কোন এক গাঁয়ের কথা
এপারে খেড়ুয়া আর ও পারে গনফুল।মাঝখানে বহে যায় দূরন্ত অজয়।অবিশ্যি তার দূরন্তপনা ঝুপঝুপিয়ে বৃষ্টি আসার ক'টা দিন মাত্র!তারপরে ঘাপটি মেরে গুটিয়ে যাওয়া যেন একখান সাপ। ভরা খরানিতে চোখ যায় যদ্দূর--ধূ ধূ বালুচর। নিকোনো উঠোনের মতো তকতকে।জলের চিহ্নটুকু নেই। তবে হ্যাঁ--অনেকটা বালি খুঁড়লে খানিক বাদে ভেসে ওঠে কাঁচ কাঁচ পানি।ঠিক যেন আয়না।ইতিউতি সোঁতার বালি ফুঁড়ে গজিয়ে উঠেছে একপোঁচ কুশের জঙ্গল। এদিকে শুধু লরি আর ট্রাকটরের কালো ধোঁয়া ছাড়ার প্রতিযোগিতা। প্রাগৈতিহাসিক জন্তুর মতো নাছোড় গর্জন ছেড়ে দিনরাত অজয়ের বুক চিঁড়ে চলাচল।মাঝ নদিতে মেশিনে কাটা হচ্ছে বালির ডাঁই।সেই বালি লোড হয়ে লরির পর লরি ছোটে শিং ভাঙা গোরুর মতো। ছুটে যাচ্ছে নদিয়া হুগলি হাওড়ার পথে পথে।-সিন্ডিকেট সাম্রাজ্যে।এই হলো গিয়ে খেড়ুয়ার বালিঘাটের বারোমাস্যা।
ব্যাতিক্রম সকলকেই ছুঁয়ে যায়।বাদ যায় না খেড়ুয়ার বালিঘাটও।গত জুন মাসে গভীর রাতে বালি কাটতে গিয়ে তলা থেকে উঠে এলো দুটো পাথরের মূর্তি।বালির কুয়োতে চান করাতেই দেখা গেল--জোড়া বিষ্ণুমূর্তি।কালো কষ্টি পাথরে খোদিত। পাল-সেন আমলের প্রচল বিগ্রহ।ততক্ষণে রাতের আঁধার কেটে পুবাকাশে আলোর আভা ছড়িয়ে পড়ছে।কিন্তু ক্ষতি যা হবার তা হয়ে গেছে।একটি মূর্তি প্রায় অক্ষত থাকলেও যন্ত্রের ধারালো ব্লেড অপরটির নাক ,বুক একেবারে চেঁচে দিয়ে সমান করে দিয়েছে।পরের ঘটনা বাংলা টিভি সিরিয়ালের চিত্রনাট্য। আপনাদের জানা।সকালে যথারীতি পুলিশ আসবে।গ্রামবাসীরা ততক্ষণ ঢাক ঢোল -কাঁসর ঘণ্টা বাজিয়ে পুজো শুরু করে দেবে।রাস্তায় রাস্তায় টাকা -পয়সার তোলা -- তোলা হবে। পুজো আর মন্দির তৈরির জন্য।ছুঁচ হয়ে ঢুকে পড়বে স্থানীয় রাজনীতি।প্রশাসন মূর্তি উদ্ধার করতে গেলেই ফাল হয়ে হয়ে বেরিয়ে আসবে উন্মত্ত জনতা।খেড়ুয়ার ক্ষেত্রেও যে এর ব্যতিক্রম ঘটেনি তা বলাই বাহুল্য!
