মহালয়া কি বাঙালীর বিলীয়মান ইতিহাস চেতনা?
শুভ মহালয়া।পিতৃপক্ষের অবসান।দেবীপক্ষের সূচনা।অমানিশার সমাপ্তি।জ্যোতির্ময়ীর অভ্যুদয়।নীল আকাশে রাশি রাশি পেঁজা তুলো।আলতা ধোয়া রোদ্দুর।হিমের পরশ।কাশের বনে হাওয়ার লুটোপুটি। শিশিরসিক্ত শিউলির সুবাসে স্নিগ্ধ শারদপ্রকৃতি।উদাসী ভোরের বাওরে ভাসে বীরেন্দ্র ভদ্রের উদাত্ত কণ্ঠের ভোরাই...।আশ্বিনের শারদ প্রাতে ...!বাজলো তোমার আলোর বেণু...। সুর ছুয়ে যায় নদীর তীরে তীরে ,ধানের বনে বনে।মন থই থই পুজো পুজো গন্ধে।এই একটা ভোরেই বা ঙালী বিভোর হয়ে থাকে বিলীয়মান বেতারের আকাশবাণীতে।
মহালয়া মানেই শারদোৎসবের কাউন্ট ডাউন শুরু। মহালয়া মানেই বনেদি বাড়িগুলিতে দেবীর মৃণ্ময়ী থেকে চিন্ময়ী হয়ে উঠার শুভক্ষণ। মহালয়া মানেই ছেলেপুলে নিয়ে মা দুগগার বাপের বাড়িতে আগমন উপলক্ষে চূড়ান্ত আয়োজন।হিমালয় তখন মহালয় ছাড়া আর কী!তবে যাই বলুন এই মহালয়া শব্দটির অর্থ বড়ো গোলমেলে।কেউ কেউ বলেন মহালয়া মানে মহালয়। অর্থাৎ আলয় ছেড়ে তখন মহাপ্রলয়।দেবাসুরের রক্তাক্ত সংগ্রাম বেধেছিল বহুযুগ ধরে।জমে উঠেছিল মৃতদেহের পাহাড়।সেই সব বেওয়ারিস মৃতদেহর আত্মার শান্তি কামনার জন্যই নাকি এই স্মরণ মূলক আচার অনুষ্ঠানের নাম মহালয়া।আবার কেউ বলেন এই দিনেই প্রভু রামচন্দ্র অকাল বোধন মানে কাঁচা ঘুম ভাঙিয়ে দেবী দুর্গার পুজো করেছিলেন দশানন রাবনকে বধ করার উদ্দেশে। এই ভয়ংকর যুদ্ধ অনুষঙ্গগুলি বাদ দিলে বাস্তবে দেখা যায় সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্র। মহালয়ার পুণ্যলগনে নদীবক্ষে পিতৃপুরুষদের উদ্দেশে অসংখ্য মানুষের তর্পণ রত জলছবি।সিক্ত বাস।অঞ্জলি বদ্ধ দু হাতে প্রদত্ত পবিত্র নীর।উচ্চারিত মন্ত্রে বিশ্বের সকল প্রাণসত্তার জন্য আকুল শান্তিকামনা।ওঁ শান্তি...।ওঁ শান্তি...।।
তর্পণ শব্দটির অর্থ-- তৃপ্ত করা।পিন্ড আর জলদান করার শাস্ত্রীয় রীতি।মহালয়া তাই এক অর্থে গণ-শ্রাদ্ধানুষ্ঠান।মৃত পূর্বপুরুষদের শ্রদ্ধা সহকারে স্মরণ।মনন ও বিনম্র ভক্তি অর্পণ।হিন্দু পুরাণ অনুসারে মানুষ মারা গেলে যমদূত তার জীবাত্মাটি নিয়ে যায় স্বর্গ ও মর্ত্যের মাঝামাঝি পিতৃলোকে।এখানেই থাকেন মৃত তিন পুরুষের আত্মা।পিতা পিতামহ ও প্রপিতামহের জীবাত্মা।সূর্য যখন কন্যা রাশিতে প্রবেশ করে অর্থাৎ ভাদ্র পূর্ণিমার পরের দিন থেকে অমাবস্যা পর্যন্ত চলে পিতৃপক্ষ। অবশ্য স্থান ভেদে এর পার্থক্য আছে। যেমন দক্ষিণ আর পশ্চিম ভারতে শুরু হয় গণেশ পুজোর পরের দিন থেকে।