লক্ষ্মী অলক্ষ্মীর পুজো এক লৌকিক কৃষি উৎসব
সোনার থালার মতো পুর্ণিমার চাঁদ উঠেছে পুব আকাশে।মাঠে মাঠে ছড়ানো মুঠো মুঠো চাঁদের হাসি।সোনামুখি সবুজ ধানখেত।আজ যে কোজাগরী লক্ষ্মীপুজো।রাতভর জাগরণ।যে শুয়ে থাকে তার ভাগ্যতে পড়বে গেরো। প্রহর জাগো রে...।সম্পদ সৌভাগ্য সমৃদ্ধির দেবী আসেন চুপি চুপি।যে ঘরে জ্বলবে আলো,থাকবে শান্তি--- সেখানেই পড়বে লক্ষ্মীর পদচিহ্ন।ঘর দুয়োর হেসে উঠবে। লক্ষ্মীর প্যাঁজ আর লতাপাতার আল্পনা পাবে প্রাণ।ছায়া ছায়া গাছপালার ফাঁক দিয়ে নিকোনো উঠোনে ঝরবে জোৎস্নার চন্দন।
প্রদোষকালে ঘটে-পটে প্রতিমায় শুরু লক্ষ্মী পুজন।কোথাও বা ব্যতিক্রমী কলাবউ পুজো। আটনের নীচে কলার পেটো দিয়ে বানানো ময়ূরপঙ্খী নাও। বাঙালীর বাণিজ্য বসতির বিলুপ্তপ্রায় স্মৃতি ।পাশে সাতটি বাকারি মানে গোলা।তাতে রাখা-- ধান-শষ্য- সোনা-দানা ফল-মাকড় ইত্যাদি।চূড় করা নৈবেদ্য।চিঁড়ে সিঁড়ি খই তিল মুড়ি আর নারকোলের সুবাসিত নাড়ু।আধপাকা নোয়ানো ধানশিশের গুচ্ছ।পিদিমের নরম আলো।শংখ ঘন্টা কাঁসর ঝাঁজ করতালের আরতি নয়।ঢোলের মিঠি বাদনে হবে পুজন।লক্ষ্মী বড়ো লক্ষ্মীমন্ত দেবী।ঝগড়াঝাঁটি অশান্তি চেল্লামিল্লি দেখলেই ফুরুৎ ধাঁ। আর সেই স্থান দখল করবে ভয়ংকরী অলক্ষ্মী।অশান্তির ঝালাপালায় জীবন হবে জেরবার,ছারখার।সবশেষে হাহাকার।
অলক্ষ্মীর কথা না হয় পরেই বলবো।এখন লক্ষ রাখি ঐ লক্ষ্মীতে। সত্যি বলতে কি---শব্দটির মূলেও এই লক্ষ ।মানে ---উদ্দেশ্য অভিপ্রায়।লক্ষ্মীর উপাসনা শুধু অর্থ উপার্জনের জন্য নয়;পরমার্থের অন্বেষণ। ।ঋগবেদে লক্ষ্মী কোন দেবী নন,সৌন্দর্যের প্রতিশব্দ মাত্র। সুন্দরের বৈদিক দেবী শ্রী।পরবর্তীকালে লক্ষ্মীর সাথে এঁটে উঠতে না পেরে শ্রীদেবী এখন পর্দে কা পিছে। তবে হ্যাঁ আমাদের নামের নাকের ডগায় উপসর্গের মত শ্রীর অবস্থান।শ্রীমান,শ্রীযুক্ত শ্রীমতির উপরেই তার যত কেরামতি। যদিও অনেকেই এখন শ্রীহীন হতে ভালোবাসেন।
পৌরাণিক যুগে লক্ষ্মী ক্রমশ শক্তিশালী দেবী।মহাকাব্য পুরাণাদি থেকে জানা যায় তিনি সমুদ্র গর্ভজাতা অপ্সরী।সুরাসুর মিলে সমুদ্র মন্থন কালে সাগর সেচে তুলে আনা হয়।।চতুর্ভূজা বা দ্বিভূজাদেবীরএক হাতে পদ্ম থাকবেই।তাই তাঁর নাম কমলা পদ্মা ।আবার সাগর থেকে উত্থিত হয়ে তিনি বিষ্ণু বক্ষস্থিতা বলে বিষ্ণুপ্রিয়া। রাতচরা পেঁচা তাঁর বাহন ।প্রাচীন মুদ্রা শিলালেখে এবং মূর্তি পরিকল্পনায় লক্ষ্মী সেই খ্রিস্টপূর্ব যুগ থেকেই রয়েছেন।শক- পার্থীয় শুঙ্গ- কুষাণ-গুপ্ত যুগের সুবর্ণ মুদ্রায় দেবী লক্ষ্মী পদ্মাসনা,বরদা।আবার লক্ষ্মীর অন্যান্য প্রস্তর মূর্তির তুলনায় গজলক্ষ্মী মূর্তি সুপ্রাচীন কাল থেকেই পূজিত হয়ে আসছে।পদ্মাসনা লক্ষ্মীকে দু দিকে এক জোড়া করে দিকহস্তী কুম্ভোদক ঢেলে অভিষিক্ত করছে।সাঁচী ভারহুতের স্তূপেও গজলক্ষ্মী খোদিত।শুধু হিন্দু ধর্মে নয়; বৌদ্ধ ও জৈনধর্মেও লক্ষ্মীর জনপ্রিয়তা তুঙ্গে।
