র।ভগীরথ গঙ্গাদেবীকে আনছিলেন মর্ত্যে শাঁখ বাজিয়ে। এদিকে ইন্দ্রের নির্দেশে দেবতারাও শঙ্খধ্বনি করতে লাগলেন কাটোয়ার অজয়-গঙ্গার মোহানার তীরে। নাম হলো শঙ্খধ্বনি ঘাট।মানে শাঁখাই ঘাট।কাটোয়ার পাশ দিয়ে সুরুধনি প্রবাহিত হতেই রাজা ইন্দ্র প্রথমে গঙ্গা নাইলেন।ঘাটের নাম হলো ইন্দ্রেশ্বর ঘাট।এই ঘাটের কথা লিখে কামাল করে দিয়েছেনপ্রাক চৈতন্যযুগের কবি কৃত্তিবাস ওঝা।ইন্দ্রেশ্বর ঘাটে যে বা নর স্নান করে /অযুত বৎসর থাকে সে স্বর্গপুরে।। নবম শতকের মহাভরতের টীকাকার নীলকণ্ঠ বাচস্পতি মশাই আবার লিখে দিলেন এই ঘাটের মাথায় বসে সুন্দরী শচী নাকি সহস্র বছর ধ্যান করে ইন্দ্রকে পতিরূপে বাগিয়েছিলেন।এখানেই গড়ে উঠেছিল ইন্দ্রাণীর মন্দির।কবিকঙ্কন মুকুন্দ সেই নগরদেবীকে বন্দনা করে লিখেছিলেন---ভুবন মোহিনী মাগো ইন্দ্রাণী জননী জাগো দৈব নাশে তব শরণে।ইন্দ্রাণীর ভূমিপুত্র কবি কাশীরাম দাস তাঁর অমৃতসম মহাভারতে লিখেছিলেন---
ইন্দ্রাণী নামেতে দেশ পূর্বাপর স্থিতি।
দ্বাদশ তীর্থে যথা বৈসে ভাগীরথী।
আজ হারিয়ে গেছে সব কিছু ...মন্দির গেছে বিস্মৃতির গর্ভে।গঙ্গা চলে গেছে দূরে---বহুদূরে।শুধু রেখে গেছে তার ভালোবাসার অভিজ্ঞানটিকে -----ইঁদের পুকুর।এখন বাঁশ ঝাড় ঘেরা নিছকই এক এঁদো পুকুর। এক সময় ইন্দ্রদ্বাদশীর দিনে কিশোরী মেয়েরা প্রথম প্রণয় পুরুষ ইন্দর ঠাকুরের একটি মাটির মূর্তি গড়ে তাকে মাথায় নিয়ে ডুব দিত ইঁদের পুকুরে।উঠে আসতো যেন এক পূর্ণ নারী হয়ে!!
শৈব শাক্ত সুফি রামায়েত বৈষ্ণব সাধনার ঘাঁটি হয়ে ঊঠেছিল ইন্দ্রাণীতীর্থ।তিনেশ্বর হলেন তিন বিখ্যাত শিবলিঙ্গ--চন্দ্রেশ্বর।ঘোষেশ্বর আর ইন্দ্রেশ্বর।একাধিক চন্ডির অস্তিত্ব আজও রয়েছে।আছে বদর শাহের মাজার।বেড়াগ্রামে মাটি খুঁড়তে গিয়ে পাওয়া গেল জৈন তাম্রশাসন।এতে খোদিত হয়েছে স্বর্গস্থানতুল্য ইন্দ্রাণী তীর্থের মহিমা।জেমস লঙ সাহেব গঙ্গা পথে ফিরছিলেন কলকাতা।দাঁইহাটের পাশ দিয়ে যেতে হঠাৎ তাঁর নজরে পড়লো এক ডুবন্ত প্রস্তরমন্দিরের প্রতিষ্ঠাফলক।রতনে রতন চেনে।ফলকটি তিনি এসিয়াটিক সোসাইটিতে জমা দিলেন।লিপির পাঠোদ্ধারে বোঝা গেল এ মন্দির পালযুগের প্রথম দিকের ।সপ্তম-অষ্টম শতকের।আর যারা কচু চেনে --তারা মন্দিরের অলংকরণগুল চুরি করে সাফ করে দিলো।দেওয়ানগঞ্জে দেওয়ান মাণিকচাঁদ আর এক রাজবাড়ি হাঁকালেন।বাঁধালেন গঙ্গার ঘাট--মাণিকচাঁদের ঘাট তথা অতিবড়ো ঠাট।এইতো আটের দশকের কথা।খবরটা এখনও বাসি হয়ে যাইনি।বিকিহাটের বকুলতলায় পড়ে থাকা ভগ্ন বিষ্ণুর পাদপীঠে খোদিরত লেখ থেকে জানা গেল পালযুগের জনৈক বণিক বসন্ত সিংহের কথা।যিনি হয়তো বিখ্যাত ভৃগু সিংহের উত্তর-পুরুষ।যাঁর নাম অনুসারেই আজকের ভাউ সিং জনপদ।