খেড়ুয়া কাটোয়া মহকুমার মঙ্গলকোট থানার যাকে বলে অতি প্রাচীন অজ গাঁ।অজয়ের ধার ঘেঁসে বসতি।প্রাচীনকাল থেকেই নদিপথে সহজ যোগাযোগ,পলি মাখা খেতে পর্যাপ্ত ফসল,সেই সংগে নদির মাছ ইত্যাদি অজয় যেমন দু হাত ভরে খেড়ুয়াকে দিয়েছে, বিনিময়ে গত পঞ্চাশ বছর ধরে অজগর সাপের মতো একটু একটু করে গ্রামের খেত,বাঁশঝাড়,মন্দির,বাস্তুভিটে জমিদার বাড়ি, চাটুজ্জ্যেদের মনসাতলা-- সবমিলিয়ে গাঁয়ের আদ্দেকটা গিলে নিয়েছে।অধিকাংশ গ্রামবাসীর হাসি-কান্না-সুখ-দুঃখ-কোলাহল-তুলসীমঞ্চ-শয়ন কক্ষ অজয়ের বানে বিলীন হয়ে স্তব্ধ এক ইতিকথা ।শুধু একটি উল্লেখযোগ্য জীর্ণ ফাটল ধরা দালান রীতির বৈষ্ণব মন্দির অজয়ের রক্ত চক্ষুকে উপেক্ষা করে অক্টোপাশের মতো আজও আটকে রেখেছে এক বিরিক্ষি বটগাছ তার ঝুরির মায়াবি বাঁধনে। যথাস্থানে তার কথা শোনানো হবে।বাকি গ্রামবাসীরা ভিটে হারিয়ে এককিমি দূরে উঁচুডাঙায় বেঁধেছে নতুন করে আস্তানা।কালক্রমে জনপদ গজিয়ে ঊঠে নামকরণ হয়েছে নতুনখেঁড়ো।আর পুরাতন খেঁড়োতে রয়ে গেছে অজয়ের কোলের সন্তান--- অন্ত্যজ সম্প্রদায়েরা। তারাই মাথায় করে তুলে এনেছে একদা বামুন-কায়েতদের পূজিত ভগবান বিষ্ণুকে।
খেড়ুয়া স্থান-নামটির একাধিক অর্থ।কেউ বলেন খড়।গেঁয়ো উচ্চারণে খ্যাড়। লোকগানে রয়েছে -"হিঁদুদের দুগগা পুজো।ভ্যাতোরে খ্যাড়ের গুঁজো।আবার নদির চরায় পর্যাপ্ত ফলে ক্ষীরা।দারুন সুস্বাদু এক সব্জি।গ্রাম্য উচ্চারণে এরই নাম খেঁরো। এর থেকেও স্থাননামটি হতে পারে হয়তো।খেড়ু মানে অশ্লীল হাসি ঠাট্টার চুটকি জাতীয় গানের নাম।এর থেকেও আসতে পারে।তবে ক্ষেত্রসমীক্ষায় দেখা গেছে--খেড়ুয়া গ্রামের সঙ্গে খড় বা ক্ষীরার ঘনিষ্ঠ সমপর্ক থাকলেও খেড়ুগানের কোন যোগ নেই।একসময় খেড়ুয়া গ্রামে নীলকুঠি ছিল।ইংরেজ কুঠিয়াল নীলচাষ করে বেশ পসার জমিয়েছিলেন।কিন্তু অজয়ের হড়পা বানে তিনিও নাকি পগার পার। এখন শুধু কুঠিরপুকুর বা মাঠের স্থাননামে ক্ষীণ স্মৃতিটুকু আটকে। আজও রয়েছে গ্রাম্য দেবতা ক্ষেত্রপাল।আষাঢ় নবমীতে বেশ জাঁক করে পুজো হতো।পাঁঠা চোট হতো ঘরে ঘরে।আত্মীয়-কুটুমরা আসতো।এখন হয় নমো নমো করে।ধর্মরাজ পুজোয় তোড়জোড় বেশ ভালো।তবে নামু খেঁড়োর চেয়ে উপর খেঁড়োতেই সরেস।
