কৌলাল অন লাইন ব্লগে এবার আপনাকেও স্বাগত। বাংলার ইতিহাস সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ক বাংলা অথবা ইংরাজি ভাষায় যে কোন মৌলিক লেখা ছবি ভিডিও সহ পাঠিয়ে দিন।নির্বাচিত হলে ব্লগে পোস্ট করা হবে।অভ্রতে টাইপ করে মেল করুন -- drswapankrthakur@gmail.com.ফোন --9332933023.সঙ্গে আপনার পাসপোর্ট সাইজের ছবি আর সংক্ষিপ্ত লেখক পরিচিতি পাঠাবেন । যোগাযোগ--ড.স্বপনকুমার ঠাকুর,কাটোয়া দত্ত মিলের মাঠ,কাটোয়া পূর্ববর্ধমান,পিন ৭১৩১৩০
Saturday, July 23, 2016
BIRVUMER ITANDA SHUDHU MANDIR-GRAM NOY;OITIHASIK GANA-AVYUTHANER EK DURJAY GHATI
বীরভূমের ইটান্ডা শুধু মন্দিরগ্রাম নয়
ঐতিহাসিক
গণ-অভ্যুত্থানের
এক দুর্জয় ঘাঁটি
ইটান্ডার গৌরব হাড়কাটা জোড়-বাংলা কালীমন্দিরসাদামাটা গন্ডগ্রাম ইটান্ডা।যদিও টেরাকোটা মন্দিরপ্রেমীদের কাছে এক অতিপরিচিত নাম। কেননা বীরভূম জেলার একমাত্র জোড়-বাংলা কালী মন্দিরটি এই গ্রামেই আছে।রয়েছে আরও কয়েকটি দৃষ্টিনন্দন টেরাকোটা সুউচ্চ শৈবমন্দির। সংস্কারের অভাবে সেগুলির দশা বার্ধক্যের শেষপ্রান্তে । তবে ইটান্ডা শুধু শিব বা কালীর বসতভূমি নয়;যাকে বলে বাণিজ্যে বসতি লক্ষ্মী। একসময় বীরভূমের বিকিকিনির বিরাট বিপণন কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল গ্রামটি ।
অজয় তীরবর্তী ইটান্ডাতে শুধু ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাণিজ্য করেনি।অতি প্রাচীন কাল থেকেই এক আন্তর্জাতিক জমজমাট বাণিজ্যকেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল।পিতল-কাঁসার তৈজসপত্রাদি,লৌহজাত হরেক কিসিমের দ্রব্য,গালার তৈরি নানান সামগ্রী, রেশম-গাড়া বস্ত্র ইত্যাদি কাটোয়ার গঞ্জ -বাজার হয়ে গঙ্গা আর সমুদ্র পথে ভিন দেশে পাড়ি জমাত।ইটান্ডায় ভিড় করতো দেশি বিদেশি সওদাগরেরা।কাঁচা টাকা উড়ে বেড়াতো।অর্থ প্রাচুর্যে গড়ে উঠেছিল প্রচুর অট্টালিকা-সৌধ।দেবায়তন। বিলাস বৈভব ভোগ-সম্ভোগে সমৃদ্ধ এক অলিখিত ইতিহাস।তারপর কালান্তরের ঝড়ো হাওয়ায় একে একে নিভিল দেউটি।
বীরভূমের দক্ষিণ-পূর্ব সীমান্তে ইটান্ডা।বোলপুর থেকে দূরত্ব মেরেকেটে ২০ কিমি।বাহিরি নিমতলা বাসস্ট্যান্ড থেকে খাড়া দক্ষিণে। সাত থেকে আট কিমি পিচ রাস্ত পেরিয়ে সবুজবনকে পিছনে ফেলে ইটান্ডায় প্রবেশ করবেন।গ্রামের পূর্বদিকে চলে গেছে আঁকাবাঁকা পাকা রাস্তা।পশ্চিমে গোলাম ঘাট।উত্তরে কানা অজয়নদি।এখন স্থির জলাশয়।অতীতে এই শাখা খাতেও অজয় প্রবাহিত হতো। বেশ কয়েক কিলোমিটার প্রবাহিত হয়ে বাসাপাড়ার কাছে গিয়ে মূল অজয়ে মিশতো।বর্তমানে অজয় বহে যাচ্ছে দক্ষিণ দিকে ।ইটান্ডার কোল ঘেঁষে।গ্রামের জনসংখ্যা হাজার তিনিকের বেশী হবে না।সব ধরনের জনজাতির বসবাস।জীবিকা সেই মান্ধাতার আমলের চাষ-বাস।ইদানিং জীবন জীবিকার প্রয়োজনে অনেকে ভিন প্রদেশে পাড়ি জমিয়েছে।