সপ্তদশ শতকে বর্ধমান রাজাদের উত্থান।তাঁদের দাক্ষিণ্য বর্ধমান ছাড়িয়ে ইন্দ্রাণী-দাঁইহাটে হয়ে গেল ক্রমবর্ধমান।দাঁইহাট হলো বর্ধমান রাজাদের ধর্মীয় রাজধানী।গঙ্গাবাসক্ষেত্র। ঠিক যেমন দ্বাদশ শতকে সেন রাজাদের ধর্মীয় রাজধানী হয়েছিল গঙ্গাহৃদি নবদ্বীপ। তেমনি দাঁইহাটের গঙ্গার তীরে গড়ে উঠলো রাজঅট্টালিকা।বাঁধানো ঘাট। রাজা রানির সাধের দেবালয় ।গড়ে উঠলো ছোট বড়ো মন্দির।যেমন কিশোর-কিশোরীমন্দির।বিকিহাটে প্রতিষ্ঠিত হলো হরগৌরীর প্রস্তরবিগ্রহ।রাজাদের সমাধি সৌধ।বর্ধমান জেলার অন্যতম পুরাকীর্তি সমাজবাটী। ১৭৪০ সালে প্রয়াত হয়েছিলেন মহারাজ কীর্তিচন্দ্র রায়।তাঁর অন্ত্যেষ্টি ক্রিয়ার স্মারক এই সমাজ বাটি। ইন্দ্রাণী দাঁইহাটের সমৃদ্ধি যখন গৌরবের চূড়ায় তখনই হাজির হলো কালান্তক যম সম বর্গিরা।নবাব আর বর্ধমান রাজশক্তিকে তাড়িয়ে তারাই হয়ে উঠলো বঙ্গেশ্বর।রাজধানী ---একালের দাঁইহাট।
১৭৪২ সালের সেপ্টেম্বর মাস।রাজধানী দাঁইহাটে দুর্গাপুজো হবে আর পুজো করবেন স্বয়ং ভাস্কর পন্ডিত। চারদিকে সাজো সাজো রব।নবাবের টিকিটি পর্যন্ত দেখা নেই।মির হবিব যেন নাগপুরের সর্দার রঘুজির দেওয়ান।ইন্দ্রাণীর জমিদাররা ভাস্করের পুজোর জন্য নজরানা নিয়ে আসছে।পালে পালে ছাগ মেষ আসছে।দুর্গার সামনে বলি দেওয়া হবে।রাজবাড়িতে তৈরি হচ্ছে দেখার মতো দুর্গা প্রতিমা। চারদিকে সাজো সাজো রব।এলাহি ব্যাপার।কবি গঙ্গারাম তাঁর মহারাষ্ট্রপুরাণে এসম্পর্কে চমৎকার লিখেছেন---
এইরূপে কুমোর প্রতিমা বানাইয়া।
ভাস্করের ঠাঁই তারা গেল বিদায় হইয়া।।
তারপর উপাদএ সামগ্রী আইলো যত।
ভার বান্ধিতে বোঝাএ কত শত।।
ভাস্কর করিবে পূজা বলি দেবার তরে ।
ছাগ মহিষ আইসে কত হাজারে হাজারে।।
সেদিন ছিল ২৬ শে সেপ্টেম্বর।দুর্গাসপ্তমীর পুজো।সারা বাংলার সঙ্গে দাঁইহাটবাসীও ভয়ে ভক্তিতে মত্ত।ভাস্করের দুর্গাপুজোয় অঢেল খানাপিনার আয়োজন।মদের ফোয়ারা ছুটছে।চলছে বাঈজিদের নাচা-গানা। দেদারফুর্তি। নবাব এই সুযোগটার জন্য ওৎ পেতেছিলেন।বিপুল সংখ্যক সৈন্য সমাবেশ করে উদ্ধারণপুরে গঙ্গা পার হলেন। দিনের আলোয় তারা মিলিয়ে গেল ভুতের মতো।মহাষ্টমীর সন্ধিপূজা বেজে উঠলো গ্রাম-গ্রামান্তরে।সকলেই দেবিপ্রাঙ্গণে হাজির।এই অবসরে সৈন্যরা আবার সমবেত হলো শাঁখাইএর অজয় তীরে।ঘোর অন্ধকার রজনী।নগরবাসীরা মাতৃ আরাধনায় মগ্ন।ধীরে পেরুতে হবে অজয়নদী।আশ্বিনের দুর্বিনীত অজয় গঙ্গার ভয়াবহ সঙ্গমস্থল।পেরুতে হবে সকলকে।তারপর দাঁইহাটে গিয়ে অতর্কিতে আক্রমণ করতে হবে উৎসব বিগলিত বর্গিদের।চুপিসারে তৈরি হলো নৌকার সেতু।কিন্তু বিধি বাম। হাতি ঘোড়া আর সৈন্যদের পদভারে সেতু গেল মড় মড় করে ভেঙে।হাতি ঘোড়া যুদ্ধের রসদ আর অসংখ্য সৈন্য গেল জলের তোড়ে ভেসে।বিপুল লোকসান।প্রায় ১৫০০ সৈন্যের ঘটলো সলিল সমাধি।জেমস গ্র্যান্ট ডাফ সাহেব তাঁর সুবিখ্যাত গ্রন্থ এ হিস্ট্রি অব মারাঠায় লিখেছেন..."Fifteen hundred men were plunged into the Adjee and totaly lost." ".