তবে লক্ষ্মী শুধু পৌরাণিক দেবী নন ,অনার্যদের আদি দেবী।আর্য সংস্কৃতিতে লক্ষ্মী যদি সম্পদ সৌন্দর্যের দেবী হন প্রাগার্য কালচারে খিদের অন্নই হলো লক্ষ্মী।তাই তিনি কৃষিলক্ষ্মী।মেয়েলি ব্রতের দেবী,ঘরের লক্ষ্মী,ধান্যলক্ষ্মী।ধান যার আছে সেই ধনবান।বহুব্রীহি মানেই ধনী। রাঢ়-বাংলায় মাঠের ফসল কাটার সময় এলেই লক্ষ্মীর আরাধনা ।চৈতি পৌষালি আর ভাদুরে ফসল উঠলেই চৈত্র ভাদ্র ও পৌষসংক্রান্তিতে লক্ষ্মী পুজো ঘরে ঘরে।এই তিনবার লক্ষ্মীকে নতুন করে পাততে হবে।আটনে আলপনা দিয়ে লক্ষ্মীর ঘরে ২১ কাঠা ধান দিতে হবে।ধানের মাথায় বসবে চেলির ঘোমটা পরা বেতের কাঠা।চার দিকে বসবে পেঁচা।সামদ্রিক কড়ি।লক্ষ্মীর চিরুনি তামার মুদ্রা আরো কত কি! সঙ্গে নৌকা।এ যেন বাঙালীর প্রত্ন মিউজিয়াম।বধূ পরম্পরায় পূজিত এক জীবন্ত ইতিহাসের সূতিকাগার।লক্ষ্মীর নৈবেদ্য বলতে ভাত ডাল শাক সব্জির সহজিয়া পদাবলী।আর থাকে মায়েদের রান্না করা পরমান্ন।এইতো পরম প্রসাদ।এটাই বাঙালীর চিরকালীন কামনাঃআমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে।শান্ত শিষ্ট বাঙালীর জাতীয় দেবী লক্ষ্মী ছাড়া আর কে হতে পারেন?
কিন্তু মাঝে মাঝে যে লক্ষ্মীছাড়া হতে হয়। তখন নেমে আসে দুর্ভাগ্য ,বিভ্রাট সর্বনাশ। এইতো জীবন!আমাদের অনেকেরই কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের মতো হতভাগ্যের গান গাওয়ার শক্তি নেই।কন্ঠ উঁচিয়ে বলতেও পারি না" হাস্যমুখে অদৃষ্টেরে করবো মোরা পরিহাস"। সেই কারণেইতো অলক্ষ্মীর পুজো,ভয়ে ভক্তিতে। তবে এর উৎস বহু প্রাচীন।একসময় পূর্ববাংলার ঘরে ঘরে আশ্বিনসংক্রান্তিতে মেতে উঠতো গাড়শিব্রতে।কেউ বলেন গাড়শি নাকি ফারসি শব্দ।অন্যরা দাবী করেন গাড়শি আসলে গৃহস্থ শব্দের বিকৃত উচ্চারণ।শব্দ নিয়ে বিতর্ক থাকলেও অর্থে কিন্তু সেই অলক্ষ্মী তাড়িয়ে লক্ষ্মী পুজো। ।ক্ষেত্রসমীক্ষায় দেখেছি---আশ্বিন সংক্রান্তির খুব ভোর বেলায় উঠে ব্রতীরা বাসি কাপড়ে মাঠ থেকে শব্জি নিয়ে আসেন।তারপর বাড়িতে পাট-ঝাঁট না দিয়ে আমানি মানে শব্জি কাটাকুটো করে সিধে গঙ্গা বা পুকুরে ভুখ ভুখ করে ডুব। । বাড়ি এসে রান্না বান্নায় মনোনিবেশ।নানারকম তরিতরকারি থাকলেও তেঁতুল মেশানো একটা ডাল থাকবেই।আগের দিন রাতে নেমন্তন্ন করতে হবে কাককে।রান্না হয়ে গেলে কলাপাতায় সব ধরনের খাবার আগে কাককে খাওয়াতে হবে।ভারি মজার এই ব্রতটি।সাঁজের বেলায় জ্বেলে দিতে হবে কলার পেটো দিয়ে বানানো চেরাগ।সেই চেরাগের আলোয় দূর হবে অলক্ষ্মী অমঙ্গল দারিদ্র।