অজয়ের স্থীর জলে...... |
কেউ কেউ বলেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাণিজ্য করার সূত্রে গাঁয়ের এমন অদ্ভুত নাম। ইস্ট ইন্ডিয়া এই শব্দ দুটির বিকৃত উচ্চারণে ইটান্ডা।প্রসঙ্গত স্মরণ করা যেতে পারে ১৭৮২ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজ বেনিয়া জন চিপ এই গ্রামে নীলকুঠী স্থাপন করে নীলচাষ শুরু করেছিলেন এবং তারপর থেকে বীরভূম জেলার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে নীলচাষের প্রসার ঘটেছিল।লালমাটির বীরভূমকে নীলচাষের খেত খামার বানিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। বরিষ্ঠ বীরভূম গবেষক সিদ্ধেশ্বর মুখোপাধ্যায় ভিন্ন মত পোষণ করেন।তাঁর মতে দুই নদির মধ্যবর্তী অংশকে বলে টান্ডা।ইটান্ডার দক্ষিণে ও উত্তরে অজয় নদি। মধ্যেকার ঊর্বর ভূভাগেই গড়ে উঠেছে প্রাচীন জনপদটি।এই কারণে গ্রামের নাম হয়েছিল টান্ডা।আর ইস্কুল আস্পর্ধা ইত্যাদি শব্দের মতোই আদিতে স্বরাগমের ফলে টান্ডা বেড়ে হয়েছে ইটান্ডা।
দশমহাবিদ্যার এক বিদ্যা |
ইটান্ডার পঞ্চচূড়া মন্দির |
ইটান্ডার গ্রামের অন্যতম পুরাকীর্তি জোড় বাংলামন্দিরটি। বীরভূম জেলায় এর দ্বিতীয় উদাহরণটি নেই।এই মন্দিরটির জন্য ইটান্ডার খ্যাতি দেশ-বিদেশে।একসময় মন্দিরটি বলতে গেলে ভেঙে পড়েছিল।অনেক মূল্যবান টেরাকোটা ফলক নষ্ট হয়ে গিয়েছিল।Indian National Trust For Art And Cultural Heritage সংক্ষেপে INTACH র উদ্যোগে নতুন করে সংস্কার হয়েছে।বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গ পুরাত্তত্ব সর্বেক্ষণ দ্বারা অধিগৃহীত।গ্রামবাসীদের মতে এখানে পূর্বে শ্মশান ছিল।পাশে বাস করতেন গ্রামের মুচি সম্প্রদায়ের হাড়কাটা গোষ্ঠীরা। মৃত পশুর হাড়, শিং প্রভৃতি কেটে খোদাই করে চিরুনি গলার মালার পুঁতি ও নানা ধরনের শৌখিন জিনিষ বানাতো তারা।সেগুলি স্থানীয় বাজারে বিক্রয় করতো।এরাই প্রতিষ্ঠা করেছিলেন শ্মশানকালী।মন্দিরটির প্রতিষ্ঠাতা তারাই।লোকে এখনো এই কালীমন্দিরকে হাড়কাটা বা হঠকা কালী মন্দির বলে থাকেন।অনেকে আবার বলেন হাড়কাটারা পেশায় দুর্ধুষ ডাকাত ছিল ।ডাকাতি করতে যাওয়ার আগে এই শ্মশান প্রান্তরে কালীভজনা করতো।অঢেল ডাকাতির পয়সা খরচ করে এই মন্দির গড়ে উঠেছিল।অনেকেই আবার বলেছেন উনিশ শতকের গোড়ার দিকে পোর্তুগিজ বণিকরা নাকি এই মন্দিরের প্রথম সংস্কার করেছিলেন।কলকাতার বউবাজারের পোর্তুগিজ কবিয়াল এন্টনি ফিরিঙ্গির স্মৃতি সম্বলিত ফিরিঙ্গিকালীবাড়ি রয়েছে ।ইটান্ডার এই মন্দিরটিও অনুরূপ বীরভূমের একমাত্র ফিরিঙ্গিকালীবাড়ি!