সকলেই ভেঙে পড়লেন।শুধু ভেঙে পড়লেন না নবাব।যেমন করেই হোক বর্গিদের তিনি বাংলা ছাড়া করবেন।কঠোর প্রতিজ্ঞায় তিনি অটল।কর্তব্যে অবিচল।তাই অতি সন্তর্পণে আবার সেতু মেরা মতির কাজ শুরু হলো।কাজ শেষ হতেই সৈন্যরা নির্বিঘ্নে অজয় পার হল।এবার নব উদ্যমে নবাবি সেনা দাঁইহাটের পথে ধাবিত।ইতিমধ্যে বর্গিরা খবর পেয়ে দলে দলে তখন ঘোড়া ছুটিয়ে মহারাষ্ট্রের পথে। দাঁইহাটের পূজা প্রাঙ্গন তখন বর্গি আর নবাবি সেনার রণাঙ্গনে পরিণত।নবমীর প্রভাতে লন্ড-ভন্ড হয়ে গেল দেবী পুজো।অসংখ্য বর্গি সেনা মারা গেল।যেন দেবীপূজায় নরবলির মহা আয়োজন।ভাস্কর পন্ডিত বিপদ বুঝে আগেই পলায়ন করেছিলেন।কথিত আছে তাঁর কাছে ছিল এক সোনার দুর্গা প্রতিমা।বিধর্মীরা পূজার পবিত্রতা নষ্ট করে দেবে বলে নাকি সেই স্বর্ণপ্রতিমাটিকে গঙ্গার জলে ভাসিয়ে দিয়েছিলেন।নবমীতেই দশমীর বাজনা বাজিয়ে ফিরে গিয়েছিলেন মহারাষ্ট্রে।কঠোর প্রতিজ্ঞা করেছিলেন দাঁইহাটের মাটিতে।রক্তের হোলি খেলবেন এই বাংলায়।আজও সেই দুর্গাপূজা আসে।ভাঙাচোরা বাড়িটাতেই।লোকমুখে যার পরিচিতি --ভাস্কর পন্ডিতের দুর্গাপুজো।
ঐ যে দেখছেন----ভাঙা দেওয়ালটুকু! ওটাই বর্ধমানরাজাদের বিরাট গঙ্গাবাস ভবনের শেষ চিহ্ন।ওখানে আজও রয়েছে গোলা বর্ষণের ক্ষতচিহ্ন।নিচে জননী জাহ্নবীর পরিত্যক্ত নদিখাত।বাঁধানো ঘাট--বারদুয়ারী।ডান দিকে রাজাদের সমাধি স্মারক--সমাজবাড়ি।কিশোর-কিশোরী মন্দির।আজ গঙ্গা অভিমানে দূরে সরে গেছে।গাছ-গাছালি আর আত্মবিস্মৃতির পলিতে চাপা পড়ে ইতিকথা!বঙ্গে বর্গি হাঙ্গামার স্মারক চিহ্ন রাজবাড়িটা ভাঙতে ভাঙতে শুধু এইটুকু!!একটা বোবা জিজ্ঞাসা চিহ্নের মত বেবাক দাঁড়িয়ে!অচিরে হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়বে।আত্মবিস্মৃত বাঙালী শুধু নিদ্রালু সন্তানদের ঘুম পারাতে পারাতে বলবে-----
খোকা ঘুমালো পাড়া জুড়ালো বর্গি এলো দেশে।
বুলবুলিতে ধান খেয়েছে খাজনা দেবো কিসে।।
শুধু পুজোর এই চারটি দিন ইতিহাসের বিবর্ণ পাতা থেকে বেরিয়ে আসবে বর্গিরা...ভাস্কর পন্ডিত...আর স্মৃতির ক্যানভাসে উজ্জ্বল হয়ে উঠবে অতীতের ইন্দ্রাণী-দাঁইহাট।।
সৌজন্য ঃদৈনিক সংবাদে প্রকাশিত
No comments:
Post a Comment