এবার আসি মন্দির কথায়। মোঘল আমলে একবার বঙ্গেশ্বর হয়েছিলেন অম্বরের রাজা মানসিংহ।তাঁর আমলে যে কয়জন বাংলার ভুঁইয়া বা জমিদার মোঘল শাসন না মানার হিম্মত দেখিয়েছিলেন তাদের মধ্যে যশোরের রাজা প্রতাপাদিত্য অন্যতম।মানসিংহ বৈষ্ণব ধর্মের প্রবল অনুরাগী হলে কি হবে রাজকার্যে শাক্তের থেকেও শক্ত।তাই প্রতাপাদিত্যকে চরম শাস্তি দিয়ে হরণ করে নিয়ে গেলেন যশোরের রাজবাড়ির কুলদেবতা রাধামধবের দারুবিগ্রহ আর যশোরেশ্বরী কালীকে।অম্বরের রাজমন্দিরে প্রতিষ্ঠিত হলো অপূর্ব শৃঙ্গার রসাত্মক চার ফুটের অধিক উচ্চতা বিশিষ্ট দারু বিগ্রহ রাধা-মাধব।তারপর গঙ্গা দিয়ে বয়ে গেল অনেক জল।
শ্রীচৈতন্যদেবের দোসর প্রভুনিত্যানন্দ বিয়ে থা করে সংসার পাতলেন।যথা সময়ে দুই সন্তানের জনক হয়ে উঠলেন।বীররভদ্র গোঁসাই আর মেয়ে গঙ্গা।মেয়ের বিয়ে হলো কাটোয়ার কাছে গঙ্গাতীরের নলিয়াপুরের কবি দ্বিজ মাধবের সঙ্গে। গঙ্গা-মাধবের সন্তান প্রেমানন্দের আরাধ্য সেই মা গঙ্গাই।তিনি যেদিন স্বর্গধামে গেলেন প্রেমানন্দ হয়ে গেলেন অনাথ।জীবনদেবতার সন্ধানে তিনি পাগলের মতো ঘুরতে শুরু করলেন সারা ভারতবর্ষ।কোথাও পেলেন না শান্তি।মনের আরাম।ঘুরতে ঘুরতে একদিন পৌঁছে গেলেন অম্বরের রাজমন্দিরে। কিন্তু একি দেখলেন! যাঁকে তিনি খুঁজে বেড়াচ্ছেন -----যিনি চেতনে -অচেতনে -মননে -স্মরণে -বিস্মরণে -শয়নে স্বপনে চির জাগরুক সেই যুগলতনু তাঁর সামনে।প্রেমানন্দ আর প্রেমের আনন্দে স্থির থাকতে পারলে না ।লুটিয়ে পড়লেন রাধা-মাধবের চরণতলে।তাঁর প্রেম-সমাধি ভঙ্গ হলো রাজবাড়ির লোকেদের সেবা শুষ্রূষায়।রাজবাড়ির লোকজন প্রভু নিত্যানন্দের দৌহিত্রকে দেখতে পেয়ে আনন্দে ভক্তিতে গদগদ হয়ে উঠলেন
।তাঁরা করজোড়ে বললেন----আমাদের পরম সৌভাগ্য আপনি এখানে পদার্পণ করেছেন।আদেশ করুন প্রভু-কি চাই আপনার?
-----আমার চাই-রাধামাধব!
---কিন্তু এ যে রাজার ঠাকুর!রাজসেবা! আপনার পক্ষে কি সম্ভব?
---সবই সম্ভব যদি প্রভু কৃপা করেন।
রাজবাড়ির লোকেরা সম্মত হয়ে রাধামাধবকে দান করলেন প্রেমানন্দকে।তিনি গঙ্গাপথে রাধামাধব নিয়ে উঠলেন শাঁখাইএর এক জগন্নাথ মন্দিরে।কিন্তু ইতিহাসের ইঙ্গিত অন্যদিকে।রাজস্থানের বৈষ্ণবধর্ম ছিল মূলত স্বকীয় পন্থার।রাধামাধব পরকীয়া বিগ্রহ।পরবর্তীকালে জয়পুরের রাজা সেহাই জয় সিংহএর সভাপন্ডিত ছিলেন কেশব ভট্টাচার্য।তিনি স্বকীয়া পন্থীর হয়ে পরকীয়াবাদীদের পরাজিত করেছিলেন।যদিও শেষপর্যন্ত তিনি পরাজিত হয়েছিলেন পরকীয়াবাদী পন্ডিত কবি রাধামোহন ঠাকুরের কাছে।