অনেকেই বলেন গাড়ুব্রত আসলে দশমহাবিদ্যার অন্যতম ধূমাবতীর পুজো।এই বিদ্যাদেবী নাকি সতীর চিতার উত্থিত ধূম থেকে নির্গত হয়েছিলেন।প্রচন্ড খিদেয় নিজের স্বামী মানে শিবকেই কড়মড়িয়েই খেয়েছিলেন।পরে শিবের কাছে তালাক পেয়ে চিরকালের বিধবা।এনার হাতে থাকে দেবী শীতলার মতো ঝাঁটা আর পতাকায় আঁকা অমঙ্গলের বার্তাবহ কাকের চিত্র।গাড়ুব্রতে ধূমাবতীর প্রভাব থাকতেই পারে ।তবে অলক্ষ্মীর প্রসঙ্গকে অস্বীকার যায় না।অনেক স্থানে গাড়শি ব্রতের দিন কাক ডাকার আগে বাড়ির সকলে ঊঠে গায়ে হলুদ মেখে নেন।মাটি দিয়ে তৈরি করে একটা আস্ত শূকর মূর্তি।কুলো বাজিয়ে সেই শূকর বলি দিয়ে ফেলে দিয়ে আসেন তেমাথা রাস্তায়। কালীপুজোর রাতে অনেক স্থানে লক্ষ্মী পুজো হয়।তবে লক্ষ্মীপুজোর আগেই অলক্ষ্মীর পুজো। সে এক দেখার জিনিষ।
লক্ষ্মী-নারায়ণ-কুবের তিন পুতুল বানানো হয় পিটুলি মানে চাল-বাঁটা দিয়ে।প্রথমটিকে সিঁদূরের প্রলেপ দেওয়া হয়।এটি লক্ষ্মী।দ্বিতীয়টিকে নীল রঙের চূর্ণ দিয়ে নারায়ণ আর কুবের পুতুলকে দেওয়া হয় অপরাজিতাপাতা বাঁটার প্রলেপ।পুতুলগুলি বসানো হয় কলার পেটোতে ।শুরু হয় লক্ষ্মীপুজোর আয়োজন।অবশ্যই তার আগে অলক্ষ্মী পুজো করে বিদেয় করতে হবে।'একটি গোবরের পুতুলকে কালো রঙে ভুত করে মেয়েদের ঝরে পরা চুলের নুড়ি গোবর আর মোমবাতি জ্বেলে বাঁহাত দিয়ে পুজো। এরপর কুলোর উলটো পিঠে চাপিয়ে কাঁসর বাজিয়ে অলক্ষ্মী বিসর্জন। তারপর লক্ষ্মীপুজোয় বসতে হবে।
এই অলক্ষ্মী পুজোকেই অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর অনার্যদের পূজিত আদি শষ্যলক্ষ্মী বলেছেন তাঁর বহুল প্রচলিত বাংলার ব্রত গ্রন্থে ।তাঁর মতে এই সবুজ হলুদ লাল রঙের তিনটি পুতুল প্রাগার্য লক্ষ্মী পুজোর নিদর্শন। আসলে শষ্যের তিন প্রকার রূপ।সবুজ হলো শষ্যের প্রথম রূপ। তারপর সেই শষ্যের পাক রঙ ধরে। শেষে পরিপূর্ণ পক্ক।লাল রঙের লক্ষ্মীপুতুল সেই ঝুনট পাকা শষ্যের প্রতীক।এই আদিম লক্ষ্মীপুজো শুধু বাংলায় নয়;বাংলার বাইরেও প্রচলিত ছিল।যেমন মেক্রিকোর পুরাণেও রয়েছে শষ্য রক্ষয়িত্রী তিন বর্ণের তিন দেবতার কথা।পরবর্তীকালে এই আদিম লক্ষ্মীপুজোই অলক্ষ্মী বলে পরিত্যক্ত হয়েছে।