উত্তর ভারতে নেপালে ভাদ্রমাসের পরিবর্তে আশ্বিন মাসের কৃষ্ণপক্ষ হলো এই পিতৃপক্ষ।এই সময়ে পিতৃলোকে বসবাসকারী আমাদের পূর্বপুরুষরা মর্ত্যলোকে নেমে আসেন।তাঁদের জীবিত উত্তরসূরীদের কাছে প্রার্থনা করেন চির আকাঙ্খিত অন্নজল,পিন্ডোদক।এই কারণে এই পনেরো দিন চলে শ্রাদ্ধ-তর্পণ-পারলৌকিক কর্মাদি। তবে শেষের দিন ভিড় হয় রেকর্ড।এই অমাবস্যা তাই মহালয়া অমাবস্যা নামে সুপরিচিত। অনেকেই বলেন সর্ব পিতৃ অমাবস্যা।এদিন আমাদের কাছে পিতা স্বর্গ,পিতা ধর্ম। পিতৃপূজার দিন।শাস্ত্রীয় বিশ্বাস এরপরই সূর্য বৃশ্চিক রাশিতে গমন করে ।শুরু হয় দেবীপক্ষ।
মহালয়া নিয়ে মহাভারতেও রয়েছে মনোজ্ঞ উপাখ্যান।মহাদানী কর্ণের মহাপ্রয়াণের পর তাঁর স্থান হয়ে ছিল স্বাভাবিক ভাবেই স্বর্গে।সেখানে রাশি রাশি মণি মাণিক্য রত্ন দেখতে পেলেন।কিন্তু পেলেন না এক মুঠো খাবার।স্বর্গের রাজা ইন্দ্রের কাছে জানতে চাইলেন কেন তার সঙ্গে এই স্বর্গীয় প্রবঞ্চনা? ইন্দ্র বললেন---মর্ত্যলোকে কি পিতৃপুরুষদের উদ্দেশে তর্পণ করেছিলেন মহাদানী কর্ণ?কর্ণ বুঝতে পারলেন তাঁর ভুল।তিনি ইন্দ্রের আদেশে পুনরায় ফিরে গেলেন মর্ত্যে।পিতৃপুরুষদের তর্পণ করে স্বর্গে এসে নিজেও তৃপ্ত হলেন।লোকবিশ্বাস ---এই সময় তর্পণ করলে জীবিত বংশধরেরা ধর্ম-অর্থ-কাম-মোক্ষ এই চতুর্বর্গ ফললাভ করেন।
মহালয়া কোন ভৌত কাহিনী নয়।আবার নিছক গরম ভাতের গপ্পোও নয়।আমাদের সুপ্রাচীন পূর্বপুরুষ পুজোর দৃষ্টান্ত এই মহালয়া।শিকর সন্ধানের স্নিগ্ধ স্মৃতি।আদিবাসীরা তাদের পূর্বপুরুষদের স্মরণে বীরস্তম্ভ প্রোথিত করতো।জৈন ও বৌদ্ধরা সমাধিগাত্রে স্তম্ভ বা স্তূপ নির্মাণ করতো।হিন্দুরা করেন পূর্বপুরুষদের স্মরণে তর্পণ।মহালয়া তাই এক অর্থে প্রাচীন ইতিহাসকে স্মরণ করা ।যাঁরা অতীত হয়ে গেছেন অথচ যাঁদের দানে আমরা সমৃদ্ধ হচ্ছি,ভোগ করছি যাঁদের সম্পদ --তাঁদেরকে শ্রদ্ধার সঙ্গে করছি স্মরণ ।মহালয়ার পুণ্য প্রভাতি লগ্নে আবক্ষ গঙ্গায় নিমজ্জিত হয়ে যখন তিল আর গঙ্গাদোক দিয়ে পূর্বপুরুষদের উদ্দেশ্যে শান্তির মন্ত্রোচ্চারণ করি তখন আসলে স্মরণ করি সেই অনাগত অতীতকে।বিলীয়মান ইতিহাসকে।ঐতিয্য আর পরম্পরাকে।
সৌজন্য ঃ দক্ষিণবঙ্গের জনপ্রিয় দৈনিক সংবাদ পত্রিকায় প্রকাশিত।
No comments:
Post a Comment