সে কারণে রাজবাড়ির লোকেরা রাধামধবের প্রকৃত সেবাইত প্রেমানন্দকে নির্বাচিত করে তাঁকেই মূর্তি দান করেছিলেন।প্রেমানন্দের জ্যেষ্ঠপুত্র খেড়ুয়াগ্রামে বসবাস করতে থাকেন।সেই সূত্রে এই গ্রামে বর্ধমান রাজাদের ও শিষ্যদের অর্থানুকূল্যে খেড়ুয়া গ্রামে টেরাকোটা অলঙ্করণ সমৃদ্ধ এক নাটমন্দিরসহ দালান মন্দির গড়ে ওঠে।রাধামাধব শুধু সেবাইত গোঁসাইদের ঠাকুর নন;সময়ান্তরে হয়ে ওঠেন এলাকার প্রাণের ঠাকুর।বছরে প্রায় মাসখানিক থাকেন রাধামাধব- জগন্নাথ খেড়ুয়াতে.১৮ ই চৈত্র থেকে ২৫ শে বৈশাখ।মেলা বসতো।অজয়ের দুপারে র গ্রামের মানুষজন আসতো কাতারে কাতারে।কীর্তনগানে নামসংকীর্তনে আর মানুষের বন্যায় ছাপিয়ে যেত।কিন্তু অজয়ের দু-কুল প্লাবী বন্যায় একদিন দেবতার মন্দির হয়ে গেল শূন্য।মানুষের সঙ্গে রাধামাধব উঠলেন নতুন খেঁড়োতে।
খেড়ুয়ার ইতিকথার নটেগাছ মুড়োতে এখনো বাকি আছে।বহুকাল আগে থেকেই এ গ্রামে প্রবাহিত হয়েছে পৌরাণিকবৈষ্ণবধর্মের ফল্গুধারা।বছর বিশেক আগেই অজয়ের দহে চান করতে গিয়ে গ্রামবাসীরা জল থেকে তুলে আনে চার ফুটের অধিক উচ্চতার পাল-সেন যুগের এক অপূর্ব বিষ্ণু মূর্তি। সে মূর্তি রয়েছে পুরনো খেঁড়োর মৌলীতলয়ায়।তারপর গত জুন মাসে পাওয়া গেল আরও দুটি বিষ্ণুবিগ্রহ।বিষয়টি নিয়ে আলোচনার দাবি রাখে।
হিন্দুদের ত্রিদেবতা ব্রহ্মা বিষ্ণু ও মহেশ্বর।বিষ্ণু জগৎপালক দেবতা।বিষ্ণু শব্দটির অর্থ-- বিশ্ব ব্যাপক,বিশ্বপ্রবেশক।বৈদিক সাহিত্যে দ্যু স্থানের প্রধান সৌরদেবতা ।পরবর্তীকালে ব্রাহ্মণ জাতীয় গ্রন্থাবলী ও উপনিষদে বর্ণিত জলদেবতা নারায়ণ এবং আরও পরবর্তী কালে মহাভারত পুরাণাদির দেবায়িত বাসুদেব -কৃষ্ণের সঙ্গে বিষ্ণু মিলে মিশে একাকার হয়ে যায়।একেবারে গোড়ার দিকে বিষ্ণু নয়;কৃষ্ণের মূর্তি পুজো শুরু হয়েছিল বৃহত্তর ভারতবর্ষে বীরপুজোর মধ্য দিয়ে ।প্রথমে চালু হয়েছিল কৃষ্ণ বলরামের পুজো।পরে যাদব পরিবারের আরও দুই প্রজন্মের বীর নায়ক যথা প্রদুম্ন্য-শাম্ব ও অনিরুদ্ধকে নিয়ে পঞ্চবীরের উপাসনা হিন্দু সমাজে ক্রমশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।কালক্রমে বিষ্ণু উপাসকরা নানা দলে ও উপদলে বিভক্ত হয়ে পড়েন।যেমন ভাগবত,একান্তিক, বৈষ্ণব ইত্যাদি।বৈষ্ণব শব্দটির প্রথম উল্লেখ মেলে পঞ্চম শতকের দ্রহসেন ও ব্যাঘ্রসেনের শিলালিপিতে।তবে এগুলির মধ্যে বিষ্ণু উপাসনায় পাঞ্চরাত্র দর্শনই ক্রমশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এবং পূর্বভারতে বিশেষ করে গাঙ্গেয় বাংলায় একসময় এই মতবাদ দারুণ ভাবে ছড়িয়ে পড়ে।