এই অলক্ষ্মী পুজোর সঙ্গে মিল আছে ঝাড়খন্ড বাংলা সীমান্তে ডোম সম্রদায় পূজিত এঁটু ঠাকুরের ।উচ্ছিষ্ট পরিত্যক্ত আবর্জনা বাসি পচা খাবার দাবার দিয়ে এই দেবতার পুজো করেন ডোমেরা।বর্ণহিন্দু উচ্চ সমাজে দুর্গাপুজোর সময় কোথাও কোথাও বিজয়াদশমীর সাঁজবেলায় এমনি এক দেবীর পুজো হয়।নাম তার উচ্ছিষ্টা চন্ডালিনী।নাথ সম্প্রদায়গত চক্রবর্তী বামুন চার দিনের বাসি ফুল বেলপাতা দিয়ে দেবী পুজো করেন ----ওঁ নমঃ উচ্ছিষ্ঠা চন্ডালিন্যৈঃ নমঃ মন্ত্রে।
অবনীন্দ্রনাথের মতে কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোর মধ্যে অনেকখানি টিকে আছে সেই আদিম অনার্যলক্ষ্মীর স্মৃতি।পুজোর উপকরণগুলি দেখলেই বোঝা যায়।কোজাগর মানে কে জাগে।এই মায়াবী পূর্ণিমার রাতে যারা জেগে থাকেন ,পাশা অর্থাৎ দ্যূতক্রীড়া করেন দেবী তাঁকে বর দান করেন।বোঝ ঠ্যালা! যে লক্ষ্মীকে নিয়ে এত বড়ো বড়ো কথা সেখানেই জুয়া খেলা!!!!তবে কি ডাল মে কুচ কালা হ্যায়! অনেকেরই সেই গল্পটা জানা আছে।জগৎ শেঠের ধনী হবার গপ্পো।বিদ্যা বুদ্ধির খাতিরে দিল্লীতে ডাক পড়লো শেঠ মশাইএর।সম্রাট তার বুদ্ধি চাতুর্যের খুব প্রশংশা করে বললেন কি চাই আপনার? মায়ের শেখানো বুলি শেঠ আওড়ে গেলেনঃ দিল্লীতে কোজাগরী রাতে কেউ যেন আলো না জ্বালে।সম্রাট বললেন ঠিক আছে।এদিকে কোজাগরী রাতে সারা দিল্লী অন্ধকার হয়ে রইলো শুধু আলো জ্বলছে শেঠের বাড়িতে।দেবী লক্ষ্মী জগৎ ভ্রমণে বেরিয়ে দেখতে পেলেন দিল্লীতে সব অন্ধকার শুধুমাত্র জগৎএর বাড়িতেই আলো জ্বলছে।দেবী বললেন আমাকে একটু আশ্রয় দেবেন?শেঠের মা দেবীর ছলনা বুঝতে পেরে বললেন আপনি বসুন আমি যতক্ষণ না ফিরে আসছি ততক্ষণ থাকুন।।শেঠের মা লক্ষ্মীকে পুত্রের কাছে চিরস্থায়ী করার জন্য যমুনার জলে প্রাণ দিলেন।
এই কিংবদন্তীর একাধিক তাৎপর্য থাকতেই পারে।তবে সারারাত জেগে উৎসবের কথাটা বেশ ভালোই বোঝা যায়।আরো বোঝা যায় আদিম কৃষি উৎসব ক্রমশ বিদেয় হয়েছে।প্রবেশ করেছেন পৌরাণিক লক্ষ্মী। কোজাগরী পূর্ণিমার মূল বৈশিষ্ট্য ছিল সারারাত ধরে রঙিন উৎসব ।এর সঙ্গে মিল রয়েছে মেক্রিকো পেরু দেশের শষ্য উৎসবের।শারদ পূর্ণিমায় সেখানকার আদিবাসীরা ভুট্টার ছড়াকে পুজো করে।নানা খাবার তৈরী করে শষ্যদেবীর কাছে নিবেদন করে।সঙ্গে থাকে একটি সিদ্ধ করা ব্যাঙ।শেষে থাকে কুমারী বলির ঘটনা।আর সারা রাত ধরে চলে মেয়েদের এলোচুলে নৃত্য। আজও কোজাগরী পূর্ণিমার মত্ততার রাত্রিতে জোৎস্না প্লাবিত মাঠের দিকে তাকালে সেই বিলীয়মান কৃষি উৎসবের কথাই মনে পড়ে।
সৌজন্যঃ সংবাদ পত্রিকায় প্রকাশিত
ছবি ঃ নেট ও নিজস্ব