চৈত্রমাসে শুধু শিবের গাজন উৎসব নয়;এর মধ্যেই আছে বাসন্তীপুজো আর ব্যতিক্রমী অন্নপূর্ণা পুজো। অন্নপূর্ণা সাধারণত রাঢ় অঞ্চলে নবান্ন উৎসবের সময় গ্রামে গ্রামে পুজিত হয়।মূর্তি বলতে সেই বহুল প্রচলিত কাহিনির মূর্তিরূপ।হর-গৌরীর সুখের সংসারে আশান্তি ধূমায়িত হয়।স্বামী স্ত্রীর মধ্যে ঝগড়া ঝাঁটি শুরু।শিব একসময় বাড়ি থেকে পলায়ন করে। এদিকে কাম ক্রোধ জয় করলেও খিদের কাছে অসহায় শিব।একমুঠো অন্নের আশায় যেখানেই যান সেখানেই হা অন্ন !শেষে কাশীধামে গিয়ে রক্ষে। ক্ষুধার্ত শিবকে অন্ন দিলেন আর কেউ নন স্বয়ং পার্বতী।দেবীর হাতে অন্ন পাত্র।দেবাদিদেব মহাদেব সে অন্ন গ্রহণ করে পরিতৃপ্ত হলেন। এই মূর্তিতেই একদিনের অন্নপূর্ণাপুজো সারা অঘ্রাণ মাস জুড়ে।
তবে চৈত্রমাসে অন্নপূর্ণামূর্তির সঙ্গে পুজোর বেশ খানিকটা তফাৎ চোখে পড়ে। কথিত আছে এই অন্নপূর্ণা পুজোর প্রবর্তক কৃষ্ণনগরের রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়। বর্গি হাঙ্গামার ফলে বাংলার অবস্থা হয়েছিল শোচনীয়।লুঠপাট,নির্যাতন ,হত্যা শোষণে বঙ্গবাসীর জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল।নবাব আলিবর্দির কোষাগার শূন্য হয়ে যায়।ফলে নবাবও বর্গিদের মতোই জোর পূর্বক কর আদায় করতে থাকেন।ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গলকাব্যের রচনার প্রেক্ষাপট থেকে জানা যায় ----নবাব আলিবর্দি কৃষ্ণচন্দ্রকে আট লক্ষ টাকা নজরানা দাবী করেন।তিনি সময় মতো টাকা দিতে না পারায় মুর্শিদাবাদে কয়েদ হন।কারাগারে রাজা কৃষ্ণচন্দ্র আরাধ্য দেবীর স্তব করলে স্বপ্নে দেবী বলেন যে রূপে তিনি দেবীকে দেখছেন সেই রূপে পূজা করলে দুঃখ কষ্টের অবসান হবে। সেই দেবীই হলেন অন্নপূর্ণা।
শুন রাজা কৃষ্ণচন্দ্র না করিও ভয়।
এই মূর্তি পূজা কর দুঃখ হবে ক্ষয়।।
আমার মঙ্গল-গীত করহ প্রকাশ।
কয়ে দিলা পদ্ধতি গীতের ইতিহাস।।
চৈত্রমাসে শুক্লপক্ষে অষ্টমী নিশায়।
করিহ আমার পূজা বিধি ব্যবস্থায়।।
অনেকেই বলেন কৃষ্ণচন্দ্র দুর্গাপুজোর সময় নবাবি কারাগারে কয়েদ হয়েছিলেন। দেবী দুর্গার পুজো সময় মতো করতে না পেরেই চৈত্রমাসে এই অন্নপূর্ণা পূজার আয়োজন করেছিলেন।প্রশ্ন উঠতেই পারে--সেক্ষেত্রে বাসন্তীপুজো কি দোষ করলো? ঠিকই! তবে অন্নপূর্ণার সমর্থনে বলা যায় রাজা কৃষ্ণচন্দ্র শুধু হিন্দুধর্মের একজন রক্ষকই ছিলেন না ;অনেক নতুন নতুন বিষয়ের প্রবর্তক ছিলেন।যেমন তিনি নাকি নবদ্বীপের রাসের উদ্ভাবক তেমনি জগধাত্রী পূজার প্রবর্তক। কোন সন্দেহ নেই--অন্নপূর্ণা পূজাও প্রবর্তন করেছিলেন তিনি ।মনে রাখা প্রয়োজন--এই অন্নপূর্ণাপূজো দুর্গাপুজোর এক সংস্করণ।যা একান্তই কৃষ্ণচন্দ্রীয় প্রভাব পুষ্ট।
এই ঘরানার এক অন্নপূর্ণাপূজা দেখেছি মুর্শিদাবাদ জেলার কাগ্রামে।কাগ্রাম এমনিতেই অতীতের কংকগ্রামভূক্তির কঙ্কগ্রাম হিসাবে অনেকেই চিহ্নিত করেছেন। কা-গ্রামের ডাকসাইটে জমিদার ছিলেন রায়-চৌধুরী পরিবার।জমিদার অম্বিকালাল চৌধুরীর ভক্তিমতী স্ত্রী রামাসুন্দরী একবার স্বপ্নাদিষ্ট হলেন।দেবি দুর্গাকে অন্নপূর্ণা রূপে পূজা করার কথা বলেন।আর সেই থেকে ব্যতিক্রমী অন্নপূর্ণার পূজা চলে আসছে।বর্তমানে রায় চৌধুরী পরিবার তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে গেছে।আছে দেবীর পুরাতন দালান মন্দির। দেবীমূর্তি বড় বিচিত্র।মাঝে দ্বিভূজা দেবীপ্রতিমা অন্নপূর্ণা।দেবীর ডান হাতে চামচ ,বাম হাতে অন্নপাত্র।বাম পাশে নন্দি।আর ডান পাশে অন্নগ্রহণ কারী শিব।এই তিন মূর্তি ছাড়া দু পাশে রয়েছে দেবীর দুই সখি জয়া ও বিজয়া।চালির ওপরাংশে দু পাশে দুটি পরি।উড়ন্ত ভঙ্গীতে।মনে হয় প্রাচীন প্রস্তর মূর্তির আদলে এ দুটি বিদ্যাধর বিদ্যাধরীর পরিবর্তিত রূপ।সপ্তমী অষ্টমী নবমী তিন দিন পুজো।তিনদিন বলি হয় কুমরো ইতাদি।বিসর্জনের দিন রায় চৌধুরী পরিবারের কূলবধূরা সিঁদূর খেলেন।