পাঞ্চরাত্রর মতবাদে 'পর-বাসুদেব"--হলেন সর্বশক্তিমান ঈশ্বর।এই পরবাসুদেবের মধ্যে রয়েছে ছয়টি গুণ যথা--জ্ঞান,শক্তি,বল,ঐশ্বর্য,বীরত্ব আর তেজ-নির্দোষ।পরবাসুদেব কোন ব্যক্তি নন। মূলত নিরাকার একটা আইডিয়া।তবে ভক্তের আকুল-ব্যাকুল ডাকে তিনি সাকার হন।তখন তিনি বূহ্য অর্থাৎ এক শরীর থেকে আরেক শরীরে রূপান্তরিত হন।চতুর্বূহ্য থেকে কালক্রমে বিষ্ণুর ২৪ প্রকার রূপ দেখা যায়।বাসুদেব থেকে তৈরি হয় কেশব নারায়ণ ও মাধব।সংকর্ষণ থেকে হয় গোবিন্দ বিষ্ণু মধুদূদন।প্রদ্যুম্ন থেকে জন্ম নেয় ত্রিবিক্রম বামন শ্রীধর ।অনিরুদ্ধ থেকে উদভব হয় হৃষিকেশ পদ্মনাভ ও দামোদর ইত্যাদি ।ভাস্কর্যের ক্ষেত্রে এই ২৪ ধরনের বিষ্ণু মূর্তির পার্থক্য দেখানো হয়েছে শুধু মাত্র শংখ,চক্র গদা পদ্ম --এই চারটি আয়ুধ লাঞ্ছনের হস্তান্তর ঘটিয়ে।
আনুমাণিক অষ্টম শতকে রচিত বৈখানসাগম গ্রন্থ থেকে জানা যায় যোগ সাধনায় সিদ্ধিলাভ ,ব্যক্তিগত শৌর্য-বীর্য লাভ,সাংসারিক কামনা বাসনা পূরণ ও শত্রুর ক্ষতিসাধন ---এই চার ধরনের উদ্দেশ্য পূরণ করার জন্য চার প্রুকার বিষ্ণুমূর্তি পুজো করা হতো।তাদের নাম যথা ১.যোগবিষ্ণু ২.ভোগবিষ্ণু ৩.বীরবিষ্ণু ৪.আভিচারিক বিষ্ণু।প্রতিটি মূর্তি আবার গঠনের দিক থেকে তিন রীতির যথা ---স্থানক,আসন ও শয়ান রীতির।সহায়ক মূর্তি নিয়ে আর একটি শ্রেণী বিভাগ আছে যেমন নির্ধারিত সহায়ক মূর্তির সমাহার থাকলে "উত্তম"।কম থাকলে "মধ্যম"।আর আদৌ না থাকলে "অধম"।অজয় গর্ভ থেকে প্রাপ্ত তিনটি মূর্তি ভোগবিষ্ণু ও স্থানক রীতির এবং মধ্যম শ্রেণীভুক্ত প্রস্তর বিগ্রহ।কালো কষ্ঠিপাথরে খোদিত।ব্যবহার করা হয়েছে হাই রিলিফ পদ্ধতি।ত্রি-মাত্রিক ফর্ম দেওয়ার জন্য বিষ্ণুর বগল থেকে দু পাশ দিয়ে পা পর্যন্ত পাথর কেটে বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে।আকৃতি ঠিক ভি- সাইজের।অধিকাংশই ত্রি বা পঞ্চরথাকৃতি।পাদপীঠে খোদিত দু পাশে উৎকটাসনে উপবিষ্ট এবং দু হাত অঞ্জলিবদ্ধ পূজক মুনি ও ভক্ত।পাদপীঠের মাঝ বরাবর পদ্মের মৃণাল।আসনটি স্বাভাবিকভাবেই ওই দ্বিদল প্রস্ফূটিত পদ্মের।বিষ্ণুর দুপাশে লক্ষ্মী সরস্বতী সহ দুই পরিচারিকার।পৃষ্ঠপটে খোদিত আরও দুটি পদ্মমৃণাল উঠে গেছে বিষ্ণুর দু হাতে