শ্রীধর মন্দির |
পাইনদের রেখদেউল |
সিংহদের পরিত্যক্ত শৈব মন্দির |
বামন আবতার |
সাধু পরিবারের আর একটি মন্দির দেখার মতো।বিষ্ণু বা শ্রীধর মন্দির।শোনা যায় রাসানন্দের কন্যা বা বিধবা ভগ্নি নাকি এই মন্দিরটি স্থাপনা করেছিলেন।তিনি একবার বৃদাবন গিয়েছিলেন।সেখান থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে ইটান্ডায় এসে সর্বস্ব খরচ করে এই দ্বিতল মন্দিরটি তৈরি করেন।দেখে মনে হবে কোন জমিদার বাড়ি।দ্বিতলে শ্রীধরের গর্ভগৃহ।অলংকৃত দেওয়াল,প্রতিটি স্থানই পঙ্খ ও স্টাকোর কাছে সমৃদ্ধ।ভূমিকম্পের ফলে মন্দিরটির বিরাট ক্ষতি হয়ে গেছে।দোতালায় উঠতে গেলে ভয় লাগে।মনে হয় যেকোন সময় যেন গোটা মন্দিরটি ভেঙে পড়বে।শ্রীধরের দোল উপলক্ষে দোল উৎসব হয়।গ্রামের সর্দারপাড়ার মোড়ে একটি আটচালা শৈব মন্দির রয়েছে।সিংহ দের জমিদারবাড়ির মতোই তাদের শিবের চালা মন্দিরটির অবস্থা বড়ো করুণ।একরকম ভেঙে পড়েছে বললেই চলে। এ বিষয়ে শুধু গ্রামবাসীদের উদাসীনতাকেই দায়ি করা যায় না;অজয়নদির বন্যার ফলে পুরাকীর্তি ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে।বর্তমানে ইটান্ডার মুখ্য উৎসব ধর্মরাজ পুজো।আষাঢ় পুর্ণিমায় অনুষ্ঠিত হয়।সেবাইত গ্রামের মাল সম্প্রদায়।
রামায়ণ ফলক |
ইটান্ডার বাজারপাড়া পেরিয়ে খানিকটা গেলেই মুসলিম জনবসতি--গড়পাড়া।দক্ষিণ দিকে কিছুটা দূরেই বয়ে চলেছে অজয় নদি।এখানেই ছিল জমিদার জোড়ালখাঁয়ের গড়বাটি।এখন পুরোপুরি জঙ্গল।বাঁশ বন।বুজে যাওয়া গড়খাত।শোনা যায় জোড়াল খাঁয়ের গড়বাটিতে বড়ো বড়ো চারটে গেট ছিল।ভিতরে ছিল মসজিদ।এখনো মসজিদের ধ্বংশাবশেষ দেখা যায়।মসজিদের পাশে বালা শহিদের মাজার।পূর্বে মাঘ মাসের শেষে উরস পালিত হতো।এখন নাম কা ওয়াস্তে হয়।কথিত আছে জোড়াল খাঁ'রা চিলেন সাত ভাই।রাজ খাঁ,বিজলি খাঁ,করাত খাঁ,গুমরো খাঁ,বাদল খাঁ প্রমুখ।জোড়াল খাঁ এক হিন্দুর ছেলেকে মানুষ করেছিলেন।সেও অসাধারণ বলশালী ছিল।একবারে ষোল সের দুধ পান করতে পারতো।এরাই সমবেত ভাবে বর্গিহানার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল। অস্ত্র বলতে বড়ো বড়ো মাটির বাঁটুল।গুলতির সাহায্যে সজোরে নিক্ষেপ করে শত্রু পক্ষকে ঘায়েল করত।
বর্গিরা ইটান্ডার বাজার লুঠ করতে এলে গ্রামবাসীরা জোড়াল খানের গড় বাটিতে এসে আশ্রয় নিত।গ্রামের ঘর বাড়ি লুঠ করলেও বর্গিরা খালি হাতে ফিরে যেতে বাধ্য হতো।এইভাবে পর পর তিনবার ইটান্ডা লুঠ হলে জোড়াল খাঁ তার ভাইদের সঙ্গে যুক্তি করে সামনা সামনি যুদ্ধ করার প্রস্তুতি শুরু করলো।তাঁর জমিদারির নিম্ন বর্গের জোয়ান ছেলেদের তালিম দিলেন-- লাঠি চালানোয় অস্ত্র ধারণে।এবার বর্গিরা আসতেই জোড়াল খাঁ'য়ের নেতৃত্বে ইটান্ডাবাসীরা ঝাঁপিয়ে পড়লো বর্গিদের উপর।তারা পরাজিত হয়ে ফিরে যেতে বাধ্য হয়েছিল। জয় হয়েছিল মানুষের সঙ্ঘ শক্তির ,গণ অভ্যুত্থানের।ইটান্ডা হয়ে উঠেছিল গণ অভ্যুত্থানের এক দুর্জয় ঘাঁটি।
জয় মানুষের জয়!!!!!!!!!!!!!!!!!!! দক্ষিণবঙ্গের অন্যতম জনপ্রিয় পত্রিকা সংবাদে প্রকাশিত |
Subscribe to:
Posts (Atom)
PROTNO-SAMRAT
https://thekoulal.wordpress.com কৌলাল ওয়েবসাইটেও পড়তে পারেন।আর দেখতে পারেন মনের মতো ছবি। ...
-
দুর্গার বাহন ঘোড়ামুখি সিংহ ও রাঢ়ের ঘোটক বাহনা দেবী দেবী দুর্গা দুর্গতি নাশিনী মহিষাসুর মর্দিনী সিংহবাহিনী। দেবীপুরাণ অনু...
-
ইতিহাসের প্রেক্ষিতে দাঁইহাট উচ্চ বিদ্যালয় দাঁইহাট উচ্চ বিদ্যালয় বারো হাট তেরো ঘাট।এই নিয়েই বর্ধমান জ...