চূড়ায় দেখা যায় একটি কাল্পনিক পশু মুখ।এরই নাম কীর্তিমুখ।চোখ দুটি গোল গোল।নাসারন্ধ্র ফোলানো। ।পরবর্তীকালে এই কীর্তিমুখ পাল-সেনযুগের প্রস্তরভাস্কর্যের অন্যতম অলংকরণের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। মূর্তির পিছনে থাকে চালি বা পৃষ্ঠপট।গবেষকদের মতে পৃষ্ঠপট পরিকল্পনায় একটি দার্শনিক প্রত্যয় কাজ করেছে।পট বা চালি যেন স্বর্গ-মর্ত্য- পাতালের ইঙ্গিতবাহী।নীচে জলসহ পাদপীঠ যেন মর্ত্যভূমির প্রতীক।ভক্তদম্পতি বা পূজক মুনি যার প্রতিনিধি।দেবদেবীর মূর্তিসহ পিছনের চালি হলো আকাশের প্রতীক।আর চালির চূড়া হলো মহাশূণ্যের ইঙ্গিতবাহী।এইভাবেই শিল্পী একখন্ড পাথরের বুকে ফুটিয়ে তুলেছেন সীমা থেকে অসীমের ব্যঞ্জনা। বিষেশজ্ঞরা আরও আনুমান করেছেন এই চালির সূচনা ব্যাপ্তি ও পরিণতি পালযুগে।প্রথমদিকে দেব-দেবীর মাথার পশ্চাতে যে গোলাকার প্রভামন্ডল ছিল তা উপরে ও নীচে প্রসারিত হয়ে পট বা চালিতে পরিণত হয়েছে।
অজয় গর্ভ থেকে প্রাপ্ত অক্ষতপ্রায় প্রথম মূর্তির উচ্চতা তিন ফুট।অপর মূর্তিটির উচ্চতা প্রায় পৌনে তিন ফুট। দুটি মূর্তি একই ধরনের।চালির উপরি ভাগে সুগঠিত কীর্তিমুখ।দুপাশে বিদ্যাধর ও বিদ্যাধরী।তাদের পায়ের উপরে বসে আছে আরো এক জোড়া মূর্তি।চালির প্রান্তে কিন্নর কিন্নরী গণধরেরা রয়েছে।অলঙ্করণ হিসাবে সিংহ হাতির মোটিফ ব্যবহৃত হয়েছে।বিষ্ণু সমপাদস্থানিক ভঙ্গিমায় দন্ডায়মান। তাঁর দু পাশে লক্ষ্মী ও সরস্বতী। বিষ্ণুর উপরের ডানহাতে গদা বাম হাতে চক্র নিচের বাম হাতে শঙ্খ আর ডানহাতে পদ্ম।বিষেশজ্ঞদের মতে মূর্তি দুটি ভোগবিষ্ণু ও ত্রিবিক্রম রূপের।পাকা রাস্তার ধারে অস্থায়ী শিব মন্দিরে পুজো শুরু হয়ে গেছে বিষ্ণুদ্বয়ের।লোক-জন আসছেন।প্রণামী পড়ছে ভালোই।
ফিরতি পথে ভাবছিলাম-- দেশের জাতীয় সম্পত্তি মূল্যবান এই মূর্তিগুলি কি গ্রামে রাখা যুক্তিসঙ্গত?নবাবিস্কৃত এই মূর্তিগুলি নিয়ে গ্রামবাসীদের এই আবেগ উন্মাদনাতো ক'দিনের মধ্যেই ভাটা পড়বে।গ্রামে গ্রামে ক্ষেত্রসমীক্ষা করতে গিয়ে দেখি এইতো বাস্তব চিত্র! ভক্তির নেশা ছুটে গেলে মূর্তি পড়ে থাকে সম্পূর্ণ অরক্ষিত অবপ্সথায় ---মূর্তিচোরেদের অপেক্ষায়।এখন যেমনটি পড়ে রয়েছে নিরাপত্তাহীন এক কুড়েঘরে বছর বিশেক আগে অজয় গর্ভ থেকে প্রাপ্ত বড়ো বিষ্ণুমূর্তিটি।সেখানটা বড়োই নির্জন!!
সৌজন্য একদিন পত্রিকায় প্রকাশিত
No comments:
